• 31 August 2022

    ডলি ভট্টাচার্য

    আঁধার ঘরে সাঁঝবাতি

    0 96




    শ্রীময়ী ঠাকুর দালান থেকে বেরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কয়েক ঘন্টা আগেই চারদিকে ফুলে ফুলে সাজানো বিয়ের আসরটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে।


    একমাত্র ভাসুরঝি শেলীর বিয়ে হয়ে গেল আজ।সব আত্মীয় স্বজনরা চলে গেছে।মেয়ে জামাইরা বাসরঘরে ,মাঝে মধ্যে হাসির শব্দ ভেসে আসছে। শ্রীময়ী শূন্য দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে থাকেন।


    খুব কষ্ট হয় শ্রীময়ীর।আতুর ঘর থেকে শুরু করে শেলীর স্কুল কলেজের টিফিন সবই তো শ্রীময়ী একা হাতে সামাল দিয়েছেন , আর আজ ছোটজা কেমন ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে মঙ্গল কাজে বিধবা মানুষদের থাকতে নেই!!আশ্চর্য সব নিয়ম!কেন রে বিধবারা কি মানুষ নয়!!এখানে কি বিপত্নীক কেউ আসেননি নাকি!!তবে!!


    কেউ এসে একবারও জিজ্ঞেস করেনি __তুমি কিছু খেয়েছ ,তোমার কিছু চাই!!কিন্তু শেলী,,,, সেকি পারতো না বঁধূ বেশে কেমন লাগছে জেঠিমাকে এসে একটি বার একটু দেখাতে!


    সে যে বিধবা তার তো কোন অধিকার নেই, তার যে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে থাকা বারণ!সবার মন বোঝার দায়িত্ব শ্রীময়ীর কিন্তু ওর মন কে বুঝবে,,,,,


    বাসনের ঠুং ঠাং আওয়াজ কানে ভেসে আসে।চকিতে চোখ চলে যায় অতসীর দিকে, খাবারের প্লেট নিয়ে ওর দিকেই এগিয়ে আসছে।


    __বৌদি এসো খাবে চল!


    __না আমি খাবোনা!


    __তুমি না খেলে আমি কেমনে খাই শুনি!


    ___বৌদি একটা কথা আজ না কইয়ে পারছিনে।সেই দা'বাবু' থাকার সময় থাইকে দেখে আসছি তুমি পুরো বাড়িটার দায়িত্ব নিইজ কাঁনধে নিছো আইজ কেমন করে ওরা তোমারে দূরে ঠেলি দিলো!!শেলী দিদিমনির তো উচিত ছিল

    তোমারে ধরি বাঁনধি বিয়ের আসরে নি যাবার!!


    শ্রীময়ী এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন --চুপ কর অতসী! -চুপ কর!আমার নতুন করে আর অশান্তি ভালো লাগে না।বিয়েটা ভালো ভালো য় হয়ে গেছে এটাই যথেষ্ট।


    ___ চুপ তো এইত্তকাল করে ছিলাম!ওখন যে আর সহ্যি হয়নি এমন অন্যায় দিখলে!


    _ __নাও নাও খেয়ে নাও।


    শ্রীময়ী তাকিয়ে থাকেন অতসীর দিকে। পঞ্চাশ বছর আগের অতসী আর আজকের অতসীর কতো পার্থক্য!


    ওর মতো অতসীও ছোট বড়ো বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের ফার ফরমাইশ খাটতো সে কিনা আজ প্রতিবাদের সুরে কথা বলছে!


    কিন্তু শ্রীময়ী সে তো বিয়ের পর থেকেই দাদাশ্বশুর ,শ্বশুর -শাশুড়ি ছোট ছোট দেওর ননদের দায়িত্ব নিজ কাঁধে বহন করে চলেছেন।এতো বছরেও পারেননি কারো কোন কথায় উচ্চবাচ্য করতে!!।এতো করেও তো সকলের মুখ ঝামটা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য শিকার।আর পড়ন্ত বিকেলে সবার অবজ্ঞার শিকার।


    কি দোষ ছিল ওর কালো, না তা তো নয় তবে অশিক্ষিত নাহ্ তবে দোষ ছিল সে গরীব বাপের সন্তান।আর এই দোষ কাটাবার জন্য শাশুড়ি পুরো সংসারের দায়িত্ব ওর কাঁধে ছেড়ে দূর থেকে গালিগালাজ আর শাপশাপান্ত করতেন।


    আর শ্রীময়ী বাধ্য বৌয়ের মতো চোখের জল ফেলে চুপ করে মেনে নিতেন। কার কাছে মুখ খুলবেন !!স্বামীর তখনো ভালো রোজগার নেই বাবার অন্নে প্রতিপালিত তার উপরে সে একটা উটকো ঝামেলা। তাই গায়ে গতরে খেটে হিসেব পুশিয়ে দিতে হয় তাকে।


    শ্রীময়ীর তো যাবার জায়গা নেই !! বাবার উপরে বিরাট অভিমান হয় শ্রীময়ীর।একমাত্র উচ্চ কুলশীল আর সৎপাত্র দেখে পড়াশোনা বন্ধ করে শহরের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলেন। শ্রীময়ী ভাবে গরীব তার উপরে কন্যাদায়গ্ৰস্ত উনি বা কি করবেন! শহরের মানুষের মেকি ভালোবাসায় ভুলে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন।কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছেন এতো বড়ো পরিবারের দায়িত্ব ভার এই অষ্টাদশী মেয়েটি বহন করতে পারবে কিনা!!


    অতসীর নিয়ে আসা খাওয়া মুখে রোচে না শ্রীময়ীর।শহরের বিখ্যাত ক্যাটারার এসে পাঁচশো মানুষের রান্না করেছে কিন্তু শ্রীময়ীর কপালে জুটেছে খই ,দই আর রসগোল্লা।কি করবেন তিনি যে বিধবা তার উপরে অন্যের গলগ্ৰহ!!যা কপালে জোটে সেটাই ভালো!


    ___'বৌদি পাকঘরে অনেক খাবার জিনিস পরে আছে গো আনি দি'!


    শ্রীময়ী অতসীর মুখের দিকে চেয়ে থাকেন।কি করেছে সে ওর জন্য তা সত্বেও মেয়েটি কেমন খেয়াল রাখে ।


    আর যাদের জন্য জীবনটা দিয়ে দিলো তারা নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে মশগুল ।একবারটি ভেবেও দেখেনি এতো বছর পুরো সংসারকে দেখাশোনা করেছে যে মানুষটা কিভাবে সারা দিনটা এক ঘরে হয়ে কাটিয়ে দিলো।


    মনে পরে শ্রীময়ীর যেদিন প্রথম এই বাড়িতে পা রেখেছিলেন উঠোন ভর্তি মানুষ জন দেখে কি আনন্দ হয়েছিল!!নব্বই বছরের দাদা শ্বশুর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন--" যে সয় সে রয়" ভগবান যেন তোমাকে সহ্য ক্ষমতা দেন"। কে জানে হয়তো তিনি বাড়ির লোকজনদের ব্যবহার আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন!বৌভাতের পরদিনই হেঁসেলে নিয়ে গিয়ে শাশুড়ি বললেন -"এবারে সব বুঝে নাও তো বাপু ,বলে সবার খাদ্য তালিকা দিয়ে এক লম্বা ফিরিস্তি দিলেন"।


    শুরু হয়ে গেল শ্রীময়ীর জীবন।সকাল থেকে এক একজনের ফাই ফরমাস শেষ করে যখন দুপুরে বিছানায় গা টা এলিয়ে দিতে মনটা চাইতো শাশুড়ি তখন বাতের তেলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন--"তোমার শ্বশুরকে একটু মেখে দাওতো!এতকাল তো আমি করে এসেছি"!


    শ্রীময়ী র কান্না পেয়ে যেত। স্বামী কে বলবে তারও সুযোগ নেই রাতেই একটু সময় স্বামীকে কাছে পাওয়ার কিন্তু সব শেষ করে যখন বিছানায় আসতো পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে যেত, আর স্বামী দীর্ঘ অপেক্ষার পর হয়তো এক সময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। শ্রীময়ী স্বামীর পাশে চুপটি করে শুয়ে পরতো।ভোরের দিকে কখন যে বরের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পরতো টেরটি পেতো না। শাশুড়ির চিৎকার চেঁচামেঁচিতে ধড়পড় করে উঠে পরতো।কতদিন যে কতো কথা শুনতে হয়েছে ওকে এ নিয়ে। --"আহা স্বামী সোহাগ যেন উথলে উঠছে"!! কিন্তু ছোটজা তো দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে এতোটা কাল কাটিয়ে দিলো। সংসারের প্রতি না ছেলেমেয়েদের প্রতি কোনো দায়িত্বতো পালন করেনি!সব কিছু শ্রীময়ীর উপর চাপিয়ে দিয়ে কেমন হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে!শাশুড়ি তো কিচ্ছুটি বলেনি!!সব দায় কি তার!!


    একে একে শ্বশুর, দাদাশ্বশুর মারা গেলেন,সবার ভার নিতে নিতে নিজের সন্তানের ভার আর বহন করতে পারলেন না শ্রীময়ী।সাতমাসে গর্ভেই মারা গেল শিশুটি,আর সন্তান সুখ পেলেন না।


    দীর্ঘশ্বাস পরে শ্রীময়ীর। একদিন স্বামীও বিনা নোটিশে ইহলোক ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু শ্রীময়ীর দায়িত্ব যেন আরো বেড়ে গেল।বৃদ্ধ শাশুড়ির সেবায় নিজেকে নিমজ্জিত করেন।কি করবেন সবাই যে যার সংসার জীবনে ব্যস্ত এই মানুষটাকে নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়!!


    বেশ কিছু বছর আগে শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর শ্রীময়ী একা হয়ে যায় কিন্তু সংসারের দায়িত্ব পিছু ছাড়ে না।


    শ্রীময়ী ভাবেন সেদিন যখন শেলীর বিয়ে ঠিক হয় আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে সবার যাতে কোন অসুবিধা না হয় সব ধরনের ব্যবস্থা নিজের হাতে নিয়েছিলেন।বিদ্ধি থেকে হে়ঁসেল নিজ দায়িত্বে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন তখন তো কেউ বাঁধা দেয়নি আর বিয়ে দেখলেই দোষ!!


    --কিগো অনেকটা রাত হলো যে খেয়ে নিয়ে ঘুমাও তো দেখি কাল আবার বাসি বিয়ে উঠতি হবে তো!!


    শ্রীময়ী অতসীর দিকে তাকান, ভাবেন ওর সাথে সাথে অতসীও কেমন এই সংসারের দায়িত্ব ভার নিয়ে নিয়েছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বোধ হয় এভাবেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে,,, পথে শেষ কোথায়,,,,,। কি আছে শেষে,,,,।



    ডলি ভট্টাচার্য


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!