প্রকৃতি আমার প্রথম প্রেম । কবিতা প্রেমিকা । গল্পরা আমার বন্ধু । মানুষ আমার সহযোদ্ধা । ভালোলাগা, ভালোবাসা আমার লেখা ।
Book Summary
গজগামিনী
সারারাত ধরে চলেছিল জলসা । উদ্যোক্তরা গাড়ি করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল । গাড়িটা নেয়নি ভোরের হাওয়ায় হাঁটবে বলে । অনেকদিন ভোর দেখা হয়নি ব্যস্ততার মধ্যে । সকালে ঘুম থেকে উঠে গুরুপ্রণাম, রেওয়াজ – এটাই ওর প্রাত্যহিক রুটিন ।
সাদার্ণ অ্যাভেনিউ রাতুলের কাছে নতুন নয় কিন্তু সকালের পথটা ওর কাছে নতুনই । লেক কালীবাড়িতে মিশ্র ভারত। মহিলাদের সংখ্যাও ভালই । হাঁটার ফাঁকে কেউ কেউ প্রণাম ঠুকে নিচ্ছে একটুও না থেমে । কেউ দাঁড়িয়ে পড়ছে। অনেকে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে ভগবানের সান্নিধ্যে ।
ফুটপাতে পা ফেলতে হচ্ছে দেখে শুনে । যত্রতত্র কুকুরের বিষ্ঠা । প্রাতঃভ্রমণকারীদের সংগে কুকুরও তো কম নয় । গলায় শৃঙ্খলিত নানা জাতের সম্ভ্রান্ত কুকুর । কী তাদের চেকনাই ! রাত পাহারার পর নেড়ি কুকুরের দল এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে কোথাও । বিবেকানন্দ পার্কে একাধারে চলছে শরীরচর্চা আর একধারে ক্রিকেট কোচিং । শহরটা যে এত সকালে জেগে ওঠে জানাই ছিল না। মনের মধ্যে নতুন একটা সুর ভাঁজে সে । ভৈরব রাগে । রাতজাগার ক্লান্তি ভুলে ভোরের আলোয় ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে জেগে উঠছে রাতুল ।
দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলার সঙ্গে মোটাসোটা একটা মানুষ আসছে উল্টোদিক থেকে । মহিলার পরনে শাড়ি । চলনে বেশ একটা ছন্দ খুঁজে পেল রাতুল । ‘গজগামিনী’ শব্দটা মনে পড়ে গেল অনেকদিন বাদে । বিপরীত মুখী তিনটে মানুষ মুখোমুখি হল । পরস্পরকে অতিক্রম করেও গেল । ওরই মধ্যে রাতুল দেখে নিয়েছে গজগামিনীকে । উজ্জল শ্যামবর্ণা এবং বয়স হলেও এখনও রীতিমতো সুন্দরী । সঙ্গী ভদ্রলোকের কালো মোটা চেহারা আর সাদা টি শার্টের কথা ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না । সুন্দরী মহিলার সঙ্গীকে কেই বা দেখে সেভাবে ! চৌম্বকীয় তত্ত্ব যে ভ্রান্ত হয়ে যেত তাহলে !
গজগামিনীর মুখটা খুব খুব চেনা ! অবশ্য রূপসী মহিলাদের সবাইকেই চেনা মনে হয় পুরুষের । এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই । গজগামিনীর দুলকিতে সুরটা কোথায় তলিয়ে গেছে । রাতুল এখন ভদ্রমহিলার মুখটা মনে করার সাথে সাথে ডুব দিচ্ছে স্মৃতির জলাশয়ে । কিছুই উঠছে না । মনের গোলকধাঁধায় পাঁক খেতে খেতে গোলপার্ক এসে গেল । আর তখনই মনে পড়ল । জলি রায় । যৌবন শুরুর দিনের হার্টথ্রব ।
শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল সে । চার পাঁচজন মেয়ে বাস থেকে নামছিল । চোখ পিছলে গিয়েছিল একটা মেয়ের মুখ থেকে মরাল গ্রীবা হয়ে পুরো শরীরেরই । মুখটা বেশ কাব্যিক কাব্যিক । চলার সময় দেখেছিল হাঁটার ছন্দটা স্বাভাবিক নয় ছান্দিক । গজগামিনী কথাটা মনে হয়েছিল সেদিনই । অনেকপরে জানতে পেরেছিল ওর বাঁ পা একটু ছোট তাই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে । রাতুলের মনে হয়েছিল ওই খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যেই রয়েছে মনে দোলা দেওয়া ছন্দটা ।
ওকে দেখার জন্যে প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ডে চলে যেত । মুগ্ধ হয়ে দেখত দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটাকে । জলি রায় ফিরেও তাকাত না কোনদিন ।
কলেজে ভর্তি হবার পর একটু কাছে থেকে দেখার সুযোগ হল । ওর চাইতে একবছরের সিনিয়র । সিনিয়র দাদা-দিদিদের সঙ্গে থাকে । তবে দাদাদের ভিড়ের মধ্যেই বেশি থাকে সে । কথা বলার সুযোগ পাওয়া মুশকিল । সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেওনি কোনদিন । ভালোবাসা নয় ভালো লাগাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তখনকার মতো ।
পূজোর ছুটিতে মনীশদের বাড়িতে গিয়েছিল রাতুল । বাড়ির অদূরেই চা বাগান । বাগান ঘুরে নদীর দিকে গিয়েছিল ওরা । নদীটার মতো নদীর নামটাও সুন্দর । আংড়াভাসা । ওখানেই দেখা হয়েছিল জলি রায়ের সাথে । ওকে দেখে জলি রায় মনীশকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ও আমাদের কলেজে পড়ে না ? তোর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বুঝি ? অতো হ্যাবলা কেন রে !” সঙ্গী ছোটখাট চেহারার শ্যামলা মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠেছিল । অপমানে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল রাতুল ।
মনীশ বন্ধুকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে বলেছিল, “ও একটু লাজুক, তবে ভালো গান গায় ।”
গান শব্দটাই যেন জলি রায়কে মুহূর্তে বদলে দিয়েছিল । রাতুলের কাঁধে হাত রেখে খুব নরমস্বরে বলেছিল, “এমনিই একটু মজা করলাম যাকে বলে রিগিং আর কি । কিছু মনে কোরো না ভাই ।”
রাতুল ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছিল তখন । তার উপর ভাই শব্দটা ওকে যেন আরো বেশি তাতিয়ে দিয়েছিল । সে বেশ কঠিন স্বরে বলেছিল, “কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখলেই যদি হ্যাবলা হয় তবে তো মানুষ মানুষকে দেখবেই না । সুন্দরী বলে আপনার খুব অহংকার তাই না ? জেনে রাখবেন সৌন্দর্য নয় মানুষের গুণই মানুষকে মহান করে ।”
ক্ষমা চেয়েছিল জলি রায় । ক্ষমা চেয়েছিল জলি রায়ের সঙ্গের মেয়েটিও । মেয়েটার নাম অঞ্জনা । রাতুলকে এরপর সহজে ছাড়েনি ওরা । গান শোনাতে হয়েছিল ওদের । গানের সুরের ভেলায় সব মান, অপমান, ক্ষোভ, জড়তা সব ভেসে গিয়েছিল আংড়াভাসার স্রোতে । নদীর জলজ হাওয়ায় সিক্ত হয়েছিল রাতুল ।
কলেজে দেখা হলে ‘কেমন আছো’, ‘গান কেমন চলছে’ এই গোত্রের কথাবার্তা ছাড়া অন্য কিছু বলত না জলি রায় । সিনিয়র জুনিয়রের চৌকাঠটা তো ছিলই, তার উপর রাতুল লাজুক আর অন্তর্মুখী ছেলে । বেশি কাছে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি । কিন্তু জলি রায়ে মজেছিল রাতুল । গয়েরকাটায় গেলে একটু বেশি কথা বলা যায় তাই মাঝে মাঝে মনীশের সঙ্গে যেতও । আংড়ভাসা নদীর ধারে দেখা হত জলি রায় ও অঞ্জনার সাথে । গান গাইতে হত ওকে । জলি রায়ের উপস্থিতিতে গান গাইতে ভালোই লাগত রাতুলের । সমস্যা হত অঞ্জনাকে নিয়ে । বড্ডো গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে । পরের বছর আবার ওদের কলেজেই ভর্তি হয়েছিল অঞ্জনা দাম । খুব জ্বালিয়েছিল দু’বছর ।
মনীশের কাছেই শুনেছিল জলি রায় গয়েরকাটার অনেক ছেলেকেই নাচিয়ে বেড়ায় । কলেজের ব্যাপারটা তো রাতুল নিজেই জানে । রাতুল নিজেকে অনেকভাবে বুঝিয়েছে তবু ভেতরে ভেতরে খুব ছটফট করত । দাদাদের মতো হ্যাংলাপনা করতে পারত না সে । কল্পলোকে বিচরণ করত জলি রায়ের সঙ্গে ।
কলেজ লাইফ হল জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময় । এ সময় প্রেম আসে গান আর কবিতার মধ্য দিয়ে । অবশ্য সবাই জীবনটাকে সেভাবে উপভোগ করে না । ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুশৃঙ্খল এবং কঠোর পরিশ্রম করে কলেজের পাঠ শেষ করে । যেমন মনীশ । এমনিতেই পড়াশুনায় খুব ভাল ছেলে । তার উপর অধ্যবসায় । সে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছিল আর রাতুল কোনটাই পারছিল না। জলি রায় নামে একটা বল্গাহীন নদীকে বাঁধতেও পারল না, অবগাহন করতেও পারল না । ঝরনার মতো উচ্ছ্বল আংড়াভাসার সৌন্দর্যে সে শুধু মুগ্ধ হয়েই রইল । সোনালি সময় কখন যে ভেসে গেল টেরও পেল না । জলি রায় পড়া সাঙ্গ করে চলে গেল একদিন । এতদিন পর জলি রায় আবার ওকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
কোন কাজেই মন বসাতে পারছে না রাতুল । গানের সুর তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার । অস্থির অস্থির করছে শরীর ও মন। অন্বেষার কথার উত্তর দিতেও ভুলে যাচ্ছে । অন্বেষা বারবার জানতে চাইছে, “কী হয়েছে তোমার ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?” রাতুল কোন উত্তর না দিয়ে শুয়ে পড়ে সোফাটাতেই ।
পৃথিবীতে যতদিন জীবন থাকবে ততদিন গানও থাকবে গুরুদেবের এ কথাটা বিশ্বাস করে সে । মানুষের জীবনের শোক-দুঃখ ভোলাতে পারে গান- বলেছিলেন গুরুদেব জয়ন্ত চৌধুরী । সে তো গান আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিল । এষা-অন্বেষা আর গান নিয়ে জীবনটা চলছিলও । হঠাৎ আবার কি যে হয়ে গেল ! মনটা জলি রায়ময় হয়ে রইল । বিরহী যক্ষের মতো ভেসে বেড়ালো প্রেমের আকাশে । একাই ।
খুব ভোরে উঠে পড়ল রাতুল । অন্বেষা পাশ ফিরে শুল । জানতে চাইল, “কী উঠে পড়লে যে !”
রাতুল ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “শরীরটা কাল থেকে ভাল লাগছে না । মনে হয় ব্লাডসুগার হচ্ছে । ক’দিন মর্নিংওয়াক করে দেখি না হলে ডাক্তার দেখাতে হবে ।”
অন্বেষা উঠে বসল তড়াক করে । চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছো !”
-হাঁ, এতে অবাক হবার কি আছে ! বয়স হচ্ছে । চাইলে তুমিও যেতে পার আমার সঙ্গে । অবশ্য মনে মনে ভাবছিল অন্বেষা যেতে চাইলেই তো সব ভেস্তে গেল ।
অন্বেষা আবার শুয়ে পড়ল, “না বাবা, আমার অত শখ নেই । তোমার ইচ্ছে হয়েছে তুমিই যাও । দেখি এ শখ আবার কতদিন থাকে। দরজাটা টেনে দিয়ে যেও ।”
বাসে করে গেল গোলপার্ক অবধি । তারপর হাঁটতে শুরু করল সাদার্ণ অ্যাভেনিউ ধরে । রাস্তায় কত লোক ! কেউ হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাস বা ট্যাক্সির জন্য । অনেকের সঙ্গে ব্যাগপত্তর আছে । হয়ত দূরে কোথাও যাবে তারা । বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে মা অথবা বাবা । ইউনিফর্ম আর স্কুল ব্যাগ দেখে বোঝা যায় বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে ।
কয়েকটা বড় বাড়ির গাড়িবারান্দায় কিছু মানুষ শয্যা পেতেছে । কেয়াতলার কাছে একটা গাড়িবারান্দায় একজোড়া নারী-পুরুষের সঙ্গে একটা ছোট্ট দুধের শিশু । শিশু মায়ের খোলা বুকে তার স্তনে মুখ দিয়ে স্তনপান করছে না স্তনপান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে ! পুরুষটির পরনের নোংরা লুঙ্গী বুকে উঠে গেছে হয়ত বা ভোরের হাল্কা ঠাণ্ডায় ।
কল্লোলিনী কোলকাতার পেটে আর একটা কোলকাতা আছে জানা ছিল না রাতুলের । গুরুদেব জয়ন্ত চৌধুরীর কাছে গান শিখতে জলপাইগুড়ি থেকে একদিন কোলকাতায় এসেছিল সে । তারপর গুরুদেবের ইচ্ছেয় এবং অনুরোধে তাঁর ডিভোর্সি কন্যাকে বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে কোলকাতায় থেকে গেছে । জলপাইগুড়ির সঙ্গে এখনও যোগাযোগ থাকলেও গয়েরকাটার সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই ।
এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটল । দেখা মিলল না জলি রায়ের । দ্বিতীয়বার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড পর্যন্ত হেঁটে ফিরছিল সে । বিবেকানন্দ পার্কের সামনে এসে পা পিছলে গেল । কোনক্রমে সামলে নিয়েছে । কুকুরের বিষ্ঠায় পা পড়ে জুতোর যা অবস্থা ! ফুটপাতের সবুজ ঘাসে পা ঘষতে ঘষতে দেখল ওরা আসছে । বুকের ভেতরে জোরে জোরে ড্রাম বাজতে শুরু করেছে উৎকণ্ঠার অবসানে । শব্দ শুনতে না পারলেও কাঁপুনি টের পাচ্ছে ।
-আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো ? পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে ফিরে এসে আচমকাই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় জলি রায় ।
শরীর কাঁপছে । গলা শুকিয়ে গেছে । উত্তর দিতে গিয়ে তোতলাতে লাগল, “চিনতে পারছেন না আমাকে !”
-কে বলুন তো ? দ্বিধাজড়নো স্বর জলি রায়ের । আগের চেয়ে দৃষ্টিটা একটু নরম । একটু কৌতুহলী । রাতুল স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে, “আমি রাতুল । মনীশের বন্ধু । এ,সি, কলেজ ।”
-আর বলতে হবে না । হাঁ, এবার মনে পড়েছে । খুব ভালো গান গাইতে তুমি । মনীশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও ? ও তো দিল্লীতে থাকে শুনেছি । তুমি বুঝি কোলকাতায় থাকো ? এই যে শোনো, আমার কলেজের বন্ধু ।
অনেকটা এগিয়ে যাওয়া মানুষটা ফিরে আসেন অনিচ্ছাসত্বেও । মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার কষাটে দৃষ্টি বর্ষিত হল রাতুলের উপর । যেন মহা অপরাধ করে বসেছে সে ।
-আমার হাজ্ব্যান্ড দেবাংশু দেব । রাতুল – বলে ভুলে গিয়ে জলি রায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী যেন ?” রাতুল হেসে মনে করিয়ে দিল, “সেন ।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাতুল সেন । ও খুব ভালো গান গাইত ।”
ব্যস ! এটুকুই । স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে ।” রাতুলের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় জলি রায় ।
জলি রায় এখনও একইরকম । সেই সম্মোহনী হাসি, উদ্ধত চাউনি, দুর্নিবার । আংড়াভাসা নদীর মতো । কে জানে আংড়াভাসা তেমনই আছে কিনা ! জলপাইগুড়ির করলা নদী কেমন বুজে গেছে । তিস্তার তো শুধু কঙ্কালটা পড়ে আছে । রাতুলের প্রেমটা মরেনি ! ‘গজগামিনী’র চলার ছন্দে সে কাঁপছে এখন । ভাবছে কীভাবে সে গজগামিনীর কাছে পৌঁছাবে ? তাকে যে ওর কাছে পৌঁছাতে হবেই । চণ্ডীদাস নাকি ১২ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল রজকিনীর জন্যে পুকুরঘাটে ছিপ ফেলে ! ওর জীবন থেকে দেড়খানা ১২ বছর হারিয়ে গেছে । তবু হার মানবে না । দক্ষিণী বাতাস ক্ষিদেটা বাড়িয়ে দিল রাতুলের ।
কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে অন্বেষা, রাতুল গুন গুন করে একটা গানই গায় আজকাল । “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি ।” যখন রেওয়াজে বসে তখন আবার আনমনা হয়ে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় । শরীরটা কি বেশি খারাপ হল নাকি ! কিন্তু মর্নিং ওয়াকে তো ঠিক যাচ্ছে প্রতিদিন ! অন্বেষা একদিন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার তোমার ? সত্যিই শরীর খারাপ নাকি প্রেম-টেমে পড়েছো বল তো ? যদি তাই হয় তবে এষা আর আমি মিলে চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ঘোরাব সেই বেটিকে আগেই বলে রাখলাম । আর তোমাকে – সেটা না হয় এখন নাই বললাম ।” মুখে ওকথা বললেও মনটা কু ডাকে। একবার ঘর ভেঙ্গেছে তার । ভালোবাসার ঘর বারবার গড়া যায় না সে বোঝে সেটা । কৌশিকের সঙ্গে ছাড়ছাড়ি হবার পর নিজের কেরিয়ারের ভীষণ ক্ষতি তো হয়েছেই গানটাও ভুলে যাচ্ছিল প্রায় ।
রাতুল অবশ্য খুবই ভালো মানুষ । উত্তরবঙ্গের সবুজ প্রকৃতির মতোই মনটাও চির সবুজ ওর । বাবার মান রাখতে অন্বেষাকে বিয়ে করেছিল সে । কোনদিন ওকে অসম্মান করেনি । ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে ওর জীবন, বরং অন্বেষারই অসুবিধে হয়েছিল কৌশিকের জায়গায় ওকে মেনে নিতে । ভালোবাসা এসেছে অনেক দেরিতে । এষা পেটে আসার পর । তার আগে নির্জীবের মতো পড়ে থাকত অন্বেষা । রাতুল পাগলের মতো আদর করত । একটানা আদরে অন্বেষার শরীর এক সময় সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে গ্রহন করত রাতুলের শরীরের নির্যাস । সেভাবেই একদিন এষা এসে গেল ভালোবাসার দাবী নিয়ে । মাতৃত্ব জেগে উঠল অন্বেষার শরীরে, মনে জন্মালো মাতৃত্বের গর্ব । রাতুল হয়ে উঠল ভালোবাসার পুরুষ ।
দিন সাতেক পর রাতে খাবার টেবিলে এষা গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, “বাবা, কাল সকালে আমরাও তোমার সাথে বের হব । মামনি আমাকে সুইমিং ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছে । তুমি গিয়ে বসে না থাকলে কিন্তু আমি জলে নামব না । ও বাবা, বসে থাকবে তো ?”
চমকে উঠল রাতুল । অন্বেষা কি কিছু টের পেয়ে গেছে নাকি ! সর্বনাশ ! জলি রায়ের সাথে দেখা হলে জলি রায় এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় । রাতুলও হাসি ফিরিয়ে দেয় । এর বেশি এখনও এগোতে পারেনি সে ।
অন্বেষা খাবারের প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল, “কিছুদিন আমরা দুজনেই বসে থাকব না হয় । তারপর ওকে সুইমিং-এ নামিয়ে দিয়ে আমিও তোমার সাথে মর্নিংওয়াক করে নেব । মাত্র তো তিনমাস । তারপর সুইমিং বন্ধ থাকবে সেই মার্চ মাস পর্যন্ত ।”
রাতুল জানে সে সুপুরুষ নয় । এ নিয়ে খুব দুঃখও ছিল মনে । কিন্তু এষার সুইমিং ক্লাবে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে তার দুঃখ ঘুচে গেল । দেখল অনেকেই চেনে ওকে । খাতিরও করে ভালো গায় বলে । ভাগ্যের সঙ্গে লড়তে থাকা রাতুল সেনের যে এত মহিলা ফ্যান আছে সেটা জানতই না সে । মানুষ এখনও গুণের কদর করে ! গানটা ছাড়লে তো চলবে না । এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত- এটা ভাবতে ভাবতেই কবে যে জলি রায়ের ভূতটা ঘাড় থেকে নেমে গেছে জানতেই পারল না সে ।
গজগামিনী
সারারাত ধরে চলেছিল জলসা । উদ্যোক্তরা গাড়ি করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিল । গাড়িটা নেয়নি ভোরের হাওয়ায় হাঁটবে বলে । অনেকদিন ভোর দেখা হয়নি ব্যস্ততার মধ্যে । সকালে ঘুম থেকে উঠে গুরুপ্রণাম, রেওয়াজ – এটাই ওর প্রাত্যহিক রুটিন ।
সাদার্ণ অ্যাভেনিউ রাতুলের কাছে নতুন নয় কিন্তু সকালের পথটা ওর কাছে নতুনই । লেক কালীবাড়িতে মিশ্র ভারত। মহিলাদের সংখ্যাও ভালই । হাঁটার ফাঁকে কেউ কেউ প্রণাম ঠুকে নিচ্ছে একটুও না থেমে । কেউ দাঁড়িয়ে পড়ছে। অনেকে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে ভগবানের সান্নিধ্যে ।
ফুটপাতে পা ফেলতে হচ্ছে দেখে শুনে । যত্রতত্র কুকুরের বিষ্ঠা । প্রাতঃভ্রমণকারীদের সংগে কুকুরও তো কম নয় । গলায় শৃঙ্খলিত নানা জাতের সম্ভ্রান্ত কুকুর । কী তাদের চেকনাই ! রাত পাহারার পর নেড়ি কুকুরের দল এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে কোথাও । বিবেকানন্দ পার্কে একাধারে চলছে শরীরচর্চা আর একধারে ক্রিকেট কোচিং । শহরটা যে এত সকালে জেগে ওঠে জানাই ছিল না। মনের মধ্যে নতুন একটা সুর ভাঁজে সে । ভৈরব রাগে । রাতজাগার ক্লান্তি ভুলে ভোরের আলোয় ফিনিক্স পাখির মতো নতুন করে জেগে উঠছে রাতুল ।
দীর্ঘাঙ্গী এক মহিলার সঙ্গে মোটাসোটা একটা মানুষ আসছে উল্টোদিক থেকে । মহিলার পরনে শাড়ি । চলনে বেশ একটা ছন্দ খুঁজে পেল রাতুল । ‘গজগামিনী’ শব্দটা মনে পড়ে গেল অনেকদিন বাদে । বিপরীত মুখী তিনটে মানুষ মুখোমুখি হল । পরস্পরকে অতিক্রম করেও গেল । ওরই মধ্যে রাতুল দেখে নিয়েছে গজগামিনীকে । উজ্জল শ্যামবর্ণা এবং বয়স হলেও এখনও রীতিমতো সুন্দরী । সঙ্গী ভদ্রলোকের কালো মোটা চেহারা আর সাদা টি শার্টের কথা ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না । সুন্দরী মহিলার সঙ্গীকে কেই বা দেখে সেভাবে ! চৌম্বকীয় তত্ত্ব যে ভ্রান্ত হয়ে যেত তাহলে !
গজগামিনীর মুখটা খুব খুব চেনা ! অবশ্য রূপসী মহিলাদের সবাইকেই চেনা মনে হয় পুরুষের । এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই । গজগামিনীর দুলকিতে সুরটা কোথায় তলিয়ে গেছে । রাতুল এখন ভদ্রমহিলার মুখটা মনে করার সাথে সাথে ডুব দিচ্ছে স্মৃতির জলাশয়ে । কিছুই উঠছে না । মনের গোলকধাঁধায় পাঁক খেতে খেতে গোলপার্ক এসে গেল । আর তখনই মনে পড়ল । জলি রায় । যৌবন শুরুর দিনের হার্টথ্রব ।
শান্তিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিল সে । চার পাঁচজন মেয়ে বাস থেকে নামছিল । চোখ পিছলে গিয়েছিল একটা মেয়ের মুখ থেকে মরাল গ্রীবা হয়ে পুরো শরীরেরই । মুখটা বেশ কাব্যিক কাব্যিক । চলার সময় দেখেছিল হাঁটার ছন্দটা স্বাভাবিক নয় ছান্দিক । গজগামিনী কথাটা মনে হয়েছিল সেদিনই । অনেকপরে জানতে পেরেছিল ওর বাঁ পা একটু ছোট তাই একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে । রাতুলের মনে হয়েছিল ওই খুঁড়িয়ে হাঁটার মধ্যেই রয়েছে মনে দোলা দেওয়া ছন্দটা ।
ওকে দেখার জন্যে প্রতিদিন বাসস্ট্যান্ডে চলে যেত । মুগ্ধ হয়ে দেখত দীর্ঘাঙ্গী মেয়েটাকে । জলি রায় ফিরেও তাকাত না কোনদিন ।
কলেজে ভর্তি হবার পর একটু কাছে থেকে দেখার সুযোগ হল । ওর চাইতে একবছরের সিনিয়র । সিনিয়র দাদা-দিদিদের সঙ্গে থাকে । তবে দাদাদের ভিড়ের মধ্যেই বেশি থাকে সে । কথা বলার সুযোগ পাওয়া মুশকিল । সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেওনি কোনদিন । ভালোবাসা নয় ভালো লাগাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তখনকার মতো ।
পূজোর ছুটিতে মনীশদের বাড়িতে গিয়েছিল রাতুল । বাড়ির অদূরেই চা বাগান । বাগান ঘুরে নদীর দিকে গিয়েছিল ওরা । নদীটার মতো নদীর নামটাও সুন্দর । আংড়াভাসা । ওখানেই দেখা হয়েছিল জলি রায়ের সাথে । ওকে দেখে জলি রায় মনীশকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ও আমাদের কলেজে পড়ে না ? তোর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে বুঝি ? অতো হ্যাবলা কেন রে !” সঙ্গী ছোটখাট চেহারার শ্যামলা মেয়েটা খিল খিল করে হেসে উঠেছিল । অপমানে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল রাতুল ।
মনীশ বন্ধুকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে বলেছিল, “ও একটু লাজুক, তবে ভালো গান গায় ।”
গান শব্দটাই যেন জলি রায়কে মুহূর্তে বদলে দিয়েছিল । রাতুলের কাঁধে হাত রেখে খুব নরমস্বরে বলেছিল, “এমনিই একটু মজা করলাম যাকে বলে রিগিং আর কি । কিছু মনে কোরো না ভাই ।”
রাতুল ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছিল তখন । তার উপর ভাই শব্দটা ওকে যেন আরো বেশি তাতিয়ে দিয়েছিল । সে বেশ কঠিন স্বরে বলেছিল, “কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখলেই যদি হ্যাবলা হয় তবে তো মানুষ মানুষকে দেখবেই না । সুন্দরী বলে আপনার খুব অহংকার তাই না ? জেনে রাখবেন সৌন্দর্য নয় মানুষের গুণই মানুষকে মহান করে ।”
ক্ষমা চেয়েছিল জলি রায় । ক্ষমা চেয়েছিল জলি রায়ের সঙ্গের মেয়েটিও । মেয়েটার নাম অঞ্জনা । রাতুলকে এরপর সহজে ছাড়েনি ওরা । গান শোনাতে হয়েছিল ওদের । গানের সুরের ভেলায় সব মান, অপমান, ক্ষোভ, জড়তা সব ভেসে গিয়েছিল আংড়াভাসার স্রোতে । নদীর জলজ হাওয়ায় সিক্ত হয়েছিল রাতুল ।
কলেজে দেখা হলে ‘কেমন আছো’, ‘গান কেমন চলছে’ এই গোত্রের কথাবার্তা ছাড়া অন্য কিছু বলত না জলি রায় । সিনিয়র জুনিয়রের চৌকাঠটা তো ছিলই, তার উপর রাতুল লাজুক আর অন্তর্মুখী ছেলে । বেশি কাছে যাওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি । কিন্তু জলি রায়ে মজেছিল রাতুল । গয়েরকাটায় গেলে একটু বেশি কথা বলা যায় তাই মাঝে মাঝে মনীশের সঙ্গে যেতও । আংড়ভাসা নদীর ধারে দেখা হত জলি রায় ও অঞ্জনার সাথে । গান গাইতে হত ওকে । জলি রায়ের উপস্থিতিতে গান গাইতে ভালোই লাগত রাতুলের । সমস্যা হত অঞ্জনাকে নিয়ে । বড্ডো গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে । পরের বছর আবার ওদের কলেজেই ভর্তি হয়েছিল অঞ্জনা দাম । খুব জ্বালিয়েছিল দু’বছর ।
মনীশের কাছেই শুনেছিল জলি রায় গয়েরকাটার অনেক ছেলেকেই নাচিয়ে বেড়ায় । কলেজের ব্যাপারটা তো রাতুল নিজেই জানে । রাতুল নিজেকে অনেকভাবে বুঝিয়েছে তবু ভেতরে ভেতরে খুব ছটফট করত । দাদাদের মতো হ্যাংলাপনা করতে পারত না সে । কল্পলোকে বিচরণ করত জলি রায়ের সঙ্গে ।
কলেজ লাইফ হল জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময় । এ সময় প্রেম আসে গান আর কবিতার মধ্য দিয়ে । অবশ্য সবাই জীবনটাকে সেভাবে উপভোগ করে না । ভবিষ্যতের কথা ভেবে সুশৃঙ্খল এবং কঠোর পরিশ্রম করে কলেজের পাঠ শেষ করে । যেমন মনীশ । এমনিতেই পড়াশুনায় খুব ভাল ছেলে । তার উপর অধ্যবসায় । সে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাওয়ার পথ খুঁজে নিচ্ছিল আর রাতুল কোনটাই পারছিল না। জলি রায় নামে একটা বল্গাহীন নদীকে বাঁধতেও পারল না, অবগাহন করতেও পারল না । ঝরনার মতো উচ্ছ্বল আংড়াভাসার সৌন্দর্যে সে শুধু মুগ্ধ হয়েই রইল । সোনালি সময় কখন যে ভেসে গেল টেরও পেল না । জলি রায় পড়া সাঙ্গ করে চলে গেল একদিন । এতদিন পর জলি রায় আবার ওকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।
কোন কাজেই মন বসাতে পারছে না রাতুল । গানের সুর তুলতে গিয়েও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার । অস্থির অস্থির করছে শরীর ও মন। অন্বেষার কথার উত্তর দিতেও ভুলে যাচ্ছে । অন্বেষা বারবার জানতে চাইছে, “কী হয়েছে তোমার ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?” রাতুল কোন উত্তর না দিয়ে শুয়ে পড়ে সোফাটাতেই ।
পৃথিবীতে যতদিন জীবন থাকবে ততদিন গানও থাকবে গুরুদেবের এ কথাটা বিশ্বাস করে সে । মানুষের জীবনের শোক-দুঃখ ভোলাতে পারে গান- বলেছিলেন গুরুদেব জয়ন্ত চৌধুরী । সে তো গান আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে চেয়েছিল । এষা-অন্বেষা আর গান নিয়ে জীবনটা চলছিলও । হঠাৎ আবার কি যে হয়ে গেল ! মনটা জলি রায়ময় হয়ে রইল । বিরহী যক্ষের মতো ভেসে বেড়ালো প্রেমের আকাশে । একাই ।
খুব ভোরে উঠে পড়ল রাতুল । অন্বেষা পাশ ফিরে শুল । জানতে চাইল, “কী উঠে পড়লে যে !”
রাতুল ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “শরীরটা কাল থেকে ভাল লাগছে না । মনে হয় ব্লাডসুগার হচ্ছে । ক’দিন মর্নিংওয়াক করে দেখি না হলে ডাক্তার দেখাতে হবে ।”
অন্বেষা উঠে বসল তড়াক করে । চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি মর্নিং ওয়াকে যাচ্ছো !”
-হাঁ, এতে অবাক হবার কি আছে ! বয়স হচ্ছে । চাইলে তুমিও যেতে পার আমার সঙ্গে । অবশ্য মনে মনে ভাবছিল অন্বেষা যেতে চাইলেই তো সব ভেস্তে গেল ।
অন্বেষা আবার শুয়ে পড়ল, “না বাবা, আমার অত শখ নেই । তোমার ইচ্ছে হয়েছে তুমিই যাও । দেখি এ শখ আবার কতদিন থাকে। দরজাটা টেনে দিয়ে যেও ।”
বাসে করে গেল গোলপার্ক অবধি । তারপর হাঁটতে শুরু করল সাদার্ণ অ্যাভেনিউ ধরে । রাস্তায় কত লোক ! কেউ হাঁটছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে বাস বা ট্যাক্সির জন্য । অনেকের সঙ্গে ব্যাগপত্তর আছে । হয়ত দূরে কোথাও যাবে তারা । বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে মা অথবা বাবা । ইউনিফর্ম আর স্কুল ব্যাগ দেখে বোঝা যায় বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে ।
কয়েকটা বড় বাড়ির গাড়িবারান্দায় কিছু মানুষ শয্যা পেতেছে । কেয়াতলার কাছে একটা গাড়িবারান্দায় একজোড়া নারী-পুরুষের সঙ্গে একটা ছোট্ট দুধের শিশু । শিশু মায়ের খোলা বুকে তার স্তনে মুখ দিয়ে স্তনপান করছে না স্তনপান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে ! পুরুষটির পরনের নোংরা লুঙ্গী বুকে উঠে গেছে হয়ত বা ভোরের হাল্কা ঠাণ্ডায় ।
কল্লোলিনী কোলকাতার পেটে আর একটা কোলকাতা আছে জানা ছিল না রাতুলের । গুরুদেব জয়ন্ত চৌধুরীর কাছে গান শিখতে জলপাইগুড়ি থেকে একদিন কোলকাতায় এসেছিল সে । তারপর গুরুদেবের ইচ্ছেয় এবং অনুরোধে তাঁর ডিভোর্সি কন্যাকে বিয়ে করে পাকাপাকিভাবে কোলকাতায় থেকে গেছে । জলপাইগুড়ির সঙ্গে এখনও যোগাযোগ থাকলেও গয়েরকাটার সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই ।
এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটল । দেখা মিলল না জলি রায়ের । দ্বিতীয়বার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি রোড পর্যন্ত হেঁটে ফিরছিল সে । বিবেকানন্দ পার্কের সামনে এসে পা পিছলে গেল । কোনক্রমে সামলে নিয়েছে । কুকুরের বিষ্ঠায় পা পড়ে জুতোর যা অবস্থা ! ফুটপাতের সবুজ ঘাসে পা ঘষতে ঘষতে দেখল ওরা আসছে । বুকের ভেতরে জোরে জোরে ড্রাম বাজতে শুরু করেছে উৎকণ্ঠার অবসানে । শব্দ শুনতে না পারলেও কাঁপুনি টের পাচ্ছে ।
-আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো ? পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে ফিরে এসে আচমকাই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় জলি রায় ।
শরীর কাঁপছে । গলা শুকিয়ে গেছে । উত্তর দিতে গিয়ে তোতলাতে লাগল, “চিনতে পারছেন না আমাকে !”
-কে বলুন তো ? দ্বিধাজড়নো স্বর জলি রায়ের । আগের চেয়ে দৃষ্টিটা একটু নরম । একটু কৌতুহলী । রাতুল স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে, “আমি রাতুল । মনীশের বন্ধু । এ,সি, কলেজ ।”
-আর বলতে হবে না । হাঁ, এবার মনে পড়েছে । খুব ভালো গান গাইতে তুমি । মনীশের সঙ্গে যোগাযোগ আছে এখনও ? ও তো দিল্লীতে থাকে শুনেছি । তুমি বুঝি কোলকাতায় থাকো ? এই যে শোনো, আমার কলেজের বন্ধু ।
অনেকটা এগিয়ে যাওয়া মানুষটা ফিরে আসেন অনিচ্ছাসত্বেও । মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমার ভেতর দিয়ে বিরক্তি আর বিতৃষ্ণার কষাটে দৃষ্টি বর্ষিত হল রাতুলের উপর । যেন মহা অপরাধ করে বসেছে সে ।
-আমার হাজ্ব্যান্ড দেবাংশু দেব । রাতুল – বলে ভুলে গিয়ে জলি রায় ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী যেন ?” রাতুল হেসে মনে করিয়ে দিল, “সেন ।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ, রাতুল সেন । ও খুব ভালো গান গাইত ।”
ব্যস ! এটুকুই । স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, “চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে ।” রাতুলের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় জলি রায় ।
জলি রায় এখনও একইরকম । সেই সম্মোহনী হাসি, উদ্ধত চাউনি, দুর্নিবার । আংড়াভাসা নদীর মতো । কে জানে আংড়াভাসা তেমনই আছে কিনা ! জলপাইগুড়ির করলা নদী কেমন বুজে গেছে । তিস্তার তো শুধু কঙ্কালটা পড়ে আছে । রাতুলের প্রেমটা মরেনি ! ‘গজগামিনী’র চলার ছন্দে সে কাঁপছে এখন । ভাবছে কীভাবে সে গজগামিনীর কাছে পৌঁছাবে ? তাকে যে ওর কাছে পৌঁছাতে হবেই । চণ্ডীদাস নাকি ১২ বছর ধরে অপেক্ষা করছিল রজকিনীর জন্যে পুকুরঘাটে ছিপ ফেলে ! ওর জীবন থেকে দেড়খানা ১২ বছর হারিয়ে গেছে । তবু হার মানবে না । দক্ষিণী বাতাস ক্ষিদেটা বাড়িয়ে দিল রাতুলের ।
কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছে অন্বেষা, রাতুল গুন গুন করে একটা গানই গায় আজকাল । “মনে পড়ে রুবি রায় কবিতায় তোমাকে একদিন কত করে ডেকেছি ।” যখন রেওয়াজে বসে তখন আবার আনমনা হয়ে গিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায় । শরীরটা কি বেশি খারাপ হল নাকি ! কিন্তু মর্নিং ওয়াকে তো ঠিক যাচ্ছে প্রতিদিন ! অন্বেষা একদিন জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার তোমার ? সত্যিই শরীর খারাপ নাকি প্রেম-টেমে পড়েছো বল তো ? যদি তাই হয় তবে এষা আর আমি মিলে চুলের মুঠি ধরে রাস্তায় ঘোরাব সেই বেটিকে আগেই বলে রাখলাম । আর তোমাকে – সেটা না হয় এখন নাই বললাম ।” মুখে ওকথা বললেও মনটা কু ডাকে। একবার ঘর ভেঙ্গেছে তার । ভালোবাসার ঘর বারবার গড়া যায় না সে বোঝে সেটা । কৌশিকের সঙ্গে ছাড়ছাড়ি হবার পর নিজের কেরিয়ারের ভীষণ ক্ষতি তো হয়েছেই গানটাও ভুলে যাচ্ছিল প্রায় ।
রাতুল অবশ্য খুবই ভালো মানুষ । উত্তরবঙ্গের সবুজ প্রকৃতির মতোই মনটাও চির সবুজ ওর । বাবার মান রাখতে অন্বেষাকে বিয়ে করেছিল সে । কোনদিন ওকে অসম্মান করেনি । ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে ওর জীবন, বরং অন্বেষারই অসুবিধে হয়েছিল কৌশিকের জায়গায় ওকে মেনে নিতে । ভালোবাসা এসেছে অনেক দেরিতে । এষা পেটে আসার পর । তার আগে নির্জীবের মতো পড়ে থাকত অন্বেষা । রাতুল পাগলের মতো আদর করত । একটানা আদরে অন্বেষার শরীর এক সময় সাড়া দিতে বাধ্য হয়ে গ্রহন করত রাতুলের শরীরের নির্যাস । সেভাবেই একদিন এষা এসে গেল ভালোবাসার দাবী নিয়ে । মাতৃত্ব জেগে উঠল অন্বেষার শরীরে, মনে জন্মালো মাতৃত্বের গর্ব । রাতুল হয়ে উঠল ভালোবাসার পুরুষ ।
দিন সাতেক পর রাতে খাবার টেবিলে এষা গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, “বাবা, কাল সকালে আমরাও তোমার সাথে বের হব । মামনি আমাকে সুইমিং ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছে । তুমি গিয়ে বসে না থাকলে কিন্তু আমি জলে নামব না । ও বাবা, বসে থাকবে তো ?”
চমকে উঠল রাতুল । অন্বেষা কি কিছু টের পেয়ে গেছে নাকি ! সর্বনাশ ! জলি রায়ের সাথে দেখা হলে জলি রায় এক টুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে এগিয়ে যায় । রাতুলও হাসি ফিরিয়ে দেয় । এর বেশি এখনও এগোতে পারেনি সে ।
অন্বেষা খাবারের প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল, “কিছুদিন আমরা দুজনেই বসে থাকব না হয় । তারপর ওকে সুইমিং-এ নামিয়ে দিয়ে আমিও তোমার সাথে মর্নিংওয়াক করে নেব । মাত্র তো তিনমাস । তারপর সুইমিং বন্ধ থাকবে সেই মার্চ মাস পর্যন্ত ।”
রাতুল জানে সে সুপুরুষ নয় । এ নিয়ে খুব দুঃখও ছিল মনে । কিন্তু এষার সুইমিং ক্লাবে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে তার দুঃখ ঘুচে গেল । দেখল অনেকেই চেনে ওকে । খাতিরও করে ভালো গায় বলে । ভাগ্যের সঙ্গে লড়তে থাকা রাতুল সেনের যে এত মহিলা ফ্যান আছে সেটা জানতই না সে । মানুষ এখনও গুণের কদর করে ! গানটা ছাড়লে তো চলবে না । এটাই তার একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত- এটা ভাবতে ভাবতেই কবে যে জলি রায়ের ভূতটা ঘাড় থেকে নেমে গেছে জানতেই পারল না সে ।
……..
জলি রায় এখনও একইরকম । সেই সম্মোহনী হাসি, উদ্ধত চাউনি, দুর্নিবার । আংড়াভাসা নদীর মতো । কে জানে আংড়াভাসা তেমনই আছে কিনা ! জলপাইগুড়ির করলা নদী কেমন বুজে গেছে । তিস্তার তো শুধু কঙ্কালটা পড়ে আছে । রাতুলের প্রেমটা মরেনি ! ‘গজগামিনী’র চলার ছন্দে সে কাঁপছে এখন । ভাবছে কীভাবে সে গজগামিনীর কাছে পৌঁছাবে ? ……..