• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    ডায়াল টোন

    0 57

       ডায়াল টোন  

       হিমি মিত্র রায়


    ' দা ডায়ালড্  নাম্বার  ডাস নট এক্সিস্ট!'

    '  আপনার ডায়াল করা নাম্বার এখন পরিষেবা সীমার বাইরে।'


    ''দা নাম্বার ইউ আর কলিং ইজ সুইচড অফ।'

    'আমাকে কষ্ট দিয়ে কি এমন মজা পাও বল তো? খুব ভাল লাগে তাই না? কতবার বললাম ওই ডুরে সবজে শাড়িটা পরে এস একবার, রাজবাড়ি দিঘিতে! এলে না! কতক্ষন বসে থেকে থেকে চলে গেলাম, শেষে মশা গুলোও আমাকে কামড়ানো ছেড়ে দিল, প্রচুর রক্ত খেয়ে যে যার মত বাড়ি চলে গেল!'


    ' এবারের পর আমি একদম অন্যদিকে মন দেব না দেখ! শুধু চাকরির পরীক্ষার পড়া পড়ব, তোমাকে আমি হারাতে চাই না শুমি, তুমি শুধু আমার, তোমার অন্য আমি সব করতে পারি, আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো গো?'


    ' বিয়ের পর প্রথম যখন ঘুরতে যাব সমুদ্রের ধারে, কোন এক অজানা নির্জন দ্বীপে, সেখানে শুধু তুমি আর আমি, আর কেউ থাকবে না, বোর হবে না তো শুধু আমায় দেখে দেখে?'

    একের পর এক চিঠি খুলছে আর পড়ে চলছে শুমি, বিছানায় ছড়িয়ে শ্রেয়ানের লেখা সব চিঠিগুলো, বিয়ের আগে যত চিঠি দিয়েছিল ও সব জমিয়ে রেখেছে। আজ ছ' বছর বাদে ওগুলো নিয়ে বসে মন দিয়ে পড়ছে তার ভালবাসার কথাগুলো। শ্রেয়ান আজ পাঁচ দিন হল একটাও ফোন করেনি শুমিকে, শুমিও যতবার ফোন করেছে ওকে ততবার হয় সুইচড অফ নয়ত পরিষেবা সীমার বাইরে বলছে। ফোন করে করে পাগল হয়ে গেছে ও। যদিও শ্রেয়ান বলে গেছে ও যেখানে যাচ্ছে ওখানে সবসময় নেটওয়ার্ক নাও থাকতে পারে, তাইবলে এতদিন? কোথাও একটা থেকে ফোন করতে পারছে না কেন সে?

    অফিসের কাজ নিয়ে দার্জিলিংএর এক পাহাড়ি গ্রামে সার্ভে করতে গেছে শ্রেয়ান। ওদের টুরিসমের বিজনেস। চাকরি ছেড়ে এই ব্যাবসায় এসেছে আজ চার বছর হল, তারপর থেকেই এদিক ওদিক যেতেই হয় ওকে টুরিস্টদের নিয়ে। এবার একাই গেছে স্পট দেখে হোমস্টে নিয়ে কথা বলতে। এদিকে শুমি সারা দিনরাত বরের ফোনের অপেক্ষায় বসে আছে, কেন এত টেনশন করছে বুঝতে পারে না শুমি। কদিন ধরে ঝড় বৃষ্টিতে একটা স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছে  ,আকাশ কালো করা মেঘ, শিরশিরে হাওয়া, সারাদুপুর অঝোর ধারা, মন খারাপের ডালি সাজিয়ে বসেছে। থেকে থেকে শুধু একটাই কথা মাথায় ঘুরছে শুমির, শ্রেয়ান ঠিক আছেতো!


    সেদিন ডোডোর স্কুলের এক বন্ধু স্নিগ্ধর কথা শুনছিল শুমি, স্নিগ্ধর বাবা নাকি হঠাৎ মারা যান স্ট্রোক করে, গাড়ি চালাতে চালাতে। কী এমন বয়স ছিল,খুব বেশি হলে উনচল্লিশ চল্লিশ! এটা কোন বয়স হল চলে যাওয়ার! জীবনটা ই তো পড়ে রইল পুরো! স্নিগ্ধর তখন এক বছর বয়স! বাবা কী জানেই না ও! আর ওর মা! তার কি অবস্থা!


    উফ! ভগবান! কেন এসব কথা বারেবারে মনে আসছে শুমির! উথাল পাথাল করছে বুকটা! শ্রেয়ানকে শুমি ভীষণ ভালবাসে, ওকে ছাড়া ওর কোন অস্তিত্বই নেই, পাঁচ বছর ভালবাসার পর অনেক ঝড়ঝাপ্টা সামলে ওদের বিয়ে হয়েছে, বাড়ির অমতেই বলা যেতে পারে,আসলে বাবা মায়ের দোষ নয়, সুন্দরি সু শিক্ষিতা মেয়ের অনেক ভাল ভাল সম্মন্ধ এসেছিল ডাক্তার, চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা কোথাও বাদ নেই। কিন্তু শুমি বেঁকে বসেছিল বলেই ওরা রাজি হয়েছিল বাধ্য হয়ে। কীএমন চাকরি করত তখন শ্রেয়ান, একটা জুস ফ্যাক্ট্রিতে বার হাজার টাকা বেতনের চাকরি । কোন বাবা মা ই কী তার মেয়েকে যেঁচে বিয়ে দিত!


    তবে শুমির তার জন্যে কোন আক্ষেপ নেই,য়ওরা একে অপর কে খুব ভালবাসে, সন্মান করে। শ্রেয়ান কোনদিন শশুর শাশুড়িকে দোষারোপ করেনি এর জন্যে, ও শুধু বলত, বাবা মা তো তার মেয়ের ভালই চাইবেন সবসময়, ওর মেয়ে হলে ও তাইই চাইত! কত ম্যাচিওরড ছিল শ্রেয়ান তখনই ,শুমিরই খুব গায়ে লাগত মায়ের কথা গুলো, কান গরম হয়ে যেত!


    ওর স্বভাব নিয়েও কথা বলতে ছাড়েনি মা, এমনকি শুমির বন্ধুদের দিয়েও বলাত যাতে ওর শ্রেয়ানের প্রতি দূরত্ব তৈরি হয়। রিনি,অযুক্তা , কমলিকা সবাই ওরা মায়ের কথা শুনত। অভিমানে কতদিন ওদের সঙ্গে কথা বলেনি ও! তারপর বিয়ের সময় আবার সব আগের মত হয়ে গেল। কিন্তু ও ফোন করছেনা কেন! শুমি দৌড়ে ঠাকুরের আসনের কাছে যায়, চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে বলে সব যেন ঠিক থাকে ঠাকুর, শ্রেয়ানের যেন খারাপ কিছু না হয়!


    মোবাইলে রিং হতেই দৌঁড়ে ঘরে আসে, হাপিয়ে ফোনটা ধরে, একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন, শ্রেয়ানই হয়ত!

    হ্যালো!


    শাশ্বতর মা নাকি, আমি অনিত্রার মা কথা বলছি, আচ্ছা আজ স্কুলে ফ্যান্সি ড্রেস কম্পিটিশনে কে ফার্স্ট হল গো? আমি না , যেতে পারিনি, মেয়ের জ্ব্রর চলে এসেছিল, দেখ কত রিহার্সাল করালাম আর শেষ সময়ে এই অবস্থা! শাশ্বত কিছু হল?

    মাথাটা রাগে বনবন করে ঘুরছে শুমির, অনেক কথা মুখে চলে এসেছিল কিন্তু নিজেকে শান্ত করল ও।


    না আজ ছেলেকে পাঠাইনি আমি, বলতে পারব না।

    কেন? ওর ও জ্বর নাকি? যা ভাইরাল ফিভার হচ্ছে চারিদিকে, এই সময়ে বাইরে বের হওয়াটাই ঠিক না, আচ্ছা, আমরা সকলে মিলে ম্যাডামের কাছে একটা এপ্লিকেশন দিলে হয় না এ নিয়ে, যে কিছুদিন স্কুল টা বন্ধ রাখা উচিৎ!


    আপনারা ঠিক করুন, আমি পাশে আছি,এখন একটু বিজি আছি, পরে কথা বলি?

    ফোনটা ছুড়ে রেখে দিল বিছানার ওপর শুমি।

    মাম্মা পাপা কবে আসবে?


    কার্টুন দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে চার বছরের ছেলে।

    ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে শুমি, চুমু খায় চোখে,চিবুকে, মাথায়! ওর চুল ভিজে যায় মায়ের চোখের জলে। ছেলেও মা কে অনেক আদর করে দেয়,বোধহয় বুঝতে পারে মায়ের কষ্ট।কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। কী করবে শুমি বুঝে পায়না, তাড়াতাড়ি  কথা বলে ফেরার কথা ছিল শ্রেয়ানের, আজ পাঁচদিন ওর সঙ্গে একটাও কথা হয়নি, উঠে এক বোতল জল খেয়ে ফেলল তেষ্টায়। সারাদিন জল ই খায়নি চিন্তায়, গলা শুকিয়ে কাঠ।


    অন্যদিকে মন ঘোরানর চেষ্টা করে, ফেসবুক খুলে বসে। আপনমনে স্ক্রোল করতে করতে একটা নিউজ চ্যানেলের খবর আর ভিডিও দেখে আঁতকে ওঠে! দার্জিলিং এর আশেপাশে সুখিয়াপোখরি, লেবং, পেডং আর আরো কিছু পাহাড়ি গ্রামে বিপুল ধসে মারাত্মক ক্ষতি, অনেক প্রাণহানি। সেনা নামানো হয়েছে।

    ডোডোর থেকে রিমোট কেড়ে চ্যানেল পালটায় শুমি, নিশ্বাস পড়তে থাকে ঘন ঘন, ডোডো অবাক চোখে মাকে দেখে আর টিভির দিকে দেখে।


    সব খবরেই দেখাচ্ছে এটা! মাথা ঘুরতে থাকে শুমির, মনে হয় পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। মোবাইল হাতে নেয় নিউজের নীচ দিয়ে যাওয়া এমারজেন্সি নাম্বারে ফোন করার জন্যে।


    ফোনের রিং শুনে চমকে যায়।   অযুক্তার ফোন, ওর ছোটবেলার বান্ধবী, আসামে থাকে। ঘুরতে আসার কথা ছিল এর মধ্যে। কোনরকমে ফোন ধরে বলল,' হ্যালো!


    ' তুই কোথায় রে?

    বাড়িতে!


    শুধু বাড়িতে বসে থাকলে হবে? বরের খোঁজ রাখিস না কেন? কোথায় তোর বর?

    হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল শুমি!

    এখন কাঁদলে হবে? সময় থাকতে কথা শুনিসনি, এখন হাতের বাইরে!


    কি বলছিস তুই? শ্রেয়ান আজ পাঁচদিন হল একটাও ফোন করেনি, নিউজে দেখাচ্ছে পাহাড়ে ধসে অনেকে মারা গেছ! শ্রেয়ান বিজনেসের কাজে পাহাড়ে গেছে,' বলে আবার ফোঁপাতে শুরু করল।


    কি?? এবার শোন! তোর বর কোন বিজনেসের কাজে যায়নি, ফূর্তি করতে এসছে মন্দারমনিতে!

    শুমি কী শুনল নিজেই জানে না,ফোন ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল শুধু!

    কি হল? শুনতে পাচ্ছিস তো?


    কি উল্টোপাল্টা বলছিস, মাথা টা গেছে তোর!

    আজ্ঞে না সোনা, আমাদের পাশের কটেজেই আছে তোর কীর্তিমান বর আর তার প্রেমিকা। কত না করেছিলাম  আমরা সকলে,  কাকু কাকীমা সবাই। বলেছিলাম এই ছেলে সুবিধের না! তুই শুনলি না! এখন বোঝ! প্রমান চাইলে তাও দিয়ে দিচ্ছি ছবি তুলেছি দূর থেকে, পাঠাব হোয়াটস অ্যাপে?

    না,না! কিচ্ছু চাই না, কোন প্রমান চাই না আমার! আমি রাখছি।


    মোবাইলটা হাতে চেপে বসে আছে শুমি, হাতে ব্যথা লাগছে এত্ত জোরে ধরে রেখেছে, হাত ঘেমেও যাচ্ছে। ডোডো কিছু বলছে না,শুধু মা কে দেখে যাচ্ছে, ওইটুকু বাচ্চাও বোধহয় বুঝতে পারছে যে মায়ের কিছু হয়েছে। নিজের হার্টবিট নিজেই শুনতে পাচ্ছে ও। গলার মধ্যে কী যেন একটা দলা পাকাচ্ছে।হোয়াটসএপে একটা মেসেজ ঢুকল, অযুক্তা নাতো! না, দেখবে না ও,দূরে সরিয়ে রাখল ফোনটা, কিন্তু মন টা মোবাইলের দিকেই রয়ে গেল। ধীরে ধীরে আবার মোবাইলটা হাতে নিল শুমি। ওয়ান নিউ মেসেজ ফ্রম অযুক্তা পাশে ক্যামেরার সিম্বল। কী ছবি পাঠাল ও! শ্রেয়ানের ছবি?


    ছবি লোডিং দেখাচ্ছে, হাঁ করে ওদিকে তাকিয়ে বসে আছে শুমি। এবার ছবি খুলে গেল! সেখানে শ্রেয়ান আর একজন মহিলা জলকেলিতে ব্যাস্ত, কখন ছবি উঠেছে তাদের খেয়াল ই নেই! এত্ত মত্ত তারা। এযে শ্রেয়ানই সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আর সন্দেহ থাকল না,অযুক্তা একটুও ভুল দেখেনি।

    শুমির চোয়াল শক্ত হচ্ছে ধীরে ধীরে, চোখের জল মোবাইলের স্ক্রিন ভিজিয়ে দিচ্ছে শুধু, চোখ ঝাপসা হয়ে যায় ওর। বড্ড চীৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে, পারে না ।

    ল্যান্ড ফোনে রিং হয়, একবার বেজে বেজে কেটে যায়, তারপর অনেকবার বাজার পর ফোন তোলে শুমি।


    কিগো ফোন তোলনা কেন? কখন থেকে ট্রাই করছি! এমনিতেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছিনা কদ্দিন ধরে,তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে না, তার ওপর ফোন তোলনা।ডিসগাস্টিং!


    কিগো উত্তর দিছনা যে! সব ঠিক আছেতো? আমি কত ট্রাই করলাম,কিছুতেই নেটওয়ার্ক পেলামনা যে তোমায় জানাব আমার ফিরতে একটু দেরি হবে!

    মুঠো বন্ধ করে রয়েছে শুমি, চোখের জলে চুল ভিজে গেছে, ফোনের রিসিভারও চ্যাটচ্যাট করছে।

    সব ঠিক আছে এখানে। তুমি ঠিক আছতো? খুব শান্ত গলায় কথাগুলো বলল শুমি।

    হ্যাঁ আমি ঠিক ই আছি, কাল ফিরব, বিকেল হবে ফিরতে ফিরতে।

    কিভাবে ফিরবে? রাস্তা যে তিন চারদিনের আগে খুলবে না!


    সেকি? কেন? রাস্তার কি হল জানি নাতো!

    দার্জিলিং শিলিগুড়ি রাস্তা বন্ধ আজ থেকে,ধ্বস নেমে কত লোক মারা গেল, নিউজে দেখাচ্ছে শুধু, আর তুমি থেকেও জান না?


    হ্যালো!! হ্যালো! দাঁড়াও তোমাকে কিছুক্ষন বাদে রিং করছি, ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না!

    ফোনটা কানে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে শুমি। ডায়াল টোনটা তীক্ষ্ণ আওয়াজ করে বেজে চলে....








    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!