• 23 May 2023

    যাত্রাপথে

    যাত্রাপথে

    0 21

    যাত্রাপথে
    শুভময় মণ্ডল

    সময়টা আজ থেকে প্রায় দেড় দশক আগের কোন এক গরমের সন্ধ্যা। আমি কর্মসূত্রে রাজ্য সরকারের চাকরি ছেড়ে, উচ্চতর পদের কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরিতে ঢুকেছি সবে। পোস্টিং ছিল ওড়িশার প্রান্তিক স্টেশন - বহরমপুর। যারা গোপালপুর বা দাড়িংবাড়ি বেড়াতে গেছেন, এই স্টেশন হয়ে এই শহরের ভিতর দিয়েই গেছেন।

    অন্ধ্র ঘেঁষা এই শহরের খাদ্যাভ্যাসে সেই প্রতিবেশী রাজ্যের ছোঁয়া ভালোমতই পাওয়া যায়। আমার আবার টক জাতীয় খাবার - সব থেকে নাপসন্দের তালিকায় শীর্ষে। তাই ভীষণ সমস্যায় যে পড়লাম তা আর অস্বীকার করি কি করে! এদিকে এত ভালো চাকরি, ছাড়িই বা কি করে?

    ঠিক করলাম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে, আবার রাজ্য সরকারের সর্বোচ্চ পদের চাকরিতে ঢুকতে চেষ্টা করবো। সেই মত পড়াশুনা শুরু করলাম আবার। মাসের প্রত্যেক পক্ষের একটা করে শনি রবিবার কলকাতায় থেকে, পড়াশুনা ও দরকারী গাইড নিয়ে আবার ফিরে যেতাম বহরমপুরে।

    আমার তখন যাতায়াতের জন্য স্থির ছিলো একটাই ট্রেন - ডাউন হাওড়া চেন্নাই মেল/ আপ চেন্নাই হাওড়া মেল। শুক্রবার বিকেল চারটে নাগাদ খাবার দাবার প্যাক করে নিয়ে ট্রেনে উঠতাম, ভোরবেলা পৌঁছাতাম কলকাতা। আবার রবিবার রাত প্রায় পৌনে বারোটায় ঐ ট্রেনে চড়েই ফিরতাম। সোমবার সকাল সাড়ে ন'টা, পৌনে দশটা নাগাদ নামতাম বহরমপুরে।

    তখন ঐ নতুন চাকরিতে মাইনে যা ছিল, তা'তে মাসে দুবার করে আসা যাওয়ার জন্য, এসি থ্রী টিয়ারের সীট রিজার্ভ করাও আমার পক্ষে বেশ কষ্টকর ছিল। তাই, নন এসি স্লিপার কোচের যে কোনো সাইড লোয়ার সীট রিজার্ভ করে ট্র্যাভেল করাই ছিল আমার সবথেকে পছন্দের।

    তো এই রকমই সেদিন ফিরছি ওখান থেকে ঐ ট্রেনেই হাওড়া। মাঝপথে ট্রেনটা গেল থেমে। আমার একটু মাথাব্যথা করছিলো বলে, আর সেদিন আমার সীটের ওপরের সীটের সহযাত্রীটি তখনও না আসায়, বসে থাকতে থাকতেই কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

    ঘুমটা ভাঙলো অবশ্য ট্রেনটার দাঁড়িয়ে পড়ার কারণে নয়, ভয়ঙ্কর শোঁ শোঁ আওয়াজে। তাকিয়ে দেখি, আকাশ ছেয়ে যাওয়া কালো মেঘের জন্য, দিনের আলো ফুরানোর আগেই নেমেছে গহীন অন্ধকার, ট্রেনটাও দাঁড়িয়ে আছে কোনো বনের মধ্যেই। জায়গাটা অন্ধকারে ঠিক চিনে উঠতে পারলাম না।

    আমার সহযাত্রীরা বোধ হয় আগেই কামরার দরজাগুলো আটকে দিয়েছিলেন, সমস্ত জানালাও ছিল বন্ধ। ঝড়ের প্রবল দাপটে, রেল লাইনের ওপরে দণ্ডায়মান ট্রেনের কামরাটা যেন পেণ্ডুলামের মত দোল খাচ্ছে! মনে হচ্ছে, এই বুঝি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়বে যাত্রীবোঝাই ট্রেনটা।

    এমন সময়, দরজায় সজোরে খটখট করে ঠোকা দিল কেউ! একবার, দুবার, তিনবার - ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোন সহযাত্রীই বাইরে গিয়ে আর ফিরতে পারছে না ভিতর থেকে বন্ধ এই কামরায়! কিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখি - কোথায় কে? কেউ তো নেই সেখানে! অগত্যা, আবার দরজাটা বন্ধ করে ফিরে এলাম নিজের সীটে।

    দেখি, বাকি যাত্রীরা কেমন যেন রোষ কষায়িত নেত্রে তাকিয়ে আছে আমার পানে। পারলে বা ক্ষমতা থাকলে বোধ হয়, দৃষ্টি দিয়ে ভস্মই করে দিতো আমায় তারা! যাই হোক, তখন না পারলেও, তাদের ক্রুদ্ধ হবার কারণটা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আর নিজের নির্বুদ্ধিতাও!

    যাই হোক, নিজের সীটে এসে দেখি - জানালায় মাথাটা ঠেকিয়ে দিয়ে আমার সামনের সীটে বসে একজন ভদ্রলোক! বললাম - ওপরের সীটটা কি আপনার? প্রশ্নটা শুনলেও, তিনি মুখ তুলে চাইলেন না, শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন।

    ভাবলাম, যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখনই হয়তো তিনি উঠেছেন আগের কোন স্টেশনে! তাই আমি তাঁকে দেখিনি। জিজ্ঞাসা করলাম - হাওড়া তো? এবারও তিনি শুধু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন! বুঝলাম, তিনি আলাপচারিতা পছন্দ করছেন না। তাই আর কথা বাড়ালাম না।

    ব্যাকপ্যাক থেকে একটা বেডশীট বের করে গায়ে জড়ালাম। সেই প্রখর গ্রীষ্ম্যের সন্ধ্যায়, বদ্ধ ট্রেনের কামরা, এতগুলো মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে যথেষ্টই উষ্ণ ছিল। সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু কি জানি কেন আমার খুব ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল - এতটাই ঠাণ্ডা যে গায়ে বেডশীট জড়াতে হল!

    ঐভাবেই কাটলো প্রায় আধঘন্টা আরও। এরই মধ্যে, বার তিনেক আরও কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম সেই সহযাত্রী ভদ্রলোকের সাথে। কিন্তু তিনি ঘাড় নাড়ানো ছাড়া আর এমন কিছুই করলেন না, যে আমি গল্পগুজবে মেতে উঠবো তাঁর সাথে!

    আপাদমস্তক ভদ্রলোককে ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখি - তাঁর পরনে একটা বর্ষাতি, পায়ের জুতোও সেই একই গোত্রের (তিনি বোধ হয় জানতেনই যে, আজ ঝড়বৃষ্টি হবে!)। মাথার হান্টার ক্যাপটা বেশ চওড়া হওয়ায়, ট্রেনের কামরার মিটমিটে আলোকে সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করে দিয়ে, তাঁর মুখমণ্ডলকে আঁধারেই ঢেকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। মোট কথা তাঁর মুখ দেখতে পেলাম না। তাঁর হাতেও সম্ভবত গ্লাভস জাতীয় কিছু ছিল!

    আমি বেশ বিরক্ত হলাম তাঁর এই এড়িয়ে যাওয়া ব্যবহারে। এরই মধ্যে ঝড় থেমেছে, ট্রেনের বোধ হয় ইঞ্জিনও সচল হল - সম্মুখ পানে টান অনুভব করলাম। বাইরে তাকাতেই বুঝলাম - ট্রেন চলতে শুরু করেছে আবার। আমি ভাবলাম তাঁকে এবার বলবো ওপরে উঠে যেতে। কিন্তু তিনি দেখি, নিজেই ওপরের সীটে চলে গেছেন। আমি আবার টান টান হয়ে শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়লাম নিজের সীটে।

    কিন্তু, ভদ্রকে এসে আমায় ধাক্কা দিয়ে তুললেন এক সহযাত্রী। ওপরের সীটটা নাকি তাঁর, আমি কেন সেটা নোংরা করে রেখেছি? আমি অবাক হলাম - আপনার সীট? কিন্তু ওখানে তো আগে থেকেই... বলতে বলতে সীট থেকে বেরিয়ে এসে ওপরের দিকে চেয়ে দেখি - গোটা সীট জু্ড়ে জমে আছে জল। যেন কেউ বোতল উপুর করে দিয়েছে সেখানে! তার ওপর আবার সেখানে রাখা - দু'টো আধপোড়া চুলোর কাঠ!

    আমার তো দেখে মাথা ভনভন করতে লাগলো। কোনো মতে নিজের সীটে বসেই, জ্ঞান হারালাম। তারাই আমার চোখে মুখে জলের ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। রক্তচক্ষু বিশিষ্ট এক প্রবীণ সহযাত্রী বললেন - ঐ শ্মশানের ধারে দাঁড়িয়ে থাকার সময়, বন্ধ ট্রেনের দরজা খুলে দিয়ে, আমিই বিপদ ডেকে এনেছিলাম সবার জন্য!

    আমি বললাম - কিন্তু সেই ভদ্রলোক তো বললেন তিনি আগেই চড়েছিলেন এই ট্রেনে!

    আমার পাশের সীটের ভদ্রলোক বললেন - ভাই, তুমি ওঠার পর তো এই ভদ্রলোকই উঠলেন! তাও এখানে, তাঁর সীট তো ভদ্রক থেকে বুকিং। এতক্ষণ তো সীটটা খালিই ছিল!

    আমি - কিন্তু আমি তো সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে কথাও বললাম!

    সহযাত্রীটি আবার বললেন - আপনি বার পাঁচ ছয়, আপনার জানালার উল্টোদিকের সীট পানে চেয়ে কিসব যেন বলছিলেন বটে, কিন্তু সেখানে তো কেউ ছিল না!

    আমি আর তর্কে গেলাম না। এতগুলো লোক তো আর মিথ্যে কথা বলছে না! কিন্তু তিনি যে এসেছিলেন তার প্রমাণ তো - ঐ আধপোড়া চুলোর কাঠ আর ঐ সীট ভর্তি জল! এবার বুঝলাম, কেন তাঁর মুখ দেখতে পাইনি, আর তাঁর সেই পরনের অদ্ভুত পোশাকের কারণটাও।



    Shubhamoy Mondal


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!