#শপি_অডিও_স্টোরি
#গল্পের_শিরোনাম:_কে এই দেশপ্রেমী?
#লেখকের_নাম:_ডাঃ_পরমেশ_ঘোষ
#বাচিক_শিল্পীর_নাম:_ডাঃ_পরমেশ_ঘোষ
যদি আমি হ’তাম সেই বাঙালী দেশপ্রেমিক – যে সাহেব মারতে পিস্তল ধরেছে, আবার পেট চালাতে খবরের কাগজও ফেরি ক’রেছে। জন্ম হ’য়েছিল মামাবাড়ীতে, ক’লকাতার দর্জিপাড়ায়। বাবা রাজবাড়ীর বংশধর; কিন্তু এক আধ্যাত্মিক- অমৃত পথের সন্ধানী; আমি বুঝে উঠতে পারিনি উনি পৌঁছতে চান কোন্ লক্ষ্যে।
স্কুলে গিয়ে লক্ষ্য হ’লো দেশকে স্বাধীন করার, হ’লাম কারাগারে অন্তরীণ; ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থেকে হ’লাম বঞ্চিত; সেই থেকে পড়েছি নিজের চেষ্টায়- নানা বিষয়ে- যাতে কিছু রোজগার করা যায় আর নিজের পেট চালিয়ে কাজ করা যায় স্বাধীনতার সংগ্রামে।
বাড়িতে বাবা-মা দু’জনের কেউই লৌকিক জগতে থেকেও যেন নেই। তাই আমারও মায়া জন্মায়নি সংসারে। অল্প বয়স থেকেই বাড়ি ছেড়ে বারবার পালিয়েছি- পাহাড়ে, সমুদ্রে, যখন যেখানে খুশি। পকেটে এক পয়সাও নেই। যেখানে খুশি যত দিন খুশি কাটিয়ে আবার ফিরে এসেছি বাড়িতে। এসে দেখেছি, বাবা-মা দুজনেই নির্বিকার, কাউকে না জানিয়ে এত দিন বাইরে থাকার পরেও। একবার তাঁরা জিগ্যেসও ক’রতেন না, ‘এত দিন কোথায় ছিলিস?’ এমন পরিবেশে বড় হয়েছি ব’লেই রাজসম্পত্তি, সংসার কোনও কিছুতেই মায়া জন্মায়নি আমার। কিশোর বয়েসেই একদিন পাকাপাকি ভাবে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম দেশবন্ধু চিত্তররঞ্জন দাশের সঙ্গে।
এক বিশাল সভার মধ্যে এক সাহেবকে গুলি ক’রে মারার দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। পিস্তল এসে গেলো। পকেটে পিস্তল নিয়ে আমি গেলাম সেই সভায়। জানি, সাহেবকে গুলি করার পরেই নিজেকেও মরতে হবে। দেশের জন্য মরতেও প্রস্তুত ছিলাম।
যেই সাহেব মঞ্চে উঠেছেন, দর্শকের আসন থেকে উঠে দাঁড়ালাম আমি। গুলি ছোঁড়ার জন্য পকেট থেকে পিস্তল বার ক’রতে যাবো, তখনই মাইকে ঘোষণা হ’লো,- আমাকেই মঞ্চে এসে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হবে।
সবার চোখ তখন আমার দিকে। আর উপায় নেই, আমাকে উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইতে হ’লো। পিস্তল পকেটেই রয়ে গেলো!
আমাদের শহরে সভা ক’রতে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দেশবন্ধুর ভাষণ শুনে এমন উদ্বুদ্ধ হ’লাম যে দেশবন্ধু ফেরার ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম ওই বগিতেই।
‘আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাবো।’
‘কী ক’রবে গিয়ে?’
‘দেশসেবা। স্বদেশী ক’রবো।’
‘চলো তাহ’লে।’
সুভাষ বোসকে চিঠি লিখলেন দেশবন্ধু, আমাকে ‘আত্মশক্তি’ কাগজে লেখার কাজ দেবার জন্যে। গুরুদেবের আদেশে আমাকে চাকরিতে নিলেন নেতাজি। কিন্তু রোজ ঠিকমতো অফিসে যেতাম না। নিয়মনিষ্ঠ নেতাজির পছন্দ হয়নি এমন অনিয়ম। একটি খাম পেলাম নেতাজির কাছ থেকে; তাতে একশো টাকার একটি নোট আর একটা চিরকুট— ‘আপনাকে আর দরকার নেই।’
‘আত্মশক্তি’ কাগজের চাকরি যাওয়ার পরে শুনলাম- ‘যুগান্তর’ দেউলিয়া; বন্ধ হ’য়ে যাবে। পাঁচশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললাম যুগান্তর-এর স্বত্ত্ব; সম্পাদকও হ’লাম। কিন্তু ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে লেখা ছেপে পড়লাম রাজরোষে।
একদিন দফতরের কাজ সেরে মেসের দিকে ফিরছি, রাস্তাতেই খবর পেলাম পুলিশ এসেছে- আমাকে খুঁজছে। আমি ঢুকে পড়লাম সামনে একটা মিষ্টির দোকানে, টপাটপ কুড়িটা রসগোল্লা আত্মসাৎ করার পর পকেটে হাত দিয়ে বুঝলাম একটা টাকাও নেই। এবার?
দোকানের মালিক সঙ্গে লোক দিলেন, যে আমার মেস পর্যন্ত গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে। বাড়িতে ঢোকার মুখেই গ্রেপ্তার হ’লাম। পুলিশকে বোঝালাম একজনকে টাকা মেটাতে হবে, একবার ঘরে ঢোকা দরকার। কিন্তু পিছনে তাকাতেই দেখি- সেই কর্মচারী জেলের ঘানি ঘোরানোর ভয়ে পালিয়েছে! কয়েদী হ’লাম প্রেসিডেন্সি জেলে; পরে বদলি হ’লাম বহরুমপুর জেলে, যেখানে ছিল কাজী নজরুলের রাজত্ব- হৈ-হুল্লোড়, গান, কবিতা, আড্ডায় সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন; আবার নিজের হাতে রান্না ক’রতেন- বিরিয়ানি, পোলাও, কোর্মা, কাবাব, কাটলেট।
ছাড়া পাওয়ার সময় জেলের দেওয়া কম্বলদুটো বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লাম।
ওই কম্বলদুটো পেতেই কাটিয়েছি বাকি জীবন।
‘কখনও কালজয়ী হ’তে চাইনি। সেই বৃথা চেষ্টার অক্লান্ত সাধনায় কালক্ষয় না ক’রে সকলের জীবনের সঙ্গী হ’তেই চেয়েছিলাম আমি।