• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    হি!হি!হি!হি!হি!!

    0 28

    হি!হি!হি!হি!হি!.....

    হিমি মিত্র রায়


    আমাদের দু বন্ধুর  ছোট থেকেই ভীষণ মিল, সবেতেই। আমাদের দুজনেরই ক্রিকেটে শচীন,  ফুটবলে মারাদোনা আর  এখন মেসি, খাবারে বিরিয়ানি ও মিষ্টি।  ফোটোগ্রাফির ও শখ ষোলো আনা। আমাদের দুজনেরই এক মেয়ে। এমন অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায় না সহজে। ক্লাস ফাইভ থেকে আমাদের দোস্তি,  বাবার ব্যাবসার সূত্রে রাজস্থানে আসবার পর। সন্দীপরা মাড়োয়ারি, রাজস্থানেরই বাসিন্দা। আমার বাবার মার্বেলের ব্যাবসার জন্যে পরিবার সহ এখানে আসা। এখন ব্যাবসা আমার হাতে, বাবা নেই আজ দশ বছর হল। মার্বেল ছাড়াও আমার জুয়েলারিরর ও কারবার রয়েছে।মাড়োয়াড়ি ব্যাবসায়ীদের মতই হয়ে গেছি প্রায়। সন্দীপদেরও একই বিজনেস, ওরা আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত ছিল জয়পুরে।


    যেটা বলছিলাম,  এই চল্লিশ বছর বয়সে এসেও যে এমন মিল দেখা দেবে তা ভাবি নি। আমরা দুজনেই বিপত্নীক হয়েছি গতবছর। আমার স্ত্রী লীনা আর সন্দীপের স্ত্রী সুনিতা খুব বন্ধু ছিল, গত ৪ই সেপ্টেম্বর  হার্টফেল করে মারা যায় সুনীতা,সন্দীপের স্ত্রী।  ! ঠিক তার পনেরো দিন পর গাড়ি চালিয়ে শপিং করতে যাওয়ার পথে এক্সিডেন্টে মারা যায় লীনা। এটাই মানা যায় না যে ড্রাইভিং এ তুখোড় মেয়ে কিভাবে ব্রেক ফেল করে।  হ্যাঁ, সত্যি।শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এমনটাই হয়েছে আমাদের সঙ্গে। যদিও সুনীতার হার্টের একটু সমস্যা আগে থেকেই ছিল তবুও এখন মনের মধ্যে এটাই ঢুকে বসে গেছে যে ওর যা হবে আমারও তাই হবে,বা আমার যা হবে ওরও তাই হবে।


    আগামী ২৫ এ সেপ্টেম্বর সুনীতার বাৎসরিক। আর তার ঠিক পনেরো দিন পরেই লীনার। আমরা ঠিক করেছি ওই দুটো দিন শহর ছেড়ে ১৩৪ কিলোমিটার দূরের  দেওরালা  গ্রামে গিয়ে গরীব দু: খিদের সেবা করব, ওখানকার হনুমান মন্দিরে দুজনের বাৎসরিকের কাজ করে বস্ত্রদান সহ খাবার ইত্যাদি দিয়ে মনের শান্তি পাব। আর রাতে ওখানকার কোনও জায়গায় রাত্রিবাস করে পরদিন সকালে যাব বিকানির। দু সপ্তাহ ব্যাবসার থেকে ছুটি নিয়ে দুই বন্ধুতে হোটেলেই থাকব। আবার ফেরার সময় ওই হনুমান মন্দিরেই লীনার বাৎসরিকের কাজ করেই ফিরে আসব। মাঝের কটা দিন নিজেদের মত কাটাব, জঙ্গলসাফারি, ফটোগ্রাফি এইসব।  মেয়েদের নিয়ে চিন্তা নেই, সন্দীপের মেয়ে ওর মাসির কাছে থাকবে আর আমার মেয়ে ওর ঠাকুমা ঠাকুরদার কাছে।


    সক্কাল সক্কাল যাওয়ার আগে ড্রইং রুমে লাগানো লীনার বিরাট ছবিটার সামনে চুপ করে বসেছিলাম কিছুক্ষণ। লীনার হাসিমুখের ছবিটা  কয়েক বছর আগে মানালী ঘুরতে গিয়ে তুলেছিলাম আমিই। সে বছরই লীনা কনসিভ করেছিল, এখন রাংতার বয়স আট। খুব কম বয়সেই মেয়েটা মা কে হারাল।


    কখন রাংতা এসে পিঠে হাত রাখল বুঝতে পারিনি।

    বাপী!

    ঘুরে তাকাই আমি।

    সন্দীপ আঙ্কেল চলে এসছে, যাবে না?

    হ্যাঁ, আঙ্কেলকে বসতে বল, যাচ্ছি।

    না, বলল ওপরে আসবে না, তোমাকে নিচে নামতে বলল।


    আচ্ছা যাচ্ছি। তুমি ভালমত থাকবে, ঠাকুমাকে ঠাকুরদাকে বেশি জ্বালাবে না খাওয়া নিয়ে, পড়াশুনো কোরো। আমি দু সপ্তাহ পরই চলে আসব। কেমন?

    ঠিক আছে বাপী, তুমিও সাবধানে থেকো।


    গাড়ি স্টার্ট দিল সন্দীপ। ওরা হাল্কা মিউজিক শুনতে শুনতে শহর ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায় পড়ল। এসির দরকার নেই এখন, কাঁচ খোলা আছে,ফুরফুর করে হাওয়া আসছে জানালা দিয়ে। বেশ আরামদায়ক। এসময় রাজস্থানে গরম থাকে কিন্তু কিছুদিন ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় আবহাওয়াটা অনেকটা ঠান্ডা হয়েছে।


    সামনেই জয়সলমীর, ওই মরুভুমি পেরিয়ে ওদের দেওরালা গ্রামে পৌঁছতে হবে। মাঝপথে বিরাট ট্রাফিক জ্যামে ফেঁসে দু ঘন্টা লেট হয়ে গেল, তারওপর যদি বালির ঝড় ওঠে তবে তো হল, দিন থাকতে থাকতে মরুভুমিটা পেরোতে না পারলে খুব বিপদ হবে। অলরেডি সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। আর অদ্ভুত লাগছে আজ মরুভূমিতে একটাও লোক নেই, যদিও এসময় টুরিস্ট থাকে না তবুও উটের লাইন থাকে,মালপত্র সমেত ওরা পারাপার করে। আজ কোনও অজ্ঞ্যাত কারণে বড্ড ফাঁকা।

    আরে চিন্তা করিস না, কতবার এদিক দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেছি,সব মুখস্থ আমার। এক ঘন্টা লাগবে জাস্ট পার হতে।

    সন্দীপ আস্বস্ত করে আমাকে।


    গাড়িতে কতক্ষন চলেছি মনে নেই,  হঠাৎ ঘুমের আমেজ চলে এসেছিল। কখনওতো হয় না এমন  আমার! ধড়ফড়িয়ে উঠলাম। চোখ খুলে দেখি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। ড্রাইভারের সিট ফাঁকা। বাইরে গাঢ় অন্ধকার।


    কেন জানি না বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল।

    সন্দীপ আবার কোথায় গেল! হাল্কা হতে নেমেছে হয়ত। ঘড়ির দিকে তাকালাম, দেখি রাত বারোটা।


    চমকে গেলাম রীতিমত। আমরা রওনা দিয়েছিলাম সেই সকালে, আমি শেষ ঘড়ি দেখেছিলাম বিকেল সাড়ে পাঁচটা। এতটা সময় এই অন্ধকারে কেনই বা রয়েছি! কিচ্ছু মাথায় আসছে না।


    নিস্তব্ধ চারিদিক। চুপচাপ গাড়ির ভেতর বসে রয়েছি সেই কখন থেকে।সন্দীপের আসার নাম নেই। এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। দমবন্ধ লাগছে।দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম বাইরে।

    নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।আকাশও মিশ কালো, এমনিতেই মেঘলা ছিল,তারওপর বোধহয় অমাবস্যা। একটুও ভাল লাগছে না। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সন্দীপকে ফোন লাগালাম।


    ফোন বেজে চলল, ওপাশ থেকে কোনও রেসপন্স হল না।

    আবার করলাম।এবারও তাই, কোন সাড়া নেই।

    দশ মিনিট থেকে কুড়ি ত্রিশ করে এক ঘন্টা হতে চলল সন্দীপের আসার নাম নেই।


    রাত একটা বাজে, আমি বালির স্তুপের ওপর একলা দাঁড়ানো। এবার সত্যি কেমন একটা লাগতে শুরু হল।গাড়ি ফেলে কোথায় খোঁজ করতে যাব তাও বুঝতে পারছি না।এ কেমন পরিস্থিতি উৎপন্ন হল। হাওয়া হচ্ছে বেশ, ঠান্ডাও লাগছে।মরুভূমিতে দিনে যেমন গরম রাতে তেমন ঠান্ডা। শেষমেশ ঠান্ডায় জমে মরে যেতে হবে নাকি! অবশ্য গাড়ির পেছনে গরীবদের দেওয়ার জন্য কিছু শীতের জামাকাপড় রয়েছে, প্রয়োজনে সেগুলো গায়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু কথা হল সন্দী.. প..


    হঠাৎ দূরে আলোর মালা দেখা গেল।মনে হচ্ছে লাইন দিয়ে কেউ প্রদীপ নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে শুধু আলোটাই চোখে পড়ছে।


    প্রাণে একটু জল এল আমার।অন্ততপক্ষে একটা গ্রামের খোঁজ তো পাওয়া যেতে পারে!

    আমি গাড়ি লক করে আলোর লাইনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম পেছন থেকে একটা চাদর দিয়ে ভাল করে পেঁচিয়ে নিলাম নিজেকে।গাড়ি নিয়ে গেলে যদি সন্দীপ এসে খুঁজে না পায়, তাই হাঁটা। বেশ ঠান্ডা লাগছে। কেন জানি না হাঁটতে একটুও ভাল লাগছে না,একা একা গভীর রাতে মরুভূমির ওপর দিয়ে যাচ্ছি এ যে কী অনুভূতি তা বোঝানো যাবে না। একটা অজানা অস্বস্তি হচ্ছে, যদিও আমি অশরীরিতে বিশ্বাস করি না কিন্তু আমার পেছনে তাকাতে একটুও ভাল লাগছে না। দ্রুত এগিয়ে চলছি,মনে হচ্ছে পেছনে কেউ আসছে। সন্দীপ আবার ভয় দেখানোর জন্য এমন করছে না তো! ওর আবার ইয়ার্কির স্বভাব আছে। যদি সত্যি এমন করে থাকে ও তবে খুব খারাপ করেছে।


    রাস্তা শেষ হচ্ছে না আর যেন, কানের কাছে হাওয়ার দাপট বেড়েই চলছে এদিকে। কিন্তু একি! ওদিকেতো অনেক ঘোমটা পরা রাজস্থানি মহিলা হাতে মোমবাতি নিয়ে একটা কিছুর চারপাশে গোল করে ঘুরছে মনে হচ্ছে। ভেতরেও আগুন দেখা যাচ্ছে। তাহলেকি ওদের কোনও পরব বা অনুষ্ঠান চলছে এত রাতে! আরও সামনে এগিয়ে গেলাম আমি।


    যাক, কাউকেতো পাওয়া গেল এই নির্জনে। প্রাণে জল এল আমার। সন্দীপ আবার এসব দেখতে চলে আসেনিতো,হতেও পারে।

    ঘাঘরা পরা ঘোমটায় পুরো মুখ ঢাকা মহিলারা নিস্তব্ধে ঘুরে চলছে,মাঝখানে চিতার মত কিছু জ্বলছে। তাহলে হয়ত দাহ হচ্ছে মৃতদেহ,কিন্তু এত রাতে শবদাহ? তাও আবার মহিলারা শুধু? অবশ্য কতরকমেরতো পরব হয়, হয়ত এমনই নিয়ম!


    আমি আর ওদের ডিস্টার্ব করলাম না। কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দেখে ওখান থেকেই আবার সন্দীপকে ফোন লাগালাম। এবারও ফোন বেজে গেল।

    আতঙ্ক হতে শুরু হল আমার।আর শরীরও ভাল লাগছে না। এবার যদি ও না আসে তবে আমি গাড়ি চালিয়ে চলে যাব ভাবলাম। বিদ্ধস্ত অবস্থায় গাড়ি অবদি এলাম,কেন জানি না এবারেও মনে হল আমি একা নই। কেউ বা কারা পিছু নিচ্ছে। ডাকাত টাকাত নয় তো!


    সজাগ হয়ে জোরে হেঁটে গাড়ির কাছে আসতেই দেখি লাঠি হাতে ঘাগরা পরা এক বৃদ্ধা নীচে বসে রয়েছে। চাকার কাছে।প্রথমে অন্ধকারে খেয়াল করিনি।

    কে,কে আপনি?

    মহিলা  মাথা ঘুরিয়ে তাকাল ওপরে, আমার দিকে। তারপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,' আভি তেরি বাড়ি হ্যায়! কো ই নহি বাঁচেগা, কো ই নেহি!

    বলেই চোখের মণি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসতে লাগল শব্দ করে। হাতের লাঠিটাকেও বালির মধ্যে আনন্দে পেটাতে থাকল, উফ,অসহ্য, রাতবিরাতে এই উৎপাত ভাল লাগে?

    বৃদ্ধাকে একটা রাগ আর ঘৃণা সূচক আওয়াজ করে চাবি দিয়ে খুলে গাড়িতে উঠলাম।ড্রাইভারের সিটে বসে পড়লাম আমি, যা খুশি হোক, এখান থেকে পালাই, কাল এসে সন্দীপের খোঁজ করব।

    হঠাৎ গাড়ির জানলায় বলিরেখা পড়া বৃদ্ধার মুখটা উঁকি দেওয়ায় চমকে গেলাম,উফ! কী ভয়ানক দৃষ্টি!


    'যো যো আপনি দুলহনকো খুন করতা হ্যায়  উও ইধর আকে মরতা হ্যায়.... ... হি!হি!হি!হি! তোর বন্ধুর চিতা জ্বলছিল ওইখানে,  ওই সতীদাহ'র ঘাটে....হি!হি!হি!হি!....যেখানে বিধবাদের জোর করে মরদের চিতার আগুনে ঠেলে দেওয়া হত...  সেখানে.... হিহিহি... সতী বানানো হত, সতী!... চিতার আগুনে যখন চিৎকার করত বৌ'রা , তখন ঢাক ঢোল পিটিয়ে ওর আওয়াজ দাবিয়ে দিতি তোরা.. তড়পিয়ে তড়পিয়ে নতুন দুলহনদের পুড়িয়ে মারতিস ! হাড় মাস সব অলগ হো যাতি থি শরীরসে !! মুঝে ভি এইসেহি............!!  আজকে তোর বন্ধুর চিতা জ্বলে গেল.... হি!হি!হি!হি.!....বহত মজা আয়ি থি ... ইতনা মজা... হি!হি!হি!হি!...

    জানলা থেকে ঝপ করে সরে গেল মুখটা..


    তারমানে, তারমানে সন্দীপ সুনীতা কে....  কী সব ভাবছে ও! একটা বুড়ি কী কী বলছে তাই বিশ্বাস করে নিচ্ছে...

    বুকের ভেতরে তাও একটা শীতল স্রোত সম্পূর্ণ শরীরটা কে কাঁপিয়ে দিল আমার... অজানা ভয়..

    আমিওতো লীনার গাড়ির ব্রেকটা....


    হি!হি!হি!হি!...... হি!হি!হি!হি!..

    . কে কে!! আওয়াজটা গাড়ির ভেতর থেকে এল মনে হল.. আমিতো গাড়ি লক করে দিয়েছিলাম....!!.

    'কো ই নেহি বাঁচে গা আ আ...'

    আমার কানের কাছে ফিসফিস করে কথাগুলো বলল কেউ...


    'হি!হি!হি!হি!হি.!.......'.












    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!