বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অধ্যায় 1

আজকের দিনে...



আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি মেয়েটির দিকে। আমি জানি না মেয়েটি কে, কিংবা হয়ত জানি কিন্তু মন থেকে মানতে চাইছি না। রিশানের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি মৈনাকের কোনো কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে। মেয়েটি দেখতে শুনতে বেশ ভাল, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কলেজে পড়াকালীন মৈনাক বলত রিশান হল আমাদের ডিপার্টমেন্টের হ্যান্ডসাম হাঙ্ক। হ্যান্ডসাম হাঙ্কের পাশে বোধহয় এরকমই কাউকে মানায়, আমার মত এই শ্যামলা, মৃদু স্থূলকায় চেহারার কাউকে না। আমি চেষ্টা করি নিজের রূপ নিয়ে ফ্রাস্ট্রেটেড না হতে, অন্য কোনো মানুষকে যে আমি রূপ দিয়ে বিচার করি তাও নয়, কিন্তু নিজের বেলায় বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র এলে সব কেমন যেন ব্যর্থ হয়ে যায়। আমি এই মুহূর্তে কী ভাবছি সেটা জানতে পারলে মৈনাক নির্ঘাত আমার মাথায় গাঁট্টা মারবে। নাহ, আমি কী ভাবছি তা কাউকে বুঝতে দেওয়া চলবে না। 



         

         আমার এসব চিন্তার মাঝেই তৌসিফ এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। অন্যমনস্ক থাকার কারণে চমকে উঠলাম আমি। চোখের কোণে অনেকক্ষণ থেকে ইতস্তত করতে থাকা জলের ফোঁটাটাকে আঙ্গুল দিয়ে আটকে দিলাম। তারপর জোর করে মুখে একটা হাসির মুখোশ টেনে তৌসিফের দিকে তাকালাম। তৌসিফ আমার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই ফিসফিস করে বলল, "নিজেকে সামলা। ওদের সামনে নিজের দুর্বল রূপটা দেখাস না।"

তৌসিফের কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা আরও বেশি করে যেন হুহু করে উঠল। আমি জানি তৌসিফ একদম সঠিক পরামর্শ দিয়েছে কিন্তু তবুও আমার দু' চোখ জলে ভরে এল। সেই দেখে তৌসিফ বলল, "চল, একটু হেঁটে আসি।"

প্রস্তাবখানা পছন্দ হল আমার। নীপাকেও ডাকলাম সঙ্গে যাওয়ার জন্য কিন্তু সে রাজি হল না। উল্টে যা বলল তা শুনে আমি যেন আরও একটু নড়ে গেলাম। নীপা বলল,


"তোরা যা, আমি বরং আপালার সঙ্গে একটু গল্প করি। বাণী আর জিষ্ণু গল্প করছে অন্যদিকে। এখন আপালার কাছে একটাও মেয়ে না থাকলে বেচারি কী ভাববে বলত!"


আমি নীপাকে কোনো জবাব দিতে পারলাম না। নীপা... আমার প্রিয় বান্ধবী... সে বোঝে না আমার মনের অবস্থা! সে এই মুহূর্তে আমার চেয়েও আমার ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার মানুষকে সঙ্গে দেওয়াটাকে বেশি প্রাধান্য দিল! কথাটা মনে হতে দ্বিতীয়বারের জন্য চমকে উঠলাম। আমার ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসার মানুষ....  রিশানের পাশের ওই জায়গাটা তো বরাবর আমার ছিল। এত সহজে সবটা ভুলে যাওয়া যায়? আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটা লাগালাম। তৌসিফ আমাকে ধরার জন্য আমার পেছন পেছন ছুটল। 



         "আমি আর এই মিটে কোনোদিন আসব না তৌসিফ, এখানে এলেই আমার সব  আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা অকেজো হয়ে পড়ে।"

খানিক তফাতে এসে একটা  ছোট নাগরদোলায় বসে আমি কথাগুলো বললাম। আমার বলা প্রতিটি শব্দের সঙ্গে কান্নাভেজা দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ল। 


তৌসিফ বলল, "তারমানে তোর কাছে রিশানই সব, আমরা কেউ না। তাই তো? আমাদের সঙ্গে দেখা করার কোনো গুরুত্ব নেই তোর কাছে?"


তৌসিফের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। আমার মনটা আবার দোলাচলে ভুগতে শুরু করেছে। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করার এই দিনটার জন্য আমি মুখিয়ে থাকি কিন্তু এবার এখানে এলেও রিশান যখন আমার সামনে আসে তখন অদ্ভুত একটা কষ্ট আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। এ এক অদ্ভুত দ্বিমুখী দ্বন্দ্ব। 



_আমাদের গল্পগুলো


অল্প সময় ঘর পাতালো


তারপর পথ হারালো


তোমায় আমায় নিয়ে..._




       "জিগি.... জিগি তোর ফোন বাজছে।"


বাণীর কথায় সম্বিৎ ফিরল আমার। তৌসিফ আর আমি খানিক আগেই আমাদের আড্ডার জায়গায় আবার ফিরে এসেছি, বাণী আর জিষ্ণুও এসে বসেছে। গানটা অনেকক্ষণ থেকেই কানে বাজছিল, আমি  সেইমুহূর্তে সব ভুলে শুধু রিশান আর অপালার দিকে তাকিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন গানটা আমার জীবনের কথা বলতে চাইছে। বাণীর ডাকে হুঁশ ফিরতে ফোনটা তুলে দেখলাম কোম্পানির ফোন। কেটে দিলাম। তারপর বাণীর দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করলাম, 


"মেয়েটি কে?"


জিজ্ঞাসা করা হয়ত নিষ্প্রয়োজন ছিল, তবুও করলাম। বাণী ভ্রূ কুঁচকে অপালার দিকে তাকিয়ে বলল,


"জানি না, আমায় শুধু বলল বিশেষ একজনকে নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। কে জানতে চাওয়ায় মেয়েটার নাম বলল।"


বাণীর কথা শেষ হতেই জিষ্ণু বলল, "ওর কোনো আত্মীয় নয় তো?"


মাথা নাড়লাম আমি। সাত বছরের সম্পর্কে ওর সব আত্মীয়দের ছবিসহ বর্ণনা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। 


আমার 'না'- বাচক ইঙ্গিত দেখে জিষ্ণু হতাশ গলায় বলল, "তাহলে কে হতে পারে?"


আমি মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার ঠোঁট দুটো শক্ত হয়ে আটকে রইল। জবাব নেই তাদের কাছে। এই রিশানকে আমি চিনি না, এই রিশানের জীবনের কোনো খবরই আমার কাছ অবধি পৌঁছায় না...

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু