• 03 June 2021

    ছোটগল্প

    সে আসে মাঝ রাতে

    0 48

    #ছোটগল্প --তার নিঃশব্দ পদধ্বনি

    ✍️Tapas Paik


    ✒️তখন সদ্য লেখাপড়া শেষ করে বাড়িতে বসে বসে চাকরির সন্ধান করছি । সকাল বিকেল সন্ধ্যে মায়ের বকুনি ঝাঁকুনি নিরন্তর চলছে -- "এত দিন বসে বসে লেখাপড়া করেও চাকরি জোটাতে পারলি না, পড়াশোনা না করে সারাদিন মোবাইল ঘাটলে কি আর চাকরি পাওয়া যায়? লেখাপড়ার মতো লেখাপড়া করতে হয়, ওইতো ওইপাড়ার অমুক নাপড়েই চাকরি পেয়ে গেলো"!


    মায়ের বকুনিতে অতিষ্ট হয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম আর বাড়িতে থেকে লেখাপড়া নয়, এবার একটু শহরে মেসে গিয়ে লেখাপড়া করে দেখা যাক ।এই চাকরির আকালের বাজারে যদি ভাগ্যের শিকে ছেড়ে । যেমন ভাবা তেমন কাজ ।

    দিনেকয়েক পর স্কুল ফ্রেন্ড সঞ্জীবের সাহায্যে বেলঘরিয়ায় একটা মেসে গিয়ে উঠলাম । মেসের চারটে মেইন রুমের একটাও কপালে না জোটায়, শেষে মেসের কমন ডাইনিং রুমের এক দেওয়ালে আমার ঠাঁই হলো ।

    বেশ ভালোই কাটছিলো দিন গুলো । হঠাৎ একদিন মেসের রাজেন দা কোথা থেকে একটি সদা রঙের বিড়াল ছানা নিয়ে এলো মেসে । রাজেন দার বিড়াল প্রীতি কে না জানে!সারাদিন রাজেন দা বিড়াল ছানাকে খাওয়ানো, স্নান করানো, মোছানো, তেলমাখানো এসবেই ব্যাস্ত!


    সে এক হই হই ব্যাপার!বিড়াল ছানার আগমনে মেসে সাজো সাজো রব! একদিন পাঁজি খুলে ভালো বার দেখে রাজেন দার উদ্যোগে বেড়াল ছানাটির নামকরণ করা হলো --পুচি!সেদিন রাতেই মাংস ভাতের ব্যবস্থাও হলো । তখন মেসে সপ্তাহে একদিন মাংস ভাত খাওয়া হতো, এবার একদিন উপরি পাওনায় মেসের সবার মন প্রাণ আনন্দে উদ্বেলিত । মেস লাইফে সপ্তাহে একবাটি মাংস যেনো মনে হতো পৃথিবীর সর্বকালের সেরা সুস্বাদু খাবার!সবাই খাওয়ার সময় ---"জয় বেড়াল বাবাজীবনের জয় বলে স্লোগান দিতে লাগলো"! কর্মব্যাস্ত জীবনের একটা দিন বেড়াল ছানাকে নিয়ে বেশ আনন্দেই কাটলো সবার ।


    মেসে বেড়াল ছানার আগমনের পর থেকে,বেশ কিছু দিন ধরেই লক্ষ্য করছি আমার থাকার

    কমন ডাইনিং রুমে রাতে কিছু একটা ঘোরা ঘুরি করছে । সবাই যে যার রুমে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেই বাইরের ডাইনিং রুমের দেওয়ালে আমি একা । প্রায়ই কিছু একটার পায়ের মৃদু পদচারণায় মাঝে মাঝেই মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে লাগলো ।আলো জ্বেলে কোনো দিনই কিছু দেখতে পেতাম না ।ক্রমশ রাতের পর রাত যেতে লাগলো এভাবেই । একটা অজানা অচেনা ভয় আমায় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগলো ।দিনের বেলায় পাশের ফাঁকা প্লটের তালগাছটার দিকে তাকিয়ে সারা দুপুর বসে থাকতাম ।মাঝে মাঝে পুচি এসে নানান শারীরিক কসরত দেখিয়ে আমার দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব করার চেষ্টা করে যেতো ।


    একটা একটা করে রাত কাটতে লাগলো ভয়ে ভয়ে, অনিদ্রায় । রোজই ওপাশের কিচেন ও আমার থাকার ডাইনিং রুমে কারো নিঃশব্দ পদচারণায় মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেতে লাগলো ।কিছুদিন পরথেকে লক্ষ্য করলাম মেসের কিচেনের ডাস্টবিন থেকে মাংসর হাড় গুলো কেউ তুলে এনে কিচেনের এদিক সেদিক ছড়িয়ে রেখেছে । সামান্য একটু মাংসও লেগে নেই হাড় গুলোতে ।

    অবশেষে মেসে কথাটা বলেই ফেললাম । প্রথমে সবাই বেশ ভয় পেলেও, রাতুল দা বললো --

    "রাজেনের বেড়ালের কান্ড হবে এটা । ভূত টুত কিছু নেই রে । ও আমার জানা আছে. যাইহোক বলছিস যখন আজ রাতে সবাই এলার্ট থাকলে হবে "!

    রাজেন দা প্রতিবাদের সুরে বললো --"আমার পুচি রাতে আমার সাথেই বিছানার একপাশে শুয়ে থাকে । তাছাড়া আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ থাকে তাই আমার বেড়ালের রাতে ডাইনিং রুমে আসার প্রশ্নই নেই "!

    তাই শুনে দূর্গা দা বললো --" ঠিক আছে আজ নয়, যেদিন রাতে মাংস খাওয়া হবে সেদিন সজাগ থেকে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলে মনে হয় ভালো হবে "!

    শনিবার রাতে মেসে মাংস খাওয়া হলো । এদিন মাংস খেয়ে কারো সেই তৃপ্তি আর হলো না । সবাই উদ্বিগ্ন!কি হয় কি হয় প্রশ্ন সবার মনেই ।

    এরই মধ্যে শোনা গেলো পাশের মেয়েদের মেসের একটি মেয়ে কোনো একটা এক্সামের ভাইভা পাস করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে আজ সন্ধ্যায় । এতল্লাতে এমন খবর প্রায়ই শোনা যায়,জীবন সংগ্রামে ব্যার্থ হয়ে আবসাদগ্রস্ত ছেলে মেয়ে আলটিমেট এই পথ বেছে নেয়, তারা একটিবার ভাবে না চাকরি পাওয়াই জীবনের সব কিছু নয়,ব্যার্থ হয়ে জীবনে হাসি মুখে বেঁচে থাকতে শেখাটাও একটা সাকসেস ।


    যাইহোক আমরা মেসের আট দশজন ছেলে সেইরাতে জেগে রইলাম । মেসের সব লাইট বন্ধ । অন্ধকারে ঘড়ির কাটার শব্দ আর আমাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া সারা মেসে পিন ড্রপ সাইলেন্স বিরাজ করছিলো। প্রতি মুহূর্তেই আমাদের মনে হচ্ছিলো এই বুঝি সে এলো, যার অপেক্ষায় আমরা গোপনে বসে আছি! সে রাতের প্রতিটি মুহূর্ত সবার কাছেই খুব বেশি দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছিলো! মাঝে মাঝে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে রাজেন দার কোলে বসে থাকা পুচি মেও মেও করে ডেকে উঠছিলো ।

    তখন রাত দেড়টা কি দুটো হবে ডাইনিং রুমের বাইরের দিকের জানলার পাল্লা ধপ করে শব্দ করে উঠলো!মুহূর্ত পরেই আবার একদম নিস্তব্ধ সব কিছু!আমরা সবাই প্রবল কৌতূহলে জানলার দিকে তাকালাম!ঘুট ঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা গেলো না!সৌরভ তার টর্চ লাইট জ্বালাতে যাবে, ইনজামামুল ওর হাতটা চেপে ধরলো । পাশেই বসে থাকা সাহেব বলে উঠলো --"আলো জ্বেলো না সৌরভ দা! অশরীরী আত্মারা আলো দেখলে সেখানে আসেনা"!

    সবাই আবার চুপচাপ!যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স!অন্ধকারে রান্নাঘর থেকে আলতো পায়ের শব্দ ভেসে আসতে লাগলো!কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাসিনাথ বলে উঠলো --"ওইতো সদা মতো একটা কি যেনো রান্না ঘরে ঢুকে গেলো "!

    আমরা তখন ভয়ে একে অপরের বেশ কাছাকাছি চলে এসেছি । ওদিকে রাতুল দা সাহসে ভর করে দ্রুত রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই ওয়াসেদ লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো ।সবাই কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখাগেলো একটা ধব ধবে সদা বেড়াল মেও মেও করে ডেকে উঠে --নিষ্পাপ অপরাধীর দৃষ্টিতে তার জ্বল জ্বলে দুটি চোখে ফেল ফেল কোরে তাকিয়ে আছে!

    রাজেন দা বেড়ালটিকে চিনতে পেরে বলে উঠলো --"এই ব্যাটা বুচি!তোর কান্ড এসব!"

    আমি বললাম --"তুমি চেনো নাকি একে"?

    রাজেন দা বললো --"আরে এই বুচিই তো পুচির মা!গত সপ্তাহে ঐ তালগাছের নিচের ঝোপ থেকেই পুচিকে তুলে এনেছি পুষবো বলে"!

    আমাদের কথা, হাসাহাসির মাঝেই বুচি কখন জানালা দিয়ে উধাও আমরা টেরও পাইনি । সেদিনকার মতো সবাই যে যার ঘরের শুতে চলে গেলো ।


    আমি শুলাম বটে কিন্তু সবার কাছে কেমন যেনো একটু খেলো হলাম ভেবে বেড়ালটার ওপর চরম রাগ হলো আমার । শুয়ে শুয়ে ফন্দি আটলাম কি ভাবে বেড়ালটার মেসে আসা বন্ধ করা যায় ।পরের দিন ইনজামামুলকে সঙ্গে নিয়ে হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে লোহার জাল কিনে এনে জানালার গ্রীল ঢেকে দিলাম ভালোকরে । যাতে বেড়ালটা আর জানালার ফাঁক গলে ভেতরে আসতে না পারে । সেদিন রাত্রিরে অনেক দিন পর পরম সুখে ঘুমাতে গেলাম । আমি নিশ্চিত যে বেড়ালটা আর আমায় জ্বালাতে আসবে না ।

    বেশ কয়েকদিন দারুন কাটলো। আমি মেসের সবাইকে জ্ঞান দিতে লাগলাম যে আরো কি কি ভাবে বাড়িতে বেড়ালের উপদ্রব হলে তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ।মাঝে মাঝে জানলাটার দিকে সাগর্বে তাকিয়ে ভাবতাম --এই কলকাতা শহরে বেড়ালের কি প্রয়োজন? আশেপাশের অলিতে গলিতে এত বেড়াল কেন ঘুরে বেড়ায়?

    বেশ কিছুদিন ভালোই ঘুম হলো!একদিন হঠাৎ মাঝ রাতে কিসের ফিসফিসানি শব্দে আবার ঘুম ভেঙ্গে গেলো!আলো জ্বেলে দেখলাম কোথাও কিছুই নেই!পা টিপে ওঘরে গিয়ে দেখি পুচি রাজেন দার খাটে শুয়ে আছে । লাইট বন্ধ করে যেই শুয়েছি আবার সেই শব্দ!ফিসফিস, ঘিসঘিস! শব্দ সমস্ত রান্না ঘর ও ডাইনিং রুম জুড়ে এদিক ওদিক ঘুরে চলেছে!আমি ভয়ে আঁতকে উঠে আবার লাইট জ্বেলেছি --না কোথাও কিছুই নেই, শব্দটাও বন্ধ! আবার জাস্ট শুয়েছি চোখে ঘুম এসেছে --আবার সেই ঘিসঘিস, ফিসফিস শব্দ! নিঝুম রাতে এই শব্দটুকু কারো ঘুম ভাঙাতে যথেষ্ট । সে রাতের পর থেকে প্রতি রাতেই ঐ একই শব্দে আমার প্রায় গোটা রাত্রি জেগে থাকার মতো অবস্থা! এদিকে কাওকে বলতেও পারছিনা --একবার বেড়াল নিয়ে যা হলো!একদিকে ভয়, অপরদিকে --অস্বাভাবিক একটা চলন্ত শব্দ! যেটা নাকি সারারাত জুড়ে এদিক সেদিক করে ঘুরে বেড়াচ্ছে! কিছুদিন পর রাতে ঘুমের মাঝে প্রায়ই পায়ের ওপর, হাতের ওপর,বালিশের ওপর দিয়ে কান ঘেঁষে কিছু চলে যাওয়ার অনুভূতি হতে লাগলো!আমি ক্রমশ ভেতর থেকে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগলাম!আমি একা বেশ কিছু রাত প্রায় না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম!কিন্তু এবার আর কাউকে কিছু বললাম না ।


    একদিন বসে বসেই ঘুমিয়ে গেছি --হঠাৎ ভাইয়ার চেঁচামেচি শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো । দেখি মেসের কিছু ছেলে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে আমার ঘরের এদিক সেদিক কি যেনো খুঁজে বেড়াচ্ছে!অবশেষে দেখাগেলো দুটো বেশ বড়ো সাইজের মেঠো ইঁদুর সবাইকে দাঁত ভেংচিয়ে বাইরের দরজার নিচের ফাঁক গলে পাশের জঙ্গলে পালালো!আমি তখন বুঝলাম বিড়ালের অনুপস্থিতে মেসে ইঁদুরের উৎপাত ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে । রাতে বিড়ালের উৎপাত সহ্য করা যেতো সহজেই কিন্তু এই হিংস্র মেঠো ইঁদুরের উৎপাত আমার অসহ্যই মনে হোচ্ছিলো!

    এই ঘটনার পর সেই সদা বেড়াল --বুচির জন্য খুব মন খারাপ করতে লাগলো!আমি অনুধাবন করলাম বিড়াল ছাড়া শহর কল্পনা করা এদেশে অসম্ভব!কারণ বিড়াল ছাড়া শহরের প্রতিটি বাড়ি কিছু দিনেই গুদাম ঘরে পরিণত হবে! বিড়াল গুলোই শহরে ইঁদুরের ভারসাম্য বজায় রাখে, তাই মানুষের গৃহস্থালীর অনেক জিনিস পত্র রক্ষা পায় ইঁদুরের হাত থেকে । প্লেগ ছড়ায় না । বাচ্চারা সুরক্ষিত থাকে বেড়ালের হাতে! কারণ শহুরে দাঁতলা মেঠো আর গেছো ইঁদুর বড়োই ভয়ঙ্কর!

    এই বিষয়ে মেসে আমি আবার নতুন লেকচার দেওয়া শুরু করেছি বেশ কিছুদিন হলো । এরই মধ্যে জানলার লোহার জাল খুলে ফেলেছি --এই আশায় যদি পুচির মা বুচি আবার মেস মুখো হয় । কারণ গেছো ইঁদুর দুটোকে ঐ পারবে তাড়াতে!

    প্রতিদিন রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে অপেক্ষায় থাকি ঐ বুঝি জানলায় শব্দ হয়!কিছুদিন পর থেকে দেখি ইঁদুরের উৎপাত আর নেই!কিছু মাংসর হাড় রান্না ঘরের মেঝেতে পরে থাকে আগের মতো । বুঝলাম বুচি আবার আসে নিঃশব্দে, আগের মতন গভীর রাতে!এখন আর ভয় লাগে না, বরং অনেক সাহস পাই এটা ভেবে যে আসে পাশে পুচির মা আছে!

    সেদিন সম্ভবতঃ সোমবার হবে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবো । খাটের নিচ থেকে নতুন কেনা লেদারের সুয়ের বাক্সোটা খুলেই দেখি জুতো দুটো আর পরে বেরোবার অবস্থায় নেই । ধেড়ে ইঁদুরে কামড়ে ওদের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!

    .................................................................

    ||সমাপ্ত ||



    তাপস পাইক


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!