আকাশে মেঘের ঘনঘটা।সন্ধ্যা হলেই বৃষ্টি নামবে।চারদিকে কেমন বিষন্নতা ছড়িয়ে আছে। অম্লানের মনটাও ভালো নেই,বিষাদের কালো ছায়া ওর মনকেও ঘিরে আছে। বিষন্নতা এক অদ্ভুত রোগ, যখন হয় মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে।কিছু ভালো লাগার অনুভূতি গুলো যেন কোথায় উবে যায়।মানুষ ইচ্ছে করলেই কিন্তু পারে এই সব ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট গুলোকে একটু সহানুভূতিশীল হয়ে মিটিয়ে নিতে। কিন্তু না আরো জটিলতার সৃষ্টি করবে!!দূর ভালো লাগে!
কি দরকার ছিল মার ওমন করে মিতুলকে বলার!! কই রঙ্গনা যখন এখানে এসে এটা সেটা পোষাক পরে,ভালো লাগুক চাই না লাগুক মা তো কিছু বলেন না! বরঞ্চ বলবেন_ খুকি তোকে কি সুন্দরটাই না লাগছে...অনেক দাম দিয়ে কিনেছিস বুঝি?এগুলো পক্ষপাতিত্ব ছাড়া আর কি?মেয়ে পরেছে বলে কোন দোষ নেই আর বাড়ির বৌ পরলেই যত দোষ!কেন তোমার বাড়ির বৌ তো আরেক বাড়ির মেয়ে!কিভাবে পারেন এভাবে পক্ষপাত করতে!
মেয়েটা সারাদিন সকলের তদারকি করে সবে মাত্র চুরিদারটা পরেছে ওমনি মা আর পিসিমা মিলে যা নয় তাই বলে দিলো!একটু না হয় শরীরে বাড়তি মেদ জমেছে বয়সের ভারে ; সকলেরই পরে তাই বলে মনে আঘাত দিয়ে কথা বলতে হবে?ওর তো নিজস্ব কিছু শখ আহ্লাদ আছে!বাড়ির বৌদের এমন করে দাবিয়ে রাখার কোন মানে হয়!!ওনারা নিজে যেটা করেননি সেটা অন্য কেউ করতে পারবে না এর তো কোন নিয়ম নেই!
এই চুরিদারটা তো আমিই এনে দিয়েছিলাম ওকে!কি খুশি হয়েছিল মিতুল।
অম্লানের খুব খারাপ লাগে, ও বাপের বাড়িতেও পরতে পারেনি একটু শ্বশুর বাড়িতে এসে পরবে তাও পারবেনা!!ব্যক্তি স্বাধীনতা বলে কিছুই নেই।
বৌয়ের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করবো তারও কি উপায় আছে!!ননদ বৌদি মিলে কান্নাকাটি শুরু করে কপাল চাপড়াবেন...'বুঝলে ঠাকুরঝি সব কপাল... সব কপাল না হলে আমার খোকা বউয়ের হয়ে কথা কয়'।
মনে পরে যেদিন দেখতে গেছিল হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিল,আঠারো বছরের একটি মেয়ে ,আজকালের দিনে এমন ভাবাই যায় না। সেদিন হয়তো বাধ্য হয়েই পরেছিল!কিন্তু আমি মিতুলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিলাম....
'তোমায় নিয়ে শত শত ইচ্ছে বুনতে শুরু করে দিলাম।সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবো হলুদ শাড়ি পড়ে এককাপ চা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো!সত্যি বলছি সেটা শুধু আমার কল্পনায় ছিল, আমি কখনো চাইনি ও শাড়ি পরুক, চেয়েছি নিজের মতো করে বাঁচুক!
কিন্তু আমার চাওয়া না চাওয়াতে কি এসে যায়!আমি যে প্রতিবাদ করতে পারিনা বউয়ের হয়ে!কোন কুল রাখি আর কোন কুল ছাড়ি!যেন ফাটা বাঁশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি।! যদি করি তাহলে তো ঘরে চরম অশান্তি হবে!
কিন্তু মা... নিজের কতটা ইচ্ছে ছিল জানা নেই তবে পিসিমার প্ররোচনায় প্ররোচিত হয়েই করছেন সেটা সহজেই বোঝা যায়।
বিয়ের পর ওকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছিলেন শাড়ি পরতে হবে..।এই বাড়ির একটা নিয়ম আছে...।
আমি দেখেছি মেয়েটির পায়ের নখ উঠে গেছিল শাড়ির পাড় জড়িয়ে।বিছানা ভেসে গিয়েছিল রক্তে।
সকালে উঠে মাকে বলাতে বললেন_"ও কোন কিছু না, আমাদের কত হয়েছে..।অভ্যাস করলে ঠিক হয়ে যাবে।
কি বলবো!!কিন্তু আমার খুব কষ্ট হয়েছিল!তাই সেদিন সবাইকে উপেক্ষা করে কয়েকটি নাইটি নিয়ে এসেছিলাম।দেখেই আপত্তি তুলেছিল বলল_"কেন যেচে অশান্তি সৃষ্টি করছো আমি ঠিক আছি"।
কি সহ্যশক্তি, সেদিন ওর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেছিল আমার।
সেদিনের পর আর অশান্তি হয়নি কিন্তু বাঁধ সাধলো কাল।
সবাই মিলে পিকনিকে যাবো ঠিক করেছি।মেয়ে এসে মাকে জড়িয়ে বললো _কাল কিন্তু বিয়ে বাড়ি যাচ্ছি না, তুমি শাড়ি পরবে না বলে দিলাম!
'ঠিক আছে ''ঠিক আছে' বলে পাশ কাটিয়ে গেলেও আমি জানি মিতুল পরবে না!অশান্তি ভয়ে ও পরবে না!
কিন্তু সকালে মেয়ের পীড়াপীড়িতে সবে মাত্র চুরিদারটা গলায় গলিয়েছে ওমনি মা এসে রাজ্যের অশান্তি জুড়ে দিলেন।
_কি অনাসৃষ্টি কান্ড ... ধিঙ্গি মেয়ের মা... তুমি কিনা চুরিদার পরে যাবে!!বোধবুদ্ধি কি হারিয়ে গেছে!!
মিতুল চুপ করে ছিল, কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম ওর ভেতরে কি তোলপাড় চলছে, আর এটাই স্বাভাবিক আমি হলে তো সহ্য করতে পারতাম না! তাহলে ও কেন করবে!
মনে মনে বলছি 'মুখ খোলো' 'মিতুল মুখ খোলো'আর কতদিন চুপচাপ থাকবে!এবারে প্রতিবাদ করো!!নিজের পক্ষে কথা বলো!অন্যায় করছো না কিছু তুমি তাহলে কেন চুপ করে আছো?অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হলে অনেক সময় নিজের পক্ষে কথা বলতে হয়!!
কিন্তু মিতুল মুখ খুললো না.... ওর হয়ে মুখ খুললো মেয়ে। সেই ছোট্ট মেয়েটি এতদিন পরে মায়ের হয়ে পক্ষপাতিত্ব করলো।
এই দিনটিই দেখার ইচ্ছে ছিল আমার, আমি পারিনি কিন্তু আমার মেয়ে দীপশিখা প্রজ্বলিত দীপের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো।
_মা কেন পরবে না শুনি?
.....চুরিদার পরলে কি অন্যায় হবে ?
_তুমি চুপ কর, অনেক ছোট আছো সবসময় মার হয়ে কথা বলা!
_চুপ তো অনেক দিন ছিলাম ঠাম্মা, ছোট ছিলাম তো কিছু বলিনি তাই বলে এই নয় সব অন্যায় মেনে নেবো।
মিতুলের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, দেখছি ও দীপশিখার দিকে তাকিয়ে আছে হয়তো ভাবছে এভাবেও প্রতিবাদ করা যায়!!
_"দেখো ঠাম্মা তুমি যদি মনে করো আমি মার হয়ে পক্ষপাতিত্ব করছি সেটাই সই,তোমাদের মতো অন্যায় করছি না।মা বাড়ির বৌ বলে কোন সখ আহ্লাদ থাকতে নেই!!
_"বাড়ির বৌরা এ ধরনের পোষাক পরে না.."
_"কে বলেছে পরে না সোনাপিসিও তো আরেক বাড়ির বৌ সে যদি পরতে পারে মা কেন পারবে না"?
_"সোনাপিসি তো এই বাড়ির মেয়ে"!!
_মাও আরেক বাড়ির মেয়ে...
_তুই তর্ক করছিস আমার সাথে...!!
_একদমই নয়!তোমরা যে একতরফা পক্ষপাত করে থাকো তারই প্রতিবাদ করছি মাত্র।মেয়ে হলে দোষ নেই আর বৌ করলেই দোষ!!
_মা মেনে নিয়েছে মানে এই নয় আমি মেনে নেব!!
দীপশিখার মোক্ষম দাওয়াইতে মাকে দেখলাম কেমন গুটিয়ে গেলেন।কিন্তু পিসিমা....
_দেখলে বৌদি সেই দিনের ছোট্ট খুকি কেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে... জন্ম দেখলাম এখন কিনা আমাগো কোনটা উচিত কোনটা অনুচিত শিখাইবো!!
না গো কালই আমি যামু গা!
_দেখো পিসিঠাম্মা আমি শুধু তোমাদের চিন্তাভাবনার পার্থক্য গুলো বিশ্লেষণ করছি।যদি বিচার করতে হয় একতরফা করবে কেন!!মা নিরীহ মানুষ বলে তার উপর সমস্ত দায়ভার চাপাতে পারো না! অন্যায় দেখেও বাপি পারেনি তোমাদের আঘাত দিতে ,কিন্তু আমি.... আমি তো পারবো না আমি মার হয়ে কথা বলবোই।
মিতুল চুপ করে দাঁড়িয়েছিল।এতদিন পর আজ মনটা খুব ভালো লাগছে।ভেতরের দুমড়ে মুচড়ে থাকা কষ্টটা কেমন জানি এক লহমায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
আর কোন চিন্তা নেই!কেউ তো আছে ওর হয়ে পক্ষপাতিত্ব করার জন্য।থাক না যতই বিঘ্ন বাধা আর হেরে যাবে না।মেয়ের সাথে থেকে মেয়ের পক্ষপাতিত্বে গা ভাসিয়ে দেবে। মিতুল ভাবে জীবনে নিজের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে দীপশিখার মতোই প্রতিবাদ করতে হয়।
সমাপ্ত।।