#হারানো_শৈশব
#প্রতীতি_চৌধুরী
শৈশব বলতেই মনে আসে মামাবাড়ির কথা। গ্রামের মেঠো লাল রাস্তা, ধানক্ষেত, মামাদের ধানের গোলা, গোয়াল ভর্তি গরু, কোঠাবাড়ি। একটু দূরেই ছিল জঙ্গল, গরুগুলো চড়তে যেত ওখানে। একবার মামার সাথে বিকেলের পড়ন্ত রোদে ধানক্ষেতের আলে আলে পা সামলে হেঁটে আমিও গেছলাম.. দেখেছিলাম সোনালী ধানে সোনার আলোতে সে এক আশ্চর্য শোভা। মামাবাড়িতে সন্ধ্যা নামতো সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে শাঁখের আওয়াজে, পিদিম জ্বেলে। শহুরে রাস্তার মতো স্ট্রিট লাইট জ্বলে উঠতো না ওখানে, বরং আকাশ ভর্তি তারা আর গাছের পাতায় খেলা করা জোনাকিদের দেখে চোখ জুড়াতো।
তবে মামাবাড়ির সব কিছু ভালো হলেও খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গার আগের থেকে ঘাটে যাওয়া গ্রামের মহিলাদের থালাবাসনের ঝনঝনানি আর একে অপরের প্রতি নানান গালমন্দ, সমালোচনা ছিল আমার অসহনীয়। এই জন্যই মামাবাড়িতে একদিন থাকলে, দুদিন আর থাকার ইচ্ছা করতো না। খুব ছোটোবেলায় একবার এসবেই বিরক্ত হয়ে মা'কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-"এরা সকাল থেকে এতো চিৎকার করার এনার্জি কোথা থেকে পায় বলো তো!"
মা হেসে উত্তর দিয়েছিল,
-"এটা তো অনেক কম শুনছিস। অপা বুড়ি এপাড়াতে এলে কানে আঙুল দিয়ে রাখতে হয়.. গালি দিয়ে সে সবার বংশ উদ্ধার করে দেয়!"
মায়ের কথা শুনে সেদিনই ভীষণ কৌতূহল হয়েছিল অপা বুড়ির প্রতি। মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-"অপা বুড়ির ঘরের লোক কিছু বলেনা?"
মা আমার কথার উত্তর দেওয়ার আগেই দিদিমা বলেছিলেন,
-"তার তো তিনকূলে কেউ নাই রে! কে কি বলবে! ওই গাঁয়ের শেষে শ্মশান ধারে ঘর করে আছে.. এদিকে অবশ্য এখন আর তেমন আসে না। বয়সটাও তো অনেক হলো.. নেহাতই কারো সাথে ঝামেলা হলে তার গুষ্টি উদ্ধার করতে চলে আসে!"
মনে মনে হেসে ভেবেছিলাম, কিছুই নাই অথচ গালি দেওয়ার কি এনার্জি! আমার ভাগ্য অবশ্য সেবার বেশ প্রসন্ন হয়েছিল। মামাবাড়ির কোঠাঘরে দুপুরে সবে ভাতঘুম দিয়েছিলাম। কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছল বুঝতেই পারিনি! হঠাৎ করেই শুনতে পেয়েছিলাম,
-"ও ওলারউঠি.. ভিক্ষে চায়তে আসিনি আমি.. চোখের কি মাথা খেয়েছিস! যা গিয়ে তোর আঁটকুড়ো বাপকে বলবি আমার জমিতে গরু ছাড়লে *****"
না বাকিটা আর গল্পে লেখার মতো নয়। তো আওয়াজ শুনে বেশ ভালোই অনুমান করতে পেরেছিলাম এই সেই অপাবুড়ি, সন্ধিগ্রামের দ্য মোষ্ট ফেমাস পার্সেন। ইচ্ছা দমন করতে না পেরে দেখারও চেষ্টা করেছিলাম। যদিও অন্ধকারের রাস্তায় মামাবাড়ির কোঠার জানালা দিয়ে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি ছাড়া কিছুই দেখা যায়নি। তবুও তার গালিগালাজ শুনে মোটামুটি একটা বিশ্রী ছবি কল্পনা করে নিয়েছিলাম। নিজের মনে হাসতে হাসতে ভেবেছিলাম কতো রকমের বিচিত্র পাগল আছে এই জগতে!
****
আরেকবার মামারবাড়ি গেছলাম একটু বড়ো হয়ে। সিক্স কি সেভেনে পড়ি তখন। গিয়ে দেখেছিলাম মামাবাড়িতে সন্ধ্যাবেলা সময় কাটাবার জন্যে যে লুডোটা আগেরবার রেখে এসেছিলাম সেটা উই পোকাতে খেয়ে মাটি করে দিয়েছে। মামাবাড়িতে ছোটোবেলায় বিজলি পর্যন্ত ছিল না যে একটু টিভি দেখতাম! পরীক্ষাও শেষ, কাজেই বই নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। প্রথম সন্ধ্যেটা হ্যারিকেনের আলোতে ছেঁড়া কিছু গল্পবইয়ের টুকরো টুকরো পাতা জুড়ে পড়তে পড়তে ব্যর্থ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রাত্রে যখন খেতে উঠেছিলাম তখন দেখেছিলাম হাত পা মশার কামড়ে ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। পাছে ম্যালেরিয়া হয় ভাবতে ভাবতে বড়োমার বানানো রুটি আর সুস্বাদু ছাগল মাংসটাও বিস্বাদ লেগেছিল রাত্রের ডিনারে। তবুও মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম ভাগ্যিস ঘুমের ঘোরে বিছানাতে হ্যারিকেন উলটে দ্বিতীয় কোনো লঙ্কাকান্ড বাঁধেনি। নয়তো ওই ছেঁড়া, ফাটা বইখাতার সাথে আমারও সৎকার হয়ে যেত!
যাইহোক, তারপরের দিন বিকেল থাকতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম এভাবে দিন কাটানো যায় না। নতুন একটা লুডোর ব্যবস্থা করতে পারলে দিম্মা, দাদুর সাথে জমিয়ে গতবারের মতো লুডোটা খেলাটা যাবে। কিন্তু লুডো কিনতে গেলেও তখন প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে জিয়াগঞ্জের মোড়ের দোকানকে যেতে হতো। মামা মহাব্যস্ত মানুষ, বিকেলে পানপাড়ার সদ্য গজিয়ে উঠা ক্লাবটাতে আড্ডা না দিলে তার আবার পেট ফেঁপে যেত, অতএব লুডো কিনে আনার ব্যাপারে তার সাড়া মেলেনি। দাদু বুড়ো লোক, বিকেল থেকেই উঠানে বসে ঝিমোতে শুরু করতো। এদিকে মা তো প্রতিবারই মামাবাড়ি এসে একজোড়া অদৃশ্য ডানা লাভ করতো, যাতে ভর করে তার কি সব সম্পর্কের কাকিমা-মাসিমা-দিদিমার বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে আমাকে একপ্রকার ভুলেই যেত!
অগত্যা রবিঠাকুরের "যদি তোর ডাক শুনে কেউ নাই আসে" স্মরণ করে সেদিন একাই লুডো কিনতে যাবো বলে মনস্থির করেছিলাম। সঙ্গে এক বোতল জলও পান পাড়ার টিউবওয়েল থেকে ভরে আনতে পারবো ভেবেছিলাম। সেই যুগের গ্রামগুলোতে আজকের মতো এতো সাবমার্শিবেল, টিউবওয়েল কোনোটাই তো ছিল না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামের একটা মাত্র কুয়ো বা কলের উপর পানীয় জলের জন্য নির্ভর করে মানুষজনকে বেঁচে থাকতে হতো। মামাবাড়ির বামুনপাড়ার জন্য যে কুয়োটি বরাদ্দ ছিল তার জল এতোটাই সুমিষ্ট ছিল যে একবার ভুল করে খেয়ে ফেললে তারপর বড়োমার হাতে বানানো পেঁয়াজি, তেলেভাজা, সরভাজাগুলোতেও নিমপাতার স্বাদ পেতাম। মনে হয় কাছেই যে নিমগাছটি ছিল তারই অশেষ করুণা ছিল কুয়োটির প্রতি। আমার আজও বদ্ধ ধারণা ওই গ্রামের কাউকে তখন ডায়াবেটিসে অন্ততঃ ভুগতে হতো না। সে যাইহোক, আমি একটা বড়ো বোতল ব্যাগে নিয়ে, কুড়ি টাকা খুচরো জোগাড় করে একাই জিয়াগঞ্জের দিকে রওনা হয়েছিলাম।
****
মোড়ের বড়ো রাস্তাতে যখন পৌঁছেছিলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সূর্য অস্ত গেছল। যদিও হাতঘড়িতে বেলা ছিল আধঘন্টার মতো, কিন্তু বাচ্চা বয়সে ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি কখন আকাশে মেঘ দেখা দিয়েছে! দোকানদার নিজেই কি মনে করে লুডোটা পলিথিন প্যাকেটে ভরে দিয়েছিলেন। তারপর সম্ভবতঃ বাচ্চা মেয়ে দেখেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে। আমার অবশ্য তখনও তেমন ভয় করেনি। কারন অনেকবারই এরকম ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে আমাদের শহরে টিউশন বা আঁকার ক্লাসে আমি যাওয়া আসা করেছি।
আমার ভুলটা ভেঙ্গেছিল আরো একটু পরে। যখন হঠাৎ করেই একটা ঝড়ো মেঘ পশ্চিম আকাশ থেকে ক্রমশ ধেয়ে আসতে রইলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম এই পল্লিগ্রামের রাস্তায় বৃষ্টি এলে দাঁড়াবার মতো জায়গাটুকু তো নেই-ই, উলটে রাস্তার কোথাও কোনো মানুষেরও চিহ্ন নেই। চোখ সরু করে দেখেছিলাম যতদূর দেখা যায় চারিদিকে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত, আর অন্যদিকে জঙ্গল। জোরে হাঁটা দিয়েও শেষ রক্ষা করতে পারিনি। আকাশে বিজলি শুরু হয়ে গেছল ততক্ষণে। ঝড়ের দাপটে বড়ো বড়ো ফোঁটা গুলো গায়ে এসে পড়ছিল। চারিদিকে নিকষ অন্ধকার। মাঝে মাঝে দু একটা বিদ্যুতের ঝিলিক তো ক্ষেতের মাটি ফুঁড়ে বিকট শব্দে চড়াৎ চড়াৎ করে পড়ছিল। মামাবাড়ি থেকে জিয়াগঞ্জের এই মোড়ে আগেও বেশ কয়েকবার এসেছিলাম, কিন্তু এরকম দুর্যোগে কখনো পড়িনি। প্রাণ বাঁচাতে বিজলির আলোয় দূরে একটা ছোটো ঘরের মতো দেখতে পেয়ে সেদিকেই দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটেছিলাম।
অনেকটা ছুটে যাবার পর বুঝতে পেরেছিলাম এদিকটা সন্ধিপুরের রাস্তা নয়। এদিকটাতে ধানক্ষেতও তেমন একটা নেই। রাস্তাটাও কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। পাথুরে ডাঙ্গা জায়গাটা জুড়ে শুধু কাঠ কয়লার ভাঙা টুকরো পড়ে থাকতে দেখার পর যখন সামনের ভাঙ্গা মন্দিরটা দেখতে পেয়েছিলাম তখন বুকের ভিতরটা কেমনই ঢিপ ঢিপ করে উঠেছিল। বিদ্যুতের ঝলকানিতে একটু দূরে ছাইভস্ম পরে থাকা একটা জায়গাতে কয়েকটা মাটির হাড়ি কলসি আর ভোঁদড়ের মতো একটা জীব দেখতে পেয়ে তো বুকের রক্ত প্রায় ছলকে উঠেছিল। মনে হয়েছিল শ্মশানে এসে পড়িনি তো এই ঝড়বৃষ্টির ভয়ঙ্কর সন্ধ্যেতে!
বৃষ্টিতে ভিজে তখন আমার ঠান্ডা লাগার পরিবর্তে ভয়ে ঘামবার মতো অবস্থা ছিল! অন্ধকারে রাস্তা চিনে কিভাবে যে এই ধূ ধূ মাঠ থেকে বাড়ি ফিরবো সেই ভেবে তো অজ্ঞানই হয়ে যাচ্ছিলাম! এদিকে দূরে কতকগুলো শিয়াল কুকুর পর্যন্ত চিৎকার করে আভাস দিচ্ছিল তেনারা আশে পাশেই আছেন। ভয়ে ভয়ে রাম নাম জপা শুরু করতেই অবশ্য সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরটা আবার দেখতে পেয়েছিলাম। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে কোনোরকম সেটার দাওয়াতে গিয়ে উঠেছিলাম। পরে ঘরের ভিতরে খুটখাট শব্দ পেয়ে ঘরের ভিতর মানুষের অস্তিত্ব আছে বুঝতে পেরে ধড়ে যেন প্রাণ ফিরে এসেছিল! ভেতর থেকেই রুক্ষ মহিলা কন্ঠটা ভেসে আসছিল,
-"কে এলি লো এতো রাত্তে! শোন.. তোদের কোনো মুখপোড়াকে আমি ভয় পাইনে.. দেখি তোদের কতো দম হয়চে! আমার সাথে মশকরা করতে এয়চিস!"
আমি ঢোঁক গিলে ভয়ে ভয়ে সাড়া দিয়েছিলাম,
-"আমি.. আমি সন্ধিপুরের মন্ডলদের বাড়ির.. ঝড়জলে রাস্তা ভুলে এসে পড়েছি..."
এক অতি শীর্ণকায় বুড়ি টিমটিমে লন্ঠন নিয়ে সেই পর্ণ কুটির থেকে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর অনেকক্ষন ধরে আমার মুখটা পর্যবেক্ষণ করার পর আমিও দেখতে পেয়েছিলাম সেই বৃদ্ধাকে। বৃদ্ধার মুখে কয়েকশো চামড়ার ভাঁজ ঝুলে পড়েছে। মাথা ভর্তি সাদা চুল। ময়লা রঙের একটা থান গায়ে জড়ানো। দেখে বোঝা যায় কোনো এককালে থানটার রঙ সাদা ছিল। লন্ঠনের আলোটা আমার মুখ থেকে নামিয়ে বৃদ্ধা বলে উঠেছিল,
-"ও মলো যা! আমি ভাবলাম ওই শ্মশানের হ্যাংলামুখোগুলো ভয় দেখাতে এসচে.. তুই কে লা!"
আমি অবশ্য সেদিন আর সাহস করে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি যে শ্মশানের হ্যাংলামুখো কারা! বুড়ি নিজের থেকেই সেই জীর্ণ ঘরের মধ্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আমাকে,
-"আয় লো পোড়ারমুখী.. এসচু যখন দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছিস কেনে! চড়কা পড়ছে.. ভিতরে আয় দিখি..."
কুঁড়ের ভিতরে গিয়ে আরো বেশি অবাক হয়েছিলাম আমি বুড়ির ভাঙ্গাচোরা ব্যবহার্য জিনিস কটা দেখে! একটা পুরোনো তক্তা, মাটির কলসি, থালা, বাটি, কয়েকটা কাপড়ের পুঁটলি ছাড়া আর কিছুই ছিল না ঘরে। আমিই বুড়িকে বলেছিলাম লুডো কিনতে আর পান পাড়ার কল থেকে জল আনতে গিয়ে কিভাবে এরকম দুর্যোগের মধ্যে পড়ে গেছি!
লুডোর নাম শুনেই বুড়ির চোখ দুটো কেমনই খুশিতে ভরে উঠেছিল। দেখে মনে হচ্ছিল হাজার বছর ধরে ঘরবন্দী থাকা কোনো অতৃপ্ত আত্মা যেন হঠাৎ আনন্দের একটুকরো আলো দেখতে পেয়েছে! বুড়ি নিজেই আমার হাত থেকে ব্যাগটা প্রায় কেড়ে নিয়ে লুডোটা বার করেছিল। তারপর ফিরে গেছল বুড়ির কোনো সুদূর অতীতের স্মৃতিতে। বলতে শুরু করেছিল তার কাহিনী।
-"তখন আমার বয়েস হবেক গিয়ে সাত কি আট! দিদির সাথে এসব কড়ি, লুডো খেলতুম বড়ো.. দিদিটা বারো বছরেই ডাগর হয়ে গেল। মাতাল বাপটা ওই বুড়ো দাঁত ভাঙ্গা লোকটার সাথে দিদির বিয়েটা ঠিক করলে.. মোর মায়ের সাথে সে কি ঝগড়া বাপের! গন্ডুগল দেখে আমি তো বনে চললাম। দুপুরে খিদা পেতে ঘরকে ফিরে শুনি দিদিকে লিয়ে মোর মা বাপের বাড়িটা পালিয়চে.. মা ভেবেছিল বড্ড জব্দ করেচে বাপটারে.. আর ওতেই আমার কপালটা ফুটলো।"
কিছুটা কৌতূহলেই জিজ্ঞাসা করে ফেলেছিলাম,
-"তাতে আপনার কপাল কি করে ফুটলো? মানে কি এমন হয়েছিল?"
বুড়ি হঠাৎ করে ঝড়বাদলের সেই নির্জন পরিবেশে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল,
-"কি আর হবেক রে ছুড়ি.. মাতাল বাপটা মদ খেতে টাকা লিয়েছিল বুড়াটার কাছে.. আমারে গুড়মুড়ির লোভ দেখিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিলেক বুড়ার সাথে.. মা কি আর অমনটা হবে বুজেছিল! দিদিটা তো বেঁচে গেল, আমারই কপালটা ফুটলো।"
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম সাতবছরের একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে কি করে দাঁতভাঙ্গা একটা বুড়োর বিয়ে হতে পারে! গল্পের বাকিটাও বুড়ির কাছেই শুনেছিলাম লন্ঠনের সেই টিমটিমে আলোতে বুড়ির কথা মতো একদান লুডো খেলতে খেলতে। বুড়ি খেলাতে বারবার নিয়ম ভুল করছিল, আর কিছু বলতে গেলেই একতরফা তেড়ে আসছিল। খিঁচিয়ে উঠে বলছিল,
-"দুদিনের ছুড়ি বড়ো নিয়ম শিখেছু! একাদশী আর নিয়ম করে করে চুলগুলো আমার পেকে গেলেক! আর তোর কাছে আমি নিয়ম শিখবো!"
আমি বুড়ির কথা শুনে মনে মনে হেসেছিলাম আর বাকিটা বুড়িকে বুড়ির মতো করেই খেলতে দিয়েছিলাম। এক একলা বৃদ্ধার জীবনে হঠাৎ আসা ঝড়ো হাওয়ার মতো সামান্য খুশিটুকু আর কেড়ে নিতে মন চাইনি। বুড়িও প্রাণ খুলে বলছিল ওর এতো বছরের জমানো সব গল্পের ইতিহাস। যেন এতোদিন পর কেউ ওর মনের দরজাতে কড়া নেড়ে ফেলেছে! যেই বুড়োর সাথে সাতবছরের বাচ্চা মেয়েটার বিয়ে হয়েছিল, সেই বুড়ো মাত্র দু মাসেই শ্মশানে উঠেছিল। বুড়োর আগেরপক্ষের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সবাই তখন বেঁচেছিল। আর তারাই না কি বুড়োর সম্পত্তির ভাগ দিতে হতে পারে ভেবে সেই বাচ্চা মেয়েটাকে অপয়া বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন ব্রিটিশদের আমল হলেও সতীদাহটা হয়তো পুরোপুরি উঠে যায়নি। তবু বাচ্চা মেয়েটা কি করে বেঁচেছিল সেই প্রসঙ্গেই বুড়ি বলেছিল,
-"অপয়া বলে আমাকে ওরা চিতাতে তুলেনি.. সোয়ামীর সাথে সগগে যাওয়াটাও আমার হয়নি আর.. মাথা মুড়িয়ে, সাদা থান পরিয়ে দিলো ওরা সব.."
বুড়ির কাছেই শুনেছিলাম পরে না কি বুড়িকে গ্রাম থেকেই শ্মশানের পাশে এই ঘরটা, আর এক বিঘে জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল গাঁয়ের মোড়ল। বুড়ি নিজেই যা পারতো মুনিষ দিয়ে চাষের ব্যবস্থা করাতো। আমি চলে আসার আগে বুড়ি দুঃখ করে বলছিল,
-"এখন তো চাষের লোকও পাইনি.. গায়ে গতরে খাটবার জোরও আর নাই.. দুটা ছাগল দিয়চে পঞ্চায়েত থেকে, কোনো রকমে দিন চইলে যায়.."
জানিনা কেন, সব কিছু শোনার পর সেদিন ওই অচেনা অজানা বুড়িমার প্রতি কেমনই অদ্ভূত একটা মায়াটান অনুভব করছিলাম! বিদায় নেওয়ার সময় মনটা অকারনেই বড়ো ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছিল। পাশের ডোবা থেকে দুটো কচুপাতা তুলে মাথা আড়াল দিয়ে বুড়িমা বলেছিল,
-"চল রে তোকে এগিই দিয়ে আসি.. বিষ্টিটা একটু ধরেছে বলে.."
অন্ধকারের ওই নিস্তব্ধ বৃষ্টি ভেজা পিছল রাস্তায় তখন আমি প্রায় দিকজ্ঞান শূন্য। খাল খোঁদল থেকে কেবলই ভেসে আসছে ব্যাঙের ডাক। একটানা ঝিঁঝিঁর আওয়াজে কোনো ইন্দ্রিয় কাজ করছিল না। অগত্যা বুড়িমায়ের পিছু পিছুই হাঁটতে শুরু করেছিলাম। মাঝখানে একবার শুধু বুড়িমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-"বুড়িমা তোমার নামটা কি গো!"
বুড়িমা হেসে বলেছিল,
-"সরমা বলে একটা নাম এককালে ছিল বটে.. মায়ে দিইছিল.. একন আর ডাকবার কেউ নাই।"
বুড়িমার পিছু পিছু আসার সময় ভেকের ডাকে, মেঘভেজা আঁধারে, ভাঙ্গা মন্দিরের পাশ দিয়ে মামাবাড়ির রাস্তা চিনবার মতো অবস্থা বা মানসিকতা কোনোটাই আমার ছিল না। মাঝখানে বুড়িমা দাঁড়িয়ে বলেছিল,
-"ওই যে তোদের পান পাড়ার কলটা, আমি আবার ছুঁলে লোক তেড়ে আসবে.. তুই জল লিগে যা.. আমি দাঁড়াচ্চি ঠাঁয়ে.."
বোতলে জল নেওয়ার সময় খুব অবাক হয়ে ভেবেছিলাম এতো সব স্মৃতি রোমন্থনেও বুড়ি আমার জল ভরবার কথাটা ভুলেনি! পানপাড়াটা পেরিয়ে বুড়ি আর একদমই সেদিন এগোতে চায়নি। মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল,
-"ওই খচ্চর বামুন পাড়াতে আমি আর এতো রাত্তে চেঁচাতে যেতে পারবুনি.. তুই যা.. আমি ইখান থেকে দেখচি.. যা রে... যা..."
আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে বুড়ির মুখের কথা আর চোখের তারার মধ্যে সেদিনের সেই অসঙ্গতি! বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি ভাবে থামেনি। বুড়ির দেওয়া কচুপাতা মাথায় নিয়ে ঘুরে দেখছিলাম বুড়িকে। দূরের আকাশে হওয়া বিজলির ঝিলিকেও বুড়ির মুখটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম অচেনা আমাকে ছাড়তে এসেও বুড়ির মনে হচ্ছিল হয়তো ও আবার একলা হয়ে যাচ্ছে! আর কোনোদিন বুড়িমায়ের সঙ্গে হয়তো দেখা হবে না জেনেও ছলছলে হয়ে গেছল আমার চোখদুটো! একবার ভাবলাম লুডো কিনে ফেরৎ পাওয়া বাড়তি চার টাকাটা বুড়িমাকে দিয়ে আসি। কিন্তু প্রায় আশি ছোঁওয়া এক বুড়ির অসম্ভব আত্মাভিমানকে সেদিন ভিক্ষে দিয়ে ছোটো করতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, যেভাবে ওই বুড়ি আমাকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছিল পয়সা দিয়ে তার বিনিময় করতে ইচ্ছা করেনি। বরং মনের মনিকোঠায় তা জিইয়ে রাখতে চেয়েছিলাম আজীবন কাল।
****
মামাবাড়ি ফিরতেই সবার নানান প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলাম যে ওই সরমা বলে বুড়িমার ঘরে মাথা গুঁজে কোনো রকমে ঝড় বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেয়েছি। সবাই তো শুনেই হাঁ। দিদিমা বলেছিলেন,
-"শেষে কি না তুই অপা বুড়ির ঘরে ঢুকেছিলি! ওই অপয়ার ঘরে ঢোকা তো দূর কেউ কখনো পাশ দিয়েও যেতে চায়নি।"
মা জিভ কেটে বলেছিল,
-"ছি! ছি! দেখিস না কেমন গালি গালাজ করে এপাড়াতে এসে!"
বড়োমা আবার মা, দিদিমার চেয়ে আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিল,
-"এখনই বড়ো সায়েরের জলে একটা ডুব দিয়ে আয়... এই ভর সন্ধ্যেতে অপা বুড়ির ঘরে! কি কান্ড! দুগগা! দুগগা!"
সাময়িক ভাবে আমিও অবাক হয়ে গেছলাম ওদের সবার কথা শুনে। কারন আমার নিজেরও খেয়াল ছিল না ওই সরমা বুড়িই অপা বুড়ি হতে পারে বলে। সম্ভবত 'অপয়া' শব্দটা থেকেই সবাই ওনার নাম দিয়েছিল অপা।
তবে সেদিন সেই ছোট্ট বয়সেই উপলব্ধি করেছিলাম মানুষকে কোনোদিনই একদিক থেকে বিচার করা উচিৎ নয়। আমাদের সমাজই ওনাকে আত্মরক্ষার্থে গালিগালাজ করতে শিখিয়েছে, খারাপ হতে শিখিয়েছে। এমনকি ওনার নামটা পর্যন্ত আমাদের এই সভ্য ভদ্র সমাজেরই দান। অপা বুড়ির মতো নোংরা পোশাক, খারাপ ভাষার আড়ালে হয়তো এরকমই অনেক সরমার দুঃখ আর দুর্ভাগ্যের ইতিহাস আজও গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে। আমাদের চোখের সামনে আর কটা আসে!
****
চাকুরি পাবার পর এই বছর দুয়েক আগে আবারও গেছলাম মামার বাড়ি। এখন ওই শ্মশানের পাশ দিয়েই পিচ ঢালা রাস্তা হয়েছে। ভ্যান গাড়ি, ট্রাক্টর যাওয়া আসা করছে। বরং শ্মশানটাই গ্রাম থেকে দূরে সরে গেছে। মামাবাড়ি যাওয়ার আগের রাস্তাটা বদলে এটাই এখন প্রধান রাস্তা। রাস্তার ধারে অনেকগুলো দালান বাড়িও হয়েছে। ভাঙ্গা মন্দিরটাও সরকারী ভাবে সংস্কার করে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো একটা আটচালা করা হয়েছে। কিন্তু সেই সরমা বুড়ির ঘরটা আর দেখতে না পেয়ে মামাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,
-"আচ্ছা এখানেই সেই বুড়িমা থাকতো না!"
মামা কপালে ভাঁজ ফেলে আমাকে পালটা জিজ্ঞাসা করেছিল,
-"কোন বুড়ি রে.."
মামার ভুলে যাওয়াতে আমিও বেশ বিস্মিত হয়েছিলাম। যেখানে গ্রামের সবার মুখে মুখে বুড়ির নাম ঘুরে সেখানে ভুলে যাওয়ার কথা তো মোটেও নয়। বলেছিলাম,
-"সেই যে গো মামা, সরমা বলে যে বুড়িমা ছিল.. সেবার ওই ঝড় বৃষ্টির রাত্রে যার ঘরে আমি কোনোরকমে ঢুকেছিলাম..."
আর অবশ্য মামাকে বেশি কিছু বলতে হয়নি। মামা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল,
-"ওহহহ... অপা বুড়ি! সে তো মরেছে বছর পনেরো হয়ে গেল প্রায়!"
কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে বুড়ির ঘরটা কোথায় ছিল মনে করার চেষ্টা করছিলাম। অনেক চেষ্টার পরেও সে সবের কোনো চিহ্ন না পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস শরীর ঠেলে বেরিয়ে এসেছিল। ভেবেছিলাম, সত্যিই তো কতো বড়ো হয়ে গেছি! কতোগুলো বছরই না আজ পেরিয়ে গেছে!
ধীর পায়ে এগিয়ে গেছলাম মামার সাথে মামাবাড়ি যাওয়ার ওই সন্ধিগ্রামের বামুনপাড়ার রাস্তাতে। তবুও কেন জানিনা ওই পিচ ঢালা রাস্তার গায়ে সেই কচুপাতা তোলা ডোবাটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল আমার শৈশব হয়তো আজও দাঁড়িয়ে আছে কোনো এক অপয়া বুড়ির হাত ধরে....
-সমাপ্ত-