॥ হাত ঘড়ি ॥
-------------------
রজত দাস
সকালে অফিস বের হবার এই সময়টাতে এত তাড়াহুড়ো করি যে বলার নয় ! প্রতিদিন কিছু না কিছু ভুলবই ভুলব । কোনোদিন কলম...More
গল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা, প্রবন্ধ ও কবিতার ফেরিওয়ালা...
Book Summary
॥ হাত ঘড়ি ॥
-------------------
রজত দাস
সকালে অফিস বের হবার এই সময়টাতে এত তাড়াহুড়ো করি যে বলার নয় ! প্রতিদিন কিছু না কিছু ভুলবই ভুলব । কোনোদিন কলম তো কোনোদিন রুমাল । বেশিরভাগ দিন যেটা ভুলি সেটা হল হাতঘড়িটা পরতে । মোবাইল ফোনের এই জমানায় সেভাবে দেখতে গেলে হাতঘড়ি ছাড়াও দিন নিস্তরঙ্গভাবেই কেটে যায় । হাতে ঘড়ি ছাড়াও নির্বিঘ্নে সময় দেখার জন্যে আজকাল ফোনই যথেষ্ট । কিন্তু আমার ব্যাপারটা আলাদা । মাধ্যমিকে লেটার নিয়ে পাশ করার পরে বাবা নামী কোম্পানীর ঘড়িটি কিনে দিয়ে বলেছিলেন, "দেখিস এই ঘড়িটা যেন দিন যাবার সাথে সাথে আমার মত ব্রাত্য না হয়ে যায় !" সেই কারণেই ঘড়িটা হাতে সর্বদাই বেঁধে রাখি । আমার বাবা জুটমিলের সামান্য কেরানি ছিলেন । এখন অবসর যাপন করছেন । একমাত্র ছেলেকে পড়াশোনা শেখাতে নিজের সাধ্যের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করে গেছেন । বাবার সদাসর্বদা ভয়, আজকালকার নিয়মানুযায়ী সন্তান তাকে একসময়ে জীবনে ব্রাত্য করে দেবে । বেশকিছু বছর আগে মা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগে গত হয়েছেন । নিঃসঙ্গ একাকী বাবা মুর্শিদাবাদের গাঁয়ের বাড়িতে একাই থাকেন । আমি কলকাতায় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরি সূত্রে একলা মেসে থাকি । কিছুদিন আগে বাবাকে একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়ে বলেছিলাম, "এখন আর চিঠিপত্রের যুগ নেই । ফোনেই যোগাযোগ করে নিও ।" গত পরশু রাতে বাবা সেই ফোন থেকেই ফোন করে আমার খোঁজখবর নিচ্ছিলেন । গলাটা অন্যরকম লাগছে টের পেয়েছিলাম । কারণ জিজ্ঞেস করাতে এড়িয়ে গিয়েছিলেন । "ও কিছু নয় । একটু ঠান্ডা লেগেছে... তাই হয়ত ওরকম শোনাচ্ছে ।" এরপর আরো কিছু কথাবার্তা বলার পর ফোনটা রেখে দিয়েছিলেন । তারপর থেকেই আমার মনটা 'কু' গাইছে । পরদিন সকালে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । সকাল থেকে রাত ন'টা অবধি ফোন করার সময় সুযোগ পাইনি । মেসে ফিরে রাতে ফোন করেছিলাম । ফোনটা সুইচ অফ পেয়েছিলাম । তাতে আমার দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গিয়েছে । বাবাকে বলে দিয়েছিলাম ফোন যেন সুইচ অফ কখনো না করেন । বৃদ্ধ বয়েসে একা থাকেন সেজন্যই চিন্তা বেশি । বহুবার ওনাকে কলকাতায় এসে আমার সঙ্গে থাকতে অনুরোধ করেছি । উনি এলে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাট ভাড়ায় নিয়ে বাপ বেটা একসঙ্গে থাকা যেত । কিন্তু উনি সে অনুরোধ রাখলে তো ! আমার মায়ের স্মৃতি বিজড়িত পৈতৃক ভিটে ছেড়ে উনি কোথাও নড়বেন না । দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বৃদ্ধকে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারিনি ।
আজও তাড়াহুড়োতে বেরোতে গিয়ে হাতঘড়িটা পরতে ভুলে গেছি । অফিসে কাজের চাপে যথারীতি সবকিছুই ভুলে গেলাম । বাবার ফোনটা সুইচ অফ সেই দুশ্চিন্তাও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর কাজের চাপ ভুলিয়ে দিলো । এমনিতে রাত আটটার আগে অফিস থেকে বের হতেই পারি না । আজ অন্যদিনের থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাব ভেবে সন্ধ্যে ছ'টা নাগাদ বস্ কে বলে অফিস থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে পা বাড়ালাম । লিফট্ বন্ধ । ব্রেক ডাউন হয়েছে বোধহয় । অগত্যা তিনতলা ওপর থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামবার জন্য পা বাড়াতেই আধো অন্ধকার সিঁড়ির মুখে, একটা কিসে যেন আমার পা টা ঠেকল । জুতো পরা পায়ে জিনিসটা ঠেকতেই সিঁড়ি বেয়ে ছিটকে কয়েক ধাপ নিচে পড়ে গেল । নেমে গিয়ে হাতে করে সেটি তুলে দেখলাম, একটি হাতঘড়ি । একেবারে অবিকল আমারটার মতই দেখতে । যেন আমার হাতঘড়িটাই খুলে পড়ে গেছে... আশ্চর্য্য !