"দূর হ এখান থেকে। তোর মুখ দেখতে চাই না। হতচ্ছাড়া বাড়ি থেকে চলে যাস না কেন কে জানে!"
বছর পঁচাত্তরের বিধু মোহন চাট্টুজে সকালে উঠেই নিজের বাপ মা মরা ভাইপোকে গালমন্দ করতে থাকেন।কেন যে কাকা তার ওপর এত চটে আছেন তা বুঝতে পারেনা শম্ভু ওরফে শম্ভুনাথ চ্যাটার্জি।অথচ কিছু মাস আগে পর্যন্ত ওকে আর ওর বউকে দুই চোখে হারাতো ওর একমাত্র কাকা বিধু মোহন।
সকাল সকাল কাকার কাছে গালমন্দ খেয়ে মাথা গরম হয়ে যায় ওর। ও ঠিক করে আজ ও কাকাকে জিজ্ঞেস করেই ছাড়বে যে কেন উনি আজকাল ওকে দেখতে পান না। ও কিছু বলতেই যাচ্ছিল তার আগেই ওর স্ত্রী কণি ওকে ঘরের ভিতরে ডাকে।
" কিগো শুনছো একটু ভিতরে আসো তো।"
স্ত্রীর ডাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভিতরে যায় ও। কণি দুইমাসের পোয়াতি।ওকে চোখে হারায় শম্ভু।
" বলো কি জন্য ডাকলে?"
" তুমি সকাল সকাল কাকার সাথে ঝগড়া করতে যাচ্ছ কেন? জানোই তো ওনার বয়স হয়েছে।মাথার ঠিক থাকেনা।তবুও তুমি বুঝবে না।তুমিও........"
"চুপ করো তো।আজকাল ওনার দুর্ব্যবহার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো।"
স্ত্রীর কথা না শুনেই কাকার সাথে কথা বলতে উঠানের দিকে চলে যায় ও।
"বলি সকাল সকাল গালমন্দ করছো কেন? একটু বলবে খোলসা করে।"
" বেশ করেছি।তোরা দুজনে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যা।তোর খুড়ি আর আমি দুজনেই তাই চাই।"
" তোমার শরীরে দয়া মায়া নেই গো।দুইমাসের পোয়াতি আমার বউটা।এখন ওকে নিয়ে কোথায় যাবো!"
" আমার বাড়ি ছেড়ে যেখানে খুশি চলে যা।"
কাকা ভাইপোর কথার মাঝখানে শম্ভুর খুড়ি স্নিগ্ধা দেবী ছুটে আসেন।
"দেখ শম্ভু আমি এতদিন তোদের মাঝে কিছু বলিনি।কিন্তু আর সহ্য হচ্ছেনা বাপ।এই লোকটার ভীমরতি ধরেছে।কেন যে এরকম করছে জানিনা।তুই বরং বৌমাকে নিয়ে অন্য জায়গাতে চলে যা।ওর এখন এসব ঝগড়াঝাটির মধ্যে না থাকাই ভালো।কিছু হোক না বুড়োর তখন দেখাবো মজা।"
"কিন্তু খুড়ি...."
"কোন কিন্তু না আর।নিজের ঘরে যা এখন।"
শম্ভু গজগজ করতে করতে নিজের ঘরে চলে যায়।
এরপর প্রায় একমাস কেটে যায়।শম্ভু অনেক খুঁজে ভালো একটা বাড়ির সন্ধান পায়।কিছুদিন পর নিজের চারমাসের পোয়াতি স্ত্রীকে নিয়ে নতুন বাড়িতে চলে যায় ও।বাপ মা মারা যাওয়ার পর খুড়ি আর কাকার কাছেই ও মানুষ হয়েছে। কণিকে পছন্দ করে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসেন খুড়ি।কাকাও যথেষ্ট করেছেন ওর জন্য।ওনাদের ছেলেপুলে হয়নি।নিজের ছেলের মতোই এতদিন ওকে আগলে রেখেছিল বিধুমোহনবাবু।কিন্তু সেই মানুষের এরকম বদল ভাবা যায় না।কেন যে এরকম ব্যবহার করছেন উনি ,সেটা কেউ সঠিক জানেনা।
"গিন্নি এটা একটা রান্না হলো?কি যে বাজে রান্না করেছো পাবদা মাছটাকে।কেমন ট্যাল ট্যালে পাতলা ঝোল।বৌমা ভালো রান্না করতো...."
কথাটা বলেই চুপ করে যান বিধুমোহন।স্নিগ্ধা দেবী কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন না।
"বলছি আজ একজন আসবে।তুমি নাম শুনেছ বোধ হয়।"
"কে আসবে আবার?"
" সুমন কর্মকার।ওর প্রমোটিং এর ব্যবসা আছে।খুব ভালো ছেলে।"
স্বামীর কথা শুনে উনি একটু অবাক হন।
"ও আবার কেন আসবে?"
"দেখো আমাদের বয়স হচ্ছে গিন্নি।এখন তো রাত বিরেতে কিছু হলে টাকার প্রয়োজন আছে।কি তাই তো?ভাবলাম এই বাড়িটার অবস্থাও ভালো না যদি ও এই বাড়িটা প্রমোটিং করে তাহলে আমরা একটা ফ্ল্যাটও পাবো আর সাথে ভালো টাকা।"
চুপ করে পুরোটা শোনেন স্নিগ্ধা দেবী।তারপর দুঃখ করে বলেন " জানিনা কেন তোমার দূর্মতি হলো। এমন করলে ছেলেটার সাথে!
"আবার তোমার সেই ঘ্যান ঘ্যান।এটা তো আমাদের ভালোর জন্যই করা নাকি?আর শোনো গিন্নি পর কখনো নিজের হয় না।বুঝলে?"
"অদ্ভুত কথা বলছো তুমি! শম্ভু কি আমাদের ওরকম ছেলে নাকি!"
গিন্নির কথা শুনে রাগ করে খাওয়া ছেড়ে উঠে যান উনি।স্নিগ্ধা দেবী বুঝতে পারেন যে ওনার স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে প্রোমোটার নিজের কাজ হাসিল করতে চাইছে।উনি বিলক্ষণ জানেন ওনার স্বামী বড়োই একগুঁয়ে আর জেদী।ওনাকে বোঝালেও কথা কানে তুলবেন না।স্নিগ্ধা দেবীর খারাপ লাগে শম্ভুর কথা ভেবে আবার বৌমার কথা ভেবে চিন্তাও হয়।কিন্তু ওর বেশ অনেকটা দূরে বাড়ি ভাড়া করে চলে গেছে,উনি বয়স্কা অতদূর যেতে পারবেন না।তাই মনে মনে ভগবানকে ডেকে বলেন " সবকিছু ঠিক করে দিও ঠাকুর।"
এর মধ্যে বেশ কিছু মাস পেরিয়ে যায়।শম্ভু এখন একটি কন্যা সন্তানের পিতা।ওর দায়িত্ব বেড়েছে।কাকার ওপর রাগটা এখনও যায় নি।তবে খুড়ির কথা খুব মনে পড়ে ওর।ওনার জন্য খুব মন খারাপ হয়।নতুন বাড়িতে এসে কাকার গালমন্দ শুনতে হয়ত হয় না তবুও মন ওই বাড়িতেই পড়ে থাকে।জেদের বশে ওই বাড়ির ছায়াও মারায় না ও।অনেকবার ভেবেছিল কাকার আড়ালে খুড়ির কাছে নিজের মেয়েকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে নিয়ে আসবে। তারপরক্ষনেই মনে হয়েছে কাকা জানতে পারলে খুড়িকে চারটে বাজে কথা শোনাবে।তাই ইচ্ছাটাকে নিজের মনেই রেখে দিয়েছে শম্ভু।
সেদিন ছিল রবিবার।নিজের নতুন ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে বিড়ি খাচ্ছিলেন বিধুমোহন।ইদানিং ওনার গিন্নি ওনার সাথে কথাবার্তা বলা কমিয়ে দিয়েছেন।গিন্নির এই ব্যবহারে কষ্ট হয় ওনার।উনি ভাবেন গিন্নি নিজের ভালোটা বুঝতে চাইলো না।স্নিগ্ধা দেবী প্রায়ই ওনাকে অভিযোগ করেন আজকাল যে নতুন দুই কামরার ফ্ল্যাটে হাত পা ছড়িয়ে থাকা যায় না।ওনার দম বন্ধ হয়ে আসে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই আচমকা বুকের বাম পাশটায় ব্যথা অনুভূত হয় বিধু বাবুর।"গিন্নি" বলে ডাক দিয়েই উনি চেয়ার থেকে টলে নিচে পড়ে যান।স্নিগ্ধা দেবী রাতের রান্নার তোড়জোড় করছিলেন। স্বামীর চিৎকারে ছুটে এসে স্বামীকে ওভাবে পড়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে যান।উনি চিৎকার করে প্রতিবেশীদের ডাকেন।ওনারা এসে মুখ জল দেন বিধুবাবুর।এর মধ্যেই ফোনে শম্ভুকে খবর দেন উনি।শম্ভু ছুটে আসে নিজের বউ মেয়েকে নিয়ে। ও দৌড় ঝাঁপ করে ভালো হাসপাতালে ভর্তি করে কাকাকে।দিন পনেরো যমে মানুষের টানাটানি করার পর বিধুবাবু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।এই কদিন খুড়ির অনুরোধে এই বাড়িতেই থেকে গিয়েছিল শম্ভু।একটুর জন্যও নিজের খুড়শাশুড়িকে চোখের আড়াল করেনি কনি।শম্ভুর চারমাসের ছোটো মেয়েটাকে পেয়ে একটু ভুলে ছিলেন স্নিগ্ধা দেবী।
কাকা ফিরতেই সেদিন রাতে ওদেরকে নিয়ে নিজেদের বাড়ি চলে যায় শম্ভু।পরদিন সকালবেলা বেশ ভোরে ওর ফোনে একটা ফোন আসে।সেই গম্ভীর গলায় ওর কাকা ওকে বলেন " তুই কোন সাহসে আমার পারমিশন ছাড়া বৌমা আর আমার দিদিভাইকে নিয়ে ওই বাড়ি গেছিস?"
শম্ভু শান্ত অথচ কঠিন গলায় বলে " আমি ওই বাড়িতে থাকতে চাইনা।নেহাৎ তুমি অসুস্থ ছিলে তাই.....।"
" তাই আর কি! থেকে মাথা কিনে নিয়েছ।এখন কি এই বাড়ি এসে থাকার জন্য তোর পায়ে পড়তে হবে নাকি?তোর খুড়ি দিদিভাইয়ের জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়েছে।আর আমারও মন ভালো নেই।শিগগির চলে আয়।আর হ্যাঁ ভুল হয়েছে আমার।লোভে পড়ে গিয়ে তোকে যত বাজে কথা বলেছি।ভগবান আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।বুঝেছি তুই আমার মত অমানুষ না।পারলে বুড়োটাকে ক্ষমা করে দিস!"
কাকার ক্ষমা চাওয়ার ধরন দেখে হেসে ফেলে শম্ভু।হাসতে হাসতে ও বলে " বুড়ো তুমি ভাঙবে তবু মচকাবে না।খুড়ি ঠিকই বলে।"