আজ আমার ষাট বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষ্যে মেয়ে ছোট একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। বেশ কিছু কাছের আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে সারাদিন বেশ আনন্দেই কেটেছে। এখন সাড়ে বারোটা বাজে। সব অতিথিরা একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেলে মেয়ে সব গুছিয়ে রেখে বাড়ি গেল বারোটার সময়। আমি শাড়ি পাল্টে একটা নাইটি পরে বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসেছি। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম আসছে না, মনটা বড়ই চঞ্চল হয়ে আছে। পুরনো কথা মনে পড়ছে। আজ সকলে কত আনন্দ করেছে অথচ একদিন আমি কত কষ্ট করেছি। জীবনে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই স্বাচ্ছন্দ্য আমি পেয়েছি।
কতই বা বয়স তখন আমার। সবে স্নাতক হয়ে একটা বেসরকারি অফিসে জুনিয়র একাউন্টেটের চাকরি করছি। অফিস যাতায়াতের পথে আলাপ সৃজিতের সাথে। সৃজিত একাউন্টটেন্সিতে মাস্টার্স করে একটা বেসরকারি অফিসে সেলসের কাজ করে। আমরা দু'জনে একই ট্রেন ধরে হাওড়া স্টেশনে এসে ওখান থেকে লঞ্চ পেরিয়ে অফিস পাড়ায় যাতায়াত করি। আস্তে আস্তে আমাদের বন্ধুত্ব বাড়তে থাকে। এক সময় আমরা ঠিক করি দু'জনে একসাথে থাকব, সেইমতো দু'বাড়িতে আমাদের সম্পর্কের কথা জানালাম। দু'জনের বাড়ি থেকেই আপত্তি উঠল। আমার বাড়ির কেউই সামান্য সেলসের কাজ করা পাত্রকে মেনে নিতে রাজি নয়। আর সৃজিতের বাড়ির লোকে বেসরকারি অফিসে কাজ করা, রাত করে বাড়ি ফেরা মেয়েকে ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয়, তাছাড়া সৃজিতের দাদা দেবজিতের তখনও বিয়ে হয়নি। সব মিলিয়ে এক বিশ্রী পরিস্থিতি। কিন্তু আমি আর সৃজিত দু'বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নিলাম। বিয়ের পর আমরা দু'জনে সোজা চলে গেলাম সৃজিতদের বাড়ি। আমাদের দেখে সৃজিতের দাদা আর মা আমাকে অপমান করল। সৃজিত নিজের ব্যাগ গুছিয়ে আমাকে বলল,'চল।'
আমরা বাইরে বেরোতে যাচ্ছি এমন সময় সৃজিতের বাবা ফিরলেন অফিস থেকে। তিনি সব শুনে আমাদের সৃজিতদের বাড়িতে থেকে যাবার আদেশ দিলেন। আমরা থেকে গেলাম। সেই থেকে যাওয়া আমার জীবনের মারাত্মক ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত।
কয়েকমাস পরে তৎকালীন ব্যাঙ্গালোর থেকে একটা ভালো অফার পেলাম আমি। সৃজিত বলল,' তুমি চলে যাও, আমি চাকরিতে বদলি নেব। যদি বদলি না হই তবে চাকরি ছেড়ে তোমার ওখানে চলে গিয়ে চাকরির খোঁজ করব।'
বাড়িতে বলতেই খুব অশান্তি শুরু হল। সৃজিতের বাবা চাইতেন না যে আমি আর সৃজিত বাড়ির বাইরে থাকি এতে ওনার সম্মানহানি হবে। অগত্যা সংসারের স্বার্থে আমাকে আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা ত্যাগ করে সংসারের শান্তি ফিরিয়ে আনতে হল।
দিন কাটতে লাগল। সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরের কাজ মিটিয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে জামাকাপড় কেচে স্নান করে কোন রকমে দুটো ভাত খেয়ে দৌড়দৌড়ি করে ট্রেন ধরে অফিস। রাতে বাড়ি ফিরে রাতের রান্না সারতে হত, তবে সৃজিত বাড়ি থাকলে আমাকে সব কাজে সাহায্য করত, সে কারণে সৃজিতের মা আমাকে কত কথা শোনাত। অত্যন্ত কষ্টে একেকটা দিন কাটত।
এরপর আমি আর সৃজিত ঠিক করি আমরা প্রফেশনাল কোর্স করব, সেইমতো আমরা পড়াশোনা শুরু করলাম। প্রথম থেকেই সৃজিতের বাবা-মা আমার পড়াশোনা করার বিরোধিতা করেছিলেন। আমি কোন কথা না শুনে রাত জেগে পড়া চালিয়ে গেছি। সেই দিনগুলোতে অমানুষিক পরিশ্রম করেছি। কয়েক বছর পর আমি আর সৃজিত সম্মানিয় প্রফেশনাল ডিগ্রি লাভ করলাম। আমরা নিজেদের ফার্ম খুলে প্র্যাকটিস করতে শুরু করলাম। এইবার সৃজিতের মা আমার ওপর আরও অত্যাচার করতে লাগল। তিনি অসুস্থ হবার ভাণ করলেন। আমাকে বাধ্য করা হল অফিস না গিয়ে ওনাকে দেখাশোনা করতে। কর্তব্যের খাতিরে আমাকে মেনে নিতে হল সব। আমি একজন প্রফেশনাল হয়ে আমাকে বাধ্য করা হল গৃহবধূ হয়ে থাকতে।
এরপর থেকে যতদিন যেতে লাগল সৃজিতের বাবা-মার চাহিদা ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগল। ওনাদের চাহিদা মেনে আমি সন্তানের মা হলাম। সৃজিত চাইত আমরা আলাদা থাকি, কিন্তু সৃজিতের অসুস্থ বাবার দেখাশোনার জন্য আমার আলাদা থাকা হল না। সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ আমি সংসার আর সন্তানের মঙ্গল কামনায় সময় কাটিয়ে দিয়েছি। মনে মনে আমি গুমরে মরেছি। আমার প্রফেশনাল সত্ত্বা আমাকে কুরে কুরে খেত। দিনের শেষে মেয়েকে ঘুম পাড়ানি গান শোনাতে শোনাতে আমি আমার চাকরি জীবনের কথা ভাবতাম। একেক সময় আমার মনে হত সব ছেড়ে দিয়ে আমাদের ফার্মে গিয়ে বসি। কিন্তু সংসারের খাতিরে আমার প্রফেশনাল আমিকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল।
এরপর সৃজিতের বাবার হঠাৎ মৃত্যু হল। সৃজিতের মা আমাকেই সব কিছুর জন্য দায়ী করলেন। আমি অসহায়ভাবে সব কিছু মানিয়ে নিয়েছি। এরপর আরও দশ বছর কেটে গেছে। মেয়ে বড় হয়ে স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ছে তখন, সেইসময় সৃজিতের মা মারা গেলেন। সৃজিতের মার মৃত্যুর পর আমি আমার স্বাধীনতা ফিরে পেলাম। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আমি অফিসে গিয়ে বসি। মেয়ের স্কুল ছুটির পর মেয়ে আমাদের অফিসে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে জামাকাপড় পাল্টে কোচিং ক্লাসে চলে যেত। কোচিং ক্লাস শেষ হলে মা-মেয়ে বাড়ি চলে আসতাম। আমার দুঃখের দিন শেষ হয়ে সুখের দিন ফিরে এসেছিল। তারপর নিশ্চিন্তে কেটে গেছে এতগুলো বছর। এখনও আমার কর্মব্যস্ত জীবন। মেয়ের বিয়ে হয়েছে, একটা নাতনি নিয়ে সংসার। গতবছর সৃজিত আমাকে একা রেখে চলে গেছে। আমি এখন একাই আমাদের ফার্ম দেখাশোনা করি। আমি বেশ সুখেই আছি, আমার নানা রঙের দিনগুলি এখন নির্বিঘ্নে কেটে যায়। আমার অসহায় জীবনের কালো পর্দাটা উঠে গিয়ে এখন রোদ ঝলমল সকাল।