#বড়োদিনের_স্মৃতি
তখন কোলকাতাতেও বেজায় শীত পড়ত। মধ্যবিত্ত শীত। বড়োদিনের সাহেব পাড়া দেখতে, হুল্লোড়ে মাততে দেশী সাহেব -- মেমদের কমতি ছিলো না। তবে আমার স্মৃতি বলছে এবং কি ভীষণ মনখারাপ নিয়ে বলছে তা হলো "বড়োদিন " বড়ো আনন্দের ছিলো। ছিলো নিকানো উঠানে মাদুর, মিঠে দুপুরের রোদ আর সবার হাতে এই বড়ো কমলালেবু। ১৯৫৯ সাল। আমাদের ঘরে এক ফুট ফুটে শিশু ছিলো। তাকে লালউলের সোয়েটার আর লালটুপিতে মনে হতো যিশু স্বয়ং মাদুরের রোদে এক দঙ্গল পাঁচ থেকে দশের ছেলে মেয়েদের ঘেরাটোপে শুয়ে আছেন। তবে স্যান্টা-- ফ্যান্টাসি ছিলো না কো। মোট্টেই ছিলো না।
এই দেখো " বড়োদিন " বলতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছি। বয়স তো কম হলো না। তা আমার তখন সাত বছর। থাকি শিকড় ছিন্ন মানুষের বসতি অশোকনগরে।
আর থাকতো আত্মার আত্মীয় অনেক আত্মজন। অনেকদিন পর্যন্ত জানতাম না তাঁদের সাথে রক্তের মিশেল নেই আমাদের। তা যাই হোক আমাদের "বড়োদিন " যে ছিলো। বাবু আগের দিন গ্রেট ইস্টার্ন থেকে দুটো বড়ো কেক, মিস্টি রুটি আর এত্ত কমলালেবু আনত। তাই বলে আমরা বিত্তবান ছিলাম না। তবে মনে অনেক বিত্ত ছিলো। আমার দিদি, তিন দাদা ছিল আমার চেয়ে অন্নেক বড়োআর ছিলো আমার বড়ো বৌদি। ছোট্ট মানুষটি । মা " বড়ো" দিনের আগের দিন মস্ত উঠোন টাকে নীলমণির মাকে সাথে নিয়ে লেপে মুছে তকতকে করে রাখত।
লেপে রাখত দুটো কাঠের উনুনকেও। সে দিন যে চড়ুই ভাতি হতো। পাড়ার গোটা কুড়ি ছেলে মেয়ে মিলে অবশ্য আমিও থাকতাম এক ডালি মটর শুঁটি ছাড়াতাম বাড়ির বাগানের থেকে তোলা। আরো তুলতাম টমেটো, ফুলকপি, গাজর কিছু আলুগাছ। তার শিকড়ে ঝুলতো বড়ো,মেজো, সেজো, ছুটকি সব আলু। তা সেব মা,কাকিমা, বৌদির ব্যাপার ছিলো। কাঠের উনুনে মস্ত পেতলের হাঁড়িতে কামিনী আতপ আর পাঁচমিশালি ডাল আর বাগানের সবজি দিয়ে মা অমৃতের মতো খিচুড়ি রাঁধত। আর হতো খেজুর রসে নারকেল কোরা, চালতে থেঁতো, আর বিশাল লালমূলো চাকা চাকা করে কেটে টক। তার স্বাদ? বোঝানো যাবে না। আমরা জনা পঁচিশ বালখিল্য সবুজ কলাপাতায় সেই অমৃত রান্না পিঠে দুপুরের রোদ মেখে উঠোনে সারি বেঁধে বসে হাপুসহুপুস করে খেয়ে ফেলতাম। হ্যাঁ হ্যাঁ আর একটি জিনিস পড়ত পাতে, বাড়ির লালী -- ধলীর দুধের সরবাটা ঘি।
তোল মাটি ঘোল করে এইবার সেই রোদ্দুরের মাদুরে বসে ছোট্ট যিশুকে কোলে নিয়ে আমি মা মেরী হতেম আর আমার সামনে রাখা বাঁশের ঝুড়ির কমলালেবু সবার হাতে দিতাম। এরপর যিশুকে তার মায়ের কোলে দিয়ে শুরু হতো লেবুর খোসা চিপে চোখে দেবার খেলা।
এই খেলা শেষ হতে হতেই শীতের সূর্য সন্ধ্যার দরজায় ঘা দিয়ে টুপ করে তার আঁচলে মুখ ঢাকতো।
বাড়ি ভরে উঠত ধূপগন্ধী বাতাসে। তুলসীমঞ্চের কুলঙ্গীতে জ্বলজ্বল করত প্রদীপ শিখা।
আমাদের দঙ্গলবাহিনী আর বাড়ির সবাই দালানে শতরঞ্চির উপর ঘেঁসাঘেঁসি করে দোলাই গায়ে বসে পড়তাম বাবুকে ঘিরে। বড়ো বৌদি আর দিদি মস্ত কাঠের তিনটে বারকোশে কেক আর মিস্টিরুটি নিয়ে হাজির হতেই এক সমবেত খুশীর সুরে গোটা বাড়ি ভরে যেত। না " জিঙ্গেল বেল " নয়। এ এক এমন আনন্দের সুর যা আজ এক্কেবারে হারিয়ে গেছে। তারপর আমকাঠের হাতল লাগানো এক মস্ত ছুরি দিয়ে বাবু সেই কেক কেটে সবার হাতে দিতো। এক আঙুলের বেশী সে কেক বেশি পুরু হতো না। হবে কি করে এত্ত গুলো মানুষকে তো দিতে হবে।
আহা!!! কি স্বাদ, কি গন্ধ, কি আনন্দ মাখা ছিলো গ্রেট ইস্টার্ন থেকে আনা সেই কেক আর মিস্টিরুটির।
এবার হাত ধুয়ে, জল খেয়ে আমরা সবাই হাতজোড় করে বসতাম সামনের ঘরে। দৈর্ঘে প্রস্থে সে নেহাতই
মধ্যবিত্ত ঘর। তবু সেই ঘর বিত্তবান হয়ে উঠত এক গানের সুরে,কথায়। বাবুর গমগমে গলার সাথে মিশে যেত আমাদের বিভিন্ন সাত সুর।
" তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে
তব পুণ্য কিরণ দিয়ে যাক মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে "
আজ বড়ো বিরহ বোধকরি সেই সব দিন, সেইসব মানুষের জন্য। " সবারে আমি প্রণাম করে যাই "..
এই সায়াহ্নে এটুকুই স্মৃতির আছে।
#চিত্র_সৌজন্যে_গুগল
#স্মৃতি_চট্টোপাধ্যায়_সমাদ্দার৷৷ ( মুক্ত)