এ কেমন প্রতিহিংসা
শুভময় মণ্ডল
ভূতপূর্বাংশ
সে তখন ইংরেজ আমলের শেষ দিক। বিদায় আসন্ন বুঝতে পারার পর, অপিসে তখন নিজেদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বজায় রাখার জন্য, লালমুখো ইংরেজ কর্তারা ভয়ংকর হম্বিতম্বি শুরু করে দিয়েছিলেন।
কোনো কর্মচারীর উপর খাপ্পা হয়ে, তাকে “ফায়ার করা” – সেই সময় খুব সাধারণ ব্যাপার ছিলো ঐ বসদের জন্য। আত্মসম্মান থাকা কত সজ্জন ব্যক্তি, তখন ঐসব কারণে চাকরী হারিয়েছিলেন!
তাদেরই একজন ছিলেন টোভার সাহেব। তো সেই টোভার সাহেব, সত্যি সত্যিই একদিন – প্রচণ্ড তর্কাতর্কির পর একজন কর্মচারীকে রাগের বশে আক্ষরিক অর্থেই ফায়ার করে বসলেন, মানে গুলি করে মারলেন আর কি!
সেই কর্মচারী ভদ্রলোকের আবার, স্বাধীনচেতা বাঙালীদের মধ্যে খুব জনপ্রিয়তা ছিল। ভিতরে ভিতরে নাকি বিপ্লবীদের, দেশভক্তদের তিনি মদতও করতেন!
যাই হোক, তাঁকে গুলি করা মাত্রই প্রতিবাদে উঠে দাঁড়ালো অফিসেরই চারজন কর্মচারী – যারা নাকি তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল।
তাদের কাছে ছিল রিভলভারও! তাই সাহেবের ঐ অন্যায় দেখে, চারজনে একসাথে চারদিক থেকে গুলি করে ঝাঁঝড়া করে দিলো টোভার সাহেবকে – তাঁর নিজের অফিসেই, সবার সামনেই!
তারপর আর কি, সেই অফিস বন্ধ হলো, পুলিশ পোস্টিং বসলো সেখানে। আর টোভার সাহেবের ঐ প্রাসাদ পড়ে রইলো বেওয়ারিস হয়ে। তারপর একদিন এই দেশও স্বাধীন হলো।
সেই প্রাসাদও তারপর একদিন হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়লো হঠাৎ। সরকার থেকে তখন ঐ বেওয়ারিস সম্পত্তি দখল করে, ইঁট কাঠ সব সাফ করিয়ে সেটাকে বাচ্চাদের জন্য পার্ক কাম খেলার মাঠ বানিয়ে দেওয়া হলো।
কাহিনীর সূত্রপাত
আমাদের ছেলেমেয়েদের অ্যনুয়াল ডে ফাংশান হচ্ছিলো এবার ঐ টোভার গার্ডেনেই। আজ সন্ধ্যায় সেখানে তাদের একটা নৃত্যানুষ্ঠান ছিলো।মাঠের একধারে, ইনডোর গেমের স্থায়ী টেন্টের দোতলার একটা ঘরকে ব্যবহার করা হচ্ছিলো গ্রীনরুমের জন্য। স্টেজ বানানো হয়েছিলো তার পাশেই।
আমি, আমার এক বন্ধু, আর আমার এক জুনিয়র ভাই – স্টেজের পিছন দিকটায় অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, প্রোগ্রামটায় এরপরেই আমার বন্ধুটির মেয়ের এন্ট্রি ছিলো। আর সবশেষে এণ্ডিং পার্ট ছিলো ঐ জুনিয়র ভাইটির, সে-ই আজকের এই অনুষ্ঠানের হোতা।
বন্ধুর মেয়ে তো স্টেজে উঠে গেলো। এরপর ঐ জুনিয়র ভাইয়ের পালা। সে তাড়াতাড়ি প্রাচীরের ধারে একপাশে গেলো বাথরুম করতে। তারপর অদ্ভুতভাবে, সোজা গটগট করে স্টেজের দিকে এগিয়ে গেলো!
এই ভাইটি আমার খুবই স্নেহের পাত্র। এইরকম অনুষ্ঠানে সাধারণত স্টেজে ওঠার আগে নিজে থেকেই এসে, সে আমার শুভেচ্ছা নিয়েই স্টেজে যায়। তাই, ওর আজকের এই আচরণ একটু যেন অদ্ভুতই লাগলো আমার!
আমার বন্ধুটি আবার নিজের মেয়ের স্টেজ-পারফরমেন্স দেখতে পারে না, টেনশান হয়! তাই, ওর গিন্নি স্টেজের সামনে থেকে পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডিং করছিলো। আর সে নিজের টেনশন কাটাতে আমায় বললো – চল, আমরাও গিয়ে একটু টয়লেট করে আসি। এখনই তো প্রোগ্রাম শেষ হলেই, আবার ডিনারের জন্য দৌড়াতে হবে।
আমার অবশ্য না ডিনারের তাড়া ছিল, না প্রকৃতির ডাকের কোন বেগ। যাই হোক, তার অনুরোধে ঐ জুনিয়র ভাইটির মতই, আমরাও প্রাচীরের পাশের সেই জায়গাতেই ঐ অনুচিত কর্মটি করতে গেলাম। সেখানে প্রসাব করার সময়েই, আমার শরীরে কেউ যেন একটা ধাক্কা দিলো বলে মনে হলো আমার!
কি লগ্নে, কোন রাশীতে আমার জন্ম জানা নেই, কিন্তু ভূত প্রেতেরা আমায় দর্শন দিলেও কখনই বিশেষ প্রভাবিত করতে পারে না। এইতো, আজই সন্ধ্যায় আমার তিন বছর আগে মৃতা দিদিমাকেই যেমন দেখতে পেলাম, এখানেই, তার সাথে কথাও বললাম।
গ্রীনরুমের নিচে বারান্দায় বসে ছিলো দিদিমা। আমায় দেখে বললো – আয়, তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরী করে আসলি কেন?
আমি হেসে বললাম – তুমি তো তিন বছর আগেই পটল তুলেছো। এখানে আবার আসা কেন? বলে তার মুখে আমার হাতের টর্চের আলোর ছটা মারলাম, আর দিদিমাও নিমেষের মধ্যে অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেলো।
যাই হোক, আমার বন্ধুটিকে দেখলাম প্রসাব করে থেকে, কেমন যেন সিরিয়াস মুখে দাঁড়িয়ে। আমি বললাম – এখানকার জায়গাটা ভালো লাগছে না রে, চল আমরা স্টেজের কাছে যাই।
দুজনে স্টেজের কাছে এলাম। দেখি, সেই জুনিয়র ভাইটা হাতে একটা পিস্তল নিয়ে, অস্বাভাবিক ভঙ্গীতে ভয়ংকর চিৎকার করছে স্টেজের ওপরে! বাচ্চাগুলো সব ভয় পেয়ে স্টেজ থেকে নেমে পালিয়ে গেছে। সে যে কি ভাষায়, কাকে উদ্দেশ্য করে, কি বলে যাচ্ছিলো, কেউই তার কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
অকস্মাৎ, সেই পিস্তলটা নিজের কানে ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে দিলো সে। তাকে হঠাৎ এইভাবে সবার সামনে আত্মহত্যা করতে দেখে, চমকে গেলাম সবাই! কোথায় চলছিল কিনা সরস্বতী বন্দনা, আর হঠাৎ করে সেই স্টেজে ঘটে গেলো একটা মৃত্যু! কিন্তু কেন?
ওদিকে, আমার ঐ বন্ধুও দেখি খুব মর্মাহত হয়েছে ঘটনাটা দেখে। সে ঐ ভাইয়ের হাত থেকে ছিটকে পড়া পিস্তলটা তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলে চলেছে – কি করে একটা ছেলে এভাবে নিজেকে গুলি করতে পারে? কি করে?
ওর স্ত্রী ওকে বোঝাতে গেলে, তাকে একটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে সে বললো – এভাবে কি করে নিজের কানপট্টিতে নিজেই গুলি করতে পারে কেউ? বলো, এভাবে? বলতে বলতে নিজের কানে ঐ পিস্তলটা ঠেকিয়ে, সেও ট্রীগারটা দাবাতেই যাচ্ছিলো!
আমি চকিতে তার হাতটা এক ঝটকায় সরিয়ে, পিস্তলের নলটা উপর দিকে করে দিলাম, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুলি ছুটলো। সৌভাগ্যক্রমে তার মাথায় না লেগে গুলিটা উপর দিকে চলে গিয়ে একটা গাছের ডালে লাগলো, আর সেই গুলির আওয়াজে বোধ হয় হুঁশ ফিরলো তারও।
হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ হাঁ করে সে নিজের হাতের পিস্তলটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পুরোপুরি সম্বিত ফিরে পেতেই চমকে উঠলো আর ঘটনার বাস্তবিকতা উপলব্ধি করে, হাত থেকে তখনই ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে পিস্তলটা!
এমন সময়, খুব কাছেই কেউ একটা গগনবিদারী অট্টহাসি হেসে উঠলো যেন, সবার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে। চারিদিকে তাকিয়েও কিন্তু কেউই কাউকে দেখতে পেলাম না।
যবনিকাপাত
পরে, টোভার সাহেবের ইতিহাস ঘেঁটে ঘুঁটে, সেদিনের ঐ ঘটনার একটা সম্ভাব্য কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। জানিনা, তার কতটা সত্য হবে।
টোভার সাহেব তাঁর অফিসে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরেও, সেদিন আরও কিছুক্ষণ জীবিত ছিলেন। বাকি সমস্ত কর্মচারীরা দৌড়ে পালালেও, সেখানে তাঁকে গুলি করা সেই চারজনের, দু’জন ভিতরেই রয়ে গিয়েছিলো।
বাকি দু’জন যখন, বাইরের পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করছিলো, ভিতরের দু'জন তখন, তাদের সেই প্রিয় সহকর্মীর গুলিবিদ্ধ শরীরে, প্রাণের লেশমাত্র অবশিষ্ট আছে কিনা, তাই পরীক্ষা করে দেখছিলো।
এমন সময়, টোভার সাহেব ক্ষীণ কন্ঠে হাত তুলে জল চাইলেন। ওদিকে, প্রিয় সহকর্মীর মৃতদেহের পাশে বসে থাকা তাঁর সেই দুই কর্মচারী, তাঁর গলার আওয়াজ পেয়ে বুঝতে পারলো - তাদের এতগুলো গুলি খেয়েও সেই পাজি লালমুখো ইংরেজটা তখনও মরে নি! তারা তো রাগে যেন অন্ধ হয়ে গেলো।
মৃত্যুপথযাত্রী সাহেবের কপালে তাই, সেই অন্তিম সময়ে পানীয় জল নয়, অধস্তন কর্মচারীদের মূত্র জুটলো। আর প্রথা মেনে গোরেও দেওয়া হয়নি তাঁকে। তাঁর ঐ বাড়িতেই, ঐ প্রাচীরেরই পাশে, বিষ্ঠাখানার গর্তেই তাঁকে ফেলে দিয়েছিলো তারা।
তাই, তাঁর শবদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি পুলিশের শত তল্লাশীতেও। লোকে বলে, তারপর থেকে নাকি প্রায়ই তাঁর বাড়ি কাম অফিস, ঐ প্রাসাদের ভিতর থেকে গুলির শব্দ শোনা যেত!
পরে, প্রাসাদ ভেঙে পড়লেও সাহেবের অতৃপ্ত আত্মা হয়তো সেই জায়গা ছেড়ে যেতে পারেনি। এখন, অনুষ্ঠানের রাতে তাঁকে পুঁতে দেওয়া সেই জায়গাটাতেই পুনরায় কাউকে মূত্রত্যাগ করতে দেখে হয়তো, তাঁর পুরানো রাগ আবার জেগে উঠেছিল!