বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

অধ্যায় 3

টাকার আত্মকথা ( তৃতীয় পর্ব )

                              গোপাল চন্দ্র মন্ডল


              দিন সাতেক পর মন্দিরের পান্ডা এক প্রণামী বাক্স থেকে আমাকে বের করেন । পান্ডা মশাই কৌশিকী অমাবস্যা তারাপীঠ যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরেন। সকালবেলা ঘুম ঘুম চোখে পান্ডা মশাই সিটে বসে আছেন, হঠাৎ একজন কানের কাছে এসে বলে -চায় চা-চা খাবেন চা-।

পান্ডা মশাই মানিব্যাগ থেকে আমাকে বের করে দিতে যাবে তখন চাওয়ালা বলে না দাদা খুচরো দিন। পান্ডা বলে আমার কি খুচরোর গাছ আছে যে তোমাকে জড়িয়ে এনে দেব। তখন আমার মনে হল যে মন্দিরের পাণ্ডাদের কাছে যদি খুচরো না থাকে তাহলে পৃথিবীতে কারো কাছে খুচরো থাকবে না। কারণ মন্দিরে বস্তা বস্তা খুচরো জমা পড়ে আর পান্ডারা খুচরোর ব্যবসা শুরু করে 100 টাকা খুচরো দিলে 130 টাকা নেয়। যাই হোক চা না খেয়েই পান্ডা মশাই সিটেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘণ্টাখানেক পর জানালা থেকে চিৎকার করে- এই পুরি, পুরি চলে এসেছে পুরি। পান্ডা তো অবাক!

সে যাচ্ছিল তারাপীঠ আর ট্রেন এল পুরী ?

এটা কি করে সম্ভব?ব্যাগ নিয়ে ট্রেন থেকে যে নামতে যাবে তখন আবার শোনা যায় পুরি খাবেন পুরি ? পান্ডা বুঝতে পারেন এটা উড়িষ্যার পুরী নয় এটা হল খাবার পুরি। তিনি আবার সিটে গিয়ে বসেন।


             তারাপীঠ পৌঁছে পান্ডা মশাই লারিকা হোটেলে ওঠেন। সারারাত থাকার পর, পর দিন দুপুর বেলা রামপুরহাট পৌঁছালেন। এই সময় আমি চলে এলাম এক মুসলিম অটো ড্রাইভার এর কাছে। বাড়ি ফিরে ড্রাইভার আমাকে দান করে দেয় মসজিদে।মসজিদে তিন দিন থাকার পর আমাকে যেতে হয় এক ধূর্ত রাজনীতির নেতার কাছে। সে আমাকে দিন পনেরো কাছে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আরে 15 দিনেই নেতার আসল চরিত্র বুঝতে পারলাম। সে সাধারণ জনগণকে টুপি পড়িয়ে নিজের স্বার্থ পূরণ করছে। যতরকম বেআইনি কাজ হয় সবকিছুই করে সে। সব ব্যাংকের একাউন্টে টাকা আছে তার। টাকার পাহাড় জমিয়েছে সে।কালো টাকাগুলো সে নিজের বাড়িতে মাটির ভিতরে পুঁতে রাখে বাক্সের মধ্যে ভরে। 15 দিন পর আমাকেও পুঁতে রাখে। প্রায় পাঁচ বছর পর মুক্তি পেলাম। এক ডাকাত আমাকে মুক্তি দিল।সে বাক্সটাকে ভেঙে টাকা গুলোকে থলেতে ভরে বাক্সটাকে পুকুরের জলে ফেলে দিল। ডাকাতের তাড়াহুড়ার কারণে বাক্সটার সঙ্গে আমিও রয়ে গেলাম। একটু একটু করে জল ঢুকতে থাকে। কিছুক্ষণ পর আমি জলের উপরে ভাসতে লাগলাম।


               পরদিন সকালবেলা একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে আমাকে দেখতে পায়।তারপর সে কোনরকমে আমাকে তার নাগালের মধ্যে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে এবং আমার সর্দি লাগা ভালো করতে সারাদিন সূর্যের আলোতে ফেলে রাখে। আমাকে পেয়ে সে এত খুশি যে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা মেয়েটা একটা স্টেশনারি দোকানে গেল আমাকে নিয়ে। তার পছন্দের মত কিছু জিনিস কিনলে সে। দোকানদার পরদিন আমাকে কোটাসুর স্টেট ব্যাংকে রেখে আসে। সেখান থেকে একটা এ.টি.এম -এ আমাকে রাখা হয়। এ.টি.এম থেকে আমাকে বের করে একটা ঢপবাজ ছেলে তার বন্ধুকে ফোন করে- কিরে মদন তুই কি পৌঁছে গেলি? আমি আজকে যেতে পারবো না। পেটের অবস্থা খুবই খারাপ।

সারাদিন টয়লেটে ঢুকে আছি। বেরিয়ে যেতে ইচ্ছেই করছে না। লোকে বলে শান্তি শ্মশানে, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা, কারণ সবচেয়ে বেশি শান্তি টয়লেটে। "শান্তি চাও, তো টয়লেট যাও"। যাইহোক বদমাশ ছেলেটার কাছে থেকে একটা অভিজ্ঞতা হয়ে গেল যে ফোনের মাধ্যমে যত খুশি মিথ্যা কথা বলা যায় আর মিথ্যা কথার শিকার হয় সহজ সরল ব্যক্তিরা।


             এরপর ধীরে ধীরে প্রায় পনেরো বছর কাটলো ভারতবর্ষের নানা জায়গায়। বিভিন্ন ধরনের লোকের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কত রকম বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভান্ডার হয়ে উঠলাম আমি। কখনো কাশ্মীর তো কখনো কন্যাকুমারিকা, কখনো আসাম তো আবার কখনো পাঞ্জাব।ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত জায়গায় যেতে হয়েছে আমাকে। তাই কখনো ভালো মানুষ, কখনো আবার ভালো ঘোষের আড়ালে সন্ত্রাসবাদি, কখনো কখনো ধান্দাবাজ, খুনি, ডাকাত সবার পকেটে থাকতে হয়েছে আমাকে। তাই আমি মনে করি টাকা যদি সাক্ষী দিতে পারতো তাহলে সব অন্যায়ের বিচার খুব সহজেই হয়ে যেত। সি.আই.ডি কিংবা সি.বি.আই তদন্তের প্রয়োজন হতো না।যাইহোক মানুষের প্রয়োজন মেটাতে মেটাতে একদিন নিজেকে লক্ষ্য করে দেখি যে আমার শরীরের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। পঁচিশ বছরে পা দিয়েছি এবং আমার শরীর জীর্ণ হয়ে এসেছে। গান্ধীজীর ভার বইতে বইতে আমি অতি ক্লান্ত। আমার শরীর দু'টুকরো হতে চলেছে। তাই আমার প্রয়োজন ধীরে ধীরে কমে আসছে। আমি বুঝতে পারছি শরীরের ক্ষমতা শেষ হয়ে এলে সবাই অবহেলিত হয়। আমিও আজ অবহেলিত। আর কোন মূল্য নেই আমার। আমিও চাইনা এই বিষময় পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে। হে ঈশ্বর-আল্লা-ভগবান আমাকে তুমি মুক্তি দাও, মুক্তি দাও।

     

                                 সমাপ্ত


পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু