বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

তাপ উত্তাপ - ১ম ই-সংখ্যা, জুলাই ২০২০

সম্পাদকের কথা ×××××××××××××

৪২ বছর বিশ্বস্ত প্রেমিকার সঙ্গে পথ চলা। প্রেমিকাটি তাপ উত্তাপ নামক একটি স্বপ্ন- পত্রিকা। আসানসোলের মিশ্র কালচারের নাগরিক সভ্যতায়, মানুষের সঙ্গে থেকে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ, ভাবা যায়? কখন যেন চার চারটি দশক পেরিয়ে গেল। কোভিড-১৯ এর দাপটে যখন তাপ উত্তাপের নি: শ্বাস বন্ধ হবার যোগার তখন ই ম্যাগাজিনের দ্বারস্থ। জানি না তাপ উত্তাপের নব যুদ্ধ পাঠকের কেমন লাগবে।

সম্পাদক : অমল বন্দ্যোপাধ্যায়

সহ: সম্পাদক: কুমারেশ তেওয়ারী

প্রচ্ছদ: সোমবারতা ঘোষ

পশ্চিম বর্ধমান জেলার প্রথম নিয়মিত ই. ম্যাগাজিন। মেল আই. ডি ~tap uttap @ gmail. Com Mobile: 9333139595/7001693521 W. Ap -9333139595

---------------------------------------------------------------------------------------------------------

এই সংখ্যার সূচী

 ১ সম্পাদকীয়, ২ এক অসাধারাণ লেখনীর বিদায় – অপর্ণা ভট্টাচার্য ৩ দেশ বিদেশের সাহিত্যে মহামারি – মালবিকা ভট্টাচার্য ৪ নারী কি সত্যিই অর্ধেক আকাশ? মালবিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ৫ ভালোবাসি কবিতাঃ সুদীপ্ত রায়   

৫ ভালোবাসা মুকুল হাজরা ৬ প্রান্তিক স্টেশন কাকলী চ্যাটার্জী ৭ কবিতা, আমার প্রথম প্রেম অন্তরা / কবিতা আমার প্রথম প্রেম অপর্ণা দেওঘরিয়া / কবিতা আমার প্রথম প্রেম শেখ ইমাম উদ্দিন

কবিতা আমার প্রথম প্রেম মালবিকা হাজরা -  প্রশ্ন ছিল তিনি যা লিখেছেন তা কি সত্যকথন?

কবিতা আমার প্রথম প্রেম / সাবিত্রী নন্দী

৬ তাপ উত্তাপ সম্পাদকের প্রতি [ ৯০ দিনে বিশাল প্রাপ্তি] কুমারেশ তেওয়ারী

৭ পার্থ প্রতীম আচার্য

৮ সুব্রত সিনহা

৯ আমি একা প্রহরী আলোকা বিশ্বাস সাহা

১০ সতর্কবার্তা রঞ্জন ব্যানার্জী

১১ কবিতার নাম করোনা মিতালী পাল

১২ এবার তো ওঠো সুমিত্রা নন্দী

১৩ অভারসীজ তাপ উত্তাপ লকডাউন/ দিদি বিভাস সাহা  

১৪ তান্ডব যাজ্ঞসেনী কৃষ্ণা

১৫ ( রম্যরচনা ) মানুবাবুর সাহিত্য সাধনা। সুব্রত সরকার ।

১৬ লক ডাউনে উপন্যাস পাঠ চন্দ্রাবলী গুপ্ত   

১৭ আমি ভাবছি শবনম দাশগুপ্ত

১৮ আমার অনুভব সম্বৃতা দাশরায়

 ১৯ অস্থির এই সময় স্বস্তিকা বোস দাস

২০  লকডাউন আনলকড: কনফিউশন অ্যারাইজড মধুমিতা তরফদার

২য় অধ্যায়ে  তাপ উত্তাপ গ্যালারিতে রয়েছে --

শিল্পী সোমবারতা ঘোষের স্কেচ, নীড়ের পথে, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা, তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে 

যদি আমি কোয়ারান্টিনে যাই, তবে এই সেন্টারে যাবো, শিল্পী সোম বার্তা ঘোষের স্বপ্ন তাঁর তুলিতে. 

আমফান আসছে, সোম বার্তা ঘোষের স্কেচ(জলরঙে) তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে

লক ডাউনের  স্কেচ করেছেন কলকাতার সোমবারতা ঘোষ, 

দেবদূত মুখোপাধ্যায়ের চারকোলের কাজ

 সঙ্গে ফোটো ফিচার

আজ স্পন্দন পার্কে

আজ স্পন্দন পার্কে একুশের উদযাপনে বসে আঁকো প্রতিযোগিদের সঙ্গে গৌরী দেবী

সীমা মন্ডল,মধুমিতা চাাটার্জী আজ স্পন্দন পার্কে।

সঞ্চালক কুমারেশ তেওয়ারি ঘোষণা করছেন -- তাপ উত্তাপের ২১শ ফেব্রুয়ারী সংখ্যা মলাট উন্মোচন করছেন সৌরভ ভাদুড়ি ও মান্না দাস স্পন্দন পার্কে

বাংলাভাষা আদৌ বিপন্ন নয়--এবিষয়ে বক্তব্য রাখছেন আসানসোল বার এসোসিয়েশনের সভাপতি অমিতাভ মুখোপাধ্যায়

সঙ্গে প্রাসঙ্গিক লেখা - বাংলাভাষায় অন্য ভাষার অনুপ্রবেশ --এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন মালবিকা হাজরা —

----------------------------------------------------------------------------------------------------------


শ্রদ্ধেয় নিমাই ভট্টাচার্যের প্রয়ানে বাংলা সাহিত্যে একটি যুগের অবসান হল। এমন উচ্চ প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ অত্যন্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন করে গেছেন। তিনি যেন চলতে ফিরতে উপন্যাস লিখতেন। দৈনন্দিন জীবন থেকে সংগ্রহ করতেন উপন্যাসের চরিত্র।
তাঁর জন্ম ১৯৩১ এর ১০ই এপ্রিল। যদিও তাঁর আদি বাড়ি ছিল যশোরের মাগুরায় কিন্তু জন্ম হয়েছিল কলকাতায়। প্রাথমিক পড়াশোনা যশোরে।১৯৪৮ এ ম্যট্রিকুলেশন পাশ করে কলকাতায় এসে রিপন্ কলেজে ভর্তি হন। রিপন্ কলেজ থেকেই আইএ এবং বিএ পাশ করেন।
এরপর দিল্লিতে শুরু করেন সাংবাদিকতা ও সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় লেখালেখি। ‘মেমসাহেব’ উপন্যাসটি লিখে সাহিত্য ক্ষেত্রে স্থায়ী আসন করে নেন। বিভিন্ন পটভূমিকায় ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বিচিত্র কাহিনী ও চরিত্রাবলীর সমাবেশ হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর সৃষ্ট কিছু বই এর নামোল্লেখ করা যাক।
চীনাবাজার, স্বপ্নভঙ্গ, এক চক্কোর ,দঃ পূর্ব এশিয়া, ফুটবলার, কেয়ার অফ ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসী, শেষ পারানির কড়ি, বিশেষ সংবাদ দাতা প্রেরিত, রাজধানী এক্সপ্রেস, রাজধানীর নেপথ্যে, অনেকদিনের মনের মানুষ, পিকাডিলি সার্কাস, ডিফেন্স কলোনী, পার্লামেন্ট স্ট্রিট, সাব ইন্সপেক্টর, লাস্ট কাউন্টার, উইং কমান্ডার, প্রবেশ নিষেধ, শ্রেষ্ঠাংশে,সেলিম চিস্তি, ভি আই পি, ভালবাসা, ডিপ্লোম্যট, রিপোর্টার, অ্যালবাম, এডিসি, গোধূলিয়া,রিটায়ার্ড,পেন ফ্রেন্ড অ্যান্ড ক্লাসফ্রেন্ড, আকাশ ভরা সূর্য তারা, এরাও মানুষ, ওয়ান আপ্ টু ডাউন, রাঙা বৌদি, নাচনী, বিপ্লবী স্বামী বিবেকানন্দ, জার্নালিস্টের জার্নাল, গল্প সমগ্র ১ম ও ২য় । এমন ১৫০ খানি বই তিনি রচনা করে গেছেন।
‘সাব ইন্সপেক্টর’ উপন্যাসটি কাশির পটভূমিকায় লেখা। দশাশ্বমেধ ঘাট তাঁর অত্যন্ত পছন্দের জায়গা। এই ঘাটে উপন্যাসের নায়কের সঙ্গে দেখা হয় কেষ্ট দারোগার।উত্তর বাহিনী গঙ্গার দিকে তাকিয়ে দুজনের কথোপকথন। সাব ইন্সপেক্টরের কর্ম জীবনের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে।এক্কেবারে প্রচলিত কথ্য ভাষায় সর্ব সাধারণের জন্য তিনি লিখে গেছেন।
‘প্রবেশ নিষেধ’ উপন্যাসে নব বিবাহিত স্বামী স্ত্রীর দুর্বার শারীরিক আকর্ষণ দেখাতে গিয়ে বলেছেন শৈশব আর কৈশোর মিলিয়েই তো যৌবন। এই উপন্যাসের নায়ক নায়িকার প্রাত্যহিক জীবন ছন্দ থেকে প্রতীত হয় লেখক নিজে জীবনকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে ভালবাসতেন।

দিল্লিতে বসবাস করার সুবাদে এই উপন্যাসে অত্যন্ত দৃপ্ত ভঙ্গীমায় নিউদিল্লির ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
তিনি দিল্লিতে সাংবাদিকতা শুরু করেন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সফর সঙ্গী হতেন। ‘বিশেষ সংবাদ দাতা প্রেরিত’ উপন্যাসটিতে সাহসী সাংবাদিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। উপন্যাসের শুরুতেই লিখছেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটের একজন উচ্চপদস্থ অফিসার গোপন তদন্ত করে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন, শুধু কলকাতার বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার রূপায়নে অন্তত ১৫ কোটি টাকা ঠিক মত খরচ করা হয়নি এবং অবিলম্বে সাতজন বিশিষ্ট অফিসার ও ইঞ্জিনিয়ারের বিরুদ্ধে সি বি আই এর কাছে সরকারী ভাবে নালিশ করার সুপারিশ করেছেন।
তিনি সাংবাদিকতা করেছিলেন বলেই তাঁর অভিজ্ঞতা এই ধরনের উপন্যাস লিখতে তাঁকে সাহায্য করেছিল।


ফুটবলার উপন্যাসটি তিনি লেখেন আসানসোলের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব শিল্পী, সাংবাদিক এবং ফুটবলার শ্রদ্ধেয় দেবব্রত ঘোষ ও তার স্ত্রী কেয়া ঘোষকে কেন্দ্র করে।
ফুটবলার জয়ের চরিত্র আঁকতে গিয়ে তাঁকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটবল খেলা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে।
এই স্বল্প পরিসরে শ্রদ্ধেয় নিমাই ভট্টাচার্যকে ধরতে যাওয়া মানে দিগন্ত বিস্তৃত সিন্ধু থেকে এক বিন্দু জল আহরণ করা। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ থেকে তিনি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন এবং একেকটি উপন্যাসে তা উজাড় করে দিয়েছেন।
১৯৬৩ সালে তিনি অমৃত বাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন এবং এই পত্রিকাতেই তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। প্রচুর উপন্যাস হিন্দি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর রচিত ১৫০টি পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তিনি রেখে গেলেন তিন পুত্র কে। স্ত্রী এবং দুই কন্যার আগেই মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বহু উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। নিমাই ভট্টাচার্যের মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে যে ভান্ডার তিনি রেখে গেলেন তা বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

'কোনো শহরের সঠিক পরিচয় পেতে হলে খোঁজ রাখতে হয় সেখানকার মানুষ কীভাবে কাজ করে, কীভাবে ভালোবাসে, আর কেমন করেই বা তারা মরণকে বরণ করে।’ আলবেয়ার ক্যামুর 'প্লেগ' উপন্যাসটি শুরু হয়েছে এই বাক্যটি দিয়ে। ১৯৪৭ সালের উপন্যাস ‘লা পেস্তে’ (‘দ্য প্লেগ’) মহামারি নিয়ে লেখা সর্বাধিক পঠিত বইয়ের সম্ভবত শীর্ষে অবস্থান করছে । যেখানে ডাক্তার রিও বলছেন, ‘এত লোকের মৃত্যু দেখেও আমি আজও মৃত্যুতে অভ্যস্ত হতে পারিনি, মৃত্যু আমার কাছে সেই রহস্যই রয়ে গেছে।’
শহরবাসীকে নিয়ে ক্যামুর সেই নির্মম সত্য বাক্য, ‘ভবিষ্যতের সমস্ত চিন্তাকে মুছে দেয়, মানুষের সমস্ত গতিবিধিকে পঙ্গু করে দেয়, তার সমস্ত আলাপ–আলোচনাকে নিরর্থক করে তোলে এমন এক ভয়াবহ মহামারির চিন্তা সত্যিই তাদের মনে আসবে কি করে? নিজেদের মুক্ত–স্বাধীন বলেই তারা ধরে নিয়েছিল, কিন্তু মহামারি কোনো দিন মানুষকে মুক্ত বা স্বাধীন থাকতে দেয় না।’

আলবেয়ার ক্যামু ছাড়াও মহামারি নিয়ে কালজয়ী উপন্যাস লিখেছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস , 'লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা'।
'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিটিউড' উপন্যাসেও মার্কেস এমন অদ্ভুত মারির গল্প বলেন। এখানে মাকোন্দো গ্রামের সবাই আক্রান্ত হতে থাকে ভুলে যাওয়া রোগে।
গোটা উপন্যাসে এভাবে মার্কেস এক আশ্চর্য স্মৃতিহীনতা আর অতীতহীনতার মহামারির জাদুবাস্তব গল্প বলেন।

মহামারি নিয়ে আরেক বিখ্যাত উপন্যাস হোসে সারামাগোর 'ব্লাইন্ডনেস'। উপন্যাসের প্রথম দিকে এক অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখে সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে! তারপর সত্যিই সে অন্ধ হয়ে যায়।
ছড়াতে থাকে মহামারিটি, আরও নতুন নতুন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন। কীভাবে একটা অন্ধ চোখ, যা দেখতে পায় না, তা অন্য কারও চোখকে সংক্রমিত করে, তা বুঝতে পারে না কেউ। শেষে এক মধ্যবয়সী নারী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে আসলে তারা কেউ কখনো অন্ধ হয়ে যায়নি, বরাবর তারা অন্ধই ছিল।

প্রাচীন সাহিত্যে অনুমান করা হয়, ১৩৪৮ সালের মহামারি মনে রেখেই ইটালীয় লেখক জোভান্নি বোক্কাসিও ‘দ্য ডেকামেরন’ লেখেন।
পরবর্তী কালে ইংরেজ কবি জেফরি চসারের ‘দ্য কেন্টারবেরি টেলস’-ও ‘দ্য ডেকামেরন’-এর কাঠামোর মতোই।
১৬৬৫ সালে লন্ডনে যে প্লেগ আক্রমণ করে তার ওপর ভিত্তি করে ড্যানিয়েল ডিফো লেখেন ‘আ জার্নাল অব দ্য প্লেগ ইয়ার’।
১৮৪২ সালে এডগার অ্যালান পোর ছোটগল্প ‘দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ’ তাঁর সময়ের রোগ-ব্যাধিতে মানুষের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরে চমত্কার শিল্পে।
১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কল্পবিজ্ঞানের লেখক স্টিফেন কিং তাঁর 'দ্য স্ট্যান্ড' উপন্যাসে প্রতিরক্ষা বিভাগের পরীক্ষাগারে অসাবধানে বের হয়ে পড়া ভাইরাস থেকে শুরু হওয়া ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারির কথা বলেন।
১৯৯৭ সালের বুকার পুরস্কারের প্রতিযোগিতায় অরুন্ধতী রায়ের বিজয়ী উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর পরেই স্থান পেয়েছিল জিম ক্রেসের ‘কোয়ারেন্টিন’।

এর আগে পৃথিবীতে বহুবার মহামারি এসেছে, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ সম্ভবত কখনো একই সঙ্গে এমন মহামারির মুখোমুখি হয়নি।
মহামারি’র সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অবশ্যই নতুন কিছু নয়। তবে বাঙালির গেরস্থালিতে তার নাম ‘মহামারি’ ছিল না। বাঙালির আবহমান তাকে চিনত ‘মড়ক’ হিসেবে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে আমরা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর-কালীন(ইং-১৭৭০, বাং-১১৭৬) মহামারির বর্ণনা পাই। যেমন : ‘রোগ সময় পাইল। জ্বর, ওলাউঠা, ক্ষয়, বসন্ত। বিশেষত বসন্তের বড় প্রাদুর্ভাব হইল। গৃহে গৃহে বসন্তে মরিতে লাগিল। কে কাহাকে জল দেয়, কে কাহাকে স্পর্শ করে। কেহ কাহার চিকিৎসা করে না; কেহ কাহাকে দেখে না; মরিলে কেহ ফেলে না। অতি রমণীয় বপু অট্টালিকার মধ্যে আপনা আপনি পচে। যে গৃহে একবার বসন্ত প্রবেশ করে, সে গৃহবাসীরা রোগী ফেলিয়া পলায়।’

জীবদ্দশায় ম্যালেরিয়া, গুটিবসন্ত, প্লেগের মতো প্রাণঘাতী বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। তাঁর সাহিত্যকর্মে এসব মহামারির জীবন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে।

১৯১৪ সালে বেরিয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘চতুরঙ্গ’। চতুরঙ্গ উপন্যাসের ঋজু চরিত্র জ্যাঠামশাই জগমোহন প্রতিবেশীদের কাছে পরিচিতি পেয়েছিলেন ‘নাস্তিক’ হিসেবে।
পাড়ায় প্লেগ দেখা দিল। পাছে হাসপাতালে ধরিয়া লইয়া যায় এজন্য লোকে ডাক্তার ডাকিতে চাহিল না। জগমোহন স্বয়ং প্লেগ-হাসপাতাল দেখিয়া আসিয়া বলিলেন - ব্যামো হইয়াছে বলিয়া তো মানুষ অপরাধ করে নাই।’ যখন প্লেগের আক্রমণে সবাই দিশেহারা হয়ে নিরাপদ স্থানে পালাচ্ছে, তখন তিনি দায়িত্ব নিলেন অসহায় চামারদের নিরাপত্তা বিধানের। নিজের বাড়িতে প্লেগ রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল স্থাপন করলেন। মুসলমান ও গরিব রোগীদের সেবা করতে করতে নিজেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।

বিংশ শতক সবেমাত্র শুরু হয়েছে। নতুন শতাব্দীর আগমনে সবারই আনন্দ করার কথা। কিন্তু কিছুতেই যেন সেই আনন্দ আসছে না বাংলায়। কলকাতায় সাহেবরাও কিরকম চুপ হয়ে আছে। চারিদিকে হাহাকার তখন। কীসের আর্তনাদ? মৃত্যুর! কলকাতা-সহ নানা জায়গায় তখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ছে প্লেগ। আক্রান্ত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যাচ্ছে একজন সুস্থ মানুষ। কতজনকে চিকিৎসার পরিষেবা দেওয়া হবে? সব জায়গাতেই তো একই অবস্থা। চিন্তায় পড়েছেন রবীন্দ্রনাথও। জোড়াসাঁকোয় বাড়ির বাকিদের জন্য তো বটেই, অসহায় মানুষগুলোর জন্যও রাতের ঘুম উধাও হয়েছে। বাড়িতে দুজন মেথরেরও প্লেগ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ভাবলেন, কিছু একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। যত সামান্যই হোক না কেন, কিছু মানুষ রক্ষে পেলেও তো অনেক!

গত শতাব্দীর প্রারম্ভে গুটিবসন্তে ভারতবর্ষে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে। এই মহামারিতে প্রাণ হারায় অগণিত মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অভিসার’ কবিতায় রাজনর্তকী বাসবদত্তা গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিল। কবির ভাষায়, ‘নিদারুণ রোগে মারীগুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ/রোগমসী-ঢালা কালি তনু তার/লয়ে প্রজাগণে পুরপরিখার/বাহিরে ফেলেছে করি পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।’

ফিরে ফিরেই বাংলা সাহিত্যে এসেছে মহামারির উল্লেখ। স্বাধীনতার আগে ভারতবর্ষে আর যারই অভাব থাক; প্লেগ , কলেরা বা বসন্ত রোগের কোনো কমতি ছিল না। দারিদ্র্য, অস্বাস্থ্যকর জল-বাতাস ও অপর্যাপ্ত চিকিৎসার জেরে প্রাণ হারাতে হত অনেককেই। আমাদের লেখকেরাও ভুলে যাননি, সাহিত্য সমাজের সামনে একটি আয়না ধরে রাখতে দায়বদ্ধ।

১৯১৮ সালে প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্রের 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্ব। উপন্যাস জুড়েই মহামারি , জনস্বাস্থ্য নিয়ে দুর্বিপাকের কথা ছড়িয়ে আছে। শ্রীকান্ত'র বিবরণ থেকে স্পষ্ট হয় মহামারি ছোটোলোক ও ভদ্রলোকের ব্যবধানকে কমিয়ে নিয়ে আসে না। শরৎচন্দ্র 'ছোটোজাত' ও 'উঁচুজাত'-এর মধ্যে বিপুল ফারাকের কথা কিছুটা হলেও ভেবেছিলেন।

উপন্যাসে শ্রীকান্ত যাচ্ছে বার্মাদেশে,


“পরদিন বেলা এগার-বারটার মধ্যে জাহাজ রেঙ্গুন পৌঁছিবে; কিন্তু ভোর না হইতেই সমস্ত লোকের মুখচোখে একটা ভয় ও চাঞ্চল্যের চিহ্ন দেখা দিল। চারিদিক হইতে একটা অস্ফুট শব্দ কানে আসিতে লাগিল, কেরেন্টিন। খবর লইয়া জানিলাম, কথাটা quarantine: তখন প্লেগের ভয়ে বর্মা গভর্নমেন্ট অত্যন্ত সাবধান। শহর হইতে আট-দশ মাইল দূরে একটা চড়ায় কাঁটাতারের বেড়া দিয়া খানিকটা স্থান ঘিরিয়া লইয়া অনেকগুলি কুঁড়েঘর তৈয়ারি করা হইয়াছে; ইহারই মধ্যে সমস্ত ডেকের যাত্রীদের নির্বিচারে নামাইয়া দেওয়া হয়। দশদিন বাস করার পর, তবে ইহারা শহরে প্রবেশ করিতে পায়।”

কোয়রান্টিনের সঙ্গে সেটাই বোধ হয় বাঙালি পাঠকের প্রথম পরিচয়। এই বর্ণনা শ্রীকান্তর বর্মা পৌঁছনোর মুহূর্তের। সেখানে প্লেগ দেখা দিয়েছে। বর্মাও তখন ইংরেজ কলোনি। ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র ব্যবস্থার লক্ষণগুলো সেখানে ‘ক্রমে আসিতেছে’। এই লক্ষণগুলোরই অন্যতম হল জনস্বাস্থ্য। মহামারি দেখা দিলে জনস্বাস্থ্য বিধি মেনেই সদ্য বহিরাগতদের কোয়রান্টিন করে রাখার ব্যবস্থা সেখানকার ঔপনিবেশিক সরকার করেছিল। পরে শরৎবাবু কোয়রান্টিনের যন্ত্রণার কথা লিখেছিলেন। এবং এটা বলেছিলেন যে, কোয়রান্টিনের যন্ত্রণা পোহাতে হয় মূলত ‘ছোটলোকদের’। ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র যে ‘জন’-কে তার টার্গেট করে, তারা তথাকথিত ভদ্রেতর। তা সে ইংরেজ আমলই হোক, আর সাম্প্রতিক কালের জীবন্ত মানুষের উপরে কীটনাশক স্প্রে করা ডিজিটাল রাষ্ট্রযন্ত্রই হোক, খেলা একই।

শরৎচন্দ্রের অন্য উপন্যাস 'পণ্ডিতমশাই'-এও কলেরা মহামারির বর্ণনা পাওয়া যায়। 'গৃহদাহ' উপন্যাসের সুরেশ তো মহামারিতে সংক্রমিত হয়েই মারা যায়।

মহামারির আরেক বিশ্বস্ত ছবি পাওয়া যায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাতে। ‘আরণ্যক’ (১৯৩৯) উপন্যাসে নায়ক সত্যচরণের মুখে সেই বিবরণ শুনি আমরা।
'সেবার শুয়োরমারি বস্তিতে ভয়ানক কলেরা আরম্ভ হইল, কাছারিতে বসিয়া খবর পাইলাম। শুয়োরমারি আমাদের এলাকার মধ্যে নয়, এখান থেকে আট-দশ ক্রোশ দূরে, কুশী ও কলবলিয়া নদীর ধারে। প্রতিদিন এত লোক মরিতে লাগিল যে, কুশী নদীর জলে সর্বদা মড়া ভাসিয়া যাইতেছে, দাহ করিবার ব্যবস্থা নাই।’

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাসের নায়ক শিবনাথও কলেরা আক্রান্তদের সেবা করতে গিয়ে বিরুদ্ধতার শিকার হয়। ‘গণদেবতা’ ও 'আরোগ্য নিকেতন' উপন্যাসেও কলেরার বিস্তৃত উল্লেখ রেখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

শশী ডাক্তারকে মনে পড়ে? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র নায়ক শশী চেয়েছিল নিজের গ্রামেই থেকে যেতে, দুঃখী মানুষগুলির কাজে লাগতে। গাওদিয়া গ্রামের প্রকৃতি ছিল নিষ্করুণ, অন্যতম বিপদ ছিল মহামারী। প্রায়ই ছড়িয়ে পড়ত কলেরা, টাইফয়েড, কালাজ্বর ও বসন্তের মতো ব্যাধিগুলি। শশী তার সাধ্যের সীমা অবধি চেষ্টা করেছিল, কাউকে কাউকে সারিয়েও তুলেছিল – কিন্তু কতদূর তার পক্ষে সম্ভব?

জহির রায়হান-এর 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসে কলেরার মড়ক বর্ণিত হয়েছে এ'ভাবে - ' অবশেষে আরও আট দশটি প্রাণ হরণ করে তবে গ্রাম থেকে বিদায় নিলেন ওলাবিবি। '

মহামারি এ দেশের ইতিহাসে নতুন কিছুই নয়। আবহমানে বার বার এ দেশে আর পাঁচটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো মড়কও এসেছে। কিন্তু তার হিসেব প্রাগাধুনিক বাংলা তথা ভারত রাখত না। আসলে রাখার দরকারও ছিল না সে কালের রাষ্ট্রের।

মধ্যবিত্ত অধ্যূষিত বাংলা সাহিত্যে নিজের ঘর না পোড়া পর্যন্ত কি অপেক্ষা করতে হয় ‘বিষয়’-কে? তারাশঙ্করের লেখায় মহামারি ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালি স্বদেশিভাবাপন্নতা প্রকাশের একটা সুযোগ। বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এর সত্যচরণ মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজ থেকে দূরে অবস্থানরত এক সত্তা। তার কাছে সেবাব্রত গ্রহণের কোনও মানে হয় না। সে শুয়োরমারী বস্তিতে ছুটে গিয়েছিল এমন এক টানে, যে টানটাই ‘আরণ্যক’-এর প্রাণশক্তি। বিভূতিভূষণের অন্য কোনও রচনায় এটা দেখা যায় না। ‘আরণ্যক’ তাই ব্যতিক্রম। জ্বলন্ত ব্যতিক্রম।

ম্যালেরিয়া বা কলেরায় গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাওয়ার এক অন্য উদাহরণ রয়েছে। একে ঠিক ‘সাহিত্য’ বলে মানতে না চাইলে কিছু করার নেই। বরং একে ‘ওরাল লোর’ বলে মেনে নেওয়াই ভাল। বহু দিন পরে জামাই শ্বশুরবাড়ি পৌঁছেছে বেশ রাত করে। শুনশান গ্রামে নিশুতি শ্বশুরবাড়িতে জামাইকে খেতে দিয়েছেন শ্বাশুড়ি। জামাই একটু লেবু চাইতে শ্বাশুড়ি ঠাকরুন ঘর থেকেই হাত বাড়িয়ে দূরের বাগানের লেবুগাছ থেকে লেবু পেড়ে আনলেন। জামাই ভয়ে অজ্ঞান। পর দিন জ্ঞান ফিরতে দেখতে পেল এক খণ্ডহরের মধ্যে সে পড়ে রয়েছে। কোনও রকমে পালিয়ে এক জনপদে পৌঁছে সে জানতে পারল, তার শ্বশুরবাড়ির গ্রামটি কলেরা বা ম্যালেরিয়ায় উজাড় হয়ে গিয়েছে। আর সেখানে আজ ‘তেনাদের’ রাজত্ব। শিশুতোষ এই ভূতের গল্প কিন্তু খুবই কমন বাংলায়। এই ‘উজাড় হয়ে যাওয়া গাঁ’-কে বাঙালির গণস্মৃতি ধরে রেখেছে। মহামারির ভয়াবহতা কথনের জন্য কেউ বেঁচে নেই আর। যা আছে, তা ‘হরর’। ‘পোস্ট এপিডেমিক হরর’। তার থেকেই জন্মায় এই ‘ভৌতিকতা’।

জানি না করোনাভাইরাসের দাপট কমলে বাংলার সাহিত্যিকরা একে উপজীব্য করে উপন্যাস বা গল্প লিখবেন কি না। কবিতা তো লেখা শুরু হয়েই গিয়েছে ।
কিন্তু একটা ‘প্লেগ’ বা ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার অফ সলিটিউড’ কি লেখা হবে? মারি কেটে যাক। মানুষ স্থিত হোক। সাহিত্য তার পরে। কিন্তু মহামারির স্মৃতিকে তো হারিয়ে যেতে দিলে চলবে না। তাকে আবার দরকার পড়বে ভবিষ্যতে কোনও এপিডেমিকের সময়ে। মিলিয়ে নিতে হবে অভিজ্ঞতা। কাল বদলাবে। কিন্তু ‘কালান্তর’-কে মনে করিয়ে দেবে সাহিত্য। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কী বলে।

আজ, ২০২০ সালের সর্বাত্মক ও দুঃস্বপ্নতুল্য করোনা-সংক্রমণ আমাদের স্বার্থকে আবারও এক করে ফেলল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দীর্ঘজীবন কামনা করি । ভবিষ্যৎ-প্রজন্ম নিশ্চয়ই আজকের দিনগুলি নিয়ে লেখা বাংলাভাষী আখ্যান পড়বে এবং একই রকম শিহরিত হবে।

( তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত )

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী—
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারি
আপন অন্তর হতে। বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনিছে বসন।
সঁপিয়া তোমার ’পরে নূতন মহিমা
অমর করিছে শিল্পী তোমার প্রতিমা।
কত বর্ণ কত গন্ধ ভূষণ কত-না,
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে খনি হতে সোনা,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন।
পড়েছে তোমার ’পরে প্রদীপ্ত বাসনা—
অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।( মানসী :: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এ আমাদের হৃদয়ের কবি রবি ঠাকুরের রচনা। নারী কখনো সৃষ্টির প্রেরণা, কখনো কবির সুললিত কাব্যের ঝঙ্কার,কখনো শিল্পীর শিল্প সুষমার নিবিড় আয়োজন, কখনো গৃহকোণের তৃপ্ত সুখের পরম আশ্রয়, আবার কখনো ঝঞ্ঝায় অশনি লিপ্ত বিধ্বংসী রূপের ঝনঝন।কখনো রহস্যময়ী কখনো বা সহজ সরল নিস্তরঙ্গ প্রতিমূর্তির প্রকাশ। তাই জীবনের চৌকাঠ থেকে সাহিত্যর পাতায় স্ব-মহিমায় নারীর দৃপ্ত উপস্থিতি।
তবু যখন সকালের খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে বধূ হত্যার খবর, শিশু কন্যার উপর যৌন নিপীড়নের মতো নৃশংসতা তখন প্রশ্ন জাগে নারীর সঠিক অবস্থান নিয়ে। কবি নজরুল বলেছিলেন -
" এই পৃথিবীর যা কিছু মহান চির কল্যাণকর /
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর"। বলা হয় নারী অর্ধেক আকাশ। সত্যিই কি নারী অর্ধেক আকাশ হতে পেরেছে?

এ প্রসঙ্গে একবার অতীতের দিকে চোখ ফেরাব। কেমন ছিল আদিম যুগের নারী? তখন বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মধ্যে অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখাই ছিল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই নারী ও পুরুষে
বিভেদ ছিলনা কোনো। খাদ্য আর নিরাপদ আশ্রয়ের চাহিদা নারী পুরুষের বিভাজন করেনি। পরবর্তীকালে বিবর্তনের ফলে মানুষ তার আদিম রূপের খোলশ ছেড়ে সভ্য হতে শিখল, শুরু হল কৃষিকাজ, কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতায় ব্যক্তি মালিকানার উন্মেষ ঘটল। কৃষিকে কেন্দ্রকরে শুরু হল গোষ্ঠীবদ্ধ যৌথজীবন। তখন থেকে স্বাধীন বন্য জীবনপথ পরিত্যাগ করে নারী হল গৃহচারিণী।

এবার আসি বৈদিক যুগে। বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারী পুরুষের সমান অধিকার ভোগ করতেন। কাত্যায়ণ ও পতঞ্জলির মতো বৈয়াকরণের রচনা থেকে জানা যায় সেকালে নারীরা শাস্ত্ররচনায় যাগযজ্ঞে ঋষিতুল্য মর্যাদা পেতেন। স্বয়ম্বর পদ্ধতিতে বিবাহের অনুমোদন ছিল। গান্ধর্ব মতে সহবাসের স্বাধীনতাও স্বীকৃত ছিল। গার্গী, মৈত্রী, অপালা, বিশ্ববারা, লোপামূদ্রা এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন পুরুষের সমকক্ষ। নারীও বেদ পাঠের অধিকারিণী ছিলেন।

ঋষি পতঞ্জলি

সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ শতকের সময় কাল থেকে নারীর অধিকারে হস্তক্ষেপ শুরু হয়। শুরু হয় নারীর অবনতি। ক্রমে ক্রমে পুরুষ নারীর ভাগ্য নিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ায়। 'মনুস্মৃতি' থেকে জানা যায় নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া নানা বিধি নিষেধের নিষেধাজ্ঞা। এর পরবর্তীকালে কিছুদিন নারী স্বাধীনতার উত্তরণ ঘটতে থাকে। তবে ইসলামিয় শাসকদলের আক্রমণে পর্যুদস্ত ভারতবর্ষের নারীরা সম্ভ্রম রক্ষার প্রয়োজনে আবার পর্দানসীন হয়ে পড়ে।

এ তো গেল তথ্যগত দিকের পর্যালোচনা। এবার আসল কথায় আসা যাক। নারী কত খানি আকাশের দাবিদার? এ বিষয়ে আলোচনার প্রথমেই বলে রাখা দরকার কেবলমাত্র আর্থিক উপার্জনই নারী মননের উত্তরণ নয়। এ ধারণা আংশিক সত্য। আর্থিক স্বাধীনতা সবসময় নারীকে তার নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার দেয় না বা স্বাধীন চিন্তার অধিকার দেয় না। বহুক্ষেত্রে নারী স্বাধীন ভাবে উপার্জনশীল কিন্তু তার নিজের রোজগার নিজের জন্য বা নিজের ইচ্ছে মতো খরচ করার অধিকার নেই। অনেক সময়ই এটি পরিবারের পুরুষ, যিনি পরিবারের প্রধান তিনিই বিষয়টি নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন। পশ্চিমবঙ্গে সাধারণত শ্রমজীবি পরিবারে নারী ও পুরুষ দুজনেই উপার্জন করেন কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী বঞ্চনার শিকার। নারীর উপার্জন সংসারে ব্যয় হয় ঠিকই কিন্তু তার মতামতের কোনো মূল্য দেওয়া হয় না। কিছু কিছু আদিবাসী সমাজে এর ব্যতিক্রম দেখা যায় তবে তার সংখ্যা নেহাতই হাতে গোনা। শিক্ষার অভাবেই নারী পুরুষের এই সম মর্যাদার তারতম্যের অন্যতম কারণ নয়। উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলিতেও এই আর্থিক স্বাধীনতার অধিকারে নারী আজও নিজের সঠিক স্থান পায়নি - অর্থব্যয় বা সঞ্চয় সবক্ষেত্রেই তার ভূমিকা হয় গৌণ। শুধু মাত্র আর্থিক দিকটি মজবুত হলেই সমস্যা মিটবে এমনটি ভাবা ভুল। শিক্ষা, যুক্তি, সংস্কারমুক্ত মানসিকতা,সাহস, নতুন কিছু করার ইচ্ছা শক্তি মানসিকতা উত্তরণ ঘটাতে পারে। শিক্ষা মানে কেবল পুঁথিগত শিক্ষা নয় ব্যবহারিক জীবনের নানা অভিঘাত থেকে পাওয়া শিক্ষাও গ্রহন করতে পারলে তবেই মনের উত্তরণ ঘটে । সবার সাথে তালমেল রাখতে গিয়ে নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। ফলত যুক্তি হিসাবে নারীর অক্ষমতাকেই দায়ী করা হয়।

সত্যিই নারী কি অক্ষম?
ঋকবেদের যুগের কথা নয় ছেড়েই দিলাম। সুলতানা রিজিয়া (১২০৫-১২২০) এই সময় কাল দিল্লীর মসনদ আলো করেছিলেন। রাণী দূর্গাবতী, চাঁদবিবি, নূরজাহান, শিবাজীর মা জিজাবাঈ, এঁরা ভারতবর্ষের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন।তেমনি মুঘল রাজকুমারী জাহানারা, গুলবদন, জিবউন্নিশাএঁরা ছিলেন কবি। ১৮৫৭ সালের মহা বিদ্রোহের সাথে জড়িয়ে আছে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ, বেগম হজরত মহল, কর্ণাটকের রানী আব্বাক্কা, কেত্তুর চেন্নামার নাম।

অষ্টাদশ শতকের হটী বিদ্যালঙ্কারের নাম অনেকের কাছেই অজানা।হটীর পিতার পরিচয় জানা যায় না। বর্ধমানের সোঁয়াই গ্রামের এই মেয়েটি বাবার কাছে সংস্কৃত ব্যাকরণ শেখেন। বিধবা হবার পর বাবা তাঁকে সহমরণে যেতে দেননি।পিতার মৃত্যুর পর তিনি কাশীধামে চলে যান।সেখানে স্মৃতি, ব্যাকরণও নবন্যায় অধ্যয়ন করে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।কাশীর পণ্ডিত সমাজ তাঁকে বিদ্যালঙ্কার উপাধি দান করেন।সেখানেই তিনি চতুষ্পাঠী স্থাপন করেন। সেকালেও তিনি প্রকাশ্যে পণ্ডিত সভায় যোগ দিতেন এবং পণ্ডিতদের মতো দক্ষিণা গ্রহণ করতেন।

১৮৬৮ সালে প্রকাশিত "হিন্দু কুল কামিনী' প্রণীত 'মনোত্তমা' উপন্যাসের রচয়িতা হিসেবে পরিচয় হীন এক মহিলা নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁর রচনায় লিপিবদ্ধ করে গেছেন।তাঁর এই রচনা 'দুর্গেশ নন্দিনী'র সমসাময়িক। তাই সমাজিক ইতিহাসের দলিলও এটি।

কামিনী রায়

বাংলার ইতিহাসে শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে চন্দ্রমুখী বসু, কাদম্বরী বসু, কামিনী রায় বেগম রোকেয়া সুলতানা, অবলা বসু এঁদের নাম।

বাংলার নব জাগরণের সূচনাকাল থেকেই ঠাকুর পরিবারের নারীদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। রবীন্দ্র অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন সফল ঔপ্যনাসিক। জ্ঞানদানন্দিনী, সরলা দেবী, ইন্দিরা দেবী, প্রতিভা দেবী এঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও নারীর কোথাও সক্রিয়, কোথাও গোপনে অংশ গ্রহন করেছে অবলীলায়। মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের কথা সবাই জানলেও, বীরভূমের দুকড়িবালা দাসী, হাওড়ার ননীবালাদাসীর কথা সক্রিয় আন্দোলনে তাঁদের ভূমিকার কথা অনেকের কাছেই অজ্ঞাত।এঁদের বীরগাথা তো কল্পকাহিনী নয়।

অবলা বসু
শিক্ষা, রাজনীতি, ক্রীড়াজগত, সঙ্গীত জগত, কারিগরি, শিল্প, বানিজ্য, সাহিত্য, সামরিক ক্ষেত্র, সমস্ত ক্ষেত্রেই নারী পুরুষের সমান প্রতিদ্বন্দ্বী। তবু প্রতিদিনের যাপনে নারী কোথাও তার যোগ্যতার সঠিক মান পান না।

এই লকডাউনের কথাই বলি। বিহারের মেয়ে জ্যোতি কুমারী তার অসুস্থ বাবাকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে ১২০০ কিলোমিটার পথ সাতদিনে পাড়ি দিয়ে দিল্লীর গুরগাঁও থেকে নিয়ে এল নিজের গ্রামে। এই উদ্যোম, এই শারীরিক ক্লেশ ও পরিশ্রমের এই নমুনার কি ব্যাখ্যা হয়? কি ব্যাখা হয় গুজরাটের আহমেদাবাদ থেকে ফেরা তরুণি মায়ের যে নিজের খাবারের শেষ কণাটুকু সন্তানের মুখে তুলে দিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে।

জামলো মকদম

জামলো মকদম নামে বছর বারোর মেয়েটি যে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে বাড়ি পৌঁছাবে বলে পথচলা শুরু করেছিল অনেক আশা নিয়ে, দীর্ঘপথের ক্লান্তি, অভুক্ত পেটের জ্বালা, রাষ্ট্রের নির্মম অবহেলায় তার আর বাড়ি পৌঁছানো হল না। তার অসমাপ্ত যাত্রার, তার বাড়ি ফেরার জেদের অসম্পূর্ণ গল্পে এ কোন উত্তরণের গল্প? কোন আকাশের গল্পে একে বাঁধা যায়? এদের কর্মের মহত্বের কাছে আকাশ এসে মাটি ছুঁয়ে দেখে তার মহিমা।

শেষে বলা যায় সেই মধ্যযুগ থেকে নারী পুরুষের যে বিভেদ যে অসাম্য তা এতো সহজেই ঘুচবে আশা করা যায় না। তবে নারী তার সপ্রতিভ ক্ষমতার বলে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেই। নারীর আত্মপ্রকৃতির মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে নিজের মহিমাকে গৌরাবান্বিত করার দায় নারীর নিজের। কারণ প্রয়োজন ছাড়া নারীর কদর হয়না এ শরৎ চন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায় বহুআগেই বলে গেছেন -- "মণি-মাণিক্য মহামূল্য বস্তু, কেন-না তাহা দুস্প্রাপ্য। এই হিসাবে নারীর মূল্য বেশী নয়, কারণ সংসারে ইনি দুষ্প্রাপ্য নহেন। জল জিনিসটি নিত্য প্রয়োজনীয়, অথচ ইহার দাম নাই। কিন্তু যদি কখনও ঐটির একান্ত অভাব হয়, তখন রাজাধিরাজও বোধ করি একফোটার জন্য মুকুটের শ্রেষ্ঠ রত্নটি খুলিয়া দিতে ইতস্ততঃ করেন না। তেমনি—ঈশ্বর না করুন,—যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেইদিনই ইহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে— আজ নহে। আজ ইনি সুলভ"।( নারীর মূল্য)

কবিতার সাথে কবির যেমন একটা নিবিড় যোগ থাকে ঠিক সেইরকম ভাবে কবিতার সাথে আবৃত্তিকারের ও একটা নিবিড় যোগ থাকে।তবে কবিতাকে ভালোবাসার জন্য আপনাকে কি কবি বা আবৃত্তিকার দুটোর মধ্যে একটা হতেই হবে? উত্তর হল না। তার জন্য শুধু কবিতার নিবিড় পাঠক হলেই চলে। এই যদি আমাকে প্রশ্ন করেন কবিতা কে আমার ভালোবাসা কি আবৃত্তির সূত্রে?এক্ষেত্রেও উত্তর হচ্ছে না। আবৃত্তি আমাকে কবিতার আরো অনেক বেশি কাছাকাছি এনেছে একথা অনঃস্বীকার্য , একথাও ঠিক যেহেতু আবৃত্তির পিছনে আবৃত্তিকারের চিন্তা ভাবনার পরিচয় আছে,সেখানে প্রতিটা স্বর পরিবর্তনের পিছনে সজ্ঞান চিন্তন প্রক্রিয়া আছে,তাই আবৃত্তি আমাকে কবিতার অনেক গভীরে পৌঁছতে সাহায্য করেছে,কবিতার প্রতিটা শব্দকে আরো বিষদে ভাবতে শিখিয়েছে। সাধকের মত নিষ্ঠা করতে শিখিয়েছে কিন্তু এসব কিছুর পরও বলবো কবিতার সাথে যোগসূত্র তৈরি বা কবিতা কে ভালোবেসে ফেলা কিন্তু তারও অনেক আগে। তখনো মনের মধ্যে আবৃত্তি বা আবৃত্তিকার জাতীয় কোনো অবয়ব তৈরীই হয়নি বা বলতে পারেন তৈরি হবার বয়স হয় নি। কিন্তু কোনো এক অজানা টানে কবিতা পড়তাম,ছড়া পড়তাম, সেগুলো মুখস্ত করতাম এবং এক মনে বলে ভীষণ তৃপ্তি অনুভব করতাম। এই টানের কারণ ব্যখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আসলে ভালোবাসার বোধহয় কোনো কারণ হয় না। আজও যত সংখ্যক কবিতা পড়ি তার আশি শতাংশ কবিতা আবৃত্তির জন্য নয় বা বলতে পারেন এই আশি শতাংশ কবিতা আবৃত্তি করার চিন্তা মনের মধ্যে আসেই না, এই পাঠ গুলো নীরব পাঠ হয়ে শুধু অন্তর কে সমৃদ্ধ করে,বা একটু অন্য ভাবে বলতে গেলে বলতে পারি কন্ঠ সেই সব শব্দ গুলো উচ্চারণ করতে না চাইলেও হৃদয় কিন্তু সেই শব্দ গুলো অনায়াসেই উচ্চারণ করে। আর কণ্ঠ এবং হৃদয়ে উচ্চারিত হওয়া শব্দ, বেদনা,আবেগ,অনুভূতি,আনন্দ গুলো যারা কলমে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তারাই হলেন কবি। তাই কবিতার কাছে যারা তাকে কলমে ফুটিয়ে তুলছেন তারা যেমন গুরুত্বপূর্ণ,যাদের কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে তারা যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমন ভাবেই যাদের হৃদয়ে উচ্চারিত হচ্ছে তারাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। তাই কবিতা কে ভালোবাসতে পারলে,তাকে আপন করে কাছে ডাকতে পারলে কবিতা সকলের ডাকে সাড়া দেয়। সেখানে আকবর বাদশার সাথে হরিপদ কেরাণির কোনো তফাৎ নেই। শুধু ভালোবাসার জন্য একটা অনুভূতিপ্রবণ মন আর প্রশস্ত হৃদয় থাকলেই যথেষ্ট।

ভালোবাসা এখন কানামাছি খেলা

যাকে পাব তাকে ছঁই

ভালোবাসা এখন ধরি মাছ না ছুঁই পানি

ভালোবাসা এখন চাঁদমামা

ঠিক যেনো ছেলে ভুলানো শব্দের মতো

ভালোবাসা এখন সুয়োরানী

ভালোবাসা এখন দুয়োরানি

তবে ভালোবাসা টা কী?

আরে রাগছেন কেন বলছি মশাই    

এটা লিটারও নয় মিটারও নয়

গিটারও নয় সেতারও নয়

জাতও নয় ধর্মও নয়

চুক্তিও নয় মুক্তিও নয়

ভালোবাসাটা ভালোবাসাই

সেই শুধু জানে

যে সত্যি ভালোবাসে

 

একা একাই বসে ছিলাম
যদি তুমি আসো,,,,,
সিগন্যাল এর লাল-হলুদ-সবুজ আলো জ্বলে উঠলো---
শেষ আশাটুকু প্ল্যাটফর্মে এক কোণে রেখে গেলাম
যদি তুমি আসো
ইচ্ছাকে বুকে জড়িয়ে
অনিচ্ছায় ভালোবাসো।

অপূর্ন ইচ্ছাগুলো সুটকেসে বন্দী
গতিশীলতায় ডুবে গেলাম,,,,
প্রশ্ন করি বারে বারে, কি পেলাম?বলো কি পেলাম?
দ্বিধা- দ্বন্দ্ব- সংশয় শব্দেরা ভারি অহেতুক,
ভালোবাসি তো, শুধু ভালোবাসায় সুখ।

খুব ইচ্ছা করে তুমি পাহাড় হও
আমি বরফ হয়ে ছুঁই
তোমার বুকে মাথা রেখে
পাইন,ফার, দেবদারু সারিতে
প্রকৃতির কোলে শুই ,,,,
ইচ্ছে করে তোমার স্রোতে
দুরন্ত ঢেউ হয়ে ভাসি
বালু-তটে আছাড় খেয়ে
আবার তোমার কাছেই আসি
ইচ্ছা করে দক্ষিণ হাওয়ায়
আদর তোমার মাখি,
ইচ্ছে করে আরো বেশি
যদি হতাম উড়ন্ত এক পাখি
ইচ্ছা করে বৃষ্টিধারায়, তোমার সাথেই সিক্ত----
আকাশ ছোঁয়া ইচ্ছে আমার, হৃদয় শুধু রিক্ত।

ইচ্ছে-চাবি লুকিয়ে রাখি, নিজের কাছে নিজেই,
সত্যি বলি, এই জীবনে, প্রান্তিক স্টেশন নেই।


ফুলছাপ ফ্রকের প্রথম বালিকাবেলা
কচি আঙুল বাবা'র মুঠি'তে গুঁজে
পায়ে পায়ে বইমেলা'র মাঠ
ছড়া, ছবি, পদ্যের রূপকথা যেন!

ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে বই দেওয়া-নেওয়ার ফাঁকে
টেস্টপেপারে'র ভেতর গুঁজে দিয়েছিল সে
"বোধ"
জীবনানন্দ বড় প্রিয় তার
পরের দিন ছেলেটি ফেরত দিয়েছিল বই
কবিতা-সমেত
আর কোনোদিন দেখা করেনি।

কলেজ -কেটে ওয়াল-ম্যাগাজিনের খসড়া তৈরী'র দুপুরে
ছেলে-হোস্টেলে'র বারান্দায়
আচমকা বুক খামচে ধ'রে
কবিতা-লেখা ছেলেটি
আগের সপ্তাহে ওই আঙুলেই
প্রতিবাদে'র কবিতা লিখে বেশ নাম করেছে সে
মেয়েটি গুটিয়ে নিয়েছে মনহীন শরীর।

ভার্সিটি পেরিয়েও সে নেশা রয়েই গেলো
বরাবরের মতো... মহুলগন্ধী কবিতা'র নেশা।

ফুলশয্যা'র নিবিড় রাতে যার সাথে
পথ চলা আজীবনের
তাকে উপহার দেবে প্রিয় কবি'র কবিতা-সমগ্র
তার নিজের লেখা একটি পান্ডুলিপি আর
ছাদ'র টবে ফুটে ওঠা একটি কাঠগোলাপের কুঁড়ি
প্রথম পুরুষ প্রেম-স্পর্শের জন্য উদ্বেল...

ভদকা'র ঝঁঝালো গন্ধে দমবন্ধ মেয়ে'র
শরীর চ'ষে বেড়াচ্ছে ফ্লেভারড কনডোম
চোখ বন্ধ ক'রে যন্ত্রণাগুলো সইয়ে নিতে নিতে
মেয়েটি ফেরায় মুখ
বিবর্ণ পাতা যেভাবে ঝরে পড়া'র আগে
শাখাবন্ধের দিকে
কবিতা তার প্রথম প্রেম, শেষ ও।

ব্যাঙ্গমা যে ভাবে খোঁজ করে ব্যাঙ্গমীকে, আমি কি সেভাবেই আজীবন কবিতার খোঁজ করে গেলাম? এই প্রশ্ন যখন মধ্যরাতে আমাকে আকাশের তলায় দাঁড় করায় অগনিত নক্ষত্রপুঞ্জ, আলোকবর্ষ দূরের ঠিকানা বিহীন ছায়া বীথিকার দূরন্ত।সীমা পরিসীমা হীন জগতেরকাছে আমিকি তখন প্রেম প্রার্থনা করি?ভালোবাসতে কতটা পারি জানিনা, তবুও কোনও কারন ছাড়াই কবিতার প্রেমে হারিয়ে ফেলেছি আমার সখ, আহ্লাদ, খুশির অপার চর্যাপদ।

কবিতাই যেন আমার উত্তাপ।এই উত্তাপ প্রার্থনা বোধহয় কিছুটা চাতকের মেঘের কাছে জল প্রার্থনার মতন। লেলিহান আগুনের মতন, কখনও বা সেই অন্তহীন মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা শেকড়ের মতন যা ক্রমশই বিস্তারিত হয়েছে হৃদয়ে। মধুময় ওই প্রেম, ছন্দে ছন্দে শব্দে শব্দে, অনুভবের তীব্রতায়, ব্যর্থতার মলিনতায় একটি জীবনের পথ চলার আনন্দে উচ্চাবচ ক্রন্দন সুরে অথবা আঁকন বাঁকন পলাশ ফুলের পাহাড়তলির রাঙা ধুলোর আশ্র‍য়ে আমাকে আলড়িত করে, আমি খুঁজে বেড়াই প্রেম, কবিতাময় বৈচিত্রের অন্তরালে মরীচিকার স্তব্ধ বাতায়ন।

অনাবিল জলস্রোতে, সংগীতের লহরী রঙিন করে যায় নীরবতার দেয়াল।উড়ে বেড়ানো পাখির কলতানে, রৌদ্র ও জ্যোৎস্নার খেলায় আমি কি তবে বিষণ্ণতা খুঁজে বেড়াই?
খড়কুটোর মতন অভিমান,আমার অবুঝ নীড়ে বাসা বাঁধে। কখনও বা ফুলের পরাগে আমি আবিষ্কার করি সাতরাজ্যের বিস্ময়। আমাদের সাজানো ঠিকানায় আমি খুঁজে বেড়াই দু'কুলে প্লাবিত উচ্ছ্বাস, আমার কবিতার প্রতি অভিযাত্রা, মানুষ কে হৃদয়ে ধারণ করাই তো প্রেম, মানুষ কে ভালোবাসাই তো কবিতা। আমার মরমী প্রেমের একমাত্র ঠিকানা।



বিশ্বাস করুন বড্ড কঠিন সময়েও
আমি প্রেম করে যাচ্ছি।
লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে লাখ লাখ স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে দিনকে দিন।
আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি প্রেমিকদের,
তারা এই সময়ে ভাঙছে নিজেদের
সঙ্গে তাদের প্রেমকেও।
কিছু মানুষ খুঁজে পাচ্ছে না
কীভাবে ভালোবেসে থাকতে হয় বা থাকা যায়!
কিছু মানুষ এখনো এটা বুঝতে পারেনি
প্রেম আসলে কী!
নারী পুরুষের প্রেমটাই তো শুধুমাত্র প্রেম নয়!
আমাদের এই সময়ে যেগুলো আমরা করে যাচ্ছি সব মিলিয়েই তো প্রেম,
আসলে যে ব্যপারটা বলতে চাইছি
আমরা ভালো নেই।
এবং সেটাই স্বাভাবিক
যে সময় আমরা উপলব্ধি করছি সেটা ভালো সময় নয়!
কিন্তু আমাদের ভালো থাকতে হবে।
টিকে থাকতে হবে!
কথায় কথায় বহু কথা হয়,
আমি জানি, যে
মানুষের প্রেমের ক্ষেত্র সব মানুষদের নিয়ে
তারা কিছুক্ষেত্রে অসফল হলেও
অনেক দরজা খোলা
তাদের মন ভালো করার জন্য।
যাঁরা মানুষ ভালোবাসেন তাঁরা প্রেমিক,
তাঁরা টিকে থাকবেন, তাঁদের টিকতেই হবে।

অপরদিকে

"কবি ছাড়া জয় বৃথা,"- তবু সমাজ বাদ দিয়ে প্রেম আলাদা বাঁচতে পারে না!
বাঁচতে হলে প্রথমেই নিজেকে বাঁচাতে হবে! সেটা না করে আমরা যদি বার বার একই ভুল করি, তাহলে তো ভেঙে যাওয়া আশ্চর্যের নয়!
কঠিন সময় বলে আমরা সব কিছু কাটিয়ে দিচ্ছি সবটা সরিয়ে দিচ্ছি! আন্তরিকতা বলে যে বস্তুটি ছিল, সেটা লোপ পাচ্ছে দিন দিন, চেহারায় প্রেম নেই! চেনা মুখ গুলো বড্ড কালো।
যখন কোনো ভয়ঙ্কর ঝড় তছনছ করে দেয় সবটা তখন আমরা অসহায় বোধ করি, অথচ যাদের বিশ্বাস করেছিলাম তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় কতটা রক্তাক্ত হই সে খবর কি কেউ রাখে?
এখন মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমার পরিচিত এক কবি বলেছিলেন "আমাদের বন্ধু কেউ নয়! কেউ বেশি শত্রু কেউ কম" যদি এই ইকুয়েশন্ ধরে আমাদের বাঁচতে হয় তবে সেটা বাঁচা বলে আমার মনে হয় না!
যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন তাঁরাই তো পথ দেখাবেন বলে ধারনা জন্মেছিল, ভেঙে গেছে যদিও!

তবে দিনের শেষে কিছু মানুষ থাকেন যাদের আমি বা আমরা ভালোবাসি আসলেই তাঁরা বাধ্য করেন ভালোবাসতে!
তাঁরাই কবিতা, আমার প্রথম প্রেম। সব শেষে যেটা বলতে চাইলাম এতক্ষণ, আমাদের বাঁচতে হবে! তবেই গান ধরা যাবে দিনের শেষে এবং কলম ধরা যাবে যতবার রাত নামবে।

"কবিতা আমার প্রথম প্রেম"-এ বিষয়ে "তাপ উত্তাপ "পত্রিকার "২১শে বুলেটিন"এ কিছু লিখে পাঠাতে শ্রদ্ধেয় সম্পাদক অমল বন্দোপাধ‍্যায় বলেছেন। বুলেটিন শুরুর কিছু পরেই আমার একটা দীর্ঘ কবিতা আর এই সেদিন বরাকের ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে লেখাও ছাপিয়েছেন। আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কি করে শুরু করি।কবে থেকে যে কবিতাকে ভাল লাগতে শুরু,আর পরিণতিতে বর্তমানের এই প্রেম এর বিশ্লেষণে লিখতে গেলে অনেক কথা।ছোটবেলায় মা শোনাতো ছড়া।ভালো লাগত।এখনও মুখস্ত।সেই যে, "পাখি সব করে রব।", "সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি"। ভালো লাগলেও এ নিয়ে মাথা ঘামাইনি।প্রাইমারীতে স্কুলের অ‍্যানুয়াল ফাংশানে কবিতা আবৃত্তি করে প্রাইজ পেয়েছি।কবিতাটা মনে আছে,কবির নাম, এমনকি কবিতার নামও মনে নেই।গুগল খুলে কবিতার প্রথম লাইন দিয়ে সার্চ করে পেলাম।"শিক্ষকের মর্যাদা ",কবি কাদের নওয়াজ।লাইনটা হল," বাদশা আলমগীর কুমারে......"।
পরে হিরাপুরে এম সি টি গার্লস হাইস্কুলে পড়ার সময় ক্লাশ-বন্ধু শিবানীকে দেখতাম কবিতা লেখে।
নবম শ্রেনীতে তখন।অত‍্যন্ত লাজুক বলে অন‍্য কাউকে দেখাত না। টিফিন পিরিয়ডে বিশাল খেলার মাঠের এক কোণে বসে ও খাতা খুলে দেখাত।খুব ফর্সা ওর গায়েরং,স্কুলের ইউনির্ফম, হলুদ শাড়িতে সুন্দর লাগত ওকে,কিন্তু এসবে ও ছিল চরম উদাসীন।স্বভাব লাজুক।অবাক হয়ে যেতাম ওর কবিতা দেখে। কি করে লেখেও।পড়াতে তেমন চৌখসও নয়।তখনই বুঝেছিলাম এ এক অন‍্য প্রতিভা।

স্কুলের পাঠ‍্য কবিতা খুব মন দিয়ে পড়তাম। শিক্ষক -দিদিমনিদের বোঝানোর পরেও সহায়িকা অর্থাৎ মানে বই সারাংশ,ইংরেজি কবিতার সামারি আর শব্দের মানে ধরে ধরে বোঝার চেষ্টা করতাম পরীক্ষায় ভালো লেখার জন‍্য। আমার মনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,নজরুল ইসলাম আর কামিনী রায়ের কবিতা ছায়া ফেলেছিল।কিন্তু এক লাইনও লেখার চেষ্টা করিনি।
কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম‍্যাগাজিনে "জাতির জাগরনে নজরুল"নামে প্রবন্ধ লিখে সবার প্রশংসা পাই। কলেজের পর "সঞ্চয়িতা"হাতে আসে।
রেডিও,টিভিতে কবিতার আসর শোনা হয়না। এখন তো কতজন কবিতা লিখে মোবাইলে পোস্ট করছে, আবৃত্তির ভিডিও পোস্ট হচ্ছে।অন লাইনে লাইভ দেখার বলারও অনুরোধ। দেখি ভালোও লাগে।অনেকে লেখেও খুব ভাল।
বিয়ের পর ষ্টেশন ক্লাবে যাই নানা অনুষ্ঠানে। নাচ, গান,আবৃত্তি হয় সে সময়ে। কজনের বিশেষ অনুরোধ, আমি যেন কিছু বলি, বা নিজের লেখা কবিতা পাঠ করি।ততদিনে অনেকেই জেনে গেছে আমি লিখি।ডিভিসির মানে আমাদের নিজস্ব পত্রিকায় নিয়মিত লিখি ওরা পড়েছে।নিস্তার পাবো না এবার জেনেও বললাম আমার লেখা তো মুখস্ত নেই।যখন যা মনে হয় লিখি। হঠাৎ জানলা দিকে চোখ পড়তে দেখি গোল চাঁদ।পূর্ণিমা ছিল বোধ হয়।ব‍্যস,মনে এলো বেগম সুফিয়া কামালের "চাঁদ" কবিতাটি মাইকের সামনে বললাম সবটাই।খুব খুশী সবাই। তখন পাঞ্চেতে।পরদিন অফিসে খুব আলোচনা। পাঞ্চেতের অনেকেই নাকি শুনছিল সেদিন। কবিতার জন‍্যই মান বাঁচল। ওয়াল্টার ডি লা মারের"দ‍্য লিসনার",উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের "দ‍্য সলিটারী রীপার" লর্ড টেনিসনের "দ‍্য ব্রুক"
মনে দাগ কেটেছিল খুব।সলিটারী রীপারের খুব তাৎপর্য আমার কাছে।
কিন্তু,যেদিন কাজী সব‍্যসাচীর আবৃত্তি শুনলাম,সত‍্যিকারে কবিতার প্রেমে মজলাম।
এখনও বৃত্ত,ছন্দ, মাত্রা দিয়ে লেখা কবিতাই সুন্দর। ভাব প্রকাশে কবিতা সাবলিল। বর্তমানে ধারনা বদলেছে। আধুনিক কবিতা সরল সহজ ভাবে লেখাও হয়না,সাধারণ পাঠক আমরা বুঝতেও পারিনা অনেক সময়। কবি সুকান্ত,সুভাষ মুখোপাধ‍্যায় অন‍্য রকম লিখলেও বোধগম‍্য। কিছু কবি কি যে লেখেন আমি চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনা,এটা আমার অপারগতাই বলবো। তবু কবিতার প্রেমে পরেছি,হয়তে নিজের অজান্তেই ভালবেসেছি।গল্প,প্রবন্ধ,রম‍্যরচনা লিখতেই অভ‍্যস্ত ছিলাম।
সুদূর ব‍্যাঙালোরে,এখন কবিতাকে নিয়েই মত্ত। তার গঠন সৌন্দর্য উপভোগ করছি।বৃত্ত,ছন্দ,মাত্রা, নিয়ে ভাবনায় লেখায় সময় কাটে।
অমলদাকে ধন্যবাদ! তার কল‍্যানে প্রায় তিনমাস ধরে এই "করোনা লক ডাউন"এর সময়ে কত জনের অনুভব পড়ছি।ভালো থাকুন ওনি। সুস্থতা কামনা করি।

(আসানসোলের মালবিকা হাজরা লিখেছেন~ কবিতা আমার প্রথম প্রেম। প্রশ্ন ছিল তিনি যা লিখেছেন তা কি)

গতকাল ম্যাসেঞ্জারে অমলদার ম্যাসেজ --
শোন, কবিতা আমার প্রথম প্রেম~ বিষয়ক একটা সত্যকথন লিখে দে জলদি।
আমি বললাম--
বাকীগুলো কি মিথ্যাকথন ?
তার জবাবে এক অসাধারণ উত্তর দিলেন অমলদা--
আসলে আমরা কেউ আজ অব্দি সত্যি কথা বলতে পারিনি, সুনীল বসু রায়ের নাম শুনেছিস? তিনি একটা কথা প্রায় বলতেন~ যারা সত্য কথা বলে, তাদের লোকে পাগল বলে, আর যারা মিথ্যা কথা চিৎকার করে বলে, তারাই সমাজ কে ডোমিনেট করে... হাহাহা অতএব সাধু সাবধান! সত্য কথনের রাস্তায় নৈব নৈব চ ।
এইসব কথোপকথনের পর আমার অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের সেই কথা মনে পড়ল, যা আমার জপমন্ত্র - " কবিতায় কখনো মিথ্যে বলিনে , সেই আমার জীবনের সমস্ত গভীর সত্যের একমাত্র আশ্রয়স্থল।" কিন্তু কথাপ্রসঙ্গে ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মের কথাও মনে এল। উনি বলছেন- " সত্যভাষণ নয় বরং অনুভূতির যথাযথ জাগরণই কবিতার উদ্দেশ্য।"

যাইহোক 'কবিতার সাথে প্রেম' বললেই আমার 'পথের পাঁচালী'র সেই অনবদ্য দৃশ্যটি মনে পড়ে -
একটা মাটির দাওয়া। কেমন গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধে নেমে রাত্রিতে যাচ্ছে। একটু দূর থেকে কেউ যেন দেখছে। কেউ নেই অথচ কেউ আছে। এ দৃশ্য শুধু পটভূমি নয় , জীবন্ত সত্ত্বা।সেখানে ঝিঁঝিঁও অন্ধকারে এক প্রাণের স্পন্দন।
এই যে গল্পের শাসনের বাইরে ছড়িয়ে যাচ্ছে একধরণের কথন , রিয়ালিজমের চূড়ান্ত মুহূর্তে তাকে ভেতর থেকে অগোছালো করে দেওয়া ন্যাচারালিজমে , একেই আমার কবিতা মনে হয়।
এই জায়গা থেকেই আমার শুরু হয়েছিল কবিতার সাথে প্রেম আর আমি নিজেকে বারবার ঐ না থাকা অনুভবে মিশিয়েছি। তাই কবিতা শুধু আমার প্রথম প্রেম নয়, কবিতাই আমার সর্ব়শেষ এবং মধ্যবর্তী সমূহ প্রেম। বস্তুত কবিতার প্রতি নয়, প্রেম কবিতার শব্দের প্রতি।
আমিও ভেবেছি , লিখব সেই রহস্যময় কবিতা, যে কবিতা আমার অন্তরাত্মাকে আলোকিত করবে। গোপন অভিন্নতার চিহ্নগুলো প্রকাশ করব, যা ক্ষয় করবে বা অন্তত কমিয়ে দেবে শারীরিক জান্তবতা কিংবা সবসময় ক্রিয়াশীল থাকবে বিশুদ্ধতার অভ্যন্তরে প্রবেশের। কবিতার ভেতরে প্রবেশ মানে ধর্মজীবনে প্রবেশ। সীমা থেকে অসীমে প্রবেশ।
কবিতা তো বিনিময় , কবি ও পাঠকের মাঝে অনুভব সঞ্চারণের সেতু। " ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত" -এর মধ্যে যে মায়া কাজলের টান আর " ভাত দে হারামজাদা, নয়তো মানচিত্র চিবিয়ে খাব" -এর ভেতর যে খিদে , দুটোই কবিতার ভাষা হয়ে উঠেছে বৈপরিত্যে।
এখানে কবি মহাদেব সাহা'র কিছু কথা লেখার লোভ সামলাতে পারছি না,
"কবিতা ছাড়া আর কিছুই এমন আচ্ছন্ন করতে পারেনি আমাকে, পারেনি ভাসিয়ে নিতে। বুঝেছি নশ্বর পৃথিবীতে যদি অমরতার স্পর্শ বলে কোথাও কিছু থাকে তা এই কবিতায়। কবিতা স্বয়ম্ভু - হয়তো বা অবিনশ্বরও। আমি যা কিছু পাব কবিতার কাছ থেকে , যা হারাবো কবিতার জন্যই। আমি মনে করি মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ বোধ ও অভিজ্ঞতার নির্যাস এই কবিতা।"
কবি যেখানে থামেন সেখান থেকে শুরু হয় পাঠকের নিঃশব্দ অন্তর্লীন পথচলা।
পাঠক আমি মুগ্ধতায় চেয়ে থাকি সেই প্রিয় কবিটির চোখে।

তাপ উত্তাপ সম্পাদকের প্রতি [ ৯০ দিনে বিশাল প্রাপ্তি]
কুমারেশ তেওয়ারী

( কুমারেশ তেওয়ারীর অভিযোগ তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিন প্রসঙ্গে। আমরা আনন্দিত। তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনের ৯০ দিনে তার পত্রটি
আমাদের অক্সিজেন দিল)

লক ডাউন পর্বে আপনি ২১ শে-র বুলেটিন নামে যে সাহিত্য চর্চাটি শুরু করেছিলেন তা অনেকটা পথ পেরিয়ে নিজস্বতায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। এই ধরনের কাজ সম্ভবত আপনিই প্রথম করলেন। কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের মন ও মেধাকে সচল রাখলেন এই লকডাউন পর্বে তাদের চিন্তা-ভাবনাকে লিখিত আকারে প্রকাশের মাধ্যমে। এই পর্বে আমরা পাঠকেরা কিছু অসামান্য মানুষের অসামান্য লেখার সঙ্গে পরিচিত হলাম। কবিতা হোক গল্প হোক কি নিখাদ ভাবনা-চিন্তার ফসলরূপী কোনো লেখা, আমরা পরিচিত হলাম সেসব লেখা ও তার লেখকের সঙ্গে। এই সব লেখা তাপ উত্তাপ কে এই অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল। এ পর্যন্ত সব ঠিক। তবে আমার অভিযোগ অন্যখানে— অসম্ভব ভালো কিছু লেখার সঙ্গে এই পর্বে আমরা পেলাম কিছু অত্যন্ত নিম্নমানের লেখাও। যা তাপ উত্তাপের মানের সঙ্গে কিছুতেই যায় না। হয়তো এটাই কম্প্রোমাইজ। একজন পাঠক হিসেবে এ ব্যাপারে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তাপ উত্তাপের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো।
কুমারেশ তেওয়ারী।।

 

প্রথমে জানাই তোমাকে তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন। তোমার অভিযোগ পত্রের ছত্রে ছত্রে আমরা পেলাম, সত্যকথনের দু:সাহসিক চাবুক। এবারে বলি, শুধু মাত্র তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে নয় দীর্ঘদিন যাবৎ পত্রিকা প্রকাশ করে আজ ২০২০র মাঝামাঝি এসে পরিস্কার বুঝতে পারছি কম্পোম্রাইজ ছাড়া বর্তমানে কোন কিছু ধারাবাহিকভাবে করা সম্ভবপর নয়। কারণ শিল্প সাহিত্যে, বা সৃস্টিশীল দুনিয়াতে বিনোদন, + আত্মপ্রকাশ এমনভাবে ঢুকে পড়েছে, যেমন তোমাকে বলি, তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে যখন বিনোদন মূলক কিছু পোস্ট করেছি, দেখেছি লাইক ও কমেন্টের ছড়াছড়ি। কিন্তু ভাই কুমারেশ আমরা অবাক হয়েছি, সিরিয়াস এবং গবেষণা মূলক লেখায় প্রায় দ্বিগুণ লাইক কমেন্ট এসেছে। যার ফলস্বরূপ তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনের জন্মলগ্ন থেকে বিশ্বের বঙ্গ সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সহাস্যে এগিয়ে এসেছেন তাদের লেখা নিয়ে।
তোমার গঠনমূলক সমালোচনা আমাদের পাথেয়, আগামী দিনে। ভালো থেকো, মাস্ক পড়ো, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখো।
~ অমল বন্দোপাধ্যায়

কুলটির সাহিত্য প্রেমী, সুব্রত সিনহা কবিতাকে অনায়াসে সখী বলতে পারেন, ছুটে যেতে পারেন কবিতার জন্য কয়েক ক্রোশ,  তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে তার অনুভব

(লন্ডনের বিঁভূই থেকে মাতৃভাষার প্রতি কত ভালোবাসা থাকলে, এরকম লেখা যায়। বিভাস সাহা বিদেশে থাকেন, তার মনের পরিচয় তাপ উত্তাপের পাতায় – সম্পাদক।)

লকডাউন
বিভাস সাহা

জানলার রেলিঙে একটা নীলকণ্ঠ পাখি,
তাকে দোল দিতে উড়ে আসে
পদ্মদিঘির পার থেকে শেষ বসন্তের হাওয়া।
আমার ঠোঁট পাপড়ির মত খুলে যায়, কাঁপে

শীত করছিল বলে সাদা কাপড়ে পাদুটো ঢাকতে চেয়েছিলাম
কারা এসে মুখ অবধি টেনে দিল,
বলল, ‘লকডাউন। এখন তাঁবুর বাইরে নয়।‘
হাতে গায়ে যত সরু টিউব লাগানো ছিল, তারা এখন
নদী শাখানদী হয়ে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এই গাঙ্গেয় উপত্যকায় কী নেই !
আহ্লাদি পলাশ আছে, ব্যাঙের আষাঢ় আছে,
সোঁদা মাটির গন্ধে ছটফট করা হাঁস আছে,
শুধু একটা তাতা থৈ থৈ আকাশ পেলে বাকি জীবনটা
এই তাঁবুর মধ্যেই কাটিয়ে দিতাম।

দিদি
নিম গাছের ডাল বেয়ে সন্ধে ঝুপ করে নেমে এলে আমরা পাঁচ ভাই বোনের চারজন হ্যারিকেনের চারপাশে গোল হয়ে পড়তে বসতাম। শীতের চাদর গলার কাছে বিদ্যাসাগরের মতো গিঁট দিয়ে বাঁধা। চাদরের তলা দিয়ে হাত বের করে আমার আঙুল তখন মুঘল সৈনিকদের পিছু পিছু হাঁটছে। বুবুনের স্লেটে খ-এর গায়ে ঢুলে পড়ছে ক। ছোট বোনের আঙুল থেকে চুঁইয়ে পড়ছে সুলেখা কালি। আর মেজ বোন গোটা গোটা অক্ষরে লিখছে, শ্রীচরণেষু বাবা।

মা বসে থাকে খোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার উঠোনের দিকে তাকিয়ে। বুবুন জিগ্যেস করে, মা বাবা কবে আসবে। মা বলে, আসবে, চোতমাস গেলে-- বোধহয়। বুবুন জানে না চৈত্রমাস আর কত রাত্রি দূরে।

আজও মা উনুন ধরায় নি। আজও আমরা খাবো দুপুরের ঠান্ডা ভাত আর এক বাটি পাঁকাল মাছের আঁশটে ঝোল। পড়া শেষ হলে ওইখানে মা বিছিয়ে দেয় দুটো তোষক, আর ঢালাও একটা লেপ, লাল রঙের – গত বছর বাবা বানিয়েছিল। সেই থেকে শীত এলেই মেঘের মতো উড়ন্ত কিছু আদর আকাশ থেকে তাপ নামিয়ে আনে। তার ভিতর আমরা পাঁচ ভাইবোন ঘুমের মধ্যে লুকোচুরি খেলি। একদিন শীত ফুরোয়, ক্যালেন্ডার থেকে ফাল্গুনের পাতা ছিঁড়ে ফেলে দিদি।

একদিন মাঝরাতে ফিরে আসে বাবা। আলতো টোকা দেয় দরজায়, তারপর ডাকে, বুড়ি মা জেগে আছিস? আমার আজন্ম বোবা দিদি দিঘির অতল থেকে ঘাই মেরে ওঠে। দরজার খিল খুলে সে দৌড়াতে থাকে, তার সমস্ত না বলা কথা শনশন হাওয়ায় ওড়ে, আর বাবা দুহাত বাড়িয়ে দূরত্বের দিগন্তে দাঁড়িয়ে। তার সামান্য রোজগার আর অফুরন্ত ভালোবাসার মধ্যে একটা অপেক্ষার মাঠ, একটা দুধে কলমির উঠুন, একটা কেঁদে ওঠা অন্ধকার।

এক সাম্রাজ্যে বাস করতে করতে হঠাৎ এক গল্প বোনা হয়ে যায়!
ফাঁকা ইনবক্সে পড়ে থাকে কিছু বোকামি,
আসছি আসছি বা আসছে না করে যখন হঠাৎ উদয়-
ভুলে যাই সে সাম্রাজ্যের আমি একা প্রহরী।

কিছুটা টহল দিয়েই ক্লান্ত হয়ে যাই অপেক্ষারত।
গল্পে যখন মত্ত সে, আমি দেখি তার উপস্থিতি।
ছুঁয়ে দেখতে চাই, আরও পেতে চাই সে ছোঁয়া।
কিন্তু উড়ে যায় সে দূরে কোথাও।

আমি দেখি হাজার হাজার দূরত্বের পরে একঝাঁক প্রজাপতি।
জড়িয়ে ধরে আদর করে আমাকে তারা।
আমার অবস্থিতির বার্তা পৌঁছে যায় আবার তাকে ছোঁয়ার রাস্তায়।
কুয়াশা ঘন পথ ঢেকে যায় মেঘের আস্তরণে।
তখনই সারা শরীর ঘিরে ধরে উষ্ণতায়।
এক নেশা যেন জাঁকিয়ে বসে সম্পূর্ণভাবে।

সেই খোলা ইনবক্স পাহারা দেয় আজও সে প্রহরী,
শুধু বার্তা এসে থাকুক কখনও নীরবে একটা,
শুধুই তার নামে, 'কেমন আছো'..
ধরে নেব স্বর্গসুখ খুব বেশি দূরে নয়,
আর প্রজাপতি এঁকে নিক আমাকে তাদের মতন করে,
এ যেন আমারই সাম্রাজ্যের এক প্রতিচ্ছবি।।

"সাদা, বাদামি, কালো, মিশকালো দু'পেয়েগুলোর অবস্থা দেখেছ - ভয়ে ঘরের ভিতরে কেমন সেঁধিয়ে গেছে!"

"হবেই তো - এখন ভাইরাসে, আর ভবিষ্যতে অনাহারে মৃত্যুভয়।"

"কেন! কথায় কথায় হাজারে, লাখে ভাইরাল ভিডিওতে লাইক দেওয়া সর্বশ্রেষ্ঠ জীব, এত বড় ভাইরাল ইভেন্টে আজ আর লাইক দিচ্ছে না? এতদিন কম্পুউটার ভাইরাস নিয়ে এত বুলি কপচেছে! এবার আসল ভাইরাসের সামনে পড়ে দ্যাখ কেমন লাগে!"

"উন্নতির নামে বাতাসে বিষ মিশিয়েছে, জলে বিষাক্ত তেল ঢেলেছে, মাটিতে নিষিদ্ধ রাসায়নিক ছড়িয়েছে - তার ফল ভোগ করতে হবেনা! আসলে দু'পেয়েগুলো খুব স্বার্থপর - নিজেদের ছাড়া কিছু বোঝে না। মিসাইলের সফল উৎক্ষেপণ দেখে কেমন হাততালি দ্যায় - দেখনি? কোনদিন ভেবেছে, যে সমুদ্রে মিসাইলটা পড়ে, সেখানকার প্রানীগুলোর কি হয়? মহাকাশে যান পাঠানো দেখে কি উত্তেজনা! কখনো ভেবেছে, পরিবেশের কি ক্ষতি হচ্ছে এর ফলে? ইচ্ছে হল, বিমানে করে গিয়ে বোমা ফেলে এলাম। বোমায় ক'টা মানুষ মরল তার হিসেব করে, কিন্তু গাছ আর অন্য প্রানীদের কথা কখনো ভেবেছে ওরা?"

"ঠিক বলেছ! এই যে আমাজনের জঙ্গলে আগুন লেগে কত গাছপালা ধ্বংস হোল, কত অসহায় জন্তুর মৃত্যু হোল, তাদের জন্য কখনো দু'পেয়েদের মিছিলে হাঁটতে দেখেছ? দু'ফোঁটা চোখের জল ফেলতে দেখেছ? ওদের জন্য বরাদ্দ শুধু খবরের কাগজের দু-একটা লাইন, কিছু ফুটেজ আর ড্রয়িংরুমে বসে বিশেষজ্ঞের মতামত প্রদান। নিজেরা বাঁচলেই হোল, অন্যরা যাকগে মরুকগে, আর কি!"

"নিজেদের শিক্ষিত আর উন্নত বলে দাবি করা দু'পেয়েগুলোর সব আসলে ফক্কা! গঙ্গাকে দূষণমুক্ত আর পরিষ্কার রাখার জন্য, কত হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে বল, করতে পেরেছে? এত আইন-কানুন, নিয়মের বেড়াজাল দিয়েও রাজধানীর বাতাসকে কি শুদ্ধ করতে পেরেছে - পারেনি! কিন্তু এখন দেখ, ফ্রিতে সব নিজে-নিজেই কেমন পরিষ্কার আর দূষণ মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমাকে ওদের ধন্যবাদ দেওয়া উচিত।"

"এদের আর শিক্ষিত বলনা - এরা সব কলঙ্ক! বলা হয়েছে, শুধু বাড়িতে থাকতে - মানছে সেকথা? তা নিয়েও কত হই-হট্টগোল দেখছ না! সবকিছুতেই এদের শুধু গরম – অহংকারের গরম, উন্নতির গরম, অস্ত্রশস্ত্রের গরম আর এখন সঙ্গে জুড়েছে ধর্মের গরম। আমাদের বেশি কিছু করতে হবে না বুঝলে, এরা নিজেরা মারামারি করেই মরবে।"

"ছাড়ো এসব দু'পেয়েদের কথা। আমি কিন্তু কম্পনবার্তায় অনেক অনেক ধন্যবাদ পাচ্ছি।"

"কম্পনবার্তা?"

"দু'পেয়েরা মোবাইল নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, মেসেজ পাঠায় দেখনি? ওদের মত পৃথিবীর অন্যরা, যেমন জল, হাওয়া, মাটি, জীব-জন্তু, গাছপালা সবাই, এই কম্পনবার্তায় বার্তা পাঠায়। এরা সবাই খুশির কম্পনের সাহায্যে, 'দু'পেয়েদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে' বলে আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। বলছে, এরপর যদি দু'পেয়েগুলো সতর্ক হয়।"

"এর আগেও কিন্তু সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল - দু'পেয়েগুলো পাত্তা দেয়নি বুঝলে! সুনামি, আয়লা, ভূমিকম্প, ছোটখাটো কিছু ভাইরাস পাঠিয়ে স্থানীয় ভাবে আমরা ওদের সাবধান করেছিলাম, কিন্তু সবই অরণ্যে রোদন ! এবার তাই সার্বিক ভাবে পৃথিবীর সব দু'পেয়েকে একসঙ্গে সতর্কবার্তা দেওয়া হল। উন্নত দেশগুলোর দু'পেয়েগুলো ভেবেছিল, আমরা উন্নত, আমাদের কেউ ছুঁতে পারবে না। হাল্কা ছুঁয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি - আমরা কি করতে পারি।'

"আশাকরি এবার দু'পেয়েগুলো সতর্ক হবে।"

"সতর্ক হলে ভালো, নাহলে আমরাও কিন্তু বসে নেই। তুমিতো আমাদের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছ। দু'পেয়েরা জানেনা, তোমার থেকেও শক্তিশালী একজন, গোপনে নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে। তার এখনো নামকরণ হয়নি। এরপরেও যদি দু'পেয়েরা নিজেদের শুধরে না নেয়,তাহলে বুঝবে ওদের ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের নতুন বন্ধু তখন ঝাঁপিয়ে পড়বে প্রতিশোধ নিতে। আমরা আর নীরবে অত্যাচার মেনে নেবনা।"

"যাই হোক, অনেক আলোচনা হল। তুমিতো এখন বিশ্রামে আছ - ভালো থেকো নিপা।"

"তোমাকে তো আর কিছুদিন এখানে থাকতে হবে। তুমিও সাবধানে থেকো। টেক কেয়ার করোনা।"

এ এক অসহনীয় যন্ত্রনা
বলছে সবাই এর জন্য দায়ী করোনা।
এর বিহিত কি আজ ও কি কেউ জানলনা
বলছে সবাই ঘরে থাকো বেরিও না।
হাত পা সব অসাড় হলো এখন উপায় কি
রাস্তা বন্ধ বন্ধ দোকান বন্ধ কথা বলা।
এর চেয়ে তো ভাল ছিল নিরুদ্দেশে চলা
প্রান আমাদের ওষ্টাগত ক‍রোনার ভয়েতে
যারা ক‍রতো শাসন ক‍রোনা এখন করছে তাদের শাসন।
আর কতদিন থাকবে তুমি এই মাটিতে বসে
বড়াই তুমি যতই কর মরতে তোমায় হবেই হবে।

আর কতো ঘুমোবে উঠে পড়ো মা। চাদর সরিয়ে শিশু সমানে যে ডাকে। নিস্তব্ধ নিঃশ্চুপ মা, শুনতে না পায় ঘুমের মধ্যে সে যে গেছে চলে । করোনা লকডাউন আমফান, খাবারে টান , যে টুকু মজুত ছিলো শিশুর মুখে তুলে অভূক্ত যুবতী পেট ভরায় জলে ।কতো দিন , আর কতো দিন । একদিন চলে গেলো না ফেরার দেশে । শিশুটি অনাথ হলো। তার কি হবে ? কে নেবে তার দায় দায়িত্ব । হায় সরকার , লকডাউন যদি করার ছিলো পরিযায়ী শ্রমিক দের আগে আনোনি কেন ? তাহলে তো এতো গুলো মানুষের প্রান যেতো না । নোট বন্দির মতো আমাদের জীবন গুলো বন্দি হয়ে গেলো। কথাতেই আছে ভাবিয়া করিও কাজ , করিয়া ভাবিও না । কুমিরের কান্না আর ভাল্লাগে না ।

এমন ধারালো জোয়ার আর
ঘুটঘুটে কালচে গ্রহণ,
সত্যছায়ায় দেখি আগামীর মরণ,
মহাপ্রলয়ের বারুদ ঝাঁঝরা করে দেয় ফুসফুস ;
তবু গান্ধারী বেশে জাগতিক বশে জড় হয়ে আছি বেশ অনেকক্ষণ!
অশীতিপর নিথর দেহের নগ্ন ঘ্রাণে,
একতা খুঁজি এখনও সজীব প্রাণে;
নিশুতি রাতের নিশ্চিত ঘুম আজ বন্ধক দেওয়া ওই মহাকাশে!
জাগুক কটা ধমনী না হয়,
উদ্ভ্রান্ত পৃথিবী দেখুক বিস্ময়!

গত বছর দুর্গাপূজার দিন কয়েক আগের কথা ।
ঘটনাচক্রে অটো থেকে নামতেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল মানুদার সঙ্গে। পারতপক্ষে ওনাকে এড়িয়ে যেতে অন্য রাস্তায় যাতায়ত করি, আজ কিন্তু হলোনা। কথায় আছেনা,
" কপালের লিখন না যায় খন্ডন।"

এতো কথা কেন বলছি, তার ধরতাইটা একটু প্রয়োজন। মানুবাবুকে যারা এত দিনে চিনে ফেলেছেন তাদের বলছিনা। তবে যারা নতুন তাদের পরিচয়টা করিয়ে দিই।

মানুবাবু, মানে শ্রীযুক্ত মানবেন্দ্র গাঙ্গুলি, রেলে বড় অফিসার ছিলেন, রিটায়ার্ড করে আমাদের পাশের পাড়ায় বাড়ি করেছেন। টাকা পয়সা প্রচুর কিন্তু মনে সুখ নেই। লোকে তার গুনের ঠিকমত মুল্য দেয়না , এটাই তার দুঃখ। গান বাজনা করেন, লোকে ঠিক মত কদর করেনা। আমরা একটু আধটু লেখা লেখি করি, অনেকেই সাহিত্য সভায় ডাকেন সম্বর্ধনা দেন , আর তিনি ভোগেন হীনমন্যতায়।
শুনেছি নিজের খরচে একটি ছোট গল্পের বইও ছাপিয়েছেন। খুব একটা খারাপ হয়নি।
ওনার মনটাও একটু সন্দেহবাতিক। তাই স্ত্রীর সাথে তেমন বনিবনা নেই। একমাত্র ছেলে, থাকে আমেরিকায়। মাঝে মাঝে স্ত্রীর সাথে কথাবার্তা বন্ধ হলে দোকান থেকে খাবার কিনে খান।

যাক গে সে সব। আজ কি হলো, সেটাই বরং বলি। আমাকে দেখেই----
----- আরে, লালুবাবু, তোমার কথাই ভাবছিলাম। কোথায় থাকো বলতো আজকাল।
মনে মনে বলি, সেরেছে, কি কুক্ষনে এই অটোটাতে ফিরলাম। কেন রে বাপু আধ ঘন্টা দেরি হলেই মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যেতো? এখন বোঝো ঠ্যালা। হাসি মুখ করে বললাম----
----- আরে, মানুদা যে, কতদিন পর দেখা হলো বলুন তো!
---- সেই কথাই তো বলছি। শুনলাম তুমি নাকি ইউরোপ বেড়াতে গেছিলে। আমাকে তো ছেলে প্রতিদিন ফোন করে যাচ্ছে, কিন্তু আমার ওই সব জায়গায় মন বসেনা।
---- হ্যাঁ মানুদা। গিয়েছিলাম, সে তো গত মাসেই ফিরে এসেছি। কেমন আছেন?
--- আমার আবার থাকা। দেখতেই পাচ্ছো, সামনে পুজো, দু তিন জায়গায় গান গাওয়ার জন্য ধরেছে। এক ঘন্টা ধরে গাইতে হবে। এই বয়সে এত পরিশ্রম কি পোষায়?
---- ওদের না বলে দেন। বলুন, দু তিন টের বেশী গাইবোনা।
-- সে কি আর বলিনি ভেবেছো। তবে পাড়ার ব্যাপার তো। মুখের ওপর না করা যাচ্ছেনা।

মনে পড়ে গেল গত পুজোর কথা। আমি সে বছর পুজোর সেক্রেটারি ছিলাম। আমাকে একদিন ধরে বসলো। পুজোতে পাড়ার অনুষ্ঠানে গান গাইবে। এদিকে পাড়ার বিভিন্ন লোকের অনুরোধে কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মানুবাবুকে কিছুতেই স্টেজে তোলা যাবেনা। কিন্তু আমার পক্ষে না বলা সম্ভব হয়নি। বললাম উদ্বোধনী সঙ্গীত টা আপনিই গাইবেন। ব্যস হয়ে গেল। উদ্বোধনীর নাম করে গেয়েই চলে গেয়েই চলে। শেষে সঞ্চালক কে মাইকে আ্যনাউন্স করতে হল, এই শেষ গান, এর পর শুরু করবো নাটকের অনুষ্ঠান। তো মানুবাবু তো চটে লাল। তাকে জোর করে স্টেজ থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর কোনদিন পাড়ার অনুষ্ঠানে গাইবেন না, ইত্যাদি ইত্যাদি।

একথা সেকথার পর ---
অবশেষে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরুলো। মানুদা সাইড ব্যাগ থেকে একটি বই বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন এই শেষ কপি। এইটি তোমার জন্য রেখেছিলাম, আমার লেখা। পড়ে দেখো, তারপর বলবে কেমন লাগলো। বইটা হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখলাম। মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল -- বাঃ, প্রচ্ছদ টা খুব সুন্দর হয়েছে।
মানুদা স্বভাব সিদ্ধ চিবিয়ে চিবিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বললেন, গল্প গুলো পড়ে দেখবে। সবাই খুব নাম করছে। আসলে ব্যাপারটা কি জানো তো! লিট্ল ম্যাগাজিনে দু চার বার লেখেছি। একদিন ছেলেরা বললো," বাবা ওইসব ফালতু লিট্ল ম্যাগাজিনে লেখা পাঠাবেনা, ওসব কেউ পড়েনা, নর্দমায় পড়ে থাকে। তার চেয়ে বরং নিজের নামে বই বের করো, আমরা তোমার সুযোগ্য সন্তান, ডলারে ইনকাম করি। যা খরচ হয় আমরা দেবো"। আমিও রাজি হয়ে গেলাম, তারপর বই বের করেছি। যাকে বলছি সেই নিচ্ছে, আবার বললে বিশ্বাস করবেনা, দু একজন ফোনেও জিজ্ঞেস করেছে, বইটা কি ভাবে পাওয়া যাবে। সামনের বইমেলায় ভাবছি একটা স্টল দেবো। অনেকেই বলছে, এটা বেস্ট সেলার হয়ে যাবে, লেখকের অটোগ্রাফ দেওয়া বই।তা হাজার খানেক বিক্রি হবেই, কি বলো?
---- দেখুন চেষ্টা করে। আপনি তো ভীষন পপুলার, কেউ না করবেনা।
---- হেঁ হেঁ হেঁ, যা বলেছো। নাও বই টা ধরো।

অগত্যা হাত পেতে বইটা নিতেই হলো। সকাল সকাল একটা বই গিফট হিসেবে পেতে কার না ভালো লাগে। ভেতরে যাই থাক, "বই" তো!!
মুখে বললাম------ ঠিক আছে চলি, বইয়ের গল্পগুলো পড়ে জানাবো, কেমন লাগলো।

মানুদা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, -- এই বইটা একশ পঞ্চাশ টাকা দাম রেখেছি, কিন্তু তোমার জন্য একশ দিলেই চলবে। এই বলে হাতটি বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে।
আমি মুহ্যমান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনেকের সাথেই এইরকম ঘটনার গল্প আমার শোনা আছে। কিন্তু ভেবেছিলাম আমাকে একটু অন্য চোখে দেখেন। যাই হোক আর আমাকে আর এড়িয়ে এড়িয়ে চলার দরকার নেই। পকেট থেকে একটি একশ টাকার নোট বের করে মানুদার হাতে ধরিয়ে দিয়ে যেন মুক্তির স্বাদ পেলাম।

মনে হলো বুকের ভেতর থেকে একটা দমকা বাতাস, গানের সুর হয়ে শরতের নীল আকাশে ভাসতে ভাসতে আমাকেও ভাসিয়ে নিয়ে চললো --- ---" এই আকাশে আমার মুক্তি, আলোয় আলোময়,,,,,।"

বই পড়া নিয়ে কোনো কিছু লিখতে বললেই আমি খুব খুশি হয়ে যাই | অমল দা জিজ্ঞেস করেছেন লকডাউন-এ কি উপন্যাস পড়লাম |

আমি সবসময়ই কিছু না কিছু বই পড়তে থাকি, তাই এই সময় আলাদা করে কিছু পড়েছি, সে কথা বললে ভুল বলা হবে | আর আমার একটা বদভ্যাস আছে, আমি একসাথে দুটো তিনটে বই নিয়ে পড়তে থাকি খামচে খামচে | তাই শেষ যে তিনটে বই নিয়ে আমি খামচে খামচে পড়ছি তা হলো.. এক : শেখর মুখোপাধ্যায় এর "গজপতি নিবাস রহস্য ", দুই :ঋতুপর্ণ ঘোষ এর "ফার্স্ট পারসন " আর তিন : নলিনী দাশ এর "গোয়েন্দা গন্ডালু "|

"গজপতি নিবাস রহস্য " হলো দুই বন্ধু গোয়েন্দা দীপেন ঠাকুর আর বিজিত রায় এর গল্প | চমৎকার টানটান একটি রহস্য গল্প | যদিও আমার খামচে খামচে বই পড়া অভ্যেস, সেই আমিই প্রায় এক নিঃশ্বাস এ পড়ে ফেলেছি পুরো বইটা | ঋতুপর্ণ ঘোষ এর "ফার্স্ট পারসন " নিয়ে আর আমি কি বলবো | অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন.. একটি সংবাদ পত্রে প্রতি রবিবার ঋতুপর্ণ নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন | অত্যন্ত ঝরঝরে ভাষায় লেখা সংকলনটি পড়তে পড়তে মনে হয় সত্যি ঋতুপর্ণ কি অসম্ভব এক প্যাশনেট মানুষ ছিলেন | বিভিন্ন বিষয়ে কি অগাধ জ্ঞান আর কি অবলীলায় সমস্ত কিছু লিখে যাওয়া |

গোয়েন্দা গন্ডালু

এছাড়াও যে বইটি আমি ভীষণ ভালোবাসা নিয়ে পড়ছি, তা হলো "গোয়েন্দা গন্ডালু "| খুব ছোটো থেকে পড়ে আসছি এই লেখা | প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী সন্দেশ-এ এদের নিয়ে লেখা বেরোতো | তখন সন্দেশ এ সম্পাদক ছিলেন সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার আর নলিনী দাশ | সত্যজিতের "প্রফেসর শঙ্কু ", লীলা মজুমদার এর "গুপী পানু " আর নলিনী দাশ এর "গোয়েন্দা গন্ডালু "গোগ্রাসে গিলতাম | মালু, বুলু, কালু, টুলু এই চারজন অর্থাৎ এক গন্ডা লু কে নিয়ে বিভিন্ন ছোটদের গোয়েন্দা গল্প | পড়তে পড়তে ছোটবেলায় নিজেও তাদের একজন হয়ে যেতাম | তাই যখন "নিউ স্ক্রিপ্ট "থেকে সংকলন বেরোলো তিনটি খন্ডে, তখন আর সে বইগুলো সংগ্রহ করতে দুবার ভাবিনি |
তবে এই মুহূর্তে যদি বলেন কি পড়তে ইচ্ছে করছে, এই বৃষ্টির দিনে? তাহলে হাতটা কেবল এগিয়ে যাচ্ছে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় এর উপন্যাস এর দিকে | এই ইনি একজন, আমার অসম্ভব প্রিয় লেখক | জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয় ওনাকে সঙ্গে নিয়ে চলি | কত যে প্রিয় লেখক আছেন এবং আশা রাখছি পরবর্তী জীবনে আরো নতুন নতুন অনেক প্রিয় লেখক আসবেন এবং আরো অনেক ভালো ভালো বই পড়বো ||

আমি যখন বসে এই লেখাটি লিখছি, তখনও আমি জানি না ভারতবর্ষে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা সারা বিশ্বের কাছে পঞ্চম থেকে চতুর্থ স্থানে পৌঁছে গেল কি না। যদিও তা আশ্চর্যের কিছু নয়। অবশ্য এই ব্যাপারে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় কোন সরকারের‌ই কোন মাথাব্যথা আছে বলে সন্দেহ হচ্ছে চিকিৎসা-ব্যবস্থা আর সাধারণ মানুষের দুরবস্থা দেখে শুনে।
পরিযায়ী শ্রমিক এবং আমফানে বিধ্বস্ত এলাকার কথা প্রত্যেকেই কম বেশি আমরা জেনেছি। অনেকেই সাহায্য করছেন সেক্ষেত্রে।অবশ্য‌ই তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু এসব কিছুর মধ্যেই অন্য একটি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে যা ,বাইরে থেকে টাকা পয়সা ত্রাণ ইত্যাদি জোগান দিয়ে মিটবে না।আর সেটি হলো শিক্ষাব্যবস্থা।লকডাউনের মধ্যে সমস্ত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ। তাই ইউনিভার্সিটি গুলো ছাত্র-ছাত্রীদের পঠন-পাঠন নিয়ে বেশ চিন্তিত(অন্তত কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী জন্য তো বটেই)।তাই তারা বিকল্প হিসেবে অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।দাবি করেছিল অনলাইনে পরীক্ষাও হবে।অথবা ঐ অনলাইন ক্লাসের ভিত্তিতেই হবে অফলাইন পরীক্ষা। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণ, যাতায়াত অসুবিধা এবং স্মার্টফোন বা ইন্টারনেটের অভাবে পঠন-পাঠনে অসুবিধা যত‌ই হোক, পরীক্ষা তো হবেই।
ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ বড়সড় একটি অংশ যদিও প্রতিবাদ করে চলেছে এর বিরুদ্ধে নিজেদের মতো করে। কিন্তু সেজন্য তাদের বলা হয়েছে, তারা নাকি ফাঁকিবাজ, পড়াশোনা করতে ইচ্ছে করে না তাদের, তাই অজুহাত খুঁজছে পরীক্ষা না দেওয়ার।সত্যিই কি তাই?নাকি সেমিস্টারের ফি-টা বন্ধ হয়ে গেলে একটা বিশাল অঙ্কের টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে এই ব্যবসা থুড়ি শিক্ষাকেন্দ্রের সেটাই আসল সমস্যা? তাতে স্টুডেন্টদের জীবন গেলে যাক।
একটা ছেলে বা মেয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করে একটা স্বপ্ন নিয়ে। কিছু জানবে, কিছু শিখবে, নিজের যোগ্যতায় উপার্জন করবে এই ভরসা নিয়ে এসে দেখতে পায়,তার স্বপ্ন হাজার হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে কলেজের গেটে।তবুও যদি এই "দুষ্টু-দামাল ছেলেদের" তোলাবাজি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হতে পারলো, সেখানে শুরু হয়ে যায় শিক্ষার নামে প্রহসন। পরীক্ষা ঘোষণা হয়,অ্যাডমিট আসে না।অ্যাডমিট আসে তো প্রশ্নপত্রে ভুল। পরীক্ষা শেষ হয় তো রেজাল্ট বেরোয় না।এতো কিছুর পরেও চাকরি আদৌ পাবে কি না সে বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো।যদি রাজ্যে কাজ থাকতো তাহলে "পরিযায়ী শ্রমিক" কথাটার উদ্ভব ই হতো না।
আসলে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা যায়।তার কারন এরা বেঁচে থাকলেই এরা কাজ চাইবে,যা দেওয়ার ক্ষমতা এ রাজ্যের নেই।এরা শিক্ষিত তাই বোধশক্তি আছে,তাই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে ভবিষ্যতে। অসুবিধা নেই এরা মরলে, কারন মৃত মানুষেরা এ-দেশে ভোট দিব্যি দিতে পারে (কিভাবে পারে সেটা সবাই জানেন তাই বিস্তারিত বলছি না) কিন্তু জ্যান্ত মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার দায় কারোরই নেই।দেখা যাক আগামী দিনে "দেশের ভবিষ্যৎ"-এর ভবিষ্যত কিভাবে নির্ধারিত হয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

সময়টা ২০২০ সালের জানুয়ারী/ফেব্রুয়ারী মাস।যখন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য "করোনা" ভাইরাসের দাপটে তামাম বিশ্ব মৃত্যু ভয়ে পর্যুদস্ত। চীন, স্পেন, ইতালি তারপর আমেরিকার মত প্রথম সারির দেশ গুলোতে এই ভাইরাসের প্রকোপ ছিল সবচেয়ে বেশি।
খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের অনান্য দেশ গুলিতেও করোনা ভাইরাস তার প্রভাব ফেলতে শুরু করল।

ভারতেও মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাড়তে শুরু করল আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। লাগু হল কোয়ারেনন্টাইন ব্যবস্থা। স্বাভাবিক জীবন হল বির্পযস্ত।বন্ধ হল কলকারখানা, অফিস কাছারী, দোকানপাট। স্বেছায় ঘরবন্ধী হলাম আমরা,অজানা মৃত্যুভয় নিয়ে। লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা থেকে কোয়ারেনন্টাইন শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সকলেই পরিচিত ছিলাম। এবারে কিন্তু উপলব্ধি করলাম এর ভয়াবহতা। মানুষ হারাল কাজ, এক ধাক্কায় অর্থনীতির পারদ নামতে নামতে তলানিতে।
অগণিত মানুষের মৃত্যু মিছিল। কেউ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা নিয়ে হাঁটা পথে পাড়ি দিয়ে মৃত্যুবরন করছেন,কেউ কেউ রোগের প্রকোপে, কেউ মানসিক চাপে।
মনে পড়ে যায় জীবনাননন্দের কবিতা
"মনন্তর শেষ হলে, পুনরায় নব মনন্তর;
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল।"

এই যুদ্ধ ক্ষুধার, বেকারত্বের, অসহায়তার। কিন্ত মানুষ সবচেয়ে উন্নত প্রানী তাই যে কোন যুদ্ধ জয়ের কৌশল তার জানা। মা সারদা বলে গেছেন "যে সয় সেই রয়"।অর্থাৎ কিনা ধৈর্যই হল প্রথম হাতিয়ার।
ধৈর্য ধরে নিয়ম মেনে এগোতে পারলে জিত নিশ্চিত।
তার সাথে আমাদের শরিক হতে হবে মানুষের দু:খে।
পাশে দাঁড়াতে হবে সবার।সেটা যে ভাবে খুশি, মানসিক বল দিয়ে,আস্থা দিয়ে, সেবা দিয়ে, মনের কাছে টেনে নিতে হবে সকলকে। কারন এই পৃথিবীতে বাঁচতে হলে সকলকে নিয়ে বাঁচতে হবে।
সর্বশেষে বলি,সময়ের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে,বাড়াতে হবে ইমিউনিটি,বাড়াতে হবে মানসিক জোর, নতুন নতুন পন্থায় অর্থনৈতিক বিকাশের দিকে নজর দিতে হবে। চার্লস ডারউইনের মতেও "survival of the fittest ".নিজেকে গড়ে নিতে হবে এই সময়ের মত করে।আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে আবার নির্মল পৃথিবী দেখব। এই বিশ্বাস রইল।


( অনেক কথা বিনিময়ে, অনেক ভাবনার শেষে আসানসোলের সম্বৃতা দাশরায় লিখেছেন এক দু:সহ সময়ের বাস্তব গল্প,)

শীতের রোদ্দুর গায়ে মেখে বন্ধুবান্ধব, ভাইবোনেরা একসঙ্গে বেড়িয়ে ঘুরে দারুন শুরু হয়েছিল 2020 । আমি যে শহরের বাসিন্দা, তাকে ঘিরে দূরে কাছে মনোরম মনোলোভন বেশ কিছু ট্যুরিস্ট স্পট আছে। সুতরাং প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়া এখানে খুব সুবিধেজনক।
হৈচৈ খুশির মধ্যে দিয়ে এত সুন্দর শুরুয়াত , ভেবেছিলাম বাকিটাও ভালোভাবেই কেটে যাবে।
এবছরের জানুয়ারি মাস আমার জন্য বিশেষ আনন্দের ছিল কারণ আমার প্রথম গল্প সংকলনটি এবারের কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হল। যারা বই-এর সঙ্গ ভালোবাসেন তাদের কাছে বইমেলা একটা মিলনমেলা । কদিনের আনন্দযাপনের শেষে আবার জড়িয়ে পড়েছি সাংসারিক আবর্তে। নানান ব্যস্ততার মধ্যে টিভিতে, খবরের কাগজে চিনের উহান প্রদেশে এক মারক জীবাণুর হানাদারির কথা শুনছি পড়ছি। সাধারণ কথোপকথনের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে মৃত্যুদূত নোবেল করোনা ভাইরাস !
এভাবেই এসে পড়ল মার্চ। তখন উহান ছাড়িয়ে সেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে ইওরোপে। ইতালিতে ভয়াবহ সংক্রমণ ,হু হু করে বাড়ছে মৃত্যু মিছিল । পৃথিবীজুড়ে মারণবীজের দাপাদাপিতে দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের জালে জড়িয়ে যাচ্ছে মানবসভ্যতা। নিউজ চ্যানেলে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা তালিকা দেখে উদ্বেগ আশঙ্কা বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশও রেহাই পেল না ভাইরাসের প্রকোপ থেকে । ফলস্বরূপ লকডাউন ! সেদিনটা কখনও ভুলতে পারব কি ?
ঐ ছোট্ট জীবাণুর কি মারাত্মক ক্ষমতা! আমাদের জীবনের রাশ এক নিমেষে চলে গেল ওর হাতে । আমার বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেছে একটা অতি ব্যস্ত রাস্তা । সারাদিন সারারাত কর্কশ হর্ণ, চাকার ঝনঝন । দুপাশে গড়ে ওঠা চায়ের দোকান , ফুচকাওলা, রকমারি ফুডস্টলে ছেলেমেয়েদের আড্ডা, সবজির পসরা ,শপিং মলে লোকজনের অনবরত যাতায়াতে জমজম করত সবসময় । হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখি কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই । সেই রূপকথার ঘুমের দেশের মতো সব নিঝুম , অথচ সোনার কাঠি রুপোর কাঠির সন্ধান নেই। মসৃণ কালো সাপের মতো রাস্তাটা আলসেমির শীতঘুমে। সবার দরজায় সন্দেহ আর সতর্কতার শক্ত পাহারা । শুধু বারান্দা আর জানলায় একমুঠো খোলা আকাশ । নোবেল করোনা ভাইরাস, নিউজ চ্যানেল, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া সেইদিনগুলোয় অন্য কিছুর অস্তিত্ব বুঝতে পেরেছিলাম কি আমরা? ও হ্যাঁ আর ছিল সোশ্যাল মিডিয়া। নিজেদের দুর্ভাবনা শেয়ার করা , খবরাখবর সংগ্রহ, একে অপরকে সাহস জোগানো এ সবই তো ভার্চুয়ালি বেঁধে বেঁধে থাকার সুফল ।
লকডাউনের দিনগুলোতে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনাও ঘটল । বহুল পরিচিত তাপউত্তাপ পত্রিকার সম্পাদক শ্রদ্ধেয় অমল বন্দ্যোপাধ্যায় , অমলদা শুরু করলেন লকডাউনের অনলাইন বুলেটিন। নাম দিলেন একুশের বুলেটিন । ম্রিয়মাণ, ভীতিকর এই সময়কে কথা এবং কবিতায় ধরে রাখার বেশ অভিনব এক পদক্ষেপ। সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে এই মানুষটির কখনওই ক্লান্তি দেখি না বরং দেখি অসীম উৎসাহ । কত কবি সাহিত্যিকের কলমে তাঁদের এই সময়ের অনুভব উঠে এসেছে এবং আসছে নিয়মিত । আজ একাশিতম দিন । এতদিন ধরে বুলেটিন চলছে ,এ বড় সহজ কাজ নয় । একুশে বুলেটিনের সমস্ত লেখা ভবিষ্যতের কাছে এই অভিশপ্ত সময়ের দলিল হয়ে থাকবে । বুলেটিন শুরুর প্রথম দিকেই আমার কাছে একটি কবিতা চেয়ে নিয়েছিলেন অমলদা। আনলক (এক) - এ পৌঁছে আরো একবার আমার অনুভব লেখার তাগাদা এল । লিখতে একদম ইচ্ছে করে না ইদানীং, এ কথা বলায় বকুনিও খেলাম। অগত্যা আমার অগোছালো ভাবনাদের জড়ো করে তুলে দিচ্ছি বুলেটিনের পাতায়। যারা দৈনন্দিনতার একঘেয়েমির ফাঁকে উঁকি দিয়ে যায় মনের কোণে।
এতগুলো দিনের লকডাউন শিখিয়ে দিল কত কিছু। জীবনযাপনের আদলও গেল বেশ খানিকটা বদলে । করোনা ভাইরাস ঠেকাতে দেশজুড়ে লড়াই-এর মাঝে চরম দুর্দশার শিকার হলেন অসংখ্য প্রবাসী শ্রমিক । উম্ফূনের নির্বিচার ধ্বংসলীলা বুঝিয়ে দিল আমরা আজও কতখানি অসহায় প্রকৃতির সামনে। তবু ভরসা জাগে যখন দেখি কতশত মানুষ সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে দুঃখী মানুষের দিকে। বুঝি একমাত্র এই আমাদের ভালো থাকার, সুখী হবার পথ ।
ধীরে ধীরে স্বাভাবিকতায় ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছে দেশ। যতদিন না প্রতিষেধক আবিষ্কার হয় ততদিন নোবেল করোনা ভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই পথ চলতে হবে এটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও বাস্তবকে অস্বীকার করার উপায় নেই । সঠিক সাবধানতা অবলম্বন করেই নতুন পথে জীবন চলবে এমনটা ভাবলেও , আনলক করার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত সতর্কতা সচেতনতার প্রতিরোধ ভেঙে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল , এরপর ? নাহ্, এর পরের উত্তর খোঁজার চেষ্টা আর করছি না।


( কলকাতার বাসিন্দা, মধুমিতা তরফদার, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আমফানের তান্ডবে, তার চোখে পড়েছিল নানান ছবি, সুনিপুণ ভাবে তিনি লিখেছেন, তাপ উত্তাপের একুশে বুলেটিনে)

করোনাও আমাদের ছাড়ছে না, আমাদের মুখে করোনা বা লকডাউন সংক্রান্ত কথাবার্তাই ঘোরাফেরা করছে। এ লেখাটাও তারই প্রতিফলন।
গত পয়লা জুন লকডাউন উঠে যাবে বলে সরকার থেকে ঘোষণা করা হলো। শুধু কনটেন্টমেন্ট জোনে নানারকম রেসট্রিকশন রইল। আমারও খুব কৌতূহল হলো ব্যাপারটা কেমন চোখে দেখার জন্য। সকাল দশটা নাগাদ করোনা প্রতিরোধকারী বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এর আগে যে কদিন বেরিয়েছি, রাস্তাঘাট মোটামুটি শুনশান ছিল। স্বাভাবিক সময়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল কলেজ খোলা থাকে তখন যাদবপুর চত্বরটা প্রায় মাছের বাজার মনেহয়। সব দোকানপাট খোলা থাকে আর ফার্স্টফুড, মিষ্টির দোকানে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের ভিড়ে গমগম করে। রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। এর সঙ্গে অটো, ট্যাক্সি, রিক্সা আর প্রাইভেট কারের গোঁতাগুঁতি তো আছেই। যাদবপুর মানুষজনই জানেন কিভাবে ফাঁক দিয়ে গলে গন্তব্যে পৌঁছতে হয়। আগে আমি রাস্তা ফাঁকা পাওয়ার আশায় বহুদিন বোকা বনেছি। এতোদিনে ওদের মতো কিছুটা ফাঁক গলে বেরতে শিখেছি।
এবারে আসল কথায় আসি। এই লকডাউনের বাজারে এই চত্বরটা খাঁ খাঁ করত। শুধু বাজার করার সময় ভিড়চোখে পড়ার মতো। কদিন আগে একটা মিম ফেসবুকে খুব ঘুরছিল-বাজার করেই এক প্রজাতি শেষ হয়ে গেছিল.. সে হচ্ছে বাঙালি জাতি। একদম খাঁটি কথা।
সন্ধ্যেবেলা সব দোকানপাট বন্ধ। আবার চারিদিকে শুনশান। এ হচ্ছে লকডাউন পর্বের কথা। আমি যেদিন লকডাউন আনলকড হওয়া দেখতে গেলাম, বাজারে মোটামুটি ভিড় চোখে পড়ছিল। পরের দিন জামাইষষ্টি (অরণ্য ষষ্ঠী) ।ডিসট্যান্সিং মেনে কতোটা জামাইষষ্টি সম্ভব জানি না তবে তুলনামূলকভাবে ভিড় কম। যথারীতি জিনিসের দাম অগ্নিমূল্য।
এবারে গেলাম যাদবপুর পোস্ট অফিসের দিকে। সেখানে কাজকর্ম কতটা স্বাভাবিক হয়েছে দেখার জন্য। সামনেই একটা ফাঁকা অটো পেয়ে বসে পড়লাম। মনে ভয় কি জানি কজন বসবে? অটোওয়ালা তার আর যাত্রীর বিভাজন করতে একটা প্লাস্টিকের পর্দা টাঙিয়েছে। ইতিমধ্যেই আর একজন এসে বসলেন.. সরকারি সতর্কিকরণ অনুযায়ী 'ছে ফুট কি দূরী' আর রক্ষা হল না। করোনা আর কি দিয়েছে জানিনা, ভয় মানুষ কে অবিশ্বাস এই মানবিক মূল্যবোধকে কেড়ে নিয়েছে।
পোস্টাপিস যাওয়ায় পথে দেখলাম তখনও আমফানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে বড়োবড়ো গাছ ভেঙে পড়ায় প্রাচীর খসে পড়েছে। কোনোরকমে গাছগুলোর ধড়মুন্ড আলাদা করে ফাইবার সিট দিয়ে টেম্পোরারি প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে। গাছের ডাল আর তারের জটাজাল গড়াগড়ি খাচ্ছে।ধ্বংসের পরিমাণ এতো প্রকট সে তুলনায় জনবল কম পড়ে গেছে। পোস্টাপিসের দিকে তাকিয়ে দেখি বিরাট জটলা। এগিয়ে গেলাম। দেখি এক কর্মচারী বড়ো লোহার গেটের ওপার থেকে জানাচ্ছে যথেষ্ট সংখ্যায় কর্মচারী না থাকায় আজ পোস্টাপিসের কাজ বন্ধ। অনেক বৃদ্ধ মানুষ এসেছিলেন টাকা তুলতে যারা ঐ টাকার ওপর নির্ভর করে সংসার চালান। খুব রুষ্ট তারা। কিন্তু কিছু করার নেই।
এবার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে লাগলাম। এখানকার জনপ্রিয় দোকানগুলো যেগুলো ছাত্রসমাগমে মুখর হয়ে থাকতো সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। এই সব মানুষগুলো কেমন আছে কে জানে? এসব ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি দেখি জনা পঞ্চাশেক যুবক বেশ শক্তপোক্ত চেহারা তারা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে এগোচ্ছে। সামনে একজন হ্যান্ডিক্যাম নিয়ে আর পাশে আরেকজন বুম নিয়ে মিছিলটাকে দাঁড় করিয়ে যার হাতে বড়ো প্ল্যাকার্ড তার বাইট নিচ্ছে। আমি একটু কৌতূহলী হয় এগিয়ে গেলাম। দেখি ওতে লেখা- Please give permission to open the Gym... We are gaining weight.
হা সেলুকস! সত্যি বিচিত্র এ দেশ!!
লকডাউন আনলক হওয়ায় রাস্তায় অনেকেই গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে। রাস্তা পার হতেই দশ মিনিট লেগে গেলো। এবার যাদবপুর স্টেশন রোডে গেলাম। ওখানে গা ঘেঁসাঘেঁসি করে প্রচুর দোকান। এই অঞ্চলটা যেহেতু পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চল তাই বাড়িগুলোও গায়ে গায়ে, দোকানগুলোও তাই। তাই একটা সার্কুলার বের হয়েছিল যে অল্টারনেট ডে তে দোকান খুলতে কিন্তু পুকুরে দুধ ঢালার মতো অবস্থা! এক দোকানদাররে সঙ্গে কথা হল লকডাউনের ব্যাপারে। সে বলল, ঘরে বসে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। রোজগার নেই! কতোদিন পুঁজি ভেঙে খাবো? তাই সবজি বেচতে বের হয়েছিলাম। কিন্তু সবার দ্বারা সব কাজ হয় না। শেষে তিনশটাকা লস খেয়ে দোকান খুলতে এসেছে। এরকম অনেক গল্প ছড়িয়ে। লকডাউন ডায়েরী হয়ে যাবে।
ঐদিন জামাকাপড়ের বাজারে মানুষজনের ভিড় কমই দেখা গেলো। মন্দির বন্ধ। মা সাদামাটা পোশাকে। এভাবেই শুরু হল আনলকের প্রথম পর্ব।
ইতিমধ্যে একসপ্তাহের বেশি কেটে গেলো। কোন দোকান খুলবে আর কি খুলবে না তা নিয়ে প্রচুর ধন্দ তৈরি হয়েছে। আবার মানুষ স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছে। কতোদিন আর বাড়িতে বসে থাকা যায়। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে নীতি নিয়েছে। তবে প্রাক করোনা যুগে তো ফিরতে পারবে না তাই দেখা যাচ্ছে প্রায় অনেকেই মাস্ক নিয়ে ঘুরছে। কোনো কোনো সময় ব্যালকনি থেকে দেখে চমকে উঠছি মেয়েদেরও চাপ দাড়ি হলো নাকি? আসলে অনেকেই কালো মাস্ক এমনভাবে গালপাট্টার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখছে ভুল হবার উপক্রম। এছাড়া আছে হাতে ঝুলন্ত মাস্ক কিংবা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের হচ্ছে.. ইত্যাদি ইত্যাদি।
এখন ইটালিয়াল সেলুন, দর্জির দোকান শপিং মল, গয়নার দোকান সবই খুলে গেছে! জানিনা এরা কিভাবে সোস্যাল ডিসট্যান্সিং মেনে চলবে? এদিকে মুখ্যমন্ত্রী আবার ঘোষণা করছেন 30 শে জুন পর্যন্ত লকডাউন অথচ সব দোকান খোলা! তাই আমি খুব কনফিউজড এই আনলকড ওয়ান নিয়ে।

সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু