বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

(পর্ব - ১)

"এই গরমে কেউ আপাদমস্তক কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে পারে?" কাক ডাকা ভোরে মনে মনে কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে গেল মালা। 

কলকাতার হরিদেবপুর অঞ্চলের ঢালি পাড়া। একাধিক মধ্যবিত্ত পরিবারের বাস এই পাড়ায়। মুক্তিসংঘ ক্লাবের ঠিক পাশেই বিপিনদের বাড়ি। বিপিনরা চার ভাই। বিপিনের বাবা সরকারি চাকরি করতেন। রিটারমেন্টের পরে যেটুকু টাকা পেয়েছিলেন প্রায় তার সবটুকুই চার ছেলের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেন। বিপিনদের পারিবারিক একটি মুদির দোকান আছে। গতবছর হঠাৎ করে সামান্য কয়েক দিনের রোগভোগে বিপিনের বাবা, শেখর সান্যাল মারা যান। বাবার মৃত্যুর এক মাস যেতে না যেতেই মাও সংসারের মায়া ত্যাগ করেন।

একদিকে যখন আত্মিক বন্ধনগুলোর মধ্যবর্তী রসায়ন ক্রমশ কমে আসছে, ঠিক তখনই বিপিনদের একান্নবর্তী পরিবার সমাজের ভেঙেপড়া এই স্তরকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য অনেক বছর ধরেই শক্ত হয়ে দুই পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বিপিনের বড় ভাই বিজয়, সল্টলেকে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করে।  বিজয় এবং তার স্ত্রী মালা, তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান অনিকেতকে সাথে নিয়ে একটি ঘরে থাকে। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় বিজয়ের পক্ষে আজকাল পরিবারের জন্য সময় বের করা একটু বেশিই কঠিন হয়ে পড়েছে। এই নিয়ে বিজয় ও মালার মধ্যে মাঝে মধ্যেই গোল বাঁধে। 

বিপিনের মেজ ভাই বিকাশ ও তার স্ত্রী দীপ্তি তাদের দুই পুত্র সন্তান রাজ ও সঞ্জয়ের সাথে আরেকটি ঘরে থাকে।বিকাশ ওদের পরিবারের ব্যবসা দেখে। পরিবারের ব্যবসা বলতে, পাশের পাড়াতে সান্যালদের একটা মুদির দোকান আছে। বিকাশ ও দীপ্তির মধ্যে আপাত কোনো বিরোধ নেই। আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতোই ওরাও ওদের সংসারের চাকা ঠেলে ধাক্কিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। তবে, মাঝে মধ্যে চাকাতে তেল দেওয়া না হলে যা হয় অর্থাৎ চাকার সাথে রাস্তার ঘর্ষণের শব্দ প্রকট হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে আবার সেটা কমেও যায়।

সেজো ভাই রূপরাজ অবিবাহিত। রূপরাজ একসময় পাড়ার একটি হোটেলে সাফাইয়ের কাজ করতো কিন্তু লকডাউনে তার সেই কাজটাও গেছে। রূপরাজের বয়স এখন চল্লিশ। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পরে, বাবা দাদাদের ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। তবে বাড়িতে বসে বসে বাংলা বই পড়তে খুব ভালোবাসে ও। ছোট থেকেই ওর ইচ্ছে ছিল, যে ভাবেই হোক টাকা রোজগার করতে হবে। বর্তমানে যেকোন কারণেই হোক, খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে সে। হতাশার প্রকৃত কারণ কী, সেটা অনুধাবন করে সান্ত্বনা দেবার লোক এই পরিবারে অনেক। শেষ কয়েক মাস ধরে পরিবারের প্রত্যেকেই নিজেদের সাধ্যমত রূপরাজের মন থেকে অন্ধকার দূর করে সেখানে ভোরের মিষ্টি আলো ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে গেছে। তবে এই কাজে তারা সফল হয়েছে, সেটা অবশ্য বলা যাবে না।

এই পরিবারের ছোট ছেলে বিপিন। বছর খানেক হয়েছে সে তার ছোটবেলার বান্ধবী নীলাকে বিয়ে করে এনেছে। নীলা, ইতিহাস নিয়ে কল্যাণী ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী পাস করেছে। তিন বউয়ের এই পরিবারে সবথেকে শিক্ষিতা এবং রুচিশীলা নীলা। কিন্তু বর্তমানে নীলা, বাড়ির আর দুই বউয়ের মতো সর্বসময়ের জন্য বাড়িতেই থাকে। সকাল সন্ধে এটা ওটা করতে করতেই দিন ফুরিয়ে নেমে আসে রাত। মনের কথা বলার মতো লোকের অভাব এই বাড়িতে প্রথম থেকেই ছিল। তাছাড়া, বিপিন কর্পোরেশনে কাজ করে। রাতে নেশা করে বাড়ি ফেরা টা সে যেন একরকমের অভ্যাসে পরিনত করে ফেলেছে। নীলার কাছে, বিয়ের পর থেকেই বিপিন যেন এক অন্য গ্রহের মানুষ। যে বিপিন বিয়ের আগে এক মুহূর্তের জন্যেও নীলার কষ্ট সহ্য করতে পারতো না, সে-ই এখন নীলার দিকে ফিরেও তাকায় না। বিপিন রাত করে বাড়ি ফিরে খেয়েদেয়ে মোবাইলে ডুবে থেকে। রাত ঘন হলে, নিঃশব্দে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিপিনের এই পাশ ফেরার শব্দ, আজকাল খুব অসহ্য লাগে নীলার। নীলার চাওয়া পাওয়ায় সাড়া দেওয়ার কোনো সময়ই যেন নেই বিপিনের কাছে। কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে খুব মিল। ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসার এমন নজির আজকালকার দিনে বিরল।

বিপিনদের বাড়িতে মোট চারটে ঘর। এছাড়াও একটা রান্নাঘর, একটা কমন টয়লেট।এই চারটে ঘরের ঠিক পাশে ইংরেজির বড় হাতের আই অক্ষরের মতো লম্বা আয়রন গ্রিল দিয়ে ঘেরা একটা বারান্দা। বারান্দার দুই প্রান্তে দুটো লোহার গ্রিল গেট রয়েছে। বড় গেটে রাতে তালা দেওয়া থাকে এবং তালার চাবিটি বারান্দার একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ঝোলানো থাকে। বাথরুমের ঠিক পাশে একটি ছোট লোহার গেট রয়েছে যেটা রাতে ভেতর থেকে আটকানো থাকে, কিন্তু এই গেটে তালা দেওয়া হয় না। বাড়ির ঠিক বাইরে, দুটি লোহার গেটের মাঝামাঝি একটি পাতকুয়ো আছে। বড় আর মেজ ভাই মূলত রান্নাঘরটি ব্যবহার করে। সেজো ভাই রূপরাজ এর জন্য খাবার বড় ও মেজ ভাইদের খাতা থেকেই যায়। বারান্দার ছোট্ট একটি জায়গায় কোনমতে রান্না করে নীলা। ছোট ভাইয়ের হাঁড়ি আলাদা হলেও ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসার কোনো খামতি নেই। বিবিধের মধ্যে এই সামান্য ছন্দহীনতা পারিবারিক ঐক্যের ছবিতে কোনভাবেই আঁচড় কাটতে পারে না।

প্রত্যেকদিন খুব ভোরে সবার আগে উঠে বারান্দা, রান্নাঘর ঝাঁট দিয়ে মুছে, রান্নার জোগাড় করে সবার জন্য চা তৈরি করে একে একে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা অনেক দিনের অভ্যাস মালার। বাড়ির বাকিরা এরপরে একে একে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির বাকি কাজে মালাকে সাহায্য করে। এটাই সান্যাল বাড়ির অলিখিত সংবিধান। এই নিয়ম-ই চলে আসছে অনেকদিন থেকেই।

আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে, বাথরুম সেরে, রান্নাঘর গুছিয়ে বারান্দার সামনে এসে হঠাৎ মালা আবিষ্কার করল, তাদের বাড়ীর প্রধান ফটক খোলা পড়ে আছে এবং ফটকের তালাটি গেটের গায়ে ঝুলছে। চাবি গুচ্ছটিও তালার সাথে নেই। একটু এদিকে ওদিকে তাকাতেই চাবির গুচ্ছটিকে স্বস্থানেই আবিষ্কার করল মালা। কিছুটা বিস্মিত হয়ে মালা ভাবতে লাগলো, এত সকালে কে উঠে বাড়ির বাইরে গেল। আর গেল তো গেল, সদর গেট টা এমন হা করে খুলে রেখে চলে গেল! এরপরেই মালার নজর গিয়ে পড়ল রূপরাজের ঘরের দরজার দিকে। দরজাটা হাট করে খোলা। ঘরে জিরো ওয়াটের একটা বাল্ব জ্বলছে। এমনটা তো হবার কথা নয়! চমকে উঠলো মালা। রূপরাজ সবসময় দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাতে ঘুমায়। দরজার বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে মালা দেখল, খাটের উপরে আপাদমস্তক কম্বল দিয়ে ঢাকা অবস্থায় সম্ভবত রূপরাজ শুয়ে আছে। ঘরের মধ্যে থাকা নিজের স্বামীর আর সঞ্জয়ের সাইকেল দুটোও উধাও।

এই ভরা গরমে কি করে একজন মানুষ মোটা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে পারে? সাইকেল দুটোই বা গেল কোথায়? একই সাথে বিস্মিত ও কিছুটা ভীত হয়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের ঘরের দিকে দৌড়ে গেল মালা। 

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু