#গল্প
সুখ নামক শুকপাখিটি।
মৌসুমী মুখোপাধ্যায়
-"মা, শুয়েছো?"
-"না, না, এই তো, জেগেই আছি। আয়। এখন ফিরলি?"
-"এই তো মিনিট পাঁচেক হলো। শরীর কেমন আছে আজ?"
-"আগের থেকে ভাল অনেকটা। জ্বরটাও আসেনি আর। মেঘনা বলে নি?"
-"হ্যাঁ বললো তো। আমি তো আগেই বলেছিলাম তোমায়, ভাইরাল ফিভার, প্যারাসিটামলেই কমে যাবে।"
-"কী জানি বাবা, নিজেদের নিয়েই সব এত ব্যস্ত তোরা, কে জানে আমার কথা আলোচনার সুযোগ হয় কিনা।"
-" উফ্, বাজে না বকে শরীর ঠিক আছে কিনা বলবে তো!"
-"হ্যাঁ। জ্বর কমেছে,কিন্তু বুকে ব্যথাটা এখনও হচ্ছে মাঝেমাঝেই।"
-"সর্দি কাশি ছিল, কাশতে কাশতে এই রকম অল্প সল্প বুকে ব্যথা তো হয়ই, তুমি তো জানোই।"
-"তা ঠিক। তবে মিনু আজ ফোন করেছিল, ওরা কলকাতার কোন এক ডাক্তারকে দেখায় বলল, অনেক টাকা নাকি ভিজিট, বুবানের সাথে খুব চেনাশোনা। তুই রাজি থাকলে বুবান ফোনে বুক করিয়ে দেবে।"
-"বুবান কর্পোরেট অফিসে আছে মা, অনেক টাকা মাইনে পায়, ওসব ওদের পোষায়, আমার এই স্কুল টিচারের মাইনেতে কি সেটা সম্ভব?"
-"সেই তো! আমার যেমন কপাল! কষ্ট করে ছেলে মানুষ করলাম, এখন এই বৃদ্ধ বয়সে এসে পয়সার জন্য একটা ভাল ডাক্তার পর্যন্ত দেখানোর উপায় নেই।"
-" তা কেন মা! তোমার তো তেমন বড় কোন অসুবিধা নেই। সমস্ত রিপোর্ট নর্মাল, ভাইরাল ফিভারের জন্য তো কেউ আর ডাক্তারের কাছে যায় না।"
-" কী করে বুঝলি শুধুই ভাইরাল ফিভার? এই তো পাশের বাড়ির বুড়োর মার....কত দিন ধরে পায়ে ব্যথা। কমেই না কিছুতেই। এদিকে রিপোর্টেও কিছুই ধরা পড়ে না, তারপর যখন ধরা পড়ল, তখন কী দেখা গেল? না, ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ।"
-" উফ্ মা! তুমি থামবে? এইবার কিন্তু রাগ হয়ে যাচ্ছে আমার। এত বাজে বকতে পারো তুমি!"
-" বাজে বকা নয়, এ তো আমার নিজে চোখে দেখা ঘটনা। এই জন্যই প্রথম থেকে ভাল ডাক্তার দেখাতে হয়। কিন্তু আমি কী আর সেই কপাল করেছি?"
-" আমার স্কুলের চাকরি মা,একার রোজগার, তোমাকে ও তো বুঝতে হবে একটু। তাছাড়া মোটা মাইনের প্রাইভেট কম্পানির চাকরি একদিন তুমিই আমাকে ছাড়তে বাধ্য করেছো মা, বাড়ি ছেড়ে যাবে না বলে।"
-" আমি ছাড়তে বাধ্য করব কেন? তুমি বরাবর কুঁড়ে, প্রাইভেট চাকরির উদয়স্ত পরিশ্রম তোমার আর পোষাচ্ছিল না, তুমিই ছেড়েছ নিজের ইচ্ছায়।"
-" তুমি বলতে পারলে এটা? কেন, তখন তুমি বলো নি, কোনোদিন আমার কাছে ব্যাঙ্গালোরে গিয়ে থাকতে পারবে না? বলো নি, সরকারী চাকরির নিশ্চিন্ততা অন্যরকম, এই চাকরিটা নিলে আমি বাড়ি থেকেই যাতায়াত করতে পারব,তোমার কাছে থাকতে পারব, বলো নি, বলো?'
-"আমার বলাতে কী আসে যায়? তুমিই ব্যাঙ্গালোরের খরচ সামলাতে পারছিলে না, তাই চলে এসেছো।"
-" কক্ষনো না, তুমি ভাল করেই জানো মা, ওখানে খরচ যেমন বেশি, মাইনে ও অনেক, অনেক বেশি ছিল। আমি আর মেঘনা যথেষ্ট ভাল ছিলাম ওখানে। আর পরিশ্রমের ভয় আমি কোনও দিনই পাই নি।"
-"তাহলে তুই কি বলতে চাস, আমার কথায় তুই চাকরী ছেড়ে চলে এলি?"
-" তাছাড়া কী মা? তুমি এখানেই থাকবে বলে জেদ ধরে থাকলে, ওদিকে স্কুল সার্ভিস কমিশনের ইন্টারভিউটাতেও উৎরে গেলাম, তখনই তো সিদ্ধান্ত নিলাম চলে আসব। তুমি তো সবই জানো, তোমার সাথে আলোচনা করেই তো চাকরিটা ছেড়েছিলাম।"
-" সে তুই যাই বল, অন্য কোন কারণ নিশ্চয়ই ছিল, শুধু আমার কথা ভেবেই তোরা চলে এসেছিস এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না।"
-" অন্য কী কারণ থাকতে পারে, তুমি বল? আমার তো কোন দিনই পড়াতে ভাল লাগত না। কেমিষ্ট হতে চেয়েছিলাম বলেই তো অ্যানালিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে স্পেশালাইজেশন করলাম, তারপর বায়োকন এর অত ভাল চাকরি, অন্য রকম বিলাস বহুল জীবনযাত্রা, সব ছেড়ে ফিরে আসতে যাবই বা কেন? "
-" সে, কেন ফিরে এসেছিস, তুই জানিস। না ফিরলে হয়ত মাকে একটা ভাল ডাক্তার দেখাতে তোকে টাকার কথা ভাবতে হতো না!"
-" আসলে কী জানো তো মা, নিশ্চিন্ত সরকারী চাকরি ছেড়ে আমি এখন আর ওই জীবনটায় ফিরে যেতে পারব না জেনেই তুমি এইসব বলছো। ফিরে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে জানলে কক্ষনো বলতে না, তোমায় তো চিনি আমি।"
-"আমার বলা না বলাতে কী এসে যায়, তোমার জীবন তোমারই সিদ্ধান্ত ছিল। তোমাকে আটকে আমার লাভটা কী হয়েছে?"
-" তোমার এই এক দোষ জানো তো মা, যখন যেটা পাও তখন আর সেটার দাম দিতে পারো না। তখন বাড়িতে সবাই একসাথে থাকাটাই তোমার কাছে সবচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল আর এখন মিনু মাসিকে হিংসা করছো!"
-" হিংসা করব কেন, হিংসা করার কী আছে? তাছাড়া, তুই ওখানে থেকে গেলে কি আর আমি না গিয়ে পারতাম? যেতে তো হতোই, তুই আমার একমাত্র সন্তান। "
-" যাক! ভালোই হলো তোমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা হয়ে গেল।আসলে, তোমাকে একটা বিশেষ কথা বলব বলেই স্কুল থেকে ফিরে সরাসরি তোমার ঘরেই এলাম। "
-"কী কথা?"
-" স্কুলের চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম মা। এই জবটাকে কিছুতেই ভালোবাসতে পারছিলাম না, জানো। বড্ড বোরিং, কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, মাইনেটা ও বেশ কম। আমি আবার পুরোনো কোম্পানিতেই ফিরে যাচ্ছি মা, বসের সাথে কথা হয়ে গেছে।"
-"অ্যাঁ!"
-" অ্যাঁ নয়,হ্যাঁ। নেক্সট উইকে তিনজনে একসাথেই শিফট করব, তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিও। আর বাবিনকে বোলো এই সপ্তাহের মধ্যেই ওই ডক্টরের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেয় যেন। যাওয়ার আগে তোমার একটা চেক আপ করিয়ে নেব।"