• 07 May 2021

    বিসর্জন

    দুষ্টের দমন ঘটে দৈবিক অথবা তার নিজের কর্মফলে

    0 62

    #বিভাগ_গল্প

    বিসর্জন


    কলমে সুরজিতা


    নাহ্ করোনা এবছরের পূজোর জৌলুশ একটুও কম হতে দেয়নি, আর দেবেন বা কেন মা সাক্ষাৎ মাথার উপর রয়েছেন... হাতজোড় করে কপালে ঠেকালেন প্রবীণ পুরোহিত নিতাই চক্রবর্তী।


    সব ঠিক আছে নিতাই... ছেলে ছোকরাদের উৎসাহে কোনো ভাটা পরেনি... এমন রোশনাই... অষ্টমীর ভোগের ব্যবস্হাও তো দিব্য... তবুও... কিঞ্চিৎ চিন্তিত দেখালো মর্ডান ক্লাবের প্রেসিডেন্ট সৌভিক ঘোষালকে।


    কি বলছো গুরু, এতো সুন্দর আয়োজন হয়েছে, সরকারি সাহায্য পাওয়া গেছে, সি ইএস সি বিনি পয়সায় এবছর বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে... আর চাঁদাও গত বছরের থেকে বেশি আদায় হয়েছে.... হাতে খৈনি টিপতে টিপতে ক্লাবের সেক্রেটারি রজত বললো।


    রজত এ পাড়ায় উঠতি মস্তান, তার নিজস্ব দলবল আছে, তবে আসল কলকাঠি নাড়ছেন সৌভিক ঘোষাল। মাথা নেড়ে বললেন, বোধন হয়ে গেল আজ তবুও মায়ের মুখে কোনো উজ্জ্বলতা নেই, কেমন নেড়া ঠাকুর বানালো এবার পাল বাবু?


    ঘোষালদা, হুকুম করো, বেঁধে নিয়ে আসছি শ্যালাকে... বক্র হাসি ফুটে উঠলো রজতের মুখে।


    থাম দেখি, পূজোর সময় এখন এসব বলবি না... ওদিকে সব ঠিক ঠাক? গলাটা খাটো করে বললেন সৌভিক বাবু।


    নো টেনসন... ওনলি আ্যটেনশন পূজোয় বস্.... পুকুরে ডুবিয়ে খল্লাশ..


    কথা শেষ করার আগেই সবাই দেখলো হন্তদন্ত হয়ে আসছেন চক্রবর্তী বুড়ো.... আগে সংস্কৃত পড়াতেন স্কুলে, একমাত্র মেয়ে সৌমিতা সেই পঞ্চমীর রাত থেকে নিঁখোজ, বাপ মেয়ের সংসার... চক্রবর্তী কাকিমা আজ পাঁচ বছর গত হয়েছেন।


    কাছে এসে রজতের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সৌমির কোনো খবর পেলে বাবা? তুমি বলেছিলে এদিক ওদিক ছেলেদের পাঠিয়ে খবর নেবে.. জানি মেয়েটা আমার তোমাদের বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছিল, তাও... ছোটো থেকে তো দেখেছো....


    সৌভিক ঘোষাল মুচকি হেসে বললেন, আরে না না স্যার, ওসব ভাববেন না, পূজোর ছুটি, মেয়ে দেখুন বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে চলে গেছে, ঠিক ফিরে আসবে!


    কাল সপ্তমী, দেবীর বোধন... পুরোহিত নিতাই চক্রবর্তী চলে গেলেন, সকালে নবপত্রিকা স্নান ও অন্যান্য অনেক কাজ আছে।


    দু'দিন সৌমিতা নিখোঁজ, এই পূজোর দালানের বাইরে কয়েকজন মিলে ধর্নায় বসেছিল মহালয়ার দিন থেকে, ওদের প্রতিবাদের বিষয় ছিল


    ১. এতো জাঁকজমকপূর্ণ পূজোর পরিবর্তে পাড়ার পূজো নমনম করে হোক,


    ২. একে এই কোভিড, কতো মানুষের চাকরি গেছে, চাঁদা আদায় করা হবে না আর পাড়ার উন্নয়নের বিশেষ প্রয়োজন,


    ৩. যেখানে সিইএসসি বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে পূজো মন্ডপ গুলোতে অথচ সাধারণ মানুষের ওপর বিলের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে।


    ৪. সরকার থেকে যে টাকা পাড়ার উন্নয়নের জন্য দিয়েছে তার পরিবর্তে ক্লাবের ছেলেদের উপর খরচা হচ্ছে আর মদের ফোয়ারা চলছে। সরকারের টাকার হিসেব চাই!


    পাড়ার সকলে ওদের পাশে ছিল প্রথমে, সত্যিই তো! কি দরকার এমন জাঁকজমকের? মা দুর্গা তো এতো আড়ম্বড় চাননি। কিন্তু সকলেই আড়ালে সমর্থন করছিল, রজত মস্তান বা সৌভিক ঘোষাল কে ভয় পায়, তাই আস্তে আস্তে সৌমিতার পাশে থাকার মতো মানুষের সংখ্যাও কমতে থাকে। চতুর্থীর দিন সকালে মেয়েটা একাই বসেছিল। কেউ পাশে না থাকলেও একলাই লড়েছিল সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।


    রজত ভ্রু কুঁচকে বললো, কাকু তাই বলেন হেব্বি ডেঁপো মেয়ে আপনার, নাক টিপলে দুধ বেড়োবে, সে কি পোতিবাদ করছে চোখে চোখ রেখে... দেখুন কোন্ ছেলের সাথে ভেগেছে।


    মাথা নীচু করে সৌমিতার বাবা বললেন, আসলে মেয়ে তো মা দুর্গার রূপ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত করে না... তা বাবা রজত মেয়েকে এমন শিক্ষা দিইনি যে এমন কাজ ছেড়ে অন্ধকারে পালিয়ে যাবে! দেখি অন্যদের জিজ্ঞাসা করে....


    চলে গেলেন সৌমিতার বাবা.... জানেন এখানে কখনোই সদুত্তর পাওয়া যাবে না।


    রজত দাঁত কিড়মিড় করে বললো, শ্যালা, মেয়েছেলেদের তেজ আমি সহ্য করতে পারিনা। টুঁটি চেপে ধরলেও শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছে... দাদা তুমি বললে এই মালটাকেও টপকে দেবো!!


    সৌভিক ঘোষাল ক্রুড় হেসে বললো, দাঁড়া মায়ের পূজোর শেষ হোক, মায়ের কাছে ঐ বুড়োর বলি দেবো। তারপর বাপ মেয়ে একসাথে স্বর্গবাস করবে।


    সপ্তমী তে নবপত্রিকা স্নান করতে গিয়ে ছিঁড়ে গেল... আসলে ক্লাবের জুনিয়র পাঁচু রাতে মদ খাওয়া বেশি হয়ে গেছিল তাই সকালে নবপত্রিকা পুকুরে ডোবাতে গিয়ে কি এক অজ্ঞাত কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।


    অষ্টমীর দিন সকালে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সময় কি ভাবে যেন কেউ জোরে একটা কয়েন ছুঁড়ে দেন, অসুরের এক চোখ কানা হয়ে গেছে... সন্ধি পূজোয় একশো আটটি পদ্ম ফুল আনলেও ঐ মুহুর্তে ঠিক অজানা কারণে একটি পদ্ম পাওয়া যায়নি অর্থাৎ একের পর এক অনাচার আর বাধা।


    অষ্টমীর বিকেলে, সুন্দর পাঞ্জাবী পরে এসেছে সৌভিক ঘোষাল, সোনার বোতাম, তিনি পকেট থেকে ৫০ হাজার টাকার একটা বান্ডিল বের করে রজতকে দিয়ে বললেন, দশমীর দিনে মুখ্যমন্ত্রী আসতে পারে, সব ব্যবস্হা যেন ঠিক থাকে... স্পেশাল ঢাকি, প্রফেশনাল মেয়েছেলে নিয়ে আয়...আদর আপ্যায়ন ঠিক হলে এবার ক্লাবের জিমটার জন্য পঁচিশ লাখ দেবে, পাঁচ তুই পাবি।


    কিচ্ছু ভেবোনা গুরু এমন সিঁদুর খেলা আর ধুনুচি নেত্য হবে না... পুরো জমে ক্ষীর... ওটা সাত হবে না, বোঝো তো? অন্য দল দশ প্রতি মাসে দেবে বলছে, কিন্তু আমি বলেছি, আমার গুরু সৌভিক ঘোষাল কে ছেড়ে কোথাও যাবো না.. হাত কচলাতে কচলাতে বললো রজত।


    জিভটা তোর বড়ো লম্বা হয়ে যাচ্ছে রজত... কোন্ দিন ছোবল আমাকেই না দিয়ে দিস। মনে মনে বললো সৌভিক ঘোষাল।


    রজত চলে যেতেই পাঁচুকে ডাকলো সৌভিক, ফিসফিস করে কি বললো।


    নিতাই চক্রবর্তী সন্ধ্যা আরতি শেষ করে প্রসাদ বিতরণ করা শুরু করেছেন, সৌভিকের হাতে দিয়ে বললেন, বাবা এবার পূজোয় বারবার বড়ো বাধা আসছে, আমার কেন যেন ঠিক ভালো ঠেকছে না! ঐ দেখো মাস্টার মশাই, মেয়েটার শোকে মাথা খারাপ হয়ে গেল... মেয়েটা যেখানে বসেছিল, ওখানে বসে সকাল থেকে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন।


    এতোক্ষণ চোখ যায়নি, সত্যি তো, মাথা নিচু করে বসে আছে আর কি বলেই যাচ্ছেন সৌমিতার বাবা। কাছে গেল সৌভিক, ফিসফিস করে বললো, কি ব্যাপার স্যার, মেয়েকে পেলেন?


    সব শেষ হবে শিগগিরি... সবকটা অসুরের বিনাশ হবে... শুনতে পাচ্ছি আমি, শুনতে পাচ্ছি... মায়ের ত্রিশুলের শব্দ.. শুনতে পাচ্ছি... বিড়বিড় করে বলে চললেন সৌমিতার বাবা।


    চুকচুক করে শব্দ করলো সৌভিক, কন্যা শোকে মাথা গেছে।


    আজ দশমী, হাজার চেষ্টা করেও ভালো ঢাকি আসেনি, রজত দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কিছু ব্যবস্থা হয়নি, সৌভিক ঘোষালের শরীর ঠিক নেই.... সৌমিতার বাবা ঐ এক জায়গায় বসে কি সব হিসেব করছে, বারবার মাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে তাড়াতাড়ি সিঁদুর খেলা শুরু হবে, কিন্তু এই প্রথম বার পাড়ার কোনো মহিলা সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে আসছে না... এও কি দৈবিক কারণ নাকি সমগ্র নারীশক্তির প্রতিবাদ আসুরিক শক্তির বিরুদ্ধে?


    প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, মায়ের বরণে কেউ এলো না দেখে রেগে গিয়ে সৌভিক ঘোষাল বললো, কাল থেকে শ্যালা পাড়ায় জল বন্ধ করে দিবি... কুত্তার ল্যাজ সিধে করতে হয় কি ভাবে এই ঘোষালের পো জানে!


    হঠাৎ মাথাটা একটু ঘুরে গেল সৌভিকের, পূজোয় অনিয়ম চলছে, আর যেকোনো মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রী এসে যাবেন কিন্তু কোনো বন্দোবস্ত হয়নি, কিরকম কান্ডজ্ঞানহীন রজতটা, না এতোদিন সত্যি দুধকলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে?


    আবার চেষ্টা করলো উঠে দাঁড়ানোর, মাথাটা ঘুরে গেল... সৌভিক ঘোষাল গিয়ে পরলো দুর্গা মায়ের বেদীর ঠিক সামনে, অতো বড়ো শরীরের ধাক্কায় মায়ের হাতের ত্রিশূলটা এসে কপালে লাগতেই ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। জ্ঞান হারানোর আগে মা দুর্গার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সৌভিক, চোখ দুটো একেবারে সৌমিতার মতো মনে হচ্ছে... কি দীপ্তিময়ী... সত্য বোধহয় এমনটাই আলোকময় হয় মিথ্যা তার সামনে এই ভাবেই ধুলোয় মিশে যায়!


    সৌভিক ঘোষাল কে সবাই মিলে তুলে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, আজ ভাসানের সব দায়িত্ব রজতের উপর, মনে মনে খুশি হলো ও, সৌভিক ঘোষাল কম তো ওকে ব্যবহার করেনি, পরিবর্তে পাওনা আদায় করতে কালঘাম ছুটে গেছে, এই সুযোগে মন্ত্রীর সামনে নিজেকে মেলে ধরতে হবে।


    পুকুরে ভাসান হবে, নিতাই চক্রবর্তী মন্ত্র বলছেন, ঢাক বাজছে, সিদ্ধির নেশায় মেতে ছেলের দল বেসামাল নৃত্য করে চলেছে.... মুটের দল ঠাকুর নামিয়ে আনছে। এ ক্লাবের নিয়ম হচ্ছে, সভাপতি মা'কে জল অবধি পৌঁছে দিয়ে আসে, সৌভিকের পরিবর্তে এই প্রথম রজত সেই দায়িত্বে।


    মা দুর্গা কে সাত পাক ঘোরানো শুরু হলো, একটু একটু করে জলে নেমে দাঁড়ালো রজত, উফ্ এই আশ্বিনের সময় জল এমন বরফের মতো ঠান্ডা কেন? ক‌ই পঞ্চমীর রাতের শেষে তখন সৌমিতা কে হাত পা বেঁধে জীবন্ত জলে ফেলে ছিল, তখনও তো এরকম ছিল না....


    হঠাৎ কি হলো মুটের দল বেসামাল হয়ে গেছে মা দুর্গার অতবড়ো মুর্তি গিয়ে পরলো রজতের উপর, কি ভারি !!! উফ্, অস্ফুটে বাঁচাও বলে আর্তনাদ করলো রজত।


    কেউ নামতে পারছে না,আর মুর্তি যেন কয়েকশো কেজি ভারি.... আর পারছে না রজত, ডুবে যাচ্ছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে... জলে ফুসফুস ভর্তি হয়ে যাচ্ছে... ঠিক এইরকম হয়েছিল সৌমিতার, হাত পা বেঁধে দেওয়ায় সাঁতার কেটে বেঁচে ফিরতে পারেনি, একটু একটু করে সলিল সমাধি হয়েছিল মেয়েটার পূজোর শুরু তে, আর শেষে রজতের পালা!


    কার ফোন বেজে উঠলো, খবর এসেছে হাসপাতালে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য জনদরদী নেতা সৌভিক ঘোষালের মৃত্যু হয়েছে। মায়ের মুর্তি কাঠামো সহ রজতকে সঙ্গে নিয়ে জলের নীচে চলে গেল।


    চারদিকে স্তব্ধতা..... আসলে মা দুর্গার আগমন তো শুধু চারদিন আনন্দ দিতে নয়, তিনি আসেন পৃথিবীতে দুষ্টের দমন করতে অসতের নাশ করতে , বারবার!!!


    -----সমাপ্ত-----



    Surajita C Chaudhuri


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!