আপনজন
দীপ আর অনামিকার আজ খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। অনামিকার শাশুড়ি সরমাও সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে পূজোয় বসেছেন। ধূপের গন্ধে আর শঙ্খের ধ্বনিতে চারদিকে পবিত্রতা বিরাজ করছে।আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী।
তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে ওরা দুজনে বেড়িয়ে পড়লো। অনামিকার খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে।পরনে নীল ঢাকাই,হালকা কার্ডিগান।আর দীপ পরেছে আকাশী শার্টের সাথে সাদা সোয়েটার।দীর্ঘ গড়ন,ফর্সা রঙ,কপালের উপর উড়ে আসা চুলে দীপকে এত সুপুরুষ লাগছে, অনামিকার ইচ্ছে করছে,পুরনো দিনের মত দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু উপায় নেই।হাইওয়েতে সাবধানে ড্রাইভ না করলে যে কোন মূহুর্তে বিপদ ঘটে যেতে পারে।আর দীপ ওকে দেখে ফিরে যাচ্ছে পুরনো দিনে।প্রায় সাত বছর আগে এক গোধুলি লগ্নে যেদিন কনে দেখা আলোয় অনামিকাকে দেখতে গিয়েছিল এক বন্ধুর সাথে,মুগ্ধ হয়েছিল ওর রূপে।তখনই মনস্থির করেছিল, একেই জীবনসঙ্গী করবে।সেদিন অনামিকা পরেছিল একটা গোলাপী তাঁতের শাড়ি।সামান্য গয়না, ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক,কপালে ছোট্ট টিপে গৌরবর্ণা অনামিকা অনন্যা হয়ে ধরা দিয়েছিল দীপের কাছে।
গাড়ি ছুটে চলেছে শহরতলির দিকে।দুপাশে গাছের সারি,হালকা শীতের আমেজ।ওরা দুজন যেন এক অদ্ভূত ভাললাগায় ভেসে চলেছে।
পথে এক প্রাচীন শিবমন্দিরে গাড়ি থামিয়ে ওরা প্রবেশ করলো।পূজো দিল।যতবার এই পথে আসে ওরা মন্দিরে প্রণাম করে যায়। পুরোহিত চেনা হয়ে গেছে।প্রসাদ নিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো।এরপর এক সুন্দর পরিবেশে গাছপালায় ঘেরা বাগান পার করে গাড়ি এসে থামলো 'মায়ের আশীষ'নামে এক অনাথ আশ্রমের অফিসের সামনে।সেখান থেকে এল একঝাঁক কচিকাঁচার মাঝখানে ওখানকার ইনচার্জ রূপকবাবুর সাথে।ওদের দেখে ছুটে এলো ডলি,রূপা,রাজা,সুধা,অয়ন-একের পর এক আহ্লাদী মুখ।দীপ আর অনামিকা ওদের হাতে তুলে দিল শীতপোষাক,খেলনা,চকলেট,বই,খাতা।এখানকার দুটো বাচ্চার লেখাপড়ার সব দায়িত্ব দীপ নিয়েছে।
অনামিকার হাত ধরে ওরা নিয়ে বসালো শিমুল গাছের ছায়ায় ঘেরা বেদীতে।একে অন্যের নামে নালিশ, খুনসুটি করার পর একে একে শোনালো ছড়া,গান,দেখালো নাচ। অনামিকার মাতৃহৃদয় খুশিতে ভরে উঠলো।
প্রতিমাসে অন্তত একবার ওরা সপরিবারে এখানে আসে। সারাদিন ওদের সাথে কাটিয়ে বিকেলে ফিরে যায়।কাল সারা বিকাল ধরে ওর শাশুড়ি সুরমা এদের জন্য পিঠে,পুলি,নারু বানিয়েছেন। সেসব খেয়ে বাচ্চাদের আনন্দ আর ধরেনা। জিজ্ঞেস করেছে,'ঐ ঠাম্মাটা আসেনি কেন?'অনামিকা বলেছে'ওনার একটু কাজ আছে।'আসলে সত্যিই আজ উনি বিশেষ কাজে ব্যাস্ত।
অনাথ আশ্রমটা চালায় পথিক বলে একটা এন জি ও সংস্থা।এখানে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাচ্চারা বড় হয়, স্কুলে যায়।অনেক মেয়েরা বড় হবার পর এরাই বিয়ের ব্যাবস্থা করেছে।কিছু শিশু নতুন বাবা মা পেয়ে নতুন আশ্রয়ে চলে গেছে। নদীর ধারে আশ্রমটা। দুপাশে সাজানো ফুলের গাছ,মাঝখানে পায়ে চলার পথ।বাচ্চাদের সাথে নিয়ে ওরা যখন হাঁটছিল আর ওদের কলরবে নিজেদের ভরিয়ে তুলছিল,নদীর ছলছল শব্দে আর পাখির কাকলিতে তখন সমস্ত পরিবেশ সুন্দর হয়ে ধরা দিচ্ছিল।
বছর দুয়েক আগে দীপের এক বন্ধুর কাছে ওরা এখানকার খবর পায়।প্রথম দিন এসেই খুব ভাল লেগে যায়।তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই আসে শিশুদের সাথে সময় কাটিয়ে যেন কয়েকদিনের অক্সিজেন নিয়ে ফেরে। কখনো বা সুরমা নানারকম খাবার বানিয়ে বৌমাকে নিয়ে চলে আসেন।ওদের হাসিমুখ,ওদের তৃপ্তি দেখে ওদের মন ভরে যায়।
অনামিকা নদীর দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায়।মন চলে যায় বছর চারেক আগের এক অভিশপ্ত সন্ধ্যায়।তারপর কত জল বয়ে গেছে গঙ্গা দিয়ে। ক্রমশঃ বদলে গেছে চারপাশ।দুঃস্বপ্নের কথা ভুলতে চেয়েছে সে প্রতিমূহুর্তে।
সে দিনটা ছিল এমনই শীতকাল। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামত। অনামিকার ননদ বাবলির বিয়ের সব ঠিকঠাক।দিন দশেক পরে বিয়ে।বাবলি আর অনামিকা বিয়ের কিছু কেনাকাটা করতে বেড়িয়েছিল।ফিরতে ফিরতে রাত নটা বেজে যায়।রিক্সা ধরে যখন ফিরছিল,একটা অন্ধকার জায়গায় একদল ছেলে জোর করে রিক্সা থামায়।ওরা হতচকিত হয়ে যায়।বাবলিকে টেনে রিক্সা থেকে নামিয়ে মুখ চেপে ধরে আড়ালে নিয়ে যেতে থাকে।রিক্সাওয়ালা বাধা দিতে গেলে তাকে মারধর করে। অনামিকা চিৎকার করতে গেলে ওর মুখ বেঁধে দেয়।তবু রিক্সাওয়ালা আর অনামিকার সমবেত চেষ্টায় বাবলি কোনমতে ছাড়া পায়। অনামিকা বলে 'দৌড়ে পালা।আমি ঠিক চলে আসব।'বাবলি ভয়ে লোক ডাকতে ছুটে যায়।দুজন পথচারীকে পেয়ে সব বলে নিয়ে আসে।ওরা আসতেই অনামাকাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। কিন্তু শানবাঁধানো চাতালে পড়ে ওর মাথা ফেটে রক্ত বেড়িয়ে আসে।ও জ্ঞান হারায়।বাবলিরা দেখে,অনামিকার দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে আসছে তাজা রক্ত।সবাই মিলে বাড়িতে আনে,নিয়ে যায় নার্সিংহোমে।থানায় এফ আই আর করা হয়।
পরদিন জ্ঞান ফেরে অনামিকার।দীপ ও বাড়ির অন্যদের দেখে ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।দীপ শান্তনা দেয়।ওকে তখন কিছুই জানানো হয় না। চারমাসের গর্ভবতী ছিল সে।ক'দিন পর নার্সিংহোম থেকে বাড়ি ফেরে।দীপের কাছে জানতে পারে ধ্বস্তাধ্বস্তিতে,আর ধাক্কা দিয়ে ঠেলে ফেলায় সেখানেই বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়।
বাবলির বিয়ে একমাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
পুরোপুরি সুস্থ হবার পর দীপের কাছেই শোনে,ও আর কখনো মা হতে পারবে না।এই ভয়ঙ্কর সত্যিটা ওরা দুজন মানতে পারছিল না কিছুতেই।তাই দুতিনজন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল আশায় বুক বেঁধে।তারপর একসময় নিজেদের দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে। অনেক দিন পর্যন্ত সেদিনের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়ে উঠতো অনামিকা,রিক্সাওয়ালা না থাকলে বাবলি বা ওর সর্বনাশ অবধারিত ছিল। কিন্তু ঐ অন্ধকারের সুযোগে পালিয়ে যাওয়া দলটা চিহ্নিত হয়নি। পুলিশ কয়েকজনকে ধরে ওদের ডেকেছিল সনাক্ত করতে।ওরা চিনতে পারেনি।
যত দিন গেছে অনামিকা হতাশায় ডুবে যেতে থাকে। শাশুড়ি সরমা সবসময় ওকে চোখে চোখে রেখেছেন। শ্বশুর ওর পছন্দের জিনিস এনে হাজির করেছেন। বাবলির বিয়ে হয়েছে কাছাকাছি।প্রায়ই ও বরকে নিয়ে চলে আসে, অনামিকাকে নিয়ে সিনেমা যায়,নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যায়।বাবলির একবছরের বাচ্চাটা অনামিকার খুব আদরের।পুরো পরিবার অনামিকার শূণ্যতাকে ভরিয়ে দিতে চেয়েছে।
এরপর একদিন এখানকার ঠিকানা পায়।এই বাচ্চারাই ওকে অবসাদ থেকে মুক্তি দিয়েছে।এরাই ওদের সবচেয়ে আপনজন।
আজকে অবশ্য ওরা আর একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে।এদের সাথে যখন অনামিকা ব্যাস্ত রয়েছে,ফুলবাগানে,নদীর ধারে গাছের ছায়ায়,সেই অবসরে দীপ অফিসে বসে আইনের ধাপগুলো একে একে পার করতে প্রয়োজনীয় সই সাবুদ সেরে ফেলছে।
এরপর মাস ছয়েকের একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তানকে নিয়ে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ওরা বাড়ির পথে রওনা দিল।ছোটদের কথা দিয়ে এল,খুব তাড়াতাড়ি আবার আসবে বলে।
দত্তক নেবার বিষয়ে দুজনের সিদ্ধান্ত নিতে যেটুকু সময় লেগেছিল।ওদের এই প্রস্তাবে অনামিকার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি,একবাক্যে সায় দিয়েছেন।বলতে গেলে এই সিদ্ধান্তে ওরা খুশি হয়েছিলেন।সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছিল বাবলি।ওর মনের গভীরে এখনো কাঁটার মত বিঁধে আছে এক হীনমন্যতা,ওকে বাঁচাতে গিয়েই আজ বৌদি নিঃসন্তান।ওর বর অর্ককে অনেকবার একথা বলে ও কষ্টটা শেয়ার করতে চেয়েছে।অর্ক ওকে বুঝিয়েছে,'তোমরা দুজন যে আরো বড় বিপদের থেকে রক্ষা পেয়েছো সেদিন ,সেজন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও।'
আজ গাড়িতে ফিরতে ফিরতে অনামিকা কোলের শিশুটার দিকে চেয়ে পরম শান্তি অনুভব করলো।আর দীপ ভাবছিল,কত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে পুচকেটাকে কোলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেবে।দীর্ঘ পথ যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ হোল।
বাড়ি ফিরে দেখে অনামিকার বাবা মা, শ্বশুর শাশুড়ি,বাবলি অর্ক সবাই মিলে ফুলে ফুলে,খেলনায়,বেলুনে সারা বাড়ি সাজিয়ে সাগ্রহে অপেক্ষা করছে।ওরা পৌঁছতেই শঙ্খ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে ঘরে তুলল নতুন অতিথিকে।
অনেকদিন পর এই উদার পরিবার একত্রিত হয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। অলক্ষ্যে থেকে ঈশ্বরও যেন ওদের আশীর্বাদে ভরিয়ে দিলেন।