মন্নিং ইসকুল..
তখন বার্ষিক পরীক্ষা হত চৈত্রের শেষে।রেজাল্ট বেরোনোর পর বৈশাখ আর জস্টি মাস জুড়ে সকাল বেলাকার স্কুল। ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে ছায়া ভরা একটা রাস্তা দিয়ে দু মাইল পথ হেঁটে যেতে একটুও বিরক্ত লাগত না।দু পাশে সবুজ সবুজ গাছ পালার সকাল বেলার গন্ধ,একটা শাপলা ফুলে ভরা পুকুর,সাইটের মাঠের পাশে নতুন সাঁওতাল পাড়ার কুঁকড়ো ডাকা ভোর,কাদের বাড়ি থেকে রেডিও তে ভোরাই অনুষ্ঠানের শেষ সুর বাজছে,পুকুর ধারে বড় বাড়ি টায় চা পাতা ফোটার গন্ধ,স্কুলের ভিতরের কৃষ্ণ চুড়ার ডালে থোকা থোকা লাল ফুল,তার বৃন্ত গুলো নিয়ে নখে লাগানো যায়।,বেশ বড়ো বড়ো নখ রাখার মত মনে হয়।ইস্কুলের দপ্তরী মহাদেব দা ঘণ্টা বাজায় ঢং ঢং ঢং।
ভূগোলের নতুন দিদিমণি বেশ রাগী,তাঁর দেওয়া পড়া করা হয়নি।লিপ ইয়ার এর ব্যাখ্যা।পিছন বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে ভাবি" আজ কী ম্যাডাম দেখতে পাবেন আমায়?"
পড়া ধরতে ধরতে যখন আগের বেঞ্চে,তখনই হঠাৎ বাজে পিরিওড শেষের ঘণ্টা। মর্নিং স্কুলের পিরিওড গুলো কম সময়ে র হয় তো!
বাংলার ক্লাসে অপু দুগ্গা র গল্প শেষ হয় না,চলে আসেন গিরিজা বাবু।অঙ্কের স্যার।এদিকে অঙ্কে ভয় মেয়েটির।ভালো লাগে না বীজ গণিতের কচ কচানি।ইস্কুলের পাশের বাঁশ বনে খট খট শব্দে বাঁশ কাটে মহিম কাকা।ইতিহাসের পুরুর গল্প মন দিয়ে শোনে ক্লাস রুম।
টিপিনে মুড়ি আর ছোলা ভিজে একটু চিনি দিয়ে দিয়েছে মা,একটা টিনের ল্যাকটোজেনের কৌটো।কবেকার কৌটো কে জানে? ভাই যখন ছোটো ছিল,তখন বোধ হয় আনা হয়েছিল এক কৌটো।
এতে করেই মুড়ি আনে সে ,বন্ধুরা স্টিলের গোল টিপীন কৌটো আনে,মুড়ি আলু ভাজা,রুটি,পাঁউরুটি।
সে আনমনে খায়,অনেক টা জল ঢেলে দেয়, ছোলা ভিজে,চিনির জলে লাল মরচে গুঁড়ো।ফাইভের ক্লাসের সামনে একটা কলে জল খেতে ভিড় হয়,তারা বন্ধুরা মিলে শিব তলার কলে জল খেতে যায়,জল ছিটিয়ে দেয় এ ওর সাদা,নীল ইসকুল ড্রেসে।ফেরার পথে দু টাকার মদন কটকটি কেনে ডাকঘরের পাশের দোকান থেকে।
টিপিনের পরের ঘণ্টা গুলোয় বড়ো ঘুম পায়,কখন সেই ভোর বেলা ওঠা,এত্ত টা হেঁটে আসে তারা ওই দূরের গ্রাম থেকে।তারপর ভৌত বিজ্ঞানের বিশ্বনাথ বাবু একটানা বুঝিয়ে চলেন পাস্কালের সূত্র।দিলীপ বাবুর ব্যায়ামের ক্লাস ছুটি হয়ে যায়।এই গরমের মধ্যে পিটি হয় নাকি?
গ্রামের বেশ কিছু ছেলে মেয়ে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরে,কখনো কখনো তারা বুলু দিদি বা বাবু দাদার কেরিয়ারে চেপে পড়ে।আবার কখনো সবাই মিলে হাঁটতে হাঁটতে পার হয়ে যায় কাঁটা পুকুর, মিঠুনীর রাস্তা,হাসপাতাল,অচিন তলার পথ,গানের লড়াই খেলতে খেলতে।ঘরে ঢুকেই ব্যাগ টা ছুঁড়ে ফেলে,পোশাক বদলেই ছুট ছুট দে ছুট। বড় পুকুরের জলে ঝাঁপাই ঝরা শুরু হয়ে গেছে যে।
মাঝে মাঝে মননিং ইস্কুলে টিপীনের পর আর ক্লাস হয় না।রবি ঠাকুরের জন্ম দিন না সামনে! তাই গান,আব্বিত্তি আর নাটকের রিয়ারসাল বসে।
সকাল বেলার হাওয়া,এক রাশ বৈশাখী আলো,ইসকুল প্রাঙ্গণে চাঁপার গন্ধ আর সাজি ভরা বেল,গন্ধরাজ,কাঠ টগর ফুলে ভরা পঁচিশে বৈশাখ। শত্রঞ্চি পাতা হয়, নাইনের ক্লাসের সামনে,নতুন দিদিমণি সেদিন একটা লাল সাদা টাঙ্গাইল শাড়ি পরে আসেন,বড়ো দিদি রা গান ধরে.... " এসো হে বৈশাখ এসো এসো"
চেয়ারের উপর সাদা উত্তরীয় পেতে বসানো রবি ঠাকুরের ছবি টা হাসতে থাকে।তখন গরমে ঘামতে ঘামতে সে শোনে... "দই চাই দই,ভালো দই"!
পাঁচ মুড়ো পাহাড়,শ্যামলী নদী, কৃষ্ণকলি,আলোকের ঝর্না ধারায় ধুইয়ে দেওয়া সেই গল্প সে দুপুরে মায়ের কাছে করে।মা তাকে শোনান নৌকাডুবি,যোগাযোগ।বাবা রাত্রে কবিতা পড়েন... " গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে"
আর তার কিশোরী মনে মর্নিং স্কুলের স্মৃতির যোগ হয়ে যায় আজীবনের রবীন্দ্র নাথের সঙ্গে।
সকালে স্কুল তাই দুপুরে ঘুম চোখ ঢুলু ঢুলু নিয়ে তারা পাঠশালায় পড়তে যায়।সে,মালা, টোটন, সুতনু, বুল্টি। পাঠশালা ঘরের চারপাশে ঘন জঙ্গল,একদিকে সবুজ শ্যাওলা ভরা পুকুর আর এক পাশে তুরি দের গোয়াল চালা।চুবি, খড়,গোবরের গন্ধে তারা নিবিষ্ট মনে পড়ে সালোক সংশ্লেষ।আর সম্পাদ্য আঁকে।
রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবে সে কাল টিফিনের সময় একটা নারকেল আইস্ক্রিম খাবো ।বাবার কাছে পয়সা চাইব,নাকি বিস্কুট আইস্ক্রিম? বান্ধবী কাল বলছিল বিস্কুট আইস্ক্রিম টা খেতে বেশি ভালো।কিন্তু বড্ড তাড়াতাড়ি গলে যায়।তারা কিনে খেতে খেতে গরমের মধ্যে হেঁটে ফেরে আর সাইটের মাঠ পেরোতে পেরোতে ফুরিয়ে যায়।
মর্নিং ইসকুল টাও এমনি করেই ফুরিয়ে যায় একদিন,ওই লাল কমলা আইস্ক্রিমের মত,মদন কটকটি র স্বাদের মত, হাওয়াই মিঠাই এর গোলাপী রঙে জিভের মধ্যে ফুরিয়ে যাওয়ার মত,তেঁতুলের আচার হাতে নিয়ে গরমের দুপুর গুলোয় সই দের ছাদে বসে গল্প গুলোর মত...