বইয়ের বিবরণে ফিরে যান প্রতিবেদন পর্যালোচনা

যাত্রা

যাত্রা 

সঞ্জয় দত্ত

 

এমন কাকভোরে ধর্মশালার দরজার বাইরে পা রাখতেই একঝলক হাড় কাঁপানো কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আছড়ে পড়ে বুদ্ধের অনাবৃত মুখ মন্ডলে । হিমালয়ে সাড়ে ছ হাজার ফুট উচ্চতায় ভোরে এমন ঠান্ডা স্বাভাবিকই হলেও সমতলে যাদের বাস তাদের কাছে অসহনীয় । বুদ্ধ বিস্মিত এমন ঠান্ডায় পাশের কুন্ডের জল কি করে গরম থাকে? হয়তো যাতে সকলে স্নানের পরে শুদ্ধ হয়ে তাঁর আলয়ে যেতে পারে।

বুদ্ধের সঙ্গে তার পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা মা। বাড়ি থেকে এতদূর বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে বুদ্ধের একটাই চিন্তা পারবে কি মা এই পাহাড়ের কঠিন চড়াই পথটা হাঁটতে? বুদ্ধ লোক মুখে শুনেছে পাহাড়ে পথের দূরত্ব কেউ সঠিক বলতে পারে না, চড়াই পথে একনাগাড়ে হেঁটে ক্লান্ত মানুষ দিশেহারা ও শেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে রয়েছে উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে অক্সিজেনের স্বল্পতা। আজ অন্ধকার থাকতে গরম জলের কুন্ডে স্নান সেরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কয়েক স্তর গরম জামার ভার নিয়ে হাতের লাঠি ঠুকে দুজনে সকালের আড়ষ্ঠ ভাবটা কাটাতে  ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করে। ওয়াক! পথের শুরুর  আস্তাবল এলাকাটা ঘোড়ার বিষ্টায় যেমন কর্দময়, পিচ্ছিল, তেমনিই দুর্গন্ধ।

"মা অনেকটা চড়াই পথ, পারবে তো? বরং একটা ঘোড়া করি তোমার জন্য?" চিন্তিত বুদ্ধ জিজ্ঞেস করে।

"না রে আমি হেঁটেই পারবো, এতদূর এসেছে শুধু ওনার ইচ্ছেয়, উনি চাইলে বাকিটাও পারবো। আর উনি না চাইলে প্লেনেও পৌঁছতে পারবো না রে," মা মাথা নেড়ে বলেন। ডান্ডির কথা বুদ্ধ বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মায়ের আত্মবিস্বাস দেখে সে আর কথা বাড়ায় না। কয়েকজন ঘোড়াওলা এগিয়ে আসে কিন্তু তারা কিছু বলার আগেই মা হাত নেড়ে ওদের প্রয়োজন নেই বুঝিয়ে দেয়।

স্লথ গতিতে দুজন হাঁটতে থাকে। পথের প্রথমটায় বেশ মসৃন পাথর বসানো চড়াই তেমন বিশেষ নয় তবুও ওরা মাঝে মাঝে পথের পশে বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটে।

 

বুদ্ধর জন্ম গয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে । ছোটবেলাতেই ও দেখেছে দারিদ্রের করাল রূপটা। খিদের সময় খাবার নেই, শীতে সময় গরমের বস্ত্র নেই, স্কুল যাওয়া নেই।  অন্যের জমিতে জন খেটে দুবেলা দুমুঠো অন্নের জন্য কি পরিশ্রম না বাবাকে করতে হত, তাও পাঁচ জনের পরিবারে সব দিন পেট ভরে অন্ন জুটতো না। তার ওপর মহাজনের সুনজরে থাকার জন্য কত এটা সেটা বেকার খাটুনিও করতে হত, উপায় কি? কুমিরের সঙ্গে বিদ্রোহ করে কি জলে থাকা যায়? প্রত্যন্ত গ্রামে দলিত গরিবের জন্য কে আছে? 

মা সারাদিন ব্যস্ত থাকতো ঘরের কাজ আর ওদের কুঁড়ে ঘরের সামনে এক ফালি জমিতে যদি দুটো আনাজ ফলানো যায় সেই চেষ্টায় ।

একদিন সন্ধ্যেতে  চিন্তিত বাবা এসে চুপ করে বসে থাকে।

লম্পের আলোতে মা রাতের খাওয়ার জোগাড় করছিল, বাবাকে চুপ করে থাকতে দেখে মা জিজ্ঞেস করে, "চুপ করে আছ, কি হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি?" 

বাবা বলে, "কদিন ধরেই ভাবছি এতো হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও কিছুতেই সংসার চালাতে পারছি না, যা থাকে কপালে এবার আমি কলকাতায় যাবো ঠিক করেছি।"

বুদ্বের মনে পরে না ওরা পাশের গ্রামের মেলা ছাড়া দূরে কোথাও কোনোদিন গেছে। গ্রামের মেঠো পথে এক ঘন্টা হেঁটে তবে বাস রাস্তা। গ্রামের কচিকাচাদের কাছে ওই অবধি পৌঁছনোই একটা অভিযান, যেমন গ্রামের শেষ প্রান্তে বড় টিলাটায় শেষ দুপুরে উঠলে অনেক দূর থেকে ট্রেনকে ঝিক ঝিক শব্দে করে যেতে দেখা যায়।

মায়ের কাছে কলকাতা লোকমুখে শোনা রূপকথার সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে এক মায়ানগরী।  বাবার কথায় তার বুক কেঁপে ওঠে।  অত দূরে গিয়ে সে কি বাড়ীর পথ চিনে ফিরে আসতে পারবে?

"সে তো বিশাল গোলকধাঁধার শহর ওখানে তো শুনেছি চাষবাস হয় না, তুমি কি করবে?" চিন্তিত মা জিজ্ঞেস করে।

"আমি এখনও জোয়ান, শরীরে জোর আছে, পরিশ্রম করে টাকা রোজকার করবো। গ্রামের যারা কলকাতায় গেছে তাদের জীবন অনেক বদলে গেছে। ওখানে সারা বছর কাজ আছে, আছে অনেক রোজকারের সুযোগও।"

লম্পর আলোয় সেদিন বুদ্ধ দেখেছিল মায়ের চোখে জল হয়তো চিন্তায় কেমন করে একা  তিনটে বাচ্চাকে সামলে সংসার করবে ।

বাবা মায়ের চোখের জল মুছিয়ে বলেছিলো, "ওখানে গেলেও, সবসময় তোমাদেরই চিন্তা থাকবে, রোজকার করেই টাকা পাঠাব, একটু বুঝে চালিও,  দেখো আমাদের ভালোই হবে।" সেই রাতে লম্পের কাঁপা আলোয় বাবার পেশীবাহুল মজবুত শরীরটাকে যেন অপরাজেয় মনে হয়েছিল।

কচি বুদ্ধ সেদিন প্রতিক্রিয়াহীন, জানা ছিল না কি করবে? দুঃখ, বাবা অনেক দূরে যাচ্ছে? না আনন্দ, এবার থেকে খিদে পেলে খাওয়া জুটবে।

পাথর বিছানো পথে ওরা ধীরে হাঁটতে থাকে, দলে দলে ওদের পাশেই অনেক পূর্ণার্থী  চলেছে "জয় কেদারনাথ " ধ্বনি তাদের মুখে। কেউ হাঁটে তো কেউ ঘোড়ার পিঠে, অনেক বয়স্ক চলেছে চারজনের কাঁধে সওয়ার কান্ডিতে। চোখ জুড়োনো পথের নৈস্বর্গিক রূপ। ডানদিকে তিরতির শব্দ তুলে একঘেঁয়ে খরস্রোতা মন্দাকিনী বয়ে চলেছে। মন্দকিনির ওপারের পাহাড়গুলোর চূড়োয় জমা বরফ গলে ঝর্ণার ধারায় মন্দকিনির সঙ্গে গিয়ে মিশছে।   পথের বাম পাশে নিবিড় ঘণ সবুজ জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়। সমস্ত পথের পশে ছোট ছোট চা-জলখাবারের দোকান। রামবারা চটি অতিক্রম করে এমনি একটা চায়ের দোকানে ওরা বসে। গরম চা দিয়ে গলা ভেজানো ও কিঞ্চিৎ বিশ্রাম। দোকানের পশে এক অন্ধ হারমনিয়াম বাজিয়ে কীর্তন গাইছে "কাম, ক্রোধ, মোহ, লোভ ছোড়কে নাম প্রভু কা গালে, মানাভ জনম জো পায়া উসকা আচ্ছা লাভ উঠা লে..." একঘেয়ে মন্দকিনির কলকলানিকে ছাপিয়ে তার গান যেন সারা উপত্যকাকে এক মধুর সুরে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষন ওই কীর্তন শুনে আবার ওরা পথে নামে ।

প্রতি মাসে সাইকেল চালিয়ে পিয়ন চাচা আসতো কলকাতা থেকে বাবার পাঠানো টাকা নিয়ে, সঙ্গে একটা ছোট চিঠি, যা তাকেই পড়ে শোনাতে হত, চিঠির সারমর্ম, আমি ভালো আছি, তোমরা সকলে ভালো থেকো হোলিতে ১০ দিনের জন্য আসবো, বাচ্চাদের খেয়াল রেখো ইত্যাদি ।

গ্রামের সামান্য কুটিরকে আনন্দে ভাসিয়ে দিল ছমাস পরে বাবা বাড়ী ফিরে। বাবা কলকাতা থেকে কত্তো কি নিয়ে এসেছে, মার জন্য নতুন শাড়ী বুদ্ধ ও তার ভাই বোনের নতুন জামাকাপড়, কলকাতার মিঠাই। সেদিন  বুদ্ধ বাবার কাছে কলকাতার কত গল্প শোনে, উঁচু উঁচু বাড়ি, অট্টালিকা, অগুন্তি লোক, ট্রাম, বাস, গাড়ি, আলো। মনে মনে বুদ্ধ এক স্বপ্নের নগরীর সন্ধান পেয়েছিলো সেদিন, আবদার করে, "বাবা আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল কলকাতায়, আমিও কাজ করবো তোমার মতন ।"

বাবা স্নেহের হাত বুদ্ধের মাথায় রেখে বলেছিলো, "এখনই নয়, তুমি অনেক ছোট, আগে তোমাকে স্কুলে গিয়ে পড়তে হবে।"

সেদিন বাবা বলেছিল কলকাতায় ছোট থেকেই ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়। আজকের দিনে লেখাপড়া জানা অত্যন্ত জরুরী, নিরক্ষর বাবা এখন তা খুব বোঝেন । গ্রামের বাড়ীর একটা ঠিকানা আর কয়েক পংতির চিঠি লিখতে লোক খুঁজে তোষামোদ করতে হয়। কাউকে না পেলে অগত্যা পোস্টঅফিসের বাইরে বসা দাদা, আমার মত নিরক্ষরদের জন্যই উনি, সানন্দে সব লিখে দেন কিছু অর্থের বিনিময়ে।

 

 

 

 

বছরে দুবার বাবা বাড়ি আসতো, হোলি, ছটপুজো অথবা দীপাবলিতে। বাবার আগমনের বাড়ি যেন উপচে পড়তো আনন্দে। বাবা সকলের ফরমাস মত গুছিয়ে সব নিয়ে আসতো কলকাতা থেকে। মা ওই কদিন মহানন্দে সুস্বাদু পদগুলো রান্না করতো। ক্রমে ওদের সংসারে এল খানিক সচ্ছলতা বাড়ির সংস্কার হল, নিজেদের গরুর দুধ হল, জমিতে আনাজ, ঘরে মজুত বস্তা ভরা চাল। তিন ভাই বোন গ্রামের স্কুলে ভর্তি হল । স্কুল থেকে ফিরে ওরা মাকে সাহায্য করতো ক্ষেতের কাজে ।

বুদ্ধর গ্রামের স্কুলে পড়া শেষ হলে বাবার সাথে প্রথমবার কলকাতায় এসে সে হতবাক।  হাওড়া স্টেশনে মানুষের সমুদ্র দেখে ওর মনে হয়েছিল পৃথিবীতে এত লোক আছে? বাইরে বেরিয়ে গাড়ি গুনতে গুনতে একসময় বুদ্ধ হাল ছেড়ে দেয়। এখানকার রাস্তা কত মসৃন, মানুষের কত রকমের সাজপোশাক, বাড়িগুলো কত্তো বড়, রাতেও কত আলো শহরময় ।

 

কলকাতায় পৌঁছে বুদ্ধ বুজতে পারল রিক্সা চালক বাবা গ্রীষ্মপ্রধান কলকাতা শহরে কি রকম হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে। দিনের বেলায় ছাতু ও রাতে ক্লান্ত শরীরে নিজের হাতে স্টোভে ডাল ভাত আলুর চোখা রেঁধে খেয়ে। রাতের আস্তানা এক পোড় বাড়ির বারান্দার তলায়। এত পরিশ্রমের উদ্দেশ্য একটাই যথাসাদ্ধ অর্থ সঞ্চয় যাতে তার পরিবার একটু সাচ্ছন্দে থাকে। সেদিন বুদ্ধ বাবার হাত পা মালিশ করতে করতে বলে, "এখানে না এলে গ্রামে থেকে জানতামই  না কি কষ্ট তুমি কর আমাদের সামান্য সুখের জন্য,"

উত্তরে বাবা বলেছিলো, "বুদ্ধ মানুষ দুভাবে সৎ পথে রোজকার করে এক কায়িক পরিশ্রম অন্যটা শিক্ষা আর মগজ দিয়ে। শিক্ষায় পুষ্ট মগজ আমার নেই,  তাইতো তোমাদের স্কুলে পাঠিয়েছি যাতে তোমাদের কাউকে আমার মত সারাজীবন গাধার খাটুনি না খাটতে হয়।"

আবেগে ভাসমান বুদ্ধ সেদিন বলেছিল, "তুমি দেখো বাবা খুব শিগগির আমি অনেক রোজকার করবো তখন তোমাকে আর কাজ করতে হবে না।"

শুনে বাবা শুধু হেঁসেছিলেন।

কলকাতায় পৌঁছে বুদ্ধ বোঝে মানুষকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তার উপার্জন এবং তা ধীরে ধীরে বাড়ানোর জন্য চাই একটা পরিকল্পনা। কলকাতায় প্রথম কিছু বছর বুদ্ধ এক পাঞ্জাবির হোটেলে কাজ করে। অভিজ্ঞতা না থাকায় শুরুটা  করে টেবিল পরিষ্কার দিয়ে। বছর ঘুরতে পদোন্নতির পর সে খাবারের অর্ডার নেয় ও তা পরিবেশন করে। পরিকল্পনা মাফিক শুরু হয় রোজ সকালে ড্রাইভিং স্কুলে তালিমও । ড্রাইভার হওয়ার পর হোটেল মালিকেরই ট্যাক্সি চালাতে শুরু করে প্রথমে ভোরে কঘন্টা দিয়ে, ক্রমে তা হয় সারাদিন, প্রতিদিন। ব্যাঙ্কে খাতা খোলে শুরু হয় অর্থ সঞ্চয়।

 

একটা সিনেমা দেখে বুদ্ধ নতুন দিশার সন্ধান পায়। পশ্চিমের কোন দেশে দারিদ্রতার নিচে দূরবর্তী কিছু গ্রামের মধ্যে গণপরিবহন না থাকায় এক যুবক পয়সার বিনিময়ে লোকেদের গন্তব্যে পৌঁছে দেয় তার গাড়ীতে । নিয়মিত এক মহিলার যাত্রীর সঙ্গে তার প্রেম ও তাদের সম্পর্ক নিয়েই বাকি গল্প । কিন্ত বুদ্ধ সেদিন মনে এক স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে সিনেমা দেখে ফেরে, প্রতিনিয়ত যা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।  কিছু বছরের সঞ্চয়ে একটা পুরোনো জীপ্ কিনে কলকাতা থেকে ফিরে যায় নিজের গ্রামে শুরু করে তার স্বপ্নের 'বুদ্ধ পরিবহন'। পৌঁছে দেয় গ্রামের যাত্রীদের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, গ্রাম থেকে কাছের শহর, বাস স্টপ, রেল স্টেশনে । অল্প কিছু মাসেই ব্যবসা বেশ জমে ওঠে, বাসরাস্তার কাছে ওদের পাকা বাড়ী হয়, বাড়ে খেত, বাড়ে গাড়ির সংখ্যাও। ভাইকেও নিয়ে আসে ব্যবসায়। বোন গুড্ডির সুপাত্র দেখে বিয়ে দেয়। নিজেও বিয়ে করে ও বছর ঘুরতে হয় এক কন্যার পিতা হয় ।

 

সেবছর বুদ্ধদের বাড়ীতে খুব ধুম ধাম করে দীপাবলী হয়। এখন বুদ্ধ একদম চায় না বাবা এখনো পরিশ্রম করুক, "বাবা এবার তুমি রিক্সা চালানো ছেড়ে বিশ্রাম নাও, আমি ও ভাই ভালোই রোজকার করি এখন আমাদের কোনই অসুবিধে হবে না।"

সেদিন উত্তরে বাবা বলেছিলো, "আসছে হোলিতে বাড়ি ফিরে আর কলকাতায় যাবো না, তোমার মাকে নিয়ে বেরোবো তীর্থে আমাদের অনেক দিনের স্বপ্ন হিমালয়ের সব তীর্থ দর্শনের।"

সেবছর শীতে জরুরি বার্তা আসে কলকাতা থেকে। ভাইকে নিয়ে বুদ্ধ ছোটে কলকাতায়। বেহুস বাবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, শরীরে লাগানো অনেক যন্ত্রপাতি, ব্যান্ডেজ। দুই বাসের রেষারেষীর দৌড়ে নির্দোষ এক রিকশাচালকের অপ্রত্যাশিত ক্ষতি। ডাক্তারের কাছে হাতজোড় করে বুদ্ধ অনুনয় করে, "বাবাকে ঠিক করে দিন, টাকা যত লাগে।"

উৎকণ্ঠার তিনদিন শেষে বাবার মরদেহ নিয়ে গ্রামে ফেরে দু ভাই। মা হাউহাউ করে কেঁদে উঠে, "সারাজীবন সংসার সামলেছি মুখ বুজে, অনেক আশা ছিল তীর্থে যাব তোমার সাথে।  তুমিই চলে গেলে আমাকে ছেড়ে এখন কে আমাকে তীর্থে নিয়ে যাবে?"

সেদিন মায়ের কান্না থামাতে বুদ্ধ প্রতিজ্ঞা করেছিল, "মা আমি শপথ করছি তোমকে তীর্থে নিয়ে যাব।"

কথা রেখেছে বুদ্ধ প্রতি বছর নিয়ম করে মাকে কোন না কোনও তীর্থে নিয়ে গিয়ে। এবারে মায়ের ইচ্ছে ছিল কেদার বদ্রী দেখার।

 

 

গরুর চটির হাড়ভাঙা খাড়া চড়াই ভাঙতে দুপুর হয়ে গেলো। দুজনেই তখন হাঁপাচ্ছে, বসে পরে পথের পাশে সঙ্গে আনা শুকনো খাবার নিয়ে। মেঘের রাজ্যে পৌঁছে হিমালয়ের চুইয়ে পরা নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেন সকল ক্লান্তি দূর করে দেয়। মনে হয় পৌঁছে গেছে কোন স্বর্গরাজ্যে। মন্দকিনির ওপারে পাহাড়গুলোর মাথা ঢাকা সাদা বরফে সেখান থেকে অগুন্তি সরু সরু ঝর্ণার জল ঝরে পুষ্ট করছে মন্দাকিনীকে। বাকি পথটা সমতল ওই তো দূরে উত্তরে দেখা যাচ্ছে নীল প্লাস্টিকের ছাউনি, অনেক ঘোড়াও, নিশ্চই ওপরের আস্তাবল, যা ছাড়িয়ে ওই শ্বেতশুভ্র কেদারশৃঙ্গ যার পাদদেশে গাঢ় পাথরের কেদারনাথের মন্দির । মা হাত জোর করে মাথায় ঠেকিয়ে বলেন, "জয় কেদারনাথজী।"

একটা জানা পাঁচেকের গেরুয়া বসনে আবৃত যাত্রী দল কেদার দর্শন সেরে গৌরীকুণ্ডের পথে নেমে যাচ্ছে, "জয় কেদারনাথ" ধ্বনি তুলে। ঐ দলের মধ্যে কে যেন ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় বুদ্ধের কানে ফিসফিসিয়ে বলে যায় "সাবাশ বেটা,"

চমকে ওঠে বুদ্ধ গলাটা কেমন যেন চেনা চেনা লাগে ওর। ঘাড় ঘুরিয়ে ওই দিকে তাকিয়ে বুদ্ধ এক্কেবারে হতবাক ।  মেরুদন্ড দিয়ে এক সৈত প্রবাহ বহে যায়, মঙ্কি টুপিতে ঢাকা যে লোকটা পিছনে ফিরে মুচকি হাসছে তাকে দেখতে এক্কেবারে যে বুদ্ধর বাবার মত। হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ় বুদ্ধ সম্বিত ফিরে পেতে পেতে পুরো দলটাই পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হয় । মাকে অবাক করে বুদ্ধ ছুটে যায় ঐ পাহাড়ের বাঁকে। এঁকে বেঁকে নামা সরু পাহাড়ী পথটা বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়, সেখানে অনেক যাত্রীর আনাগোনা, কিন্তু ঐ গেরুয়া বসনের দলটা যেন কোন হাওয়াই  মিলিয়ে গেছে ।

সমাপ্ত

পর্যালোচনা


আপনার রেটিং

blank-star-rating

বামদিকের মেনু