ভূতের কেত্তন
শুভময় মণ্ডল
লেখার আগে একটাই ভয়, তেনারা না ক্রুদ্ধ হয়।
কারণ, লেখার জন্য পারমিশান তো নেওয়াই হয় নি! অবশ্য, তা' নেওয়ারও খুব একটা উপায় বিশেষও ছিলো না! তিনি তো আর আমাদের দলের নন, তেনাদের একজন।
আমি নিজেও কি ছাই তখন ভাবতে পেরেছিলাম নাকি, যে বেঁচে বাড়ি ফিরবো, তারপর বহাল তবিয়তে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে একদিন সেই রাতের অভিজ্ঞতা সকলকে শুনিয়ে কৃতার্থ হবো!
কলেজের পাঠ চুকিয়ে তখন কি করবো, কোন পেশায় যাবো এইসব নিয়ে চিন্তাভাবনার মাঝে, হঠাৎ ইচ্ছে হলো - সিনেমায় নামবো, অ্যাক্টিং করবো! ব্যস দুম করে একদিন রোববার সকালে গিয়ে হাজির হলাম উত্তর কলকাতায় 'বয়েজ ওন লাইব্রেরী'-'তে, রূপবানী স্টপেজের কাছে।
আইফা নামের একটা ছোট সংস্থা, বেশ কয়েক জন স্বনামধন্য অভিনেতা অভিনেত্রীর সাহায্য নিয়ে অভিনয়ের এ বি সি ডি শেখানোর একটা চেষ্টা চালাচ্ছিলো - আমি গিয়ে তাদের দলে ভিড়লাম।
শ্রদ্ধেয় নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী অসিত বসু মহাশয়ের কাছে, সেই ভুতুড়ে মেসের কাহিনীটা ওখানেই শুনেছিলাম - ঐ চিত্রনাট্যে, মেয়েলি শূচীবায়গ্রস্ত ছেলেটা, মানে সেই মামদো ভূতের চরিত্রটায় আমি অভিনয়ও করেছিলাম। যাই হোক, ভূতের বিষয়ে আগ্রহ আমার তখন থেকেই শুরু।
ঐ ঘটনার বছর খানেক পর, মায়ের মামাতো ভাই, মানে আমার মামাতো মামার বিয়েতে, ঐ মামার বাড়ি গেলাম - খেঁয়াই, কাটোয়া রুটের ত্রিবেণী আর মেন লাইনের মগরা স্টেশনের ঠিক মাঝামাঝি একটা গ্রাম।
গ্রামজুড়ে ছড়ানো অজস্র প্রাচীন মন্দির, রাজার কাছারী, জমিদার বাড়ি, সিংহদ্বার এ'সবের ধ্বংসাবশেষ। আমার মায়ের দাদামশাই এবং তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার, রাজার ঐ কাছারী বাড়িটিও তাঁদেরই নিয়ন্ত্রণে ছিলো।
এ যেন আমার জন্য মেঘ না চাইতে জল! ঐ মেসের ভূত সাজার পর থেকে, মনে আমার খুব সুপ্ত ইচ্ছা ছিলো - একবার সত্যিকারের ভুতুড়ে পরিবেশে গিয়ে, ভূত সেজে সেই নাটকের মত রঙ্গতামাশা করার।
আমার তো তখন মামার বিয়ের থেকে, ঐ আধ ভাঙা দুর্গম প্রাসাদ, জীর্ণ প্রাচীর বেয়ে ওঠা, বট আর অশ্বত্থ গাছের শূন্যে ঝুলন্ত শিকড়গুলো বেশি আকর্ষণীয় লাগছিলো। আমি প্রথমবার ওখানে গিয়েছিলাম, আমার মা-ও তাঁর কৈশোরে শেষবার গিয়েছিলেন ওখানে।
সেই কারণেই, কেউই আমায় কোন কাজেই বাধা দিচ্ছিলো না। উল্টে আমার উৎসাহ দেখে, তারাও সেইসব বাড়ির ইতিহাস, ঐতিহ্য সব বেশ রং চড়িয়ে শোনাচ্ছিলো। আমারও সে'সব শুনতে মন্দ লাগছিলো না।
শুনলাম, দোর্দণ্ডপ্রতাপ জমিদারের কথা, তাঁর থেকেও প্রতাপশালিনী তাঁর গিন্নীর কথা - তিনি বোধ হয়, আমার মায়ের দাদামশাইয়ের ঠাকুরমা ছিলেন! তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হবে বোধ হয় - প্র-প্র-প্রনাতি। যাক গে, সে বিচারের পথে না হয় পরে যাবো।
তো, তাঁর অনুমতি ব্যতীত নাকি, ঐ বাড়িতে একটা কাক পক্ষীও বসার সাহস পেতো না! এ হেন জমিদার বাড়িতে, একবার বিনা-অনুমতিতে নাকি প্রবেশের সাহস দেখিয়েছিলো - এক ম্লেচ্ছ সাহেবের নাপিত!
আসলে, তারও দোষ ছিলো না। ফোঁড়া কাটার জন্য, নাপিতের ক্ষুরই তখনকার দিনে একমাত্র অস্ত্র ছিলো। আর জমিদার মশাইয়ের ফোঁড়াটা হয়েছিলো এমন এক বেরসিক জায়গায় - মন চাইলেও, নিজের গিন্নীকেও সেকথা বলতে কেমন বাধো বাধো লাগছিলো তাঁর।
তাই ঐ নাপিতকে চুপিচুপি ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি। একে সে সাহেবদের ক্ষৌরকর্ম করে রোজ, তার ওপর ঘা-ফোঁড়া-কাটা-ছড়ায় লাগাবার জন্য সাহেবী ওষুধপত্র, মানে ঐ টিন্চার আয়োডিন টায়োডিন আর কি - ঐ সব থাকতো তার কাছে। সাহেবের নাপিত বলে, স্বদেশীয় অর্বাচীনদের সে আবার বিশেষ একটা পাত্তাও দিতো না।
এটাই ছিলো জমিদার মশাইয়ের, তাকেই ডাকার মূল কারণ। তাঁর কোথায় ফোঁড়া হয়েছে তা যেন পাঁচ কান না হয়, আর নির্বিঘ্নে সেটা সেরেও যায় - এই ছিলো তাঁর চিন্তা! তাঁর গিন্নীর প্রতাপ সম্পর্কে আগেই অবগত করিয়েছিলেন তিনি নাপিতকে। বারংবার সাবধান করেছিলেন তাকে গোপনে আসার জন্য।
কিন্তু, সে ভাবলো - আমি সাহেবের নাপিত, এখানে জমিদারের প্রাইভেট কাজে, স্পেশালী ইনভাইটেড হয়ে এসেছি। আমার কে কি করে নেবে? তাই, সাহেবী কায়দায় মশমশিয়ে জুতো পায়ে দালান পাড়িয়ে, সে সরাসরি জমিদার মশাইয়ের বৈঠক খানায় ঢুকে গেলো!
যথারীতি, এ'খবর কানে যেতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না জমিদার গিন্নীর। তাঁর অজ্ঞাতে, তাঁর অনুমতি বিনা, কি করে বাড়ির অন্দরমহলে এসে ঢোকে কেউ? তিনি তো ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে, দাপাতে দাপাতে, প্রাসাদের তৃতীয় তল থেকে পদব্রজে ভূতলে অবতরণ করলেন।
তিনি যখন বৈঠক খানায় প্রবেশ করলেন, সদর্পে দরজায় তীব্র পদাঘাত করে, নাপিত তখন সবে জমিদার মশাইয়ের লিঙ্গমূলে, ফোঁড়ার পার্শ্বদেশ ছেদনের জন্য ক্ষুর সঞ্চালন করেছে। গিন্নীমার পদাঘাতের তীব্র শব্দে শিহরিত হওয়ার কারণে, ক্ষুরের চাপে জমিদার মশাইয়ের শ্মিশ্নদণ্ডটিই আমূল কাটা গেলো!
জমিদার মশাই নিজের ঐ যন্ত্রণায় ও ততোধিক লজ্জায় তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করলেন। সতীদাহ তখন দেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া সত্ত্বেও, নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জায়, গিন্নীমাও সহমরণে গেলেন! সেই নাপিত বাবাজীবনকেও জমিদার বাড়ির লোকেরা রেহাই দেয়নি। প্রথমত জমিদারকে খুন, পরে তারই কারণে জমিদার গিন্নীর সহমরণে যাবার দায়ে, তাঁরা সেদিনই তার মুণ্ডচ্ছেদ করেন, ঐ বাড়িতেই!
ওখানেই নাকি একটা মজে যাওয়া কুয়োর মধ্যে, তার দেহটা ফেলে চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সে নাপিত বেচারা চালাকি করে সাহেবিয়ানা করলেও, ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রীষ্টান হয়নি, সে হিন্দুই ছিলো - সে কথা অবশ্য কারোরই জানা ছিলো না। যাই হোক, শবদাহ না করে তাকে কবর দেওয়ায়, তাই তার আত্মার মুক্তি হল না। সে বেচারা স্কন্ধকাটা হয়ে এই জমিদার বাড়িতেই ঘুরে বেড়াতে লাগলো।
আজও নাকি তাকে দেখতে পায় লোকে! আমি বুঝতেই পারছিলাম, এসব মনগড়া ভাঁওতা কথা, গুজব, তবু বেশ মজা পাচ্ছিলাম শুনতে। বললাম - আজ রাতে তাহলে দেখতে হচ্ছে, ঐ স্কন্ধকাটা নাপিত বেটার দেখা পাওয়া যায় কিনা! তার মুণ্ডুটা কোথায় ফেলেছিলো তারা, জানেন?
তার মুণ্ডুটা নাকি জমিদার মশাই আর তাঁর গিন্নীর শবদাহের পর, তাঁদের অস্থির সাথেই ঐ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। আগেও সেই নাপিত বেটার ভূত, রাতে দু'চার বার কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসে, নিজের মুণ্ডুর খোঁজ করেছিলো।
কিন্তু তাকে সাহায্য করেনি কেউ - না দেশী ভূতের কেউ, যাদের সে জীবদ্দশায় কখনও বিশেষ পাত্তাই দেয়নি; না সাহেবদের ভূতেরা, কারন সে তো খ্রীষ্টান ছিলো না। ওদিকে বেচারীর নিজের মুণ্ডু না থাকায়, কিছু দেখতেও পায় না, বলতেও পারে না - খালি এদিকে ওদিকে ঠোকা খেয়ে কষ্ট পায়!
শেষে রেগে মেগে, সে সব ধাক্কা মেরে ভেঙেই ফেলবে বলে, ঠিক করেছিলো বোধ হয়। তাই রোজ রাত গভীর হলে, শুরু করে সামনে যা কিছু পায় তাতেই ধাক্কা দেওয়া। তার জোরাল আঘাতে একে একে ধ্বংসের পথে যায় - সিংহ দরজা, প্রাসাদের কাছারী ঘর, বৈঠকখানা। এমনকি পিছনের দেওয়ালটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে, প্রাসাদটাই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে! তাই, সবাই এই বাড়ি ছেড়ে বর্তমান বাড়িতে চলে আসে। তত দিনে দেশও স্বাধীন হবার মুখে, পরে তো দেশ থেকে জমিদারী প্রথাই উঠে গেল!
সেদিন সেই নাপিতের ভূত রেগে গিয়ে, নিজেরই আরো বেশি সমস্যা করে ফেলেছিলো। কারণ, তাকে আর জবাব দেবারও কেউ রইলো না, যে বলবে কোথায় রাখা আছে তার মুণ্ডুটা - দেশী এবং সাহেব ভূতের দল তো তাকে আগেই একঘরে করেছিলো, এখন আর কোন মানুষও রইলো না তাকে হেল্প করার জন্য। সেই বেচারা নাপিতের আত্মার বুঝি আর মুক্তি লাভ হল না।
শুনে, আমারও বেচারা নাপিতের জন্য, মনটা কেমন সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো। ভাবলাম - এই সুযোগ, নাপিতের ঐ স্কন্ধকাটা প্রেতাত্মাকে যদি মুক্ত করতে পারি, তাহলে আমার আজীবন স্মরণীয় একটা ভুতুড়ে অভিজ্ঞতা হবে, যার জন্য নিজেরও গর্ব হবে, আবার অ্যডভেঞ্চারের শখও আমার পূরণ হবে! কিন্তু কিভাবে সম্ভব হবে সেটা?
মায়ের এক পুরোহিত দাদামশাই ছিলেন গ্রামে। একজনের পরামর্শে তাঁর কাছে গিয়ে বললাম আমার ইচ্ছের কথা। তিনি সব শুনে একটু হেসে বললেন - এসব কাহিনীতে বিশ্বাস করো? ওসব তো মনগড়া কথা!
বললাম - হতে পারে, আমি তো অ্যাডভেঞ্চারের জন্যই যেতে চাই ওখানে, রাতে একাকী। এখন ঐ কাহিনী যদি সত্যি হয়, মানে যদি সত্যিই সেই স্কন্ধকাটা ভূতের দেখা পাই তাহলে তার থেকে বাঁচার উপায় কি? আর যদি কোন ভাবে তার আত্মাকে মুক্তি পাওয়াতে হয় তার জন্যই বা কি করতে হবে সেই পরামর্শ দিন।
তিনি মৃদু হেসে বললেন - সে হিন্দু হলেও তার শবদাহ করেনি ওরা, মাটিচাপা, বলা ভালো পুঁতে দিয়েছিল তাকে মেরে। এখন যদি তার হাড়গোড় কিছু বেঁচে থাকে ওখানে কোথাও তবে সেটাই দাহ করে সেই অস্থিভস্ম গঙ্গায় গিয়ে বিসর্জন দিলে হয়তো সে মুক্তি পেলেও পেতে পারে।
বললাম - কিন্তু সেগুলো ঠিক কোন জায়গায় আছে জানেন? মানে সেগুলো উদ্ধার না করতে পারলে আর দাহ করা যাবে কি করে?
তিনি বললেন - তার যদি মুক্তির সময় হয় তাহলে সে নিজেই সেসবের ব্যবস্থা করে দেবে তোমায়। ভালো লাগলো তার মুক্তিলাভের জন্য তোমার সদিচ্ছা দেখে। উদ্দেশ্য মহৎ না হলে তোমাকে বারণ করতাম ওখানে যেতে। কিন্তু এখন বলবো, আজ রাতে অবশ্যই ওখানে যাও, আশা করি তোমার যাত্রা বৃথা যাবে না।
আমি তাঁর পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ চাইলাম। তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন - ঐ বাড়ির উত্তর ফটকের কাছে একটা মজে যাওয়া কুয়ো আছে, তুমি যেটার খোঁজ করছো সেটাই হলো ওটা। সাবধানে যেও, কল্যাণ হোক।
ব্যস, রাতের বেলায় ঐ কুয়োর ধারে গিয়ে হাজির হলাম, নাপিতের সেই স্কন্ধকাটা ভূতের জন্য। সাথে নিয়ে নিয়েছি একটা লোহার রড, একটা কেরোসিনের বোতল আর একটা কাপড়ও। ব্যাটা বের হলেই, প্রথমে তাকে রড দিয়ে মেরে পাট করে দেবো, তারপর কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দিলেই কাজ শেষ।
কুয়োর পাড়ে বসে আছি তো আছিই - সে বেটা নাপিত ভূতের পাত্তা নেই। এদিকে রাত ভোর হয়ে আসছে, সকালবেলায় নিশ্চয়ই বাবাজীর দেখা পাবো না - তাহলে, সে বেটা এলোই না আজ? আর আমি তাকে মুক্তি পাইয়ে দেবো বলে বসে রইলাম সারারাত? মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পরদিন মামার বিয়ে, তাই ফিরে গিয়ে একটা লম্বা ঘুম দেওয়াটাই বরং ঠিক হবে ভেবে, উঠে চলে আসতে গেলাম।
পা বাড়িয়েছি আর মাথায় একটা কিছু ঠাণ্ডা মত ঠেকলো। ভাবলাম, সেই বটগাছের ঝুড়ি নেমেছে, ওটাই বোধ হয়। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে দেখি - একটা কংকাল, পড়নে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে শাঁখা, পলা, নেড়া কপালে আবার সিন্দুরের টিপও! তিনি ঠ্যাং ঝুলিয়ে, সিংহ দরজার ভাঙা দেওয়ালের ওপরে বসে আছেন, তাঁর সেই ঝুলন্ত শ্রীচরণের শীতল স্পর্শই কপালে তখন অনুভব করেছিলাম আমি।
তাঁর আগুনের গোলার মত চোখদুটো দিয়ে, আমার দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন - কে রে তুই, এত সাহস তোর, আমার বাড়িতে ঢুকিস বিনা অনুমতিতে?
আমার তো ভয়ে বুক কেঁপে গেলো। তিনি সামনে ঝুঁকে, আমার পানে তাঁর লম্বা হাতটা বাড়িয়েই দিতে যাচ্ছিলেন আমার গলাটা টিপে ধরার জন্য, এমন সময় তাঁর সামনে, মানে আমার ঠিক পাশে হাজির হলো আর এক কঙ্কাল। তাঁর পরনে আবার, যাত্রাদলের রাজ রাজাদের চরিত্রের অভিনেতাদের যেমন পড়ানো হয়, সেই রকম জমকালো রাজপোশাক, মাথায় পাগড়ি।
তিনি বললেন - আহা, কি করো গিন্নী, মরে ভূত হলে তবু সেই তোমার খবরদারির স্বভাব গেলো না! আরে ও তো আমাদের মালুর ছেলে - তোমার নাতির নাতনির নাতি, মানে ধরে নাও তোমারও নাতিই। ও এখানে আমাদের দুজনেরই ভালোর জন্যই এসেছে। কত প্ল্যান করে ওকে আমাদের সব কাহিনী শুনিয়ে, এখানে আনতে হয়েছে তুমি জানো? ব্যাটা নাপিতের কঙ্কালটা ও পুড়িয়ে দেবে বলে এসেছে। তাহলেই সে ব্যাটা নাপিতও মুক্তি পায়, আর আমরা দুজনেও। কিন্তু তোমার ভয়ে তো সে ঐ কুয়ো থেকে বেরই হচ্ছে না আজ!

বুঝলাম, এনারাই হলেন সেই জমিদার আর তাঁর প্রতাপশালিনী গৃহিণী। আহা রে, ঐ নাপিতটার জন্য ওনারাও মুক্তি পাচ্ছেন না? এবার আমার সত্যিই খুব কষ্ট হলো তিনজনের জন্যই। ভাবছি কি করা যায় এখন, এমন সময় জমিদার গিন্নী ডাক দিলেন - ও নাপিতের পো, বাইরে এসো। আমার নাতি এসেছে, আজ আমাদের তিন জনেরই মুক্তি হবে। আর ভয় পেতে হবে না, বাইরে এসো।
কুয়ো থেকে নাপিতের স্কন্ধকাটা ভূত, মানে তার কঙ্কাল চেহারাটা বেরিয়ে এলো তখন। আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তখন ভাবছি, এবার কি করবো? জমিদার ভূত বোধ করি সেটা বুঝতে পারলেন, তাই নাপিত ভূতকে বললেন - তুই কুয়োর পাড়টা ভেঙে, তোর কঙ্কালটাকে বের করে দে। সেই নাপিত ভূতের জোরালো আঘাতে, ঐ মজে যাওয়া কুয়োর একটা ভাগ তখনই ধ্বসে গেলো। আমি নিচে উঁকি মেরে দেখি - নাপিত ভূত বেটা, নিজের গায়ের জোরেই সেই চাপা পড়া মাটির স্তুপ সরিয়ে, নিজের শিরহীন কঙ্কাল শরীরটা বের করে দিয়েছে।
আমি দেখলাম, আসে পাশে শুকনো পাতা জমে আছে প্রচুর। কঙ্কালটাকে কাপরটায় জড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে, তারওপর পাতাগুলো একত্র করে কেরোসিন ঢেলে তা'তে আগুন লাগিয়ে দিলাম। দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো আগুন। আগুন নিভতে দেখি, পড়ে আছে সামান্য ছাই।
জমিদার গিন্নীর সেই পেত্নী বললেন - ওর সব ছাই ভস্মগুলো একজায়গায় করে ঐ বোতলে ভরো। আমি তাই করলাম।
জমিদার ভূত বললেন - দেখো, সকাল তো হতেই চলেছে প্রায়, এখান থেকে গঙ্গাও বেশি দূর না। ঐ অস্থি ভস্ম গঙ্গায় ভাসিয়ে দিলেই, ওরও মুক্তি হবে, আর আমাদেরও। আট পুরুষ ধরে মুক্তির জন্য প্রতীক্ষায় আছি আমরা। আজ তোমার দ্বারা সেই প্রতীক্ষার অবসান হবে। চলো তোমায় রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, যেতে পারবে তো?
আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে, পাশেই রাখা মামার সাইকেলটায় চড়ে গঙ্গার দিকে রওনা দিলাম বোতলটাকে নিয়ে।
ত্রিবেণী শ্মশানঘাটে এসে, বোতলটা গঙ্গায় ধুয়ে পরিস্কার করে ভাসিয়ে দিলাম। মনে মনে তাঁদের তিনজনেরই আত্মার মুক্তি কামনা করে মা গঙ্গার কাছে মিনতি জানিয়ে ডুবও দিলাম গোটা তিনেক। তারপর পাড়ে উঠে এসে দেখি - শ্বেতবস্ত্রে জমিদার মশাই, তাঁর গৃহিণী এবং সেই নাপিত পূর্ণাঙ্গ শরীরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। আমি তাঁদের তিন জনকেই প্রণাম করলাম, তাঁরাও আশীর্বাদ করলেন - কল্যাণ হোক।
ভোরের আলো ফুটতে তখন আর বিশেষ বাকি নেই, পাখপাখালিদের ডাক শোনা যায়। তাঁরা বললেন - বহু প্রতীক্ষার পর, তোমার কারণে আমরা তিন জনেই আজ ইহলোকের বন্ধন থেকে মুক্তি পেলাম। আলোয় থাকা আর এই ইহলোকে থাকার সময় আমাদের ফুরিয়েছে। এবার আমরা আসি দাদুভাই, ভালো থেকো তুমি।
তাঁরা সেই সূর্যোদয়ের কোমল আলোয় যেন, স্নিগ্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে, আমার চোখের সামনেই ধীরে ধীরে উবে গেলেন। আমি, ভেজা গায়ে সাত সকালে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা স্বাস্থ্যকর হবে না ভেবে, সাইকেলটা নিয়ে মামার বাড়ি পানে দৌড় দিলাম।