বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

মিলির সঙ্গে দিল্লীতে পনেরো বছর কাটানোর পরে

অঞ্জু মাসীকে নিয়ে প্রথম দিল্লীতে পৌঁছানোর কয়েক দিন পরে, আমি স্বপনকাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলাম এবং তাকে আমার দিল্লীর ঠিকানাটি দিয়েছিলাম। এর মূল কারণ এই - অঞ্জু মাসী ভবানীপুরের বাড়িতে কী ঘটছিল তা জানতে আগ্রহী ছিল, বিশেষতঃ তার মেয়ে টুম্পা কীভাবে বেড়ে উঠছিল সে সম্পর্কে। স্বপনকা তখন তার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসাবে আমাকে বিশ্বাস ক’রেছিল, সে সপ্তাহে কমপক্ষে একবার আমার কাছে নিয়মিত চিঠি লেখা শুরু ক’রেছিল। আমি তার বেশির ভাগ চিঠি মিলিকে দেখিয়েছি; ও আমাকে বলেছিলো স্বপনকাকে টুম্পার ছবি পাঠানোর জন্যে অনুরোধ ক’রতে, কিন্তু আমি তা ক’রি নি; আমি ভেবেছিলাম টুম্পার ফটোগুলির জন্যে অনুরোধ করলে স্বপনকার কাছে বাপারটা সন্দেহজনক হ’য়ে উঠবে।
 
স্বপনকা'র চিঠিগুলি থেকে, আমি প্রায় তিন বছর পরে জানতে পারি যে প্রদীপকা চেন্নাইয়ে একটা খুব মোটা মাইনের কাজ পেয়েছে এবং একটি বিশাল বাংলো পেয়েছে। আমি প্রদীপকার নতুন ঠিকানা স্বপনকার কাছ থেকে নিয়েছি এবং তাকে আমার অভিনন্দন পত্র পাঠিয়েছি। হয়তো কোনও দিন প্রদীপকার যোগাযোগ আমার জন্যে কাজে লাগতে পারে। তবে স্বপনকার জন্যে ভবানীপুরের বাড়িটি আরও ফাঁকা হ’য়ে গেছিল; এতদিন স্বপনকা কেবল অঞ্জু মাসীকে মিস্ ক’রতো; এখন থেকে প্রদীপকা, চেরি মাসী, লালু এবং ভুলুকেও মিস্ ক’রতে হবে। স্বপনকা তার মেয়ে টুম্পাকে লালন-পালন ও শিক্ষিত করার জন্যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, পরী-দিদার কাছ থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য নিয়ে।
 

আমরা দিল্লীতে পৌঁছানোর সাত বছর পরে, স্বপনকার একটি চিঠি থেকে আমি জানতে পারি যে, অঞ্জু মাসীর মা মারা গেছেন। আমি ভাবলাম, এই খবর অবশ্যই মিলির কাছে পৌঁছে দেওয়া ঠিক হবে না। মিলির মাকে আমি কখনও দেখিনি, তাই তার মৃত্যুর খবরে আমি খুব একটা দুঃখ অনুভব করি নি। তবে আমি জানতাম আমার নিজের মার মৃত্যু আমার কাছে কতটা হৃদয়-বিদারক হ’য়েছিল।
 
আরও চার বছর পরে স্বপনকার কাছ থেকে একটি দুঃখজনক সংবাদ এল - তার মা অর্থাৎ আমার পরী-দিদা মারা গেছেন। আমি এই ভদ্রমহিলাকে বিদায় জানাতে ভবানীপুরে যেতে চেয়েছিলাম, আমি ছোটবেলা থেকে ওঁর অনেক আদর আর ভালবসা পেয়েছি। মিলিও এই ক্ষতিটি ওর হৃদয়ে অনুভব ক’রেছিল এবং এই দিনটিতে স্বপনকার পাশে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু আমাদের অনুভূতিগুলো চেপে রাখতে হ’য়েছিল অঞ্জু মাসীর আত্মগোপনের খবর ফাঁস হ’য়ে যাবার ভয়ে। তাই আমাদের দুঃখকে নিজেদের কাছেই রাখতে হ’য়েছিল; আমি কেবল ভবানীপুরের বাড়িতে একটা ফুলের তোড়া পাঠানোর ব্যবস্থা ক’রেছিলাম।
 

ভবানীপুরের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হবার পর পনের বছর কেটে গেল অঞ্জু মাসীর। এই বছরগুলোতে, স্বপনকা ওকে ফিরিয়ে আনার জন্যে চেষ্টার কোনও ত্রুটি  রাখেনি। স্বপনকা অঞ্জু মাসীর মা-বাবাকে হাজারবার ফোন ক’রেছিল এবং প্রতি সপ্তাহে আমাকেও চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু স্বপনকা অন্য কাউকে জানায় নি যে, অঞ্জু মাসী নিখোঁজ রয়েছে। আমি এবং অঞ্জু মাসীর বাবা-মা বাদে প্রত্যেককে বিশ্বাস করানো হ’য়েছিল যে অঞ্জু মাসী তার পিএইচডি করার জন্যে তার বাবা-মার বাড়ীতে রয়েছে। যেহেতু আমি তার সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু, স্বপনকা অঞ্জু মাসী সম্পর্কে যখন যা ভেবেছিল তা আমাকে জানিয়েছিল, তা সে যখনই হোক না কেন। প্রতিবার আমি অঞ্জু মাসীর আসল ঠিকানা গোপন ক’রে সহানুভূতির সাথে তাকে উত্তর দিয়েছিলাম; অনেক সময় মিলিকেও জানাইনি, পাছে ও বিরক্ত হয়। অঞ্জু মাসীর নিখোঁজ হওয়ার দু'বছর পরে আমি স্বপনকাকে জানিয়েছিলাম যে আমি মিলি নামে একটা মেয়ের সাথে প্রেম ক’রেছি, সুন্দর গোল গোল তার চোখ এবং গায়ের রঙ মেঘের মতো শামলা, আমি মেয়েটিকে আমার প্রস্তাব দিয়েছিলাম এবং সে উত্তরে বলেছিলো ‘হ্যাঁ’। যদিও স্বপনকাকে পাঠানো বিয়ের এই খবরটি মিথ্যে ছিল, তবে এটি আমার বন্ধু, আত্মীয়স্বজন এবং দিল্লীর সহকর্মীরা সবাই সত্যি ব’লে মেনে নিয়েছিল।
 

পনেরো বছর পরে, আমি অবাক হ’লাম স্বপনকার কাছ থেকে একটি বিবাহের নিমন্ত্রণ পত্র পেয়ে, সঙ্গে একটা ছোট হাতে লেখা নোট।
‘প্রিয় বাবলু,
তোমার অঞ্জু মাসীর বাবা রাঁচি থেকে লিখেছেন যে অঞ্জু সাপের কামড় থেকে বাঁচতে পারেনি। তোমার প্রদীপকা চেন্নাইতে স্থায়ী রয়েছে। তুমি ইতিমধ্যে জানো যে তোমার পরী-দিদা গত বছর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ ক’রেছে। আমাদের বাড়িতে কেবল একজন পুরুষ আছে, সে আমি, টুম্পার দেখাশোনা ক’রি। আমাকে সাহায্য করার জন্যে আমার নিতান্তই দরকার একজন গৃহিণীর; এই কারণে আমাকে আবার বিয়ে ক’রতে হচ্ছে। প্লীজ, তোমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের সাথে এই উপলক্ষে এখানে এসো। তোমার স্ত্রীকে র’লো যে, আমি ওকে এয়ো ক’রতে চাই।
শুভেচ্ছান্তে,
স্বপনকা’
 
বৌভাতের দিন বিকেলে, মিলি এবং আমি স্বপনকার বাড়িতে পৌঁছলাম। মিলি এয়ো হতে রাজি ছিল না। আমি আমাদর বাচ্চাদের দিল্লীতে আমার দাদা এবং বৌদির কাছে রেখেছিলাম। মিলি ভয় পেয়েছিল যে কেউ তাকে অঞ্জু ব’লে চিনে ফেলতে পারে, যদিও ওর চেহারা আগের মতো সরু পাতলা নেই।
ক’নে সিংহাসনে ব’সেছিল। আমরা ওর কাছে আমাদের পরিচয় দিয়েছি এবং একগোছা ফুলের সাথে একটি গিফ্ট কার্ডও হাতে তুলে দিয়েছি। কয়েকজন কিশোর কিশোরী আশেপাশে ছিল। মিলি খুঁজে বের করার চেষ্টা ক’রছিল যে টুম্পা তাদের মধ্যে একজন কিনা। আমার নাম শুনে এক কিশোর বালক উচ্ছ্বসিত হ’য়ে ব’লে উঠলো, ‘আমার নামও বাবলু!’
‘তাই নাকি?’ আমি হাই-ফাই করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলাম। আমারও পনের বছর আগে একই রকমের মিষ্টি মুখ ছিল।
‘অঞ্জু!’ শুনলাম স্বপনকা কাকে ডাকছে। চমকে যাওয়া মিলি যখন সাড়া দিতে যাচ্ছিল, তখন স্বপনকা সামনে হাজির হ’য়ে বলেছিল, ‘আমি আমার নতুন স্ত্রীকে অঞ্জু ব’লে ডাকি, যদিও ও প্রায়ই সাড়া দিতে ভুলে যায়; ওর আসল নাম হ’লো নন্দিতা। ’
মিলির চমকে যাওয়া মুখটি কেবল আমি দেখেছি তাই নয়, অন্য বাবলুরও নজরে এসেছে, যদিও দুজনের কেউই তাকে কোনও প্রশ্ন ক’রিনি।
 
আমরা টুম্পার সাথেও দেখা ক’রেছিলাম, মিলি তার কাছে নিজের পরিচয়  দিয়েছিল ওর অর্থাৎ টুম্পার বাবলু মামার স্ত্রী হিসাবে; মিলি বলেছিলো, ‘আমার সাথে দিল্লী চলে এসো, আমি তোমাকে ওখানে রাইসিনা স্কুলে ভর্ত্তি ক’রে দেব।’
টুম্পা মন্ত্রমুগ্ধ হ’য়ে ব’ললো, ‘তুমি খুব ভালো আন্টি। ইচ্ছে করছে, আমি তোমার সাথে যাই, কিন্তু বাবা আমাকে সবসময় তাঁর চোখে চোখে রাখেন। তিনি শুধু আমার বাবা নয়, আমার মাও বটে।’
 
পরে রাতে মিলি আমাকে বলেছিলো, ‘প্লীজ, তোমার স্বপনকাকে রাজি করাও, বোঝাও  - টুম্পা আমাদের কাছে মেয়ের মতোই থাকবে।’
আমি বললাম, ‘কেসটা আরও মজবুত হবে, যদি তুমি বলো যে টুম্পা তোমার নিজের মেয়ে।’
- ‘যদি আমি এ কথা ব’লি, তবে তুমি নিজের স্বপনকাকে আর তোমার মুখ দেখাতে পারবে না। তুমি তার সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অথচ তুমি তার স্ত্রীকে কিডন্যাপ ক’রে পালিয়েছ। এতে কেবল আমাদের ঘর ভাঙবে তা নয়, নন্দিতাও তার স্বপ্নের ঘর বানাতে পারবে না। এ কারণেই - আমি নয় তুমি বোঝাও তোমার স্বপনকাকে - যে টুম্পার পক্ষে দিল্লীতে আরও ভালো হবে।‘
-  ‘ঠিক আছে, আমি চেষ্টা ক’রবো। তোমার জুনিয়র বাবলুকে কেমন লাগলো?’
-  'খুব হ্যান্ডসাম! সুযোগ হ’লে আমি ওর সাথে পালাতে পারতাম। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি যে, নন্দিতা একদিন ওর সাথে উধাও হ’য়ে যাবে।’
 
আমি স্বপনকাকে অনুরোধ ক’রেছিলাম, টুম্পাকে আমাদের সাথে নিয়ে দিল্লী নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবার জন্যে, কিন্তু স্বপনকা তাতে রাজি হয় নি; স্বপনকা বলেছিলো, ‘টুম্পা এ বছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ব’সবে; তার ঠিকানা পরিবর্তন করার জন্যে এটি সঠিক সময় নয়। তাছাড়া, টুম্পা ও তার নতুন মায়ের মধ্যে সম্পর্কের ভিত গড়ার এটাই তো সময়।’
 

পরের দিন আমরা স্বপনকার বাড়ী ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু দিল্লীতে ফিরে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি; মিলি বলেছিলো, ‘রাঁচিতে গিয়ে আমার বাবাকে অবাক ক’রে দেবো। উনি কি পনেরো বছর পরে চিনতে পারবেন আমাকে, বিশেষতঃ পারবেন চিনতে তোমাকে আমার স্বামী হিসাবে?’

 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু