• 13 November 2022

    চন্দ্রবিন্দু থেকে চ

    চন্দ্রবিন্দু থেকে চ

    0 56

    চন্দ্রবিন্দু থেকে চ
    শুভময় মণ্ডল

    প্রথমেই নিজের পরিচয়টা দিয়ে নিই। আমি হীরক সেন, এক শখের গোয়েন্দা, প্রকৃত জীবিকায় আধা সরকারি কর্মচারী। এক প্রকার বলতে গেলে, আমার নিজের গোয়েন্দাগিরি শুরু করার কারণ ও কিভাবে আমি তার প্রয়োজনীয়তা নিজে উপলব্ধি করি, সেটা নিয়েই এই কাহিনীর উপস্থাপনা। গোয়েন্দা হিসেবে আমার প্রথম উদ্ধার করা সেই রহস্য কাহিনীটিই বলবো এখানে।

    এই ঘটনার সূত্রপাত হয় যখন, তখন আমি নিজের গোয়েন্দাগিরি করার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি। জীবিকার সন্ধানে তখন একাগ্র চিত্তে পড়াশুনা করছিলাম - বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোয় বসছিলাম, মানে পুরোই সাধারণ মানুষ, আম আদমি। সঙ্গে টুকটাক টিউশনি বা ফ্রীলান্সিং ইত্যাদি করে নিজের প্রয়োজনীয় খরচ খরচা মেটানোর চেষ্টা করতাম, আর কি! এই ঘটনাটির সূত্রপাত ঘটেছিল ঠিক আমার চোখের সামনে।

    চলুন, আর কথা না বাড়িয়ে সেই ঘটনাতেই বরং প্রবেশ করা যাক।

    চন্দ্রবিন্দুর কথা

    ২০০৭-এর এক বর্ষার সন্ধ্যায় কাজ সেরে বেলুড় থেকে ফিরছিলাম। বেলুড় মঠ থেকে কুঠিঘাটে এসে পৌঁছালো শেষ নৌকাটা। লোকজন সবাই নেমে যেতেই, মাঝি নৌকাটাকে একটু পাশে টেনে এনে, জেটির ভিতর দিকে বাঁধতে গিয়ে দেখে- জলে ভেসে এসে ওখানে আটকেছে একটা যুবতীর লাশ।

    পুলিশে খবর দেওয়া হলো। বরানগর থানার পুলিশ এসে তুললো মেয়েটার লাশ। তার গলায় লাল ফাঁশের দাগটা তখনও ছিলো! সেটা তার ওড়নার কারণে কিনা তখনই বোঝা যায়নি। তবে ওড়নাটা পেঁচিয়েই যে তাকে মারা হয়েছে বা সে নিজেই আত্মহত্যা করেছে, সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো পুলিশ।

    মেয়েটার পরনের জীন্সের প্যান্টের পকেটে ছিলো একটা আইকার্ড, যদিও সেটা ইস্যু করেছিলো যে সংস্থা তার নাম প্রায় মুছেই গিয়েছিলো। মেয়েটির ছবিও ছিল না। শুধু মেয়েটার নাম আর নদীয়ার একটি গ্রামের ঠিকানা কোনোমতে পড়া সম্ভব হলো। একটা জেন্টস রুমাল, সাধারণত কোনো লেডিস রুমাল স্কোয়ার চেক-প্রিন্টেড হয়না তো তাই, ছিলো অন্য পকেটে। একহাতে লোহার চুড়ি আর অন্যহাতে ছিল টাইমেক্সের লেডিস ঘড়ি। তার কাছে কোনো পার্স পাওয়া যায়নি- এটা খুবই আশ্চর্য্যের। অবশ্য হতেই পারে, সেটা জলে অন্যত্র ভেসে চলে গেছে!

    জীন্সের বেল্টটা পিইউ লেদারের কিন্তু জীন্সের ব্র্যাণ্ড লী! একটা পায়েই স্নিকার ছিলো- ব্র্যাণ্ড পুমা। লী ব্র্যাণ্ডের জীন্স বা পুমার স্নিকার তখন নদীয়ার সেই প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা পরার সুযোগ পেতো কিনা বা এখনও পরতে পায় কিনা সন্দেহ আছে! পুলিশ তার পরনের টপ এবং অন্যান্য অন্তর্বাসের কোনও পরিচিত ব্র্যাণ্ড খুঁজে পায়নি। ব্লু-জীন্স আর গোলাপী কোয়ার্টার-স্লিভ টপ পরিহিতা সেই মেয়েটারই কি ছিল- ঐ লাল ওড়নাটা? নাকি, জলে ভেসে এসে আটকে গেছে সেটা ওর গায়ে? অথবা তাকে মারার জন্যই কি ব্যবহৃত হয়েছিলো ওটা? কিংবা সে নিজেই কি ওটার সাহায্যে আত্মহত্যা করেছিল?

    বডিটা পোস্ট-মর্টেমে পাঠিয়ে দিয়ে, ফোন তুললেন বরানগর থানার বড়বাবু।
    -হ্যালো, কে রমেশ নাকি? আমি সেবাব্রতদা বলছি রে। তোর নাকাশীপাড়া থানায় পড়ে তো সুধাকরপুর গ্রামটা? ঐ গাঁয়েরই একটা ঠিকানা একটু দেখে দিতে হবে ভাই। হ্যাঁ, তোকে এসএমএস করেছি। আরে না না, একটা মেয়ের বডি পাওয়া গেছে আজ গঙ্গার ঘাটে, তার পকেটে যে আই-কার্ডটা ছিলো, সেটাই ভেরিফাই করা আর কি!

    তোকে ডিটেল্স মেসেজ করলাম, একবারেই জেনে নিস সব। আর মেয়েটার নামে কোন মিসিং ডায়রী আছে কিনা তোর ওখানে সেটাও দেখে নিস। রাখি তাহলে? হ্যাঁ, আর বলিস কেন এই লোকাল ক্লাব আর পার্টীর ছেলেরা সবাই ঢুকে বসে আছে কেসটায়। একটা এনকোয়ারী রিপোর্ট না দিলে, কেসটা ক্লোজই হবে না। এদিকে আবার মিডিয়াও... সে এক বিশ্রী ব্যাপার। তুই একটু দেখে শুনে নে, আমি পরে ফ্যাক্স করে সব জানাচ্ছি।

    পরের সপ্তাহেই আবার ফিরতে হলো আমায়, ঐ নৌকাতেই। নিয়মিত যাতায়াতের কারণে, মাঝি অমিতদার সঙ্গে বেশ পরিচয় হয়ে গিয়েছিলো তখন। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম- কিগো, সেদিন যে মেয়েটার বডি পাওয়া গেলো, তার ব্যাপারে কিছু জানতে পারা গেলো?

    অমিতদা- আর বোলো না দাদা, বড়বাবু নিজেই তো থাকেন বালিতে। মাঝে মাঝে এই দিকে যাতায়াতও করেন। ওনার কাছেই শুনলাম রোববার, মেয়েটার পকেটে যে আই-কার্ডটা পাওয়া গিয়েছিলো, সেটা ফেক। নদীয়ার সেই গ্রামে ঐ নামের কোনো মেয়ে নেই, ঐ পদবীরই নাকি কেউ নেই সেখানে। গ্রামটা নাকাশীপাড়া থানায় পড়ে, সেই থানাতেও গত তিন-চার মাসে একটা মিসিং ডায়রী পর্যন্ত কেউ করেনি!

    আমি খবরটা শুনে বেশ হতাশ হলাম। ঘাটে নেমে সিঁথির মোড়ের অটো ধরবো বলে হাঁটছি, হঠাৎ রাজীবদার সঙ্গে দেখা। বললো- কোথায় যাচ্ছিস রে এ'দিক দিয়ে?
    বললাম - বেলুড় থেকে ফিরছি, ব্যারাকপুর যাবো। কিন্তু তুমি এখানে?
    বললো - আমরা তো এখানেই ফ্ল্যাট নিয়ে চলে এসেছি, তাও প্রায় বছর সাতেক হলো। ঐ তো আমাদের ক্লাবে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তোকে দেখে বেরিয়ে এলাম। আয়, একটু চা খেতে খেতে গল্প করি, বহুদিন পর দেখা হলো তোর সঙ্গে। তোকে দমদম থেকে ট্রেন ধরিয়ে দিলেই হবে তো? চল একটু বসা যাক।

    অগত্যা, কুঠিঘাটের গায়েই চায়ের দোকানটা থেকে দু'কাপ চা নিয়ে গঙ্গার ঘাটে বসলাম। একথা ওকথার পর সেই মেয়েটার কথাও উঠলো। ঠিকানাটা নাকি ফেক বেরিয়েছে বলতেই, রাজীবদা বললো - তোর কি মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করেই পুলিশ কেসটা থেকে গা এড়িয়ে যাচ্ছে?

    বললাম - পুলিশের অনেক কাজের চাপ। একটা বেওয়ারিশ লাশের জন্য তারা মাথা ঘামাতে কেন যাবে বলো তো? তাদের কি কাজ কিছু কম আছে?

    রাজীবদা - কিন্তু আমরা ক্লাব থেকে যে কেসে ডায়রী করেছি, এত সহজে তো ক্লোজ হবে না সেটা! জানতে হচ্ছে ব্যাপারটা! তুইও চল, একবার থানাটা হয়েই তোকে স্টেশনে ড্রপ করে দেবো।

    নিরুপায় হয়ে যেতেই হলো থানায়। দেখি বড়বাবু, মেজবাবু নেই। ডিউটিতে এএসআই যিনি ছিলেন, বললেন - আজই তো ঐ কেসের পোস্ট-মর্টেম রিপোর্ট নিয়ে বড়বাবু কথা বলছিলেন। শুনলাম, শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছে মেয়েটাকে, স্যুইসাইড নয়। তবে যে ওড়নাটা পাওয়া গিয়েছিলো সেটা নয়, ব্যাগের ফিতে জাতীয় কিছু দিয়ে, তার গলাটা পিছন থেকে পেঁচিয়ে ধরে খুনটা করেছে! ঘাড়ে ঐ ফিতের ক্রস মার্ক ডিটেক্ট করা গেছে। বডিটা ফাঁস দিয়ে ঝোলায়নি, উপুড় করে শুইয়ে, তার গলাটা ফিতের ফাঁসে চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে খুন করেছে।

    এর বেশি তথ্য তার কাছে ছিলো না। আমাদেরও আর বিশেষ কিছু করারও ছিলো না। তাই চলে এলাম। রাজীবদা ওর বাইকে বসিয়ে স্টেশনে ছেড়ে গেলো আমায়। পরে শুনলাম, ঐ ক্লাবের জোরাজুরিতে, বড়বাবু নাকাশীপাড়া থানায় মেয়েটার একটা ফটো পাঠিয়েছেন, ফার্দার এনকোয়ারীর জন্য।

    মেয়েটার সেই আই-কার্ডের ঠিকানায় আরও খোঁজ খবর নিলো পুলিশ, ফটোটা নিয়ে। বরানগরের এমএলএ সাহেবের ক্লাব বলে পরিচিত হওয়ায়, বড়বাবু বোধ হয় একটু বেশিই গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন এই কেসটায়! যাই হোক, পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারলো, মেয়েটা ঐ গ্রামের নয় কিন্তু ওখানকার মেলায় হয়তো গিয়েছিলো সে কারও সঙ্গে, কিন্তু কার সঙ্গে জানা যায়নি।

    কল্যাণীর কৃষিবিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদেরও কেউ হতে পারে সে। কারণ, ওখানকার একদল ছাত্রছাত্রী, কোন একটা ফসল চাষের ব্যাপারে কোনো এক্সপেরিমেন্ট বা রীসার্চের জন্য কিছুদিন ছিলো সেখানে। ওখানে গঙ্গার একটা বিরাট অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ আছে, ভরা জোয়ারে সেখানে জল ঢোকে এখনও! তাই ওদের আনাগোণা চলে সেখানে প্রায়ই। সেও হয়তো তাদেরই কেউ অথবা তাদেরই সঙ্গে গিয়ে থাকবে ওখানে!

    মেয়েটির কপালে একটা রোমশ কালো ছোট জড়ুল ছিল। সে'জন্যই লোকে ছবিটা দেখে চিনতে পারছিলো তাকে। নয়তো মেলার ভিড়ে, বাইরে থেকে আসা একটা সাধারণ মেয়েকে লোকে অকারণ মনে রাখতে যাবেই বা কেন? যাই হোক, এরপর খোঁজখবর নিল পুলিশ কল্যাণীতেও। মেয়েটি সেখানকার স্টুডেন্ট ছিল না! অগত্যা, তাকে অন্তত চেনে এমন কাউকে খোঁজা হলো, কিন্তু প্রথমে সে'রকমও কাউকে পাওয়া গেলনা!

    পরের সপ্তাহে ফেরার পথে রাজীবদার কাছে শুনলাম, ওখানকার স্টুডেন্ট ইউনিয়নের এখন জিএস যে মেয়েটা, তা'কেই ওদের ক্লাবের এক দাদা সেই মেয়েটার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলেছিল। মেয়েটার যে ফটো তারাও তুলেছিলো সেদিন, তারই একটা কপি পাঠিয়েছিলো তাকে। সেখান থেকেই জেনেছে যে, ওখানকার এক পার্টটাইম লেকচারারের গার্লফ্রেণ্ড ছিলো মেয়েটা। তিনি পার্মানেন্ট লেকচারার হিসাবে পরে শ্রীরামপুর কলেজে জয়েন করেছেন, তাই আর কল্যাণী আসেন না। তাঁর মোবাইলে যোগাযোগ করে ক্লাবের ছেলেরা, উত্তরপাড়ায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিলো।

    স্যারের নাম অভিরূপ রায়। মেয়েটিকে তিনি ছবি দেখে শনাক্তও করেন, কিন্তু আসল খবরটা শুনে, ওদের সামনেই হাউ হাউ করে নাকি কেঁদে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর, নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন- এমএসসি করে, নেট দেবে বলে কলকাতায় এসেছিলো স্বপ্না। ওর নাম স্বপ্না দাস, সেই আইকার্ডে যে নামটা ছিলো সেটা না!

    ময়েটির নাম স্বপ্না দাস, সেই আইকার্ডে যে নামটা ছিলো সেটা না! তার আসল বাড়ি মালদা, সঠিক ঠিকানাটা তাঁর জানা ছিলো, কিন্তু সেই মুহুর্তে মনে করতে পারেননি। পড়াশুনার কারণে স্বপ্না আড়িয়াদহে থাকতো, তাঁর কাছে আসতো রোজ নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে। অনেকদিন ধরেই রীলেশান তাঁদের। সবে তিনি কলেজে লেকচারার হিসাবে জয়েন করেছেন। ঠিক করেছিলেন তার নেট পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই বিয়ের কথা বলবেন বাড়িতে। কিন্তু এই নিয়েই মাস খানেক আগে নাকি, নিজেদের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাঁদের।


    স্বপ্না এখনই বিয়ের জন্য রাজী ছিলো না। কোনো বিশেষ কারণও ছিলো না তার মানা করার। শুধু এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চায় না সে, এমনটাই বলে হঠাৎ রাগ করে উঠে চলে গিয়েছিলো ঘর থেকে। মোবাইলটা রাগ করে সে ওখানেই ফেলে গেছে দেখে, তাকে সেটা দেবার জন্য উনি লঞ্চঘাটে দৌড়েছিলেন।


    কিন্তু সেখানে এসে দেখেন, স্বপ্না ওখানে যায়ই নি! আড়িয়াদহে স্বপ্নার মেসের রুমমেট ছিলো রত্না, সেও তাঁর ছাত্রী। তাই তাকেই কল করেন তিনি খবরটা জানাতে। কিন্তু রত্না জানায়, স্বপ্না নাকি তার কয়েকদিন আগেই ওখানকার ঐ মেস ছেড়ে, চলে এসেছে উত্তরপাড়ায়! এখন সে নাকি উত্তরপাড়াতেই কোনো মেসে থাকে! অথচ তিনিও জানতেন না এ বিষয়ে কিছুই!


    দু'তিন দিন বাদেও যখন না তো স্বপ্না এলো, না রত্না দিতে পারলো তার কোনো খোঁজখবর, তিনি থানায় মিসিং ডায়রী করেন, সেও প্রায় মাস খানেক আগে। তার রিসিপ্টও ছিলো তাঁর কাছে। মোবাইলের কল-হিস্ট্রি থেকে, রত্নার সঙ্গে কলের ডেটটাও দেখান তিনি। ঐ তারিখেই তিনি লাস্ট কল করেছিলেন রত্নাকে। স্বপ্নার সেই মোবাইলটাও দেখালেন তিনি। স্বপ্না, রত্না দু'জনেরই ফোন নম্বরও কাগজে লিখে দেন তিনি।


    ক্লাবের ছেলেরা বরানগর থানায় মেয়েটার সেই মিসিং-ডায়রীর কপি, আর তাদের দুজনের ফোন নম্বরদু'টো জমা করে দেয়। স্বপ্নার বাড়ির সঠিক ঠিকানাটা পাওয়া গেলো না তবুও। মোবাইল নম্বরের সাবস্ক্রাইবার ডিটেলস থেকে জানা গেলো, প্রিঅ্যাক্টিভেটেড সিম ব্যবহার করছিলো সে। তাই সাবস্ক্রাইবারের নাম ঠিকানা কোনো কিছুরই হদিশই পেলোনা পুলিশ। অভিরূপ রায় নিজেও পরে বরানগর থানায় এসে, বড়বাবুকে সেই মিসিং-ডায়রীর অরিজিনাল রিসিপ্টটা জমা দেন।


    নেট পরীক্ষার জন্য নাকি গাইড করছিলেন তিনি স্বপ্নাকে। সেই থেকেই প্রেমের সূত্রপাত হয় তাঁদের, তাও প্রায় বছর খানেক আগে। স্বপ্না নিজের বাড়ির ব্যাপারে কিছু বলতে বিশেষ উৎসাহ দেখাতো না, তিনিও জোরাজুরি করতেন না। তবে এটা জানতেন যে, মালদারই কোনো গ্রামে তার বাড়ি, নামটা একটু আনকমন বলে এখন মনে নেই তাঁর।


    স্বপ্নার মার্কশীট বা পাস সার্টিফিকেটগুলো পাওয়া গেলে, সেই ইন্স্টিটিউট থেকে হয়তো জানা যেতে পারতো তার ঠিকানা। তার স্কুলের পড়াশুনার ব্যাপারে স্বভাবতই তাঁর কিছুই জানা ছিল না। এদিকে দক্ষিণ-ভারতের কোন কলেজ, কোন ইউনিভার্সিটি থেকে যে গ্রাজুয়েশন আর মাস্টার্স ডিগ্রী করেছিলো সে, তাও তো মনে করতে পারলেন না তিনি। মোট কথা, মেয়েটির বিষয়ে নতুন করে আর কোনো কিছুই জানা গেলো না তার সেই লেকচারার প্রেমিকের থেকে!


    পুলিশের কাছে এখন একটাই পথ খোলা ছিলো, যদি রত্নার থেকে কোনও খোঁজখবর মেলে। বেলঘরিয়া থানার মেজবাবু অপূর্ব সাহাকে তাই কল করলেন বড়বাবু। তাঁকে সব ঘটনা জানিয়ে, রত্নার ফোন নম্বরটাও দিয়ে, তার থেকে যা যা দরকার সব জানতে অনুরোধ করলেন।


    বেলঘরিয়া থানার মেজবাবু, প্রথমে রত্নাকে একটা কল করাই ঠিক হবে ভাবলেন। রত্না ফোনটা ধরতেই, তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বেলঘরিয়া থানায় একবার আসতে বললেন তাকে।


    রত্না জিজ্ঞাসা করলো- খুব জরুরী দরকার কি? আমি আপনাদের থানার উল্টোদিকেই কোচিং-ক্লাসে আছি এখন! আধঘন্টায় ক্লাসটা শেষ করেই আসছি, কিন্তু কি ব্যাপার সেটা একটু বলবেন?
    মেজবাবু- আপনার বন্ধু তো স্বপ্না দাস?
    রত্না- হ্যাঁ, তার খোঁজ পাওয়া গেছে? কোথায় সে?
    মেজবাবু- সে মারা গেছে। তাই আপনাকে ডাকা, এসে জাস্ট তাকে আইডেন্টিফাই করে দিয়ে চলে যাবেন, পাঁচ দশ মিনিটের কাজ। ঠিক আছে, আপনি ক্লাস শেষ করেই আসুন।
    রত্না- না না, আমি এখনই আসছি, দু'মিনিট টাইম দিন।

    অপূর্ব সাহা ফোনটা কেটেই, বরানগর থানায় কল করলেন। বড়বাবু ফোন ওঠাতেই, তিনি বলা শুরু করলেন- স্যার, মেয়েটা থানার সামনেই আছে, দু'মিনিটে চলে আসছে থানায়। আপনি কি ওখান থেকে কাউকে পাঠাতে পারবেন? এদিকে প্রবর্তক-পল্লীতে বিশাল ঝামেলা লেগেছে, টিভি নিউজেও দেখাচ্ছে, দেখুন। বড়বাবু তো আগেই গেছেন ওখানে, এখন আমিও বেরোচ্ছি।

    বড়বাবু ফোনটা ধরে এতক্ষণ কিছু বলার চেষ্টাই করছিলেন, অপূর্ববাবু থামতেই তিনি বললেন- ঐ ঝামেলার খবরটা দেখে, এএসআই সুমিত আগেই বেরিয়ে গেছে আপনাদের থানার দিকে। ওকেই বরং মোবাইলে একটু জানিয়ে দিন।

    সুমিত বেলঘরিয়া থানায় পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতে নামতেই, রত্নাও ওখানে পৌঁছালো৷ দু'জনকে তাঁর চেম্বারে বসিয়ে দিয়েই, মেজবাবু দৌড় দিলেন প্রবর্তক-পল্লীর দিকে। সুমিত রত্নাকে জানালেন যে, স্বপ্নার বডিটা তো মর্গে, কিন্তু তার ফটো তাঁদের কেস ফাইলে আছে। এখন, সে যদি তাঁর সঙ্গে বরানগর থানায় গিয়ে তাকে শনাক্ত করে, তাহলে ভালো হয়।

    রত্না তাঁর সঙ্গে বরানগর থানাতেই চলে যায়। সেখানে বড়বাবু তাকে ফাইলে রাখা স্বপ্নার ছবি দেখালে, সে আইডেন্টিফাই করে তাকে। রত্নাকে বড়বাবু স্বপ্নার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করেন। মানে, স্বপ্না আগে কোথায় কোন কলেজে পড়তো, কোথায় তার আসল বাড়ি, এখানে পরে কোথায় সে থাকতো, ইত্যাদি।

    রত্নার থেকেও অবশ্য বিশেষ কিছু নতুন তথ্য পুলিশ পায়নি। কারণ, প্রায় মাস দুয়েক আগে মেস ছেড়ে যাবার সময়, নিজের সঠিক ঠিকানা দিয়ে যায়নি স্বপ্না। পরে এসে, ওকে তার নতুন মেসে নিয়ে যাবে বলেছিল। নিজের বইপত্র জামাকাপড় পোশাক-আশাক সবই সে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে যে আর ফিরবেই না কখনও, এটা রত্না ভাবতেই পারেনি।

    মালদার গ্রামে স্বপ্নার আসল বাড়ির কথাটা বললেও, গ্রামের নামটা সেও বলতে পারল না। তার কলেজের ব্যাপারে প্রশ্নের উত্তরেও সেই একই সমস্যা হলো- দক্ষিণভারতের কোন কলেজ থেকে স্বপ্না পড়েছে, তার নাম মনে রাখেনি সেও। সম্ভবত তার বাবা-মা দক্ষিণ ভারতেই থাকতেন, কর্মসূত্রেই হবে হয়তো। কিন্তু স্বপ্নাকে তার বাবা মার সাথে কথা বলতে সে দেখেনি কখনও।

    তবে নদীয়ার সুধাকরপুর গ্রামটাতে তার যাওয়ার ব্যাপারটা সে জানতো। কল্যাণী ইউনিভার্সিটির কিছু এক্স-স্টুডেন্টদের সঙ্গে গিয়েছিল সে সেখানে। কিন্তু ঠিক কাদের সঙ্গে সেটা বলতে পারলো না। সেই আই-কার্ডের রহস্যটার অবশ্য সমাধান হল। স্বপ্না তাদের সঙ্গে সুধাকারপুর না গিয়ে, পরে যাবে বলায়, তাদেরই একজন পার্সের ভিতরে যেসব মডেল আই-কার্ড থাকে, সেইরকমই একটা কার্ডে, তার নাম আর ঐ গ্রামের ঠিকানাটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলো তাকে। সেই মেয়েটিরও যে ওখানে বাড়ি নয় সেটা জানলেও, কোথায় যে তার আসল বাড়ি তা' অবশ্য রত্না জানতো না।

    অভিরূপ স্যারের সাথে স্বপ্নার প্রেমের ব্যাপারটা সে জানতো, তারা বিয়ে করবে খুব তাড়াতাড়ি সেটাও জানতো। কিন্তু ইদানিং স্যারকে যেন একটু এড়িয়ে চলছিল স্বপ্না, যদিও কারণটা সে জানে না, স্বপ্নাও তাকে কিছু বলেনি। তবে, বোধ হয় অন্য কোনো ছেলেকে তার ভাল লেগেছিল, কিন্তু সেটা যে কে সে বিষয়েও কিছুই জানা নেই তার।

    তার এমন মনে হওয়ার কারণ সম্পর্কে, সে ব্যাখ্যা দিয়েছিল, স্যারের সাথে কথা বলার জন্য স্বপ্না কখনই উঠে যেত না তার কাছ থেকে। বরং তাকে শুনিয়ে শুনিয়েই সে স্যারের সাথে প্রেমের কথা বলতো! কিন্তু ইদানিং একজনের ফোন এলেই, সে তার থেকে দূরে চলে গিয়ে, চুপি চুপি একা কথা বলতো। তার যতটুকু নজরে পড়েছিল, সেই নম্বরটা লোকাল ল্যান্ডলাইন নম্বর ছিলো, হয়তো কোন টেলিফোন বুথ থেকে ফোনটা আসতো। কারণ, তারা ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলতো না। দ্রুত ফোনের কথা শেষ করে, সে বেরিয়ে যেতো মেস থেকে, আর ফিরতোও অনেক দেরী করে।


    তার গত দু-তিন মাসের মোবাইল কল ডাটা চেক করে, পুলিশ রত্নার সেই কথার সত্যতা খুঁজে পায়। সত্যিই সে যা ভেবেছিল তাই, ল্যান্ডলাইন থেকে তার নম্বরে আসা স্বল্প সময়ের কলগুলোর প্রত্যেকটাই এসেছিল দক্ষিণেশ্বরের কয়েকটা পাবলিক বুথ থেকে। ফলে পুলিশের পক্ষে সেই কলারকে খুঁজে পাওয়া কোনভাবেই সম্ভব হয়নি।

    খবরের কাগজে স্বপ্নার ছবিসহ একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পুলিশ, কিন্তু স্বপ্নার বডি ক্লেম করতে কেউ আসেনি। অভিরূপ রায়ের হাতেও তার বডি তুলে দিতে রাজী হয়নি পুলিশ। এরই মধ্যে কর্মসূত্রে আমিও চলে গেলাম অন্যত্র। আর জানাই হলো না শেষ পর্যন্ত কেসটার কি হলো।

    চ-এ ফেরা

    প্রায় বারো বছর পর, সেই কুঠিঘাটেই আজ দেখা হলো হঠাৎ রাজীবদার সঙ্গে। সে এখন বড় নেতা হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম- রাজীবদা, সেই মেয়েটার কথা মনে পড়ে, যার ডেডবডিটা পাওয়া গিয়েছিল এই ঘাটে? জানতে পেরেছিলে মেয়েটা কে ছিল বা কে মেরেছিল তাকে?
    রাজীবদা বলল- না ভাই, আজও রহস্যই রয়ে গেল রে কেসটা। বুঝতেই পারলাম না কি যে রহস্য!

    বললাম- তোমার কি মনে আছে, সেই মেয়েটার সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত ঠিক কি কি জানা গিয়েছিল? কিংবা পুলিশ তার বিষয়ে ঠিক কতটা ইনফর্মেশন জোগাড় করতে পেরেছিল? আমার পুরনো বন্ধু বলেই তোমাকে বলছি, তুমি কি চাওনা রহস্যটার কিনারা হোক?

    রাজীবদা- সে আর বলতে? স্কুলে পড়ার সময়, তোর-আমার মধ্যে কত প্রতিযোগিতা হয়েছে বল এই রকম রহস্য উদ্ধার করা নিয়ে, মনে আছে? আধখানা করে উপন্যাস পড়ার পর, শেষ না করে রেখে দিতাম শেষটা কি হতে পারে নিজেরাই সেটা উদ্ধার করবো বলে! আর এখন, এমন একখানা রহস্য হাতের কাছে থাকতেও, সেটা না জেনে ছেড়ে দেবো?

    আসলে তখন মূলতঃ রাজনৈতিক কারণেই একটু অসুবিধা হয়ে গিয়েছিলো, তুইও ছিলি না। তাই আর বিশেষ ইনভল্ভড্ হতে পারি নি বিষয়টাতে, কিন্তু এখন যখন তুইও একটা হেস্তনেস্ত চাইছিস, তো আব ছোড়নে কা নেহি। বল কি করতে হবে, রহস্যটার একটা কিনারা করেই ছাড়বো।

    বললাম- দেখো, তুমি তো এখানেই ছিলে, আমিই বরং বহুদিন কর্মসূত্রে বাইরে ছিলাম। তো তুমিই ভালো জানো কেসটার শেষে কি অবস্থা হয়েছিল। আমায় সেগুলোই একটু বলো, মানে যতটা জানতে পেরেছিলে তুমি সেটুকুই বলো। আরো যদি কিছু জানার থাকে, সেটা আমিই তোমার থেকে জেনে নেবো।

    রাজীবদা তখন একবারে আগাগোড়া পুরো কেসটা ঝালিয়ে দিল আবার। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, কোথাও যেন একটা সূত্র বারবার সামনে এসেও হারিয়ে যাচ্ছে, ধরতে পারছি না। অনেকক্ষণ ভেবে রাজীবদাকে বললাম- কয়েকটা পয়েন্ট তোমাকে বলছি, একটু খবর নাও দেখি।

    এক, কল্যাণীর যে মেয়েটির নাম পাওয়া গিয়েছিল ওর পকেটের আই-কার্ডে, তাকে খুঁজে বার করতে হবে। জানতে হবে, সে স্বপ্নাকে কিভাবে চিনতো আর তার বিষয়ে সে ঠিক কি জানে?

    দুই, তাদের দুজনেরই, মানে স্বপ্না এবং রত্নার ২০০৭-এ নেট দেবার ছিল, তাহলে তারা অবশ্যই নিজেদের সমস্ত এ্যাকাডেমিক ক্রেডেন্সিয়াল্স ফর্ম ফিলাপের সময় জমা করেছিল। সুতরাং ইউজিসি অফিসে তাদের সমস্ত ডিটেলস থাকার কথা! যে করেই হোক, সেখান থেকে ওগুলো আনাতে হবে।

    তোমাদেরই কোনো একজন নেতার রিলেটিভ ইউজিসিতে জয়েন করলো বলে, কিছুদিন আগে খুব সমালোচনা হচ্ছিলো, শুনেছিলাম। পারলে তাঁরই সাহায্য নিয়ে দেখো, কাজটা করতে পারা যায় কিনা!

    তিন, অন্তত ঘটনার আগের দু-তিন মাসের জন্য রত্নার মোবাইলের কল ডাটা, অভিরূপ রায়েরও কল ডাটা এবং অভিরূপ রায়ের মোবাইল টাওয়ার লোকেশন হিস্ট্রি জোগাড় করতে হবে। পুলিশের কাছে ওদের মোবাইল নম্বরগুলো পেয়ে যাবে। ইনফরমেশনগুলোও তাদের কাছ থেকে পাওয়া গেলে ভালো, না হলে বিএসএনএল-এর থেকে হেল্প নিতে হবে। এটাতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না, জানি।

    আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছে, আমি বোধহয় অল্প হলেও বুঝতে পারছি, খুনি কে? তুমি ঐ তথ্য তিনটে জোগাড় করে দাও, বাকি রহস্য আমি উদ্ধার করে দেবো। কি বলছো, কতদিন সময় লাগবে?

    রাজীবদা- আমায় দু'সপ্তাহ সময় দে, তার মধ্যেই আমি সব তথ্য জোগাড় করে দিচ্ছি। দেখা যাক, রহস্যের কিনারা করা যায় কিনা।


    দু'সপ্তাহ বললেও, রাজীবদা অতটাও তাড়াতাড়ি সব কাজ করে উঠতে পারেনি। প্রায় মাস দু'য়েক পর, একদিন সন্ধ্যাবেলায় রাজীবদা কল করে ডাকলো - ভাই, সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে, চলে আয়। চলে গেলাম।

    রাজীবদা আমাকে দুটো সিডি আর একটা এফোর সাইজের সিল্ড এনভেলপ দিয়ে, বলল - আই-কার্ডে পাওয়া কল্যাণী ইউনিভার্সিটির সেই মেয়েটা জানিয়েছে যে, তাদের প্রফেসর অভিরূপ রায়ের গার্লফ্রেন্ড বলেই স্বপ্নাকে দলে নিয়েছিল তারা। এছাড়া, স্বপ্নার সঙ্গে তাদের গ্রুপের কারোরই কোনো সম্পর্ক ছিল না।

    এই উত্তরটা আমার আশানুরূপই ছিল। তাই খবরটা শুনে খুশি হলাম দেখে, রাজীবদা বলল - ওর থেকে তো কাজের কিছুই জানা গেল না, তবুও তুই খুশি হচ্ছিস কেন?

    বললাম- দাদা, আমি এক্সপেক্টই করেছিলাম যে ওই মেয়েটি বা তার সঙ্গী সাথীরা বিশেষ কিছুই জানবেনা এই স্বপ্না নামের মেয়েটির সম্পর্কে। তদন্তকে ভুল পথে চালনা করার জন্যই সম্ভবত ইচ্ছা করে ওর পকেটে ওই কাগজটি রাখা হয়েছিল। জেন্টস রুমালটাও সম্ভবত সেই কারণেই রাখা।

    খুনি জানতো যে কোনো না কোন ভাবে লাশটা পুলিশের হাতে এসে যেতেই পারে‌। সেক্ষেত্রে যথাসম্ভব নিজেদের বাঁচাবার জন্য, বেস্ট প্ল্যান করে কেসটা সাজিয়ে দিয়েছিলো। একটা সাধারণ ঘটনা হিসাবে, এই কেসটাতে পুলিশ যতটা তদন্ত করতে আগ্রহী হতে পারে, ততটা পর্যন্তই প্রকাশের উপযোগী করে বাকি সমস্ত ঘটনা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখে দিয়েছে।

    তাদের অনুমান ছিল যে বেওয়ারিশ একটা লাশের জন্য পুলিশ নিশ্চয়ই স্বর্গ-মর্ত্য এক করে অনুসন্ধান করবে না, তাদের আরো অনেক কাজ আছে। সুতরাং তাদেরকে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করণীয় তাই করে রেখেছে কেসটায়।

    তুমি কি এই সিডিআর-গুলো বা ইউজিসির রিপোর্ট বা টাওয়ার লোকেশনগুলো চেক করে দেখেছো? তাহলে হয়তো তুমিও অনেক কিছুই বুঝতে পারতে। এটাও পরিষ্কার বুঝতে যে আমি কোন দিকে ইঙ্গিত করছি।

    রাজীবদা - না রে, আমি আর ওগুলো চেক করিনি। তুই নিজেই যখন দায়িত্ব নিয়েছিস, এই বিষয়টায় আলাদা করে সময় দিচ্ছিস, তদন্তটা করছিস, তখন আমি আর এখানে নাক গলাতে চাইনা। তোর তদন্ত শেষ হলে তোর থেকেই শুনবো সব, আর যদি কিছুর দরকার পড়ে আমাকে বলিস, আমি চেষ্টা করব।

    বাড়ি ফিরে আমি বসলাম রত্না আর অভিরূপ রায়ের কল-ডাটা রেকর্ড চেক করতে। একটু সময় লাগলো রিপোর্টগুলোকে এডিটেবল ভার্সনে ট্রান্সফার করে নিতে। আর সেটা হয়ে যেতেই, যথারীতি রহস্যের জালও খুলতে শুরু করলো।

    ইউজিসির ডকুমেন্টসগুলো খুঁটিয়ে দেখলাম - না, স্বপ্না কোন দক্ষিণ ভারতের স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করেনি। সে দক্ষিণবঙ্গের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছিল। তার স্কুলের ঠিকানায় গিয়ে হাজির হলাম পরদিন সকালেই।

    হেডমাস্টার মশাইটি নতুন এসেছেন, কিন্তু স্কুলের বড়বাবুটি বেশ পুরনো। স্বপ্নার মাধ্যমিকের পাস সার্টিফিকেটের কপিটা তাঁকে দেখিয়ে, তার সঠিক ঠিকানা জানতে চাইলাম। তিনি ভালো করে সেটা দেখে একটু চিন্তা করে, হাঁক দিলেন - ভবতারণ!

    একজন ছিপছিপে চেহারার মাঝবয়সী লোক এসে হাজির হলো। মুখ থেকে তার ভুর ভুর করে বেরোচ্ছে দেশী কারণের গন্ধ, জর্দা দেওয়া পানের পিকে লাল ঠোঁট। সে এসে আমাকে আপাদমস্তক দেখতে দেখতে বলল - বলুন স্যার, কি আনতে হবে?

    বড়বাবু বললেন - ২০০০ সালের আগের মাধ্যমিকের রেজিস্টারটা নিয়ে এসো।

    ভবতারণ একখানা ইয়াব্বড় জাবদা খাতা এনে হাজির করলো তাঁর সামনে। তিনি একটু উল্টে পাল্টে দেখে, একটা কাগজে খসখস করে একটা ঠিকানা লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন - নাম ঠিকানা সব লিখে দিলাম। কিন্তু ওখানে গিয়ে কোনো লাভ নেই, তারা সব বহুদিন আগেই মারা গেছে।


    আমি একবার চেক করে দেখছিলাম, ওদেরকেই খুঁজছেন কিনা। দেখছি, আপনি ঠিক তাদেরকেই খুঁজছেন। স্বপ্নার বাবা-মা দু'জনেই মারা গিয়েছিল ওর মাধ্যমিকের পরেই। সরকারের লোকেরা বলে বটে ওটা অ্যাক্সিডেন্ট, কিন্তু এলাকার সবাই জানে ওটা আসলে খুন ছিল।

    ওদের মেয়েটাও বাঁচতো না, সেদিন শুধুমাত্র ভাগ্যক্রমে মামার বাড়িতে থেকে গিয়েছিল তাই। ক'বছর পরে তো শুনলাম সেও খুন হয়েছে কলকাতায়। এত কথা বললাম, বলতে পারলাম আপনাকে, কারণ মেয়েটা আমায় সম্মান করে কাকু বলে ডাকতো, বড় ভালোবাসতো আমায়।

    আমি নিজে বিয়ে-থা করিনি, যা রোজগার করি সব এলাকার গরীব দুঃখীদের মধ্যে বিলিয়ে দিই। মেয়েটার প্রতি একটু মায়া পড়ে গিয়েছিল কেমন আমার, তাই বলে ফেললাম কথাগুলো। তা' নাহলে, ওদের বিষয়ে মুখ খুলবে এমন কোনো মানুষ এই এলাকায় এখন আর বেঁচে নেই।

    সে এক করুণ রাজনৈতিক পরাকাষ্ঠার কথা শুনে এলাম সেখান থেকে। আমার এই তদন্তের সঙ্গে সেই করুণ কাহিনীর যোগ আছে, কিন্তু সেই বিষয়ে গভীরে আলোচনা না করলেও, এই তদন্তের গতি-প্রকৃতি বোঝাতে আমার বিশেষ অসুবিধা হবে না। মোট কথা, স্বপ্নার খুন তো হবারই ছিল- এখানে না হলেও, গ্রামে ফিরলেই তাকে মরতেই হতো হয়তো।

    নিজের অস্তিত্বের সংকট সম্পর্কে খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল সম্ভবত স্বপ্নার। তাই সচরাচর কাউকে নিজের বাড়ি এবং বংশপরিচয় দিতে সে বিশেষ উৎসাহ বোধ করত না। প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন, বিষয়টা জানার পর, তার সেই করুণ ইতিহাস আমার তদন্তকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

    এতক্ষণ অবধি মনে হচ্ছিল, হয়তো রত্না এবং অভিরূপ রায় আসল সত্য গোপন করেছেন। সেটা মনে হবার অসংখ্য কারণও ছিল। কিন্তু স্বপ্নাদের এলাকায় গিয়ে আসল সত্যটা জানার পর, এখন আমি নিজেই সন্দিহান হয়ে পড়েছি- তারা ইচ্ছা করে মিথ্যে বলছিল, নাকি অজান্তে?

    স্বপ্নার কল ডাটা রেকর্ডে তার যত কল ছিল অভিরূপ রায়ের সঙ্গে, তার থেকে অনেক বেশি কল ছিল রত্না এবং অভিরূপ রায়ের নিজেদের মধ্যে। থানায় এসে নিজের বয়ান দেওয়ার সময় সেদিন, খুব ছোট্ট একটা ভুল রত্না করে ফেলেছিল, অভিরূপ রায়ের নম্বরটা দিতে গিয়ে।

    ****৮১৭৭৬১ -এই নম্বরটি নিজের মোবাইল নম্বর হিসেবে অভিরূপ রায় সকলকেই দিতেন, পুলিশকেও তাইই দিয়েছিলেন। কিন্তু রত্নার কাছে তার অন্য নম্বরটি ছিল- ****৮৭১৭৬১, যেটাতে শুধু তাঁরা দু'জনই কথা বলতেন।

    খুব সম্ভবত স্বপ্নার মোবাইলে টেলিফোন বুথ থেকে যে কল আসতো, সেগুলো অভিরূপ রায়েরই করা। কারণ, স্বপ্নার মোবাইলে সেই কলগুলোর আসার ঠিক আগে, অভিরূপ রায়ের অন্য নম্বরটি থেকে অবশ্যই কল বা মেসেজ এসেছে রত্নার মোবাইলে। তাঁর সেই মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনও জানাচ্ছে যে, তিনি সেই সময় ওই এলাকাতেই ছিলেন।

    এখন খটকা রইলো শুধু একটাই, অভিরূপ রায় এইভাবে স্বপ্নাকে, রত্নার কাছে বিষয়টা গোপন রেখে দেখা করতে ডাকছিলেন কেন? এটাই আমার কাছে পরিষ্কার হলো না। আর স্বপ্নাই বা রত্নাকে গোপন করতে গেল কেন বিষয়টা, যখন তাদের রিলেশন সম্পর্কে কোন কিছুই গোপন ছিলনা তার কাছে?

    এই প্রশ্নের উত্তর কেবল রত্না আর অভিরূপ রায়ই দিতে পারতো! সুতরাং আমার করণীয় এখন শুধু একটাই, তাদের কাছে সরাসরি গিয়ে এই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা! তার জন্য রাজীবদার সাহায্য নেওয়াটা একান্ত জরুরী হয়ে পড়ল।

    পরদিনই রাজীবদার সঙ্গে দেখা করে, পুরো কাহিনী শোনালাম তাকে, আর বললাম তার থেকে ঠিক কি সাহায্যের আমার দরকার এখন। তাই আমারই পরামর্শমতো তখন স্থানীয় বিধায়কের সরকারি লেটার-হেডে, আমাকে এই কেসের তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে একখানি চিঠি ইস্যু করানো হলো।


    সেই পত্রখানি পকেটে নিয়ে আজ দেখা করলাম অভিরূপ রায়ের সঙ্গে। পত্রখানি দেখাবার আর দরকার পড়েনি। খুব দরকার না পড়লে কোথাও নিজের কেরামতি বড় একটা দেখাই না আমি। বিধায়ক সাহেবের সেই নিয়োগপত্রটি দেখানোর আগে, বহুদিন পর তার জোরটা একবার পরখ করে দেখলাম।

    ।পরবর্তী অংশ পরের কলামে।



    Shubhamoy Mondal


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!