বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অধ্যায় 1

হাই, আমি জিগীষা ওরফে জিগী। আমাকে মনে আছে নাকি ভুলে গিয়েছো? আশা করি এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওনি। এর আগে তোমাদের আমার কলেজ জীবনের গল্প শুনিয়েছিলাম। শুনিয়েছিলাম সেই বিশেষ মানুষটির গল্পও যে এখন আমার জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে। ঠিক আমার পরিবারের পরেই আমি যাকে নিজের বলে বলতে পারি। 



       এখন আমাদের কলেজ শেষ। ফলাফল বেরোতে খানিক দেরী রয়েছে। এই সময় অনেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নীপা আর পৌলমীও ঠিক করেছে ওরাও বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা দেবে। আমার বাবা মুখে স্বীকার না করলেও আমাকে চোখে হারায়, আমাকে ছেড়ে বাবা থাকতে পারবে না। সে কথা সরাসরি না বলে ঘুরিয়ে বলেছে, "বাইরে কোথাও যাওয়ার দরকার নেই, যা হবে এখানেই হবে।"

আমার কলেজ যে ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত সেখানে পঞ্চাশ শতাংশ ছাত্রছাত্রীকে গ্র্যাজুয়েশনের ফলাফলের ভিত্তিতে সরাসরি ভর্তি নিয়ে নেয়, আর বাকি পঞ্চাশ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে ভর্তি হয়। আমার যা রেজাল্ট রয়েছে তাতে করে চোখ বন্ধ করে আমি সরাসরি ভর্তি হতে পারব ওখানে। এইবারের পরীক্ষাও যথেষ্ট ভাল হয়েছে, আমি যে গ্রাজুয়েশনে সব মিলিয়ে একটা ভাল পার্সেন্টেজ রাখতে পারব সেই নিয়ে আমি যথেষ্ট আশাবাদী। আপাতত তাই আমি কোনো প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি না, তবে পড়াশুনা থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে যাইনি। গল্পের বই থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের বই পড়ছি। গ্র্যাজুয়েশনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করার তাগিদে অনেক কিছু বাদ দিয়ে পড়তে হয়েছিল, এখন সময় পেয়ে সেই জিনিসগুলোও পড়ে নিচ্ছি। সেই সঙ্গে লেখালেখিও চলছে বেশ। সব মিলিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে দিব্যি। রিশান মাস্টার্স করবে না, ওর বাবা চায় ও টেকনিক্যাল লাইনে যাক। সেই মতোই প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে রিশান। যদিও মন থেকে ওর খুব একটা ইচ্ছে নেই কারণ এতে সুযোগ পেলে ওকে বাড়ি ছেড়ে গিয়ে থাকতে হবে। এখন এই লাইনে কাজের লোকের চাহিদা খুব বেশি, তাই আমি ওকে বিভিন্নভাবে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছি, বোঝানোর চেষ্টা করছি যে কাকু অর্থাৎ ওর বাবা একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মনে হচ্ছে আস্তে আস্তে রিশান নিজেও এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। 



             এসবের মাঝেই একখানা ভয়ঙ্কর কান্ড ঘটে গেল। নাহ, আমি ভুল করে ভূত দেখে ফেলিনি। ভূত দেখার চেয়েও মারাত্মক কিছু হল বলা যায়। গতকাল রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে যথারীতি সবাই মিলে একটু গল্পগুজব করছিলাম। দিদিরা

এসেছে আজ দিন তিনেক হল। দিদির আড়াই বছরের ছেলে মঙ্কু এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে আর আমরা টেবিলে বসে কথা বলছি। কথা বলতে বাবা নিজের হস্টেল জীবনের গল্প বলছেন। বাবার এই হস্টেল জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার গল্প কোনোদিন পুরানো হয় না। আমরা বারবার শুনলেও প্রত্যেকবার সমানভাবে উপভোগ করি। আজকে বাবা নিজের এক বন্ধুর কথা বলছিলেন যে মাঝবয়সে এসে ভাল বেতনের সরকারি চাকরি ছেড়ে একটা স্টার্ট আপ শুরু করেছিলেন। এই ভদ্রলোককে আমরা চিনি, অনেকবার আমাদের বাড়ি এসেছেন। তাঁর কথা বলতে বলতে বাবা হঠাৎ বলল,


 "তোকে সাধুর দেওয়া একটা স্পেশ্যাল ডায়েরী দিয়েছিলাম না?" 


সাধু অর্থাৎ বাবার ওই বন্ধু কিন্তু বাবা ঠিক কোন ডায়েরীর কথা বলছে প্রথমে ঠিক মনে পড়ল না। বাবা মনে করানোর চেষ্টা করল,


"খুব ভাল পেজ, ওপরে নীল ভেলভেটের কভার। কভারের ওপর সোনালী রং দিয়ে লেখা। ওটা সাধু তার কোম্পানির পাঁচ বছর পূর্তিতে বিশেষভাবে বানিয়েছিল। দারুণ ছিল ডায়েরীটা।"


শুনেই তো আমি 'আঁক' করে উঠলাম। ডায়েরীটা বিলক্ষণ মনে পড়ছে আমার। কিন্তু... কোনোমতে আমতা আমতা করে বললাম, 



"আমাকে তো তোমাদের অফিসের ছাড়া আর সেভাবে কোনো ডায়েরী দাওনি।"


 এই বলে দিদির দিকে তাকালাম, ভাবলাম আলোচনাটা ওর দিকে ঘুরবে। কিন্তু দিদি সঙ্গে সঙ্গে অস্বীকার করল ওই ডায়েরীর কথা আর বাবাও জোর দিয়ে বলল ওটা আমাকেই দিয়েছিল। আসলে আমার তো মনে আছে ডায়েরীটার ওপর দিদির ভীষণ লোভ ছিল কিন্তু বাবা একদিন নিজের আলমারি পরিষ্কার করার জন্য ওটা আমাকে দিয়ে দেয়, দিদি তখন ওর শ্বশুর বাড়িতে। বাবা বলল, 


"খোঁজ ডায়েরীটা।" 


আমি প্রমাদ গুনলাম। ডায়েরীটা আমি কলেজ জীবনে পার্সোনাল ডায়েরী হিসেবে ব্যবহার করেছি, খুব বেশি হয়ত লেখা নেই কিন্তু যা লেখা আছে... হেঁ হেঁ... কলেজ জীবনের কথা মানে সেই ভদ্রলোকের কথা থাকবে না তা কী হয় নাকি! রোজ ডায়েরী লেখা আমার ছোটবেলার অভ্যেস ছিল, কলেজ জীবনে এসে পড়াশুনার চাপে অভ্যেসটায় ভাটা পড়েছে। তার ওপর ডায়েরীতে তো সবাই মনের কথা লেখে, মনের কথা বলার জন্য যখন আস্ত একটা মানুষ রয়েছে তখন আর সেভাবে ডায়েরী লেখার প্রয়োজন পড়ে না। তবে কিছু কিছু সময় অবশ্যই লিখেছি আর সেটা ওই সুন্দর ডায়েরীটাতেই লিখেছি। রিশানের কথা আমার বাড়িতে জানে কিন্তু সেটা বন্ধু হিসেবে। আমাদের মধ্যেকার বিশেষ সম্পর্কের কথা জানানোর সঠিক সময় নয় এটা। মা বাবা শুধু শুধু উদ্বিগ্ন হবে। আগে নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হই তারপর বাড়িতে জানাব। তাই এই মুহূর্তে কিছুতেই ওই ডায়েরীটা বাবার হাতে দেওয়া যাবে না। 



       তবুও গিয়ে একটা কাবার্ড খুললাম যেখানে আমার লেখালেখি সংক্রান্ত ডায়েরী, গল্পের বই, পত্রিকা এইসব থাকে। আমি নিশ্চিত ছিলাম লাল ডায়েরীটা ওখানে থাকবে না। কিন্তু বিধি বাম। কবে কী কুক্ষণে ভগবানই জানেন ডায়েরীটা আমি পুরোনো পূজাবার্ষিকীর  মধ্যে সাজিয়ে রেখেছি। তবে লম্বালম্বি আছে বলে চট করে নজর পড়ে না। আমি তড়িঘড়ি ওই কাবার্ড বন্ধ করে অন্য একটা খুললাম। সেখানে আমার ছোটবেলার সব পার্সোনাল ডায়েরী রাখা। বাবা দূর থেকেই বুঝল ওর মধ্যে থাকবে না। বাবা আফসোসের সুরে বলল, 


"অত সুন্দর ডায়েরীটা এমনি লিখে লিখে শেষ করে ফেলে দিলি!" 


আমি ঢোক গিললাম। বাবা নিজের রুমে চলে গেল। তবে খুব খারাপ লাগছিল আমার। আমি ডায়েরীটা পেড়ে দেখলাম  বেশি নয়, ছ'সাত পাতা লেখা। লেখাগুলো পড়তে ইচ্ছে করল আবার। বিগত তিন বছরের কিছু অব্যক্ত অনুভূতি লিখে রাখা যেগুলো কোনোদিন তাকেও বলিনি। আজকে পড়তে পড়তে আবার যেন সেই প্রথমদিকের মত লজ্জা পেলাম, গালগুলো গোলাপী হয়ে উঠল আমার। ইচ্ছে করছিল না যদিও তবুও ছুরি দিয়ে পাতাগুলো কেটে ফেললাম, তারপর হাতে করে দলা পাকিয়ে আমার ক্রাফটসের জিনিসপত্র রাখা থাকে যেখানে সেখানে গুঁজে দিলাম। মানুষটা আমার কাছে রয়েছে তখন সারাজীবন ধরে আরও অনেক নতুন নতুন স্মৃতি তৈরী হবে প্রতিনিয়ত। এই ছয় সাত পাতা লেখাতে তার কিছু যাবে আসবে না বরং বাবার মুখে হাসি ফুটবে। 



       আজ দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বাবাকে ডায়েরীটা দেখালাম। মা খেয়াল করল কাটা জায়গাটা। জিজ্ঞেস করতে বললাম, "কেটেছি কিন্তু কেন মনে নেই, আর কবে কেটেছি তাও মনে নেই।"


 বাবা মা ডায়েরীটা নিয়ে কথা বলছিল, মঙ্কু তখন একটা কার্টুন দেখতে ব্যস্ত। কার্টুন দেখেই আমার গুণধর বোনপোর মাথার দুস্টু বুদ্ধি কিলবিল করে উঠল। তার হঠাৎ ইচ্ছে হল সে স্নো ম্যান বানাবে। মঙ্কু একজন প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন নাগরিক, অন্তঃত নিজেকে সে তাই মনে করে। তার সব কাজ নিজে নিজে করা চাই। বড়দের সাহায্য নেওয়া তার ঘোর অপছন্দের। তাই সে আমার অলক্ষ্যেই টিভির ঘর থেকে এসে গুটিগুটি পায়ে আমার ঘরে ঢুকে গেল। বাড়িতে আর মামাবাড়িতে কার কোন জিনিস কোথায় থাকে তা সেই মানুষটা ভুলে গেলেও মঙ্কু কখনও ভোলে না।  আজকেও তাই বিনা বাধায় সে পৌঁছে গেল আমার ঘরের নির্দিষ্ট ড্রয়ারে যেখানে তার স্নো ম্যান বানানোর জিনিসপত্র পাবে। উপযোগী জিনিসপত্র খোঁজার অছিলায় আমার ক্রাফটের জিনিস ঘাঁটতে লাগল সে, আর ঘাঁটতে গিয়ে ডায়েরীর দলা পাকানো পাতাগুলো পেয়ে গেল। 


    "কী ছুন্দর কাগজের বল। এটা দিয়ে কী হবে লে?" 

আধো আধো গলার স্বর শুনে আমি সহ মা বাবা সবাই ঘুরে তাকালাম।  দলা পাকানো কাগজগুলো যে ডায়েরীর পাতা তা বুঝতে কারুর অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমি তড়িঘড়ি মঙ্কুর হাত থেকে ওগুলো নিয়ে ডাস্টবিনে ফেললাম বটে কিন্তু মা বাবা নিশ্চয় যা বোঝার বুঝে গেল। 


          যদিও কেউ কিছু বলেনি তবে একটু শীতল আবহাওয়া প্রতিমুহূর্তে অনুভব করতে পারছি। জানি না এর রেশ কোথায় গিয়ে থামবে। 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু