• 14 December 2020

    জীবনী

    চুপ ! ধম্মপোচার চলচে গো___

    5 120

    চুপ ! ধম্ম পোচার চলচে গো'__


    আমেরিকার শিকাগো ধর্মসম্মেলন মহাসভায় তার স্থাণ পাওয়া ও সেই বিখ্যাত মঞ্চে তার পদার্পণ এবং প্রথম উচ্চারণ' ভাতৃত্ববোধে আপ্লুত সমস্ত ইউরোপবাসী এককথায় তাকে বিশ্বখ্যাতির চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছিল। 1893 খৃষ্টাব্দের 11ই সেপ্টেম্বর বেলা দশটা। পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিগন নিজ নিজ জাতীয় পোষাকে উপবিষ্ট। ভারতীয় সনাতন ধর্মের মামুলি এক প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ। নিতান্ত অনভিজ্ঞ ও অপ্রস্তুত তিনি মঞ্চে ডাক পরলে প্রথমে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চারণ করলেন ' আমেরিকাবাসি আমার ভ্রাতা ও ভগ্নীগন ' বিশ্বভাতৃত্বের এই কথাকটায় নিহিত ছিল অপরিসীম শক্তিমন্ত্র যার মাধ্যমে রাতারাতি খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছিল তাকে।


    পরবর্তীকালে গ্রামাফোন কলে রেকর্ড চলা কালে শিষ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত গুরু রামকৃষ্ণদেবকে ভক্তদের কৌতূহলের উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গেল ' চুপ কর ধম্ম পোচার চলচে গো ___


    সেই 'কলাম্বাস হলে প্রথম উচ্চারিত শব্দের অন্তর্নিহিত শক্তি উদ্বেলিত করে তুলেছিল গোটা ভারতবর্ষকে। সমস্ত দেশ থেকে আগত সন্ন্যাসীদের যার যার প্রথামাফিক বক্তৃতায় চমক ছিল না কোন। সেই বিশ্বজনীন সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্লাবিত হয়ে উঠল মানবজাতির একাত্ববোধ,সেই ভাষণে ঝংকৃত হল বৈদিক ঋষির বাণী ও সৌভ্রাতৃত্বের একাত্বতা। শিবজ্ঞানে জীবের পূজা ও সেবা হল পরমব্রম্মের সাথে মিলিত হওয়ার একমাত্র সহজ উপায় এই ছিল তার জীবনের মূল মন্ত্র।


    প্রথম থেকেই এই ক্ষুদে প্রানাধিক শিষ্যটির গভীর বাগ্মীতা এবং দিব্যালোক প্রাপ্ত মুখের জ্যোতি আকৃষ্ট করত ঠাকুরকে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এই শিষ্যটিই ছিল তার অন্তরের একমাত্র সম্পদ যেখানে তিনি অন্য কাউকেই স্থান দিতে পারেন নি। এই নিয়ে অন্যান্য শিষ্যদিগের মধ্যে কোলাহলের ও হিংসার সীমা ছিল না। তথাপি সবকিছু অগ্রাহ্য করেও ঠাকুর এই বালসুলভ প্রকৃতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করতে পারেন নি। এটা ছিল ধ্রুব সত্য। অন্যান্য আশ্রমিকদের পরিভাষায় এর বহু মুখরোচক তথ্যের সন্ধ্যান মেলে।

    1884 সালের ঘটনা যেবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গুরুতর অসুস্থ নরেনকে দেখে বেজায় চটে উঠে বললেন " ধূর শালা, জীবে দয়ার তুই কি বুঝবি? অতি নগন্য কীটানুকীট তুই আবার কি দয়া করবি? দয়া করবার কে তুই? যে জায়গায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস সেটা কি তোর বাপের কেনা? ওসব দয়া টয়া নয়। সমস্ত জীবকে শিবজ্ঞানে পূজা করা চাই। আচমকা চমক ভেঙে নুতনভাবে সাজিয়েছিলেন জীবনের উদ্যোগ। নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন স্বামিজী" হঠাৎ যেন একটা আলোর ঝলক দেখে চমক ভাঙল। আমরা জানি সেই আলোকপ্রাপ্ত মনিষী শ্রী শ্রী ঠাকুর I সেই সময়টা কাশিপুর উদ্যানবাটিতে ভক্তদের ব্যকূল আবেগে কাটত ঠাকুরের দিনগুলো কি জানি কখন কি ঘটে ! মাথার কাছে নরেন, প্রায়ই শুনতে চাইতেন তার স্বরচিত সেই বিখ্যাত গানটি " মন চল নিজ নিকেতনে_____l


    নরেন,রাখাল,যোগীন,বাবুরাম,নিরঞ্জন,তারক,শরৎ,শশী,বুড়োগোপাল,কালী ও লাটু__ মৃত্যুর পূর্বে এই এগারোজনকে ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন শহরের দ্বারে দ্বারে। বলতেন " ভিক্ষান্ন বড় পবিত্র জিনিস রে মনে কোন কু" থাকে না। তোরাও গ্রহণ কর এই অন্ন। ঠাকুরের শারিরীক অবস্থার ক্রম অবনতি হতে থাকলে উদ্বিগ্ন হয়ে পরে নরেন। কি এক উদাসীনতা ! যেন কেহই আর অবশিষ্ট নাই তার জীবনে। মাথার উপরে ঠাকুরের হাতখানি যে কত প্রশস্ত ও ভরসার উপলব্ধি করতে পারেন মর্মে মর্মে। বুকের ভেতর কি এক কষ্ট জ্বালা কখনও ছুটছেন কখনও থামছেন কখনও ধ্যানমগ্ন অচেতন আবার কখনও চরম বিচলিত। এ যেন পরম স্থিতির সঙ্গে গভীরতার মিলন ঐশ্বরিক আলোর ঐশ্বর্যে আলোকপ্রাপ্ত সার্থক সন্ন্যাস জীবনের প্রাকলগ্ন । চরম অভীষ্টের সঙ্গে একাত্মবোধের পরিপূর্ণ একাত্মতা না আসা পর্যন্ত আভ্যন্তরীন প্রকাশের প্রসব বেদনার চরম সন্ধিক্ষণ। জপতপের এই চরম ক্ষনে ঠাকুর অন্যান্যদের উদ্দেশ্যে বলতেন " চুপ ! কথা কোস নে পচার চলছে যে ___ I


    কাশীপুর উদ্যানবাটীতে ঠাকুরের শেষ অবস্থা। সকলেই বিচলিত তার অবর্তমানে এত পরিমাণ শিষ্য পূজার্চনা এসব কোথায় স্থানান্তরিত করা হবে? সন্ন্যাস জীবনের প্রথমার্ধে যখন তিনি ব্রাম্ম সমাজের অন্তর্ভূক্ত হয়ে অস্থিরভাবে অনুসন্ধাণ করেছেন সেই পরমব্রম্মকে কিন্তু কোনখানেই সেই কাঙ্কিত পূর্ণ রুপের দেখা না পাওয়ার যন্ত্রণায় একপ্রকার উন্মাদপ্রায় অবস্থা কোথাও শান্তি নেই একমাত্র কেশব ছাড়া কোন সঙ্গই মনে ধরে না। সেই অন্তিম মুহূর্তে পরম ব্রম্ম যোগী শ্রী শ্রী ঠাকুরের সন্ধাণ পেয়ে যেমন পরম শান্তি লাভ করেছিলেন নরেন ___ এই অন্তিম চরম সময়েও সেই একই রকম দুশ্চিন্তা ও হতাশায় ব্যকূল হয়ে পড়লেন তিনি। মৃত্যুর দিন পাঁচেক পূর্বে বাটির একটি কক্ষে দরজা বন্ধ করে আসনে উপবিষ্ট দু'জনে বসলেন মুখোমুখি। বললেন ' আজ তোকে আমার জ্যোতি দান করব ' ধ্যনস্থ হ', ক্রমে ধ্যানস্থ হলে ঠাকুর ওর দুই ভ্রূর ঠিক মধ্যিখানটা মধ্যমা দিয়ে চেপে ধরে বিড়বিড় করে কি যেন আওড়াতে থাকলেন। নরেন উপলব্ধি করলেন এক দিব্য জ্যোতি ঠাকুরের শরীরের ভেতর থেকে যেন তার দেহে প্রবেশ করল। মুহূর্তে দিব্যলোকের উপস্থিতি টের পেল সে। কি এক অসাধারণ দিব্যালোক তাকে যেন পরিপূর্ণতার দিকে টেনে নিয়ে চলেছে। বাকরুদ্ধ হল নরেন। কিছুক্ষণ পরেই অবাক করে দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন ' যা আজ থেকে তুই অবতার ' তোর কাজ হল মানুষ শিক্ষা দেওয়া '


    1886 র 16 ই আগষ্ট সোমবার রাত্রি 1 টা 6 মিনিটে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব ইহলোক ত্যাগ করেন। শোকাকূলা সারদাদেবীর কাছে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লে মাতৃত্বের পরম স্নেহে কোলের নরেনের মাথায় অশেষ আশীর্বানীর অশ্রু ঝড়ে পরেছিল সেদিন।

    সেই পিতৃবিয়োগকালে পিতা বিশ্বনাথ দত্তের তাকে ভাইবোনসহ মহাসংকটময় আর্থিক পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে যাওয়ায় তার অন্তরে যে চরম নাস্তিকতার ভাবে পরিপূর্ণ হয়ে পরলে উত্তেজিত তিনি সন্ত ও ঠাকুরের সমুখে ঈশ্বরের কু-নাম করতে থাকেন এতে ক্ষিপ্ত ঠাকুর তাকে যৎপরোনাস্তি ভৎর্সনা করে টানতে টানতে মায়ের মূর্তির কাছে নিয়ে দাঁড় করিয়ে প্রবেশপথ রুদ্ধ করে বলছিলেন ' যা, চা দেকিনি যা চাইবি চা, যা দেবার তো ওই দেবে ____ '

    একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে পরম সত্যের সন্ধাণ পেয়েছিলেন নরেন। দ্বার মুক্ত করে দেবার জন্য ছটফট করতে লাগলে শ্রী ঠাকুর বুড়ো আঙুল নাচিয়ে ছেলেমানুষের মত হে হে করে হেসে উঠে বলেছিলেন ' জানতুম তুই কিস্সু পাবি না '


    ঠাকুরের মৃত্যুর পর ঠিক তেমনই এক পরিস্থিতি যেন তার সমুখে বুড়ো আঙুল নাচিয়ে বলেই চলেছেন' এইবার দ্যাকা দিকি তোর অবতারগিরি ___'


    ক্রমশঃ



    মল্লিকা রায়


Your Rating
blank-star-rating
Chaina Chaina - (20 September 2023) 5
খুব ভালো লাগলো বন্ধু লেখাটা

0 0