• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    খেলা

    1 45

    খেলা

    রাতে খাওয়ার পর সামনের লম্বা রাস্তা দিয়ে একটু পায়চারি করা অনেক দিনের অভ্যেস সহেলীর, না হাঁটলে ঘুম ই আসবে না ওর! আসলে প্রদীপ্তকে হাজার বলা সত্ত্বেও ও একটু আগে খেতে চায় না , আর ওই শেষ সময়ে খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়তে সহেলীর একটুও ভাল লাগে না, ভীষণ অস্বস্তি হয়।

    কিছুতেই বুঝতে পারে না প্রদীপ্ত। কত বোঝানর চেষ্টা করে ও যে ডক্টর রা বলে যে ডিনারের পর অন্তত দু ঘন্টা পর বিছানায় যেতে! কীসের বোঝানো, শিক্ষক মশাই অন্যদের শিক্ষা দেবেন, কিন্তু নিজে কোন সদুপদেশ গ্রহন করবেন না, ডিসগাস্টিং!

    এখন আর ওকে বুঝিয়ে লাভ নেই সহেলী বুঝে গেছে, তাই বলে না কিছু, নিজেই হাঁটে বেশ কিছুক্ষন। বুমবুম না ঘুমোলে অবশ্য হাঁটা খুব মুশকিল, শব্দ পেলেই মায়ের পেছন ধরবে, কতদিন তো ওর জ্বালায় হাঁটাই হয় না ভাল করে, মা না ঘুম পারালে বাবুর ঘুম ই আসে না। সাত বছরে পা দেবে আগামী মাসে। কত বড় হয়ে গেল একরত্তি ছেলেটা। মনে হয় এইতো সেদিন হল। অনেক কষ্ট সাধনা করে ছেলে এসেছিল সহেলীর কোলে।

    এ ডাক্তার সে ডাক্তার ঘুরে ক্লান্ত হয়ে গেছিল ওরা। কত মানত করেছে এখানে সেখানে।কিছুতেই কিছু হচ্ছিলনা,শেষমেশ ডক্টর মিনা বসুর কাছে গিয়ে ফল পেল। উনি ভগবানের মত এসছেন সহেলীদের জীবনে।

    মনে আছে নার্সিং হোমে যেখানে ও ভর্তি ছিল, বুমবুম হওয়ার দিন তিল ধারণের জায়গা হচ্ছিল না, এত লোক এসেছিল। সকাল এগারো টা বাইশে ও যখন হল তখন সহেলীর দুচোখ জলে ভিজে গেছিল আনন্দে। প্রথম মা হওয়ার স্বাদ সব মা দের কাছেই এক ই রকম। বিশেষ করে এত কষ্ট করার পর যারা মা হয় তাদের বোধহয় আর একটু বেশি আনন্দ। ছেলেকে পুতুপুতু করে রাখে সহেলী, সব সময় সাথে সাথে যায়, স্কুল বাসেও দেয়নি। কীজানি বাবা, আজকাল যা সোনা যাচ্ছে যে একদম কেয়ার নেওয়া হয় না, জায়গাও পায় না বসার, ধাক্কাধাক্কি তে পড়ে যায় যদি!

    'তুমি বেশি বেশি কর! অন্য কারো কি ছেলে নেই নাকি? ' সবসময়েই কাঠকাঠ প্রদীপ্ত।

    'থাকবে না কেন? অন্যেরা কী করছে আমার দেখার দরকার নেই, আমি আমার ছেলেকে আগলে রাখব সবসময়।'

    'বেশি আগলাতে গেলে ছিটকে যেতে পারে কিন্তু!' এই কথাটা শুধু কানে বাঁজছে সকাল থেকে সহেলীর। কাজে মন নেই একটুও, কীজানি কেন এমন হচ্ছে ওর। বাড়িতে লোকজন অসহ্য লাগছে ওর। ঘুম নেই দুচোখে যবে থেকে বাবুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কান বোঁ বো করে, প্রেসার বেড়েছে, আর খুব মনমরা লাগে।

    কত চেষ্টা করেছিল এই বিয়ে আটকানোর, মুখে অবশ্য কিছু বলেনি, কিন্তু হাভেভাবে বোঝানর কত ফন্দি এঁটেছিল, কোনটাই ধোপে টিকল না, এই মেয়েকেই বিয়ে করবে ছেলে। অগত্যা রাজি না হয়ে উপায় নেই।

    আসলে রাজি না হওয়ারওতো কারণ ছিলনা, মেয়ে সুন্দরি,শিক্ষিতা, একটা স্কুলের প্যারাটিচার,নাচ জানে,আর কী লাগে! কিন্তু মন মানেনা সহেলীর। আঠাশ বছর নিজের করে গড়ে তোলা ছেলে মা কে ছেড়ে বউএর পেছন পেছন ঘুরবে! এ কী করে সম্ভব! কিছুতেই এমন হতে দিতে পারবে না ও,কিছুতো একটা করতেই হবে, কিন্তু কী করবে ও। ঠাকুরের সিংহাসনের সামনে বসে পড়ে সহেলী। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে চলে।

    'কীরে দিদিভাই, এতক্ষন ধরে এখানে কী করছিস? সারা ঘর খুঁজে এলাম,চল চল নীচে চল, ময়দার কৌটো টা রাধা দি খুঁজে পায়নি, বের করে দে।'

    কিছু বলে না সহেলী।

    'সব ঠিক মত হবে, ভাবিস না। ঠাকুরের কাছে মন দিয়ে বলেছিস না? দেখবি, খুব ভাল ভাবে বিয়ে হবে, খুব ভাল মেয়ে আসবে এই বাড়িতে।'

    ভাল ভাবে না ছাই! আমি চাই না আমার পরে কোন মেয়ে আসুক এই বাড়িতে! বাবু কে আমি কাউকে নিতে দেব না, কোনদিনও না, দূর হয়ে যা আমার চোখের সামনে থেকে!

    'তুই যা আমি আসছি।' কটু কথা গুলো বলতে পারলনা সহেলী।

    পরশু বুমবুমের বিয়ে, পাত্রি ওর পছন্দের, সুলগ্না। খুব মিষ্টি মেয়ে, শান্তশিষ্ট, আত্মিয় স্বজনেরা তো ওদের বাড়ি থেকে এসে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছে, গা জ্বলে যাচ্ছে সহেলীর।ও ও তো এমন স্বভাবের ছিল, ওকে নিয়েতো কেউ এরকম আধিখ্যেতা করেনি, উল্টে বাচ্চা হচ্ছিল না বলে কত কথা শুনিয়েছে!

    মাথা ঘুরছে সহেলীর। কোনরকম ধরে ধরে উঠল ও। দোতালায় ওদের বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

    'আচ্ছা মাসি, মা কে দেখেছ?'

    'কেন রে কিছু বলবি? আমাকে বল,মা পুজোর ঘরে আছে, আসবে এখুনি।'

    'না আসলে বিয়ের পাঞ্জাবি টা একটু টেলরের কাছে নিয়ে যাব, একটু ফিটিংস টা প্রব্লেম আছে, ঠিক করাতে হবে। আলমারিতে আছেতো, ওটাই বের করতে হবে,তাই।'

    'একদম না, দিদিভাই শুনলেই রাগ করবে, বিয়ের জামা কাপড় যেমন থাকে তেমন ই পরতে হয়, সেলাই ফোড়াই করতে হয় না, এখন পরে নাও বাবা একদিন, পরে ঠিক করে নিও খন। কেমন?'

    'ও বৌদি ময়দার কৌটো খুঁজে পেয়িচি গো, বড় বৌদিকে আসতে হবি না নীচে কষ্ট কইরে। ক খানা লুচি হবে গো?'

    'ও আচ্ছা, কর না আন্দাজ করে, ঘরে তেইশ জন লোক রয়েছে, এবার হিসেব করে নাও, আর তাড়াতাড়ি কর কিন্তু, জল খাবারের দেরি হয়ে যাবে নয়ত।'

    'আচ্ছা বৌদি।'

    রাধা দি চলে যায় নিজের কাজে। যে যার নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। রঞ্জা, মেঘা,রিয়া রা মিলে লাস্ট মিনিট শপিং এ যায়, কুটুস আর দ্বীপ ও ওদের পিছু ধরে, বলে যে ওরাও দেখবে মেয়েগুলোর কীসের এত শপিং!

    বেলা বাড়ে। হঠাৎ প্রদীপ্তর খেয়াল হয় অনেকক্ষণ সহেলীকে দেখা যাচ্ছেনা করে! গেল কোথায়?

    'সত্যিই তো, বুমবুম,কী রে, তোর মা কোথায়? আমিতো বাজার থেকে এসে আর ওপরে উঠিনি, দোতলায় দেখে আয় তো একবার! শরীর টরীর ঠিক আছে তো আবার? যা যা শিগগিরি! '

    বুমবুম লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে উঠল। মা এর ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বোধহয় শাড়ি পড়ছে। তাও জানার জন্য হাক দিল ও,'মা!'

    কোন সাড়া শব্দ নেই। ও আবার ডাকল। টোকা দিল আস্তে করে, যদি ঘুমোয়!

    ততক্ষনে নীচ থেকে মেসো, মাসি, পিসিরা,বাবা, সবাই চলে এসেছে, সবার মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।

    খট করে ছিটকিনি খোলার শব্দ হল।খুলে গেল দরজা।

    ভেতরে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার পরনে ছেলের বৌএর জন্য কেনা গোলাপি রঙ এর বেনারসি, মাথায় সিঁদুরের মোটা ধারা, গলায় সোনার হারের সম্ভার, বুমবুমের বউএর জন্যে কেনা আশীর্বাদী সীতাহার, হাতে ওর জন্যে কেনা বালা, মান্তাসা,আর কপালে কাঁপাকাঁপা হাতে আঁকা চন্দনের নক্সা।

    বুমবুম শুধু একবার 'মা' বলে চুপ করে গেল। বাকিরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সহেলীর দিকে, কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সহেলীর বোন দিপালী দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে দিদিকে জড়িয়ে ধরল।

    'দিদিভাই কি হয়েছে তোর?এসব কেন সেজেছিস? এগুলো কী?'

    প্রদীপ্ত চুপ। হাঁ করে স্ত্রীকে দেখে যাচ্ছে।

    ততক্ষনে রঞ্জা, মেঘা, রিয়া রাও উপস্থিত,ওরা একে অপরের হাত ধরে আছে।

    নীরবতা ভেঙ্গে সহেলী বলে উঠল,' ওদের কে খাওয়াতে হবে তো, বাচ্চা গুলোকে ভাতকাপড়ের দিন বোউএর থালা থেকে খাইয়ে দিতে হয়, আমার মা শিখিয়ে দিয়েছে। খাওয়ার রেডি হয়েছে?'

    এই সিন্ড্রোমে পেশেন্ট নিজেকে অল্পবয়েসী ভাবতে শুরু করে, নিজের যৌবন কালের সময় টা ভাবতে শুরু করে, নিজেকে সেই সময়টার সাথে ভিসুয়ালাইজ করে। যখন সে মনে করে যে তার কোন প্রিয় মানুষের কাছে তার ইম্পরট্যান্স কমে আসতে পারে, তখন এগুলো ভাবতে শুরু করে দিনরাত। ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময়।

    হারানোর ভয়ে তার কল্পনা শক্তি এমন পর্যায়ে নিয়ে যায় যে তার মধ্যে সাডেনলি এই চেঞ্জ টা চলে আসে। তিনি আপনাদের কে ভাবছেন যে আপনারা ওনার শশুড় বাড়ির লোকজন। আপনারা যে যত ওনাকে বাস্তব টা বোঝানোর চেষ্টা করবেন তত অপ্রিয় হয়ে উঠবেন ওনার কাছে, বরং সাপোর্ট করুন,আস্তে আস্তে এই ঘোড় কেটে যাবে।

    তবে কতদিন তা এক্স্যাক্টলি বলা মুশকিল, দু মাস হতে পারে, একবছর হতে পারে, আবার চারদিন ও হতে পারে।

    'আমার ছেলের, মানে ওর পরশু বিয়ে। ' ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রদীপ্ত ডক্টর অরুণাভ মিত্রকে কথাগুলো বলল।

    'খুব ই রিস্কি হয়ে যাবে ব্যপার টা সেক্ষেত্রে। উত্তেজিত হয়ে পড়ে একটা মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে, এমনকি পেশেন্টের হার্ট এটাকও হতে পারে।'

    চমকে উঠল ওরা।

    'তবে? আপনার সাজেশন? '

    'আপাতত পোস্টপোন করুন, যদি সম্ভব হয়। আদারওয়াইস ইট উইল ক্রিয়েট হিউজ প্রব্লেম।'

    প্রদীপ্ত দের বেডরুমটা খুব সুসজ্জিত, সহেলীর টেস্ট খুব সুন্দর। ওরা যত জায়গায় ঘুরতে গেছে সেখান থেকে বিভিন্ন ধরনের ঘর সাজাবার জিনিস নিয়ে এসেছে, বাকুড়ার টেরাকোটার ঘোরা, রাজস্থানের পুতুল,আর কত ধরনের গণেশ যে ওর ঘরে আছে তা গোনা মুশকিল,কাঁচের,মাটির,শ্বেত পাথরের,কাঠের, কিছুটি বাদ নেই।

    ওর ঘরটা দখিন খোলা, ফুরফুর করে হাওয়া ঢুকছে, সহেলী বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে, ওর মুখটা হাঁটুর ওপর রাখা।

    একটা কমলা রঙ এর তাঁত পড়ে আছে ও। বড় টিপ,কানে ঝুমকো, দু হাতে সোনার চুড়ি। কী যে ভাবছে বসে! প্রদীপ্ত আর বুমবুম বেরিয়ে গেল ডক্টর এর কাছে, সাত দিনের রিপোর্ট দিতে। আর তাছাড়া দু একজনের বাড়ি যেতে হবে যাদের সাথে ভাল সম্পর্ক, তাদের সহেলীকে নিয়ে চিন্তা আছে। ওদের সাথে দেখা করে কেটারার এর সঙ্গেও হিসেব নিয়ে একটু বসবে ওরা, বিয়ে হল না বলে সব ই তো গন্ডোগোল হয়ে গেল।

    'বৌদি, আমি নিচেই আছি, দরকার হলেই আমাকে ডাক দিও। তুমি রেস্ট নাও একটু।' রাধাদি চলে গেল।

    মাথা নীচু করে বসে থাকা সহেলী আস্তে করে মাথাটা তুলল। ঠোঁটের কোণায় নিষ্ঠুর হাসির রেখা ফুটে উঠল ওর। কোনো খেলায় জিতলে এমন নিষ্ঠুর হাসি বোধহয় কেউ হাসেনি আগে।।



    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Tamal Ray - (31 May 2020) 1
ছেলেকে তো সন্তান স্নেহে মানুষ করেছে। সেইক্ষেত্রে borderline personality disorder (BPD ) এর যে লক্ষ্ণন আপনি বলেছেন সেটাকি সম্ভব? এক্ষেত্রে ছেলের বৌয়ের ওপর অত্যাচার করতে দেখা যায়।

0 1