মিলির বাবার রাঁচীর বাড়ীতে ওঁর সঙ্গে দেখা
রাঁচি যাওয়ার আগে মিলি, যার আসল নাম অঞ্জু, ভেবেছিল এত বছর পরে তার বাবা মা তাকে আর চিনতে পারবেন না। কিন্তু যখন ও ওখানে পৌঁছেছিল, দেখলো আসলে জীবনটা যে ছকে চলবে ব’লে ভাবা হয় তার থেকে অনেকটাই আলাদা ভাবে চলে - অঞ্জুর বাবা অঞ্জুকে চিনতে কোনো অসুবিধে হয় নি; বরং অঞ্জুর বাবার মুখখানি একেবারেই বদলে গেছে, ওঁকে অনেক কষ্টে চিনতে পারা যায়। আট বছর আগে অঞ্জুর মা মারা গেছেন। বাড়িতে অন্য একজন কাজের লোক ছিলেন, অঞ্জু তাকে আমুকাকা বলে ডাকে, তিনি বাগান আর বাড়ি দুটোরই দেখাশোনা করেন এবং বাবার জন্যে রান্না করেন। মূলতঃ বই লেখার কাজ নিয়ে বাবা তাঁর দিনগুলি কাটাচ্ছিলেন। এছাড়া তিনি বই পড়তেন, গান শুনতেন এবং টিভির প্রোগ্রাম দেখতেন।
আমি ব’লতে পারলাম না যে স্বপনকা আমাকে অঞ্জুর মায়ের মৃত্যু সম্পর্কে অনেক আগে জানিয়েছিল; তবে আমি মিলিকে এই ব্যাপারে কিছু ব’লতে পারি নি, কারণ ও তখন গর্ভবতী; আমাদের ছেলে মিন্টু তখন আট মাস ওর পেটে।
বাবা অঞ্জুকে চিনতে পেরে জিগ্যেস করলেন, ‘এতদিন কোথায় ছিলে?’
অঞ্জু ব’ললো, ‘এই বাবলুর সঙ্গে দিল্লীতে, তোমার জামাই স্বপনের কাছ থেকে লুকিয়ে। যাতে স্বপনকে তোমার কোনও মিথ্যে কথা বলার দরকার না হয়, সে জন্যে আমি তোমাকে এতদিন বলিনি। বাবলুকে প্লীজ তোমার নতুন জামাই হিসাবে মেনে নাও। টুম্পার পরে, তোমার আর এক নাতনী হ’য়েছে – তার নাম রিমি, এখন বয়স ১৪বছর; আর পেয়েছো – এক নাতি মিন্টু, এখন বয়স আট বছর। এই দুই নাতি নাতনি এখন দিল্লীতে বাবলুর বৌদির হেফাজতে রয়েছে।’
বাবা ব’ললো, ‘তুমি আমাকে পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছো, অঞ্জু, স্বপন প্রায় প্রতিদিন তোমার সম্পর্কে জিগ্যেস ক’রতো। কোনও রকম নোটিশ না দিয়ে ও এখানে বহুবার এসেছে, দেখার জন্যে তুমি কী ক’রছো এখানে। ও অন্য সমস্ত আত্মীয়কে ব’লে বেড়িয়েছে যে তুমি এখানে থেকে পিএইচডি করছো।’
- ‘তোমার কাছ থেকে আমার মৃত্যুর খবর পেয়ে স্বপন সম্প্রতি বিয়ে ক’রেছে জানো তো?’
- ‘হ্যাঁ আমি জানি. এছাড়া আমি আর কি ব’লতে পারি বলো? আমি কখনোই ভাবতে পারি নি যে তুমি এখনও বেঁচে আছো। টুম্পাকে যত্ন করার কথা না ভেবে, এক দিন বা দু'দিনের জন্যে নয়, পনেরো বছর ধ’রে গায়েব।‘
- ‘তুমি তো কখনই মিথ্যে বলো না, বাবা।‘
- ‘সত্যি, তবে আমি যখন উপন্যাসগুলি লিখি, প্রায়ই আমাকে পাঠকদের মন ভোলানোর জন্যে অনেক গল্প তৈরী ক’রতে হয়। এখানেও আমি গল্প তৈরী ক’রেছি যাতে স্বপন তোমার সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা বন্ধ ক’রে দেয় এবং আবার নতুন ক’রে বাঁচা শুরু করে। আমি তাকে বলেছি যে, কেউ যদি সাপের কামড়ে মারা যায় তবে তার দেহটি পুড়িয়ে দেওয়া হয় না; তাই আমি বাগানে দেহটি কবর দিয়েছি এবং দেহটিকে মাটিতে পুঁতে তার উপর একটি বেদী ক’রেছি আর বেদীটির উপরে একটি আমের গাছ লাগিয়েছি।‘
বাবা কিছুক্ষণ থামলো; তারপরে জানালার মধ্যে দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে দেখালো, ‘এটিই সেই আমের গাছ। টুম্পা এবং তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর সাথে স্বপন আগামীকাল এখানে আসবে। ওর নতুন বৌকে ও অঞ্জু ব’লে ডাকে; অনুরোধ ক’রেছে আমাকে - তাকেও আমার মেয়ে ক’রে নেবার জন্যে। ওরা অবশ্যই বেদী এবং আমের গাছের সামনে এসে মাথা নত ক’রবে। তোমরা দুজন তখন, প্লীজ কোণার ঘরে গিয়ে নিজেদের লুকিয়ে রেখো।’
***
‘বাবা, এই দেখো তোমার নতুন মেয়ে অঞ্জু’, স্বপন ব’ললো, নন্দিতার সঙ্গে ঘরে ঢোকার সময় এবং বাবার সামনে এসে মাথা নত ক’রে, পায়ের ধুলো নিলো; নন্দিতাও স্বপনকে অনুসরণ ক’রলো।
বাবা তাদের কপাল স্পর্শ ক’রে তাদের আশীর্বাদ ক’রলেন এবং দরজার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস ক’রলেন, ‘টুম্পা কোথায়?’
- ‘ও আসে নি বাবা, ও পরীক্ষার জন্যে পড়াশোনা ক’রতে ব্যস্ত।‘
- ‘সে কি স্বপন, আমাকে দেখার কোনও সুযোগ টুম্পা কখনই হাতছাড়া করে না। ওর কি নতুন মা পছন্দ হয় নি?’
- ‘মোটেই না. পুরো গতকাল ও ওর নতুন মায়ের সাথে ছিল। কিন্তু ও আজ সকাল থেকে নিখোঁজ ...’
পাশের একটি ঘর থেকে, মিলি আর আমি শুনছিলাম শ্বশুর জামাইয়ের কথোপকথন; স্বপন কথা শেষ করার আগেই মিলি ছুটে এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে প’ড়লো। গত পনেরো বছরে মিলির এমন মহিষাসুর মর্দ্দিনী অগ্নিমূর্ত্তি কখনও দেখিনি, ‘তুমি কেন মিথ্যে ব’লছো, টুম্পার বাবা? টুম্পা কোথায় তা দয়া ক’রে আমাদের জানাও। গতরাতে যখন তুমি তোমার মেয়ের বয়সী একটি তরুণীর সাথে শুয়েছিলে, তখন কি দেখেছিলে, টুম্পা তার দুধের গ্লাস নিয়েছে কিনা? তোমার শোবার ঘরের দরজা লক করার আগে তুমি ‘গুড নাইট’ ব’লেছিলে কি তাকে?’
‘হ্যাঁ, টুম্পার মা। অন্যান্য দিনের মতো, শুতে যাওয়ার আগে ওকে হরলিক্স দিয়েছি। আমরা টুম্পাকে প্রথমে তার বেডরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম, তারপর আমরা আমাদের ঘরে ফিরে আসি। আমরা আমাদের দরজা লক করিনি। আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, ও আমাদের ঘরে উঁকি মারবে না। সকালে, আমরা তার জন্যে বেড টী নিয়ে গেলাম। কিন্তু তখন দেখি ও ওখানে নেই… ..
‘তুমি এত বছর এখানে ছিলে, টুম্পার মা? তুমি কি পিএইচডি শেষ ক’রেছো? প্লীজ, আমার সাথে ফিরে চলো।’
তারপরে স্বপনকা বাবার দিকে ফিরে ব’ললো, ‘বাবা তুমি কেন ব’লেছিলে যে অঞ্জু সাপের কামড়ে মারা গেছে?’
হতভম্ব হ’য়ে বাবা খুঁজছিলেন পরিত্রাণের উপায়। উপন্যাসগুলিতে, বাবা প্রায়ই সময়মতো উত্তরগুলো তৈরি ক’রে ফেলেন। কিন্তু সত্যি ঘটনা উপন্যাসের চেয়েও বেশী প্রহেলিকার জন্ম দেয়। হঠাৎ পনেরো বছর পরে তাঁর মৃত কন্যার ফিরে আসা, কোনও কল্পকাহিনীর চেয়েও অভাবনীয় অসম্ভব ছিল; এর কোন ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কোন ধারণা তাঁর ছিল না।
মিলিও নির্বাক ছিল। ও ব’লতে চেয়েছিল, ‘আমি আমার পিএইচডি ঠিকঠাক ক’রেছি, তবে এখানে বাবার বাড়ীতে থেকে নয়, আমি দিল্লীর স্কুলে শিক্ষকতা করার সময় পার্ট-টাইম গবেষণা ক’রেছি।’
কিন্তু দীর্ঘ পনেরো বছর ধ’রে স্বপনের সাথে মিথ্যে কথা ব’লে গেছে যে বাবলু - তারই সাথে ভবানীপুর থেকে পালাবার পরে অঞ্জু কীভাবে রাইসিনা বাংলা স্কুলে তার চাকরি পেয়েছিল - সে সম্পর্কে কোনো কিছু বলতে সাহস পায়নি অঞ্জু।
স্বপনের মধ্যে যেন জেগে উঠলো ওর পনেরো বছর আগের যৌবন, তারুণ্য। ও লাফিয়ে উঠে মিলির হাত ধ’রে ব’ললো, ‘দয়া ক’রে আমাকে ক্ষমা করো, টুম্পার মা। এতদিন তুমি কী ক’রেছো তা আমার জানার দরকার নেই; অনুগ্রহ ক’রে ফিরে এসো. একসাথে, আমরা আমাদের টুম্পাকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে আনবো। ও আর আমাদের ছেড়ে যাবে না। ’
এর পরে, এই প্রথম শোনা গেল স্বপনের নতুন বিয়ে করা বৌ নন্দিতার কান্নার আওয়াজ, ‘আমি কোথায় যাবো, স্বপন? এখন দু'দিনও পার হ’য়নি আমরা চিরকাল একসাথে থাকার জন্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি দুজনে দুজনকে …।‘
‘সে প্রতিশ্রুতি রাখবো আমি, নন্দিতা, যতদিন আমি বাঁচবো তুমি স্ত্রী হ’য়ে থাকবে আমার সাথে।’, স্বপন ব’লেছিলো, ’যদি অঞ্জু ফিরে আসে, তুমি থাকবে অঞ্জুর ছোট বোন হ’য়ে, সতীন হ’লেও তুমি ওর বোন বা বন্ধু হবে।’
পাশের ঘরে বসে, আমি মিলির বাবা, স্বপনকা এবং দুই অঞ্জুর বলা প্রতিটি শব্দ শুনেছি। এক অঞ্জু স্বপনকার নতুন স্ত্রী নন্দিতা আর অন্য অঞ্জু যে একসময় আমার শ্রদ্ধেয়া অঞ্জু মাসী ছিল, এখন যে আমার প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী মিলি, - সমস্ত অফিসিয়াল ডকুমেন্টে আমার অংশীদার যদিও আইনতঃ আমরা কোনোদিনই বিবাহিত নই। আমি আকাশ পাতাল অনেক চিন্তা ক’রছিলাম, খুঁজছিলাম মিলিকে উদ্ধার করার কী কী উপায় হ’তে পারে। ঠিক এই সময়ে আমার মোবাইলে একটি টোন আসে – সদ্য পরিচিত ছোট বাবলুর কাছ থেকে - হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইমেল মেসেজ:
‘বাবলুদা, তুমি যেমন বলেছিলে ঠিক সে ভাবেই আমি টুম্পাকে অপহরণ ক’রেছি, তাকে দিল্লীতে আমার মাসীর বাড়ীতে নিয়ে এসেছি। আমি মাসীকে বলেছি, ‘টুম্পার বাবা-মা দিল্লীতে থাকেন, তবে এখন বাইরে গেছেন; তারা কয়েক দিন বাদে ফিরলে ওকে তাঁরা নিয়ে যাবেন।’ টুম্পা সহজেই আমার মাসীর মেয়ের বন্ধু হ’য়ে গেছে এবং ওরা একই বিছানায় শুচ্ছে। আমি তোমার সম্পর্কে টুম্পাকে জানিয়েছি। এখানে ওর ফোন নম্বর দিলাম। যখন প্রয়োজন মনে ক’রবেন, আমাদের প্লীজ কল করুন।’
বাবলুর মেসেজ আমার কাছে মনে হ’লো ভগবানের পাঠানো। ও ঘরের নাটকীয় দৃশ্যে এই সময় আমাকে হাজির হ’তে হবে। আমি ঘরে ঢুকলাম, এবং কোনও রকম দ্বিধা না ক’রে আমি স্বপনকার পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম এবং ব’ললাম, ‘আমাকে বাঁচাও, স্বপনকা; দয়া ক’রে তোমার দোষী ভাইপোকে ক্ষমা করো। আমিই অঞ্জু মাসীকে কিডন্যাপ ক’রেছিলাম, অঞ্জু মাসীকে পরে আমি আমার আরও আপন জন ক’রে নিয়েছি – সবাই জানে - মিলি আমার জীবন সঙ্গিনী। আমি তোমাকে তার সম্পর্কে অনেক কিছুই আগে জানিয়েছি। তবু সে এখনও টুম্পার মা রয়ে গেছে – সেখানে ও এতটুকু বদলায় নি। দয়া ক’রে, অঞ্জু মাসীকে তোমার জীবনে আবার আমন্ত্রণ কোরো না; দয়া করে ওকে আমার মিলির মতো থাকতে দাও; ও শুধু টুম্পার মা নয়, ও ১৪বছরের রিমি এবং ৮বছরের মিন্টুরও মা… .. ’
স্বপনকা আমাকে থামিয়ে ব’ললেন, ‘তোমাকে আর ব’লতে হবে না। আমার প্রিয় ভাইপো এবং বিশ্বস্ত বন্ধুর কাছে ঠকতে আমার আপত্তি নেই। বন্ধুদের বিশ্বাস ক’রে ঠকতে রাজী আছি, কিন্তু বিশ্বাস না ক’রে বন্ধু হারাতে রাজী নই। বলো কেন তুমি অঞ্জুকে কিডন্যাপ ক’রেছো, আর কীভাবে?’
এর পরে মিলি উত্তর দিয়েছিল, আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে, ‘এটি বাবলুর কোনও দোষ নয়। আমিই তোমাদের বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছি - কারণ আমি অনুভব ক’রেছি যে, মেয়েরা সেখানে অবাঞ্ছিত। লালু, ভুলু - দুই নাতি থাকা সত্ত্বেও মামণি আর এক নাতির আশা ক’রেছিলেন আমার কাছে; টুম্পা জন্মাতে ওঁর আশা ভেঙ্গে যায়। এমনকি তুমি খুব আলাদা ছিলে না; তুমি আমাকে ঠিচ স্ত্রী হিসেবে দেখোনি কোনোদিন, দেখেছো তোমার ক্রীতদাসীর মতো। বাবলু আর আমি যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিই কীভাবে আমাদের প্রতিদিনের জীবন কাটানো উচিত। বাবলুর কাছে আমি ওর আপন জন ‘মিলি’; কেবল ‘রিমির মা’ বা ‘মিন্টুর মা’ নয়।’
স্বপনকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত হ’য়ে দাঁড়ালেন; তারপরে মিলিকে ব’ললেন, ‘যদি তুমি চাও, সুখে থাকো বাবলুর সাথে। তোমার চেহারা আমার না দেখলেও চলবে। টুম্পা ফিরে আসুক, আমি টুম্পার বাবা হিসাবে বেঁচে থাকবো। টুম্পা আর নতুন বাবলু একে অপরকে খুব পছন্দ করে। তবে আমি চাই টুম্পা তার বিয়ের আগে একজন গ্র্যাজুয়েট হোক এবং নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখুক।
তুমি যদি কখনও মনে করো যে তোমার কর্ত্তব্য টুম্পার সাথে থাকা তবে প্লীজ ফিরে এসো আমার কাছে, হয়তো ‘টুম্পার মা’ হ’য়ে নয়, মিলি হ’য়ে, অঞ্জু হ’য়ে, বা তোমার ইচ্ছেমতো অন্য যে কোনও নাম নিয়ে। আশা করি নন্দিতা আর আমি একসাথে থাকবো সারা জীবন, পরস্পরের জন্যে ক’রবো দিন যাপন। তুমি আমাদের সাথে যদি কোনও দিন যোগ দাও, হয়তো তবে আরও পরিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন ... ’
*** সমাপ্ত ***