• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    রডোডেনড্রন আর একটি মুখ

    0 43

    রডোডেনড্রন আর একটি  মুখ

    হিমি মিত্র রায়


    ইচ্ছে হলে আসতে পার,

    একটু ভালও বাসতে পার

    থাকে যদি ইচ্ছে কোনও,

    ইচ্ছে পূরণ হবে যেনো!!!


    গ্রামটিতে ঢোকার ঠিক আগেই একটি ঝাঁকরা গোলাপি ফুলে ঠাসা রডোডেনড্রন গাছের ডালে আটকানো ছোট্ট সাইনবোর্ডে বাংলায় লেখা এই চারলাইনের দিকে চেয়ে রয়েছে অর্ণা আর শুভ! ওরা এসেছে ইচ্ছেগাঁও এ । ঊটি থেকে আরো তিরিশ কিলোমিটার ওপরে ছোট্ট গ্রাম এটি। অদ্ভুত ব্যাপার হল এখানে মাত্র চোদ্দটি পরিবার বাস করে আর তারা সকলেই বাঙালি।


    হ্যাঁ সত্যি! উটির কাছে হঠাৎ করে একটা সম্পূর্ণ বাঙালি গ্রাম কেমন করে এল এই প্রশ্ন আসতেই পারে সকলের মনে। শোনা যায় কোন এক সময় এক বাঙালি ব্যাবসায়ি এ পথ দিয়ে যেতে যেতে জায়গা টিকে খুব ভালবেসে ফেলে। এখানকার কৃষ্ণ মন্দিরে পুজো দিয়ে ব্যাবসায় সাফল্য কামনা করে সে। আর ফল পায় খুব তাড়াতাড়ি, ধনী ব্যাবসায়ী হয়ে যায়। আর তারপর তার পরিবার নিয়ে এখানেই বসবাস শুরু করে, পরবর্তীতে আরো অনেক বাঙালি পরিবার ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন করে এই

    গ্রামেই।


    সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল এই গ্রামে এলে ইচ্ছেপূরণ হয়,আর তাই এর নাম ইচ্ছেগাঁও ! আজগুবি মনে হলেও লোকজনের তাই বিশ্বাস। আর সেজন্যেই দূর দূরান্ত থেকে কত্ত মানুষ এসে এখানে থাকে, শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে পুজো দেয়।তবে এখানে কিন্তু কোন হোটেল বা রিসর্ট নেই,গ্রামের লোকেরাই সামান্য টাকার বিনিময়ে টুরিস্ট দের থাকতে দেয়, খেতে দেয়।


    যেমন হোমস্টে আর কী। তারা বাইরের ব্যাবসায়ীদের গ্রামে ব্যাবসা ফাঁদতে দেয় না, প্রচারের আলোয় বেশি আসতে দেয় না, তাহলেই ঠগ জোচ্চুরি শুরু হবে এই তাদের ভয়, দূর থেকে যে মানুষেরা ইচ্ছে পূরণের জন্য আসে তাদের যেন মনে না হয় এসব মিথ্যে বুজরুকি। গ্রামের মানুষের এই বিশ্বাসে ভর করেই ইচ্ছেগাঁও আছে।তবে সবসময়  কিন্তু এখানে আসা যায় না, বছরের শুধু অক্টোবর নভেম্বর আর ডিসেম্বর মাসে ইচ্ছেগ্রাম উন্মুক্ত হয়ে যায় সকলের জন্যে।


    অর্ণা আর শুভও এসেছে মনস্কামনা পূরণ করতে। আজ ছ' বছর হয়ে গেল ওদের বিয়ের, কিন্তু সন্তান আসেনি অর্ণার কোলে। প্রব্লেম টা শুভরই। কত ডাক্তার বদ্যির কাছে ছুটেছে ওরা, কিন্তু ডাক্তারদের একটাই কথা, সমস্যা তো আছেই, তবে মিরাকল ক্যান হ্যাপেন এনি টাইম!


    প্রস্তাবটা কিন্তু শুভর কাছ থেকেই এসেছিল এখানে আসার। অর্ণা এসব কুসংস্কারে একদমই বিশ্বাস করেনা, নাস্তিক টাইপ। শুভ্রর জোড়াজুড়িতেই রাজি হয়েছে ও। ধরে নিয়েছে নিখাদ ঘুরতে এসেছে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে, কলকাতার ভিড় ভাট্টা পলিউশন থেকে পালিয়ে বরের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে।


    আসলে কলকাতায় ও বড় একা, চার দেওয়ালের বাইরে আর কোন জগৎ নেই। ওই ঘর গোছান, রান্না করা,খাওয়া, আর উইকেন্ডে হয় চাইনিজ  নয় কন্টিনেন্টাল রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, তাও সবার শেষে গিয়ে পৌঁছনো।


    আসলে কী ই বা করবে। মার্কেটিং এর কাজ তার, ওর ই বা দোষ কোথায়! অর্ণার ওর কাছ থেকে সময় চাওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। এভাবেই দিন কাটে ওর। তাও যদি একটা সন্তান থাকত, তাকে নিয়ে সময় কেটে যেত, কিন্তু সেটাও এখনো হয়নি,তাই বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে এখন। কথা বলতে ভাল লাগে না,কার সঙ্গে বলবে, লোক ই তো নেই বাড়িতে। শাশুড়ি শশুর মালদায় থাকেন, তারা কিছুতেই ভিটে ছেড়ে এই ছোট্ট খুপরি ফ্ল্যাটে আসবেন না,কত্ত অনুরোধ করেছে ওরা! কিন্তু ওই এক কথা, দমবন্ধ হয়ে যাবে! অর্ণা এখন আর কমপ্লেন করে না কোন, সয়ে গেছে সব। আর শুভ টাও অদ্ভুত,একটু যে সিম্প্যাথি দেখাবে তাও না, কেমন যেন কাঠকাঠ।


    যাকগে এসব  নিয়ে বিশেষ আর মাথা খারাপ করে না ও, এটাই স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছে। আর চেষ্টা করছে গানের ক্লাস জয়েন করতে নতুন করে। দু একটা জায়গায় খোঁজ নিয়েছে, সামনের মাসেই ভর্তি হয়ে যাবে। তার ই মাঝে এই শর্ট ট্রিপ টা নিজেই প্ল্যান করেছে শুভ, ওকে পরে জানিয়েছে। ইচ্ছেগাঁও  যেতে যেতে  রাস্তায় ওকে সব বলেছে, ইচ্ছেপূরণের গল্প টা আগে বলেনি, যদি অর্ণা রাজি না হত!


    তবে সে যাই হোক রাজি হয়ে ভালই হয়েছে, এত্ত সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হল ওর, গ্রামে ঢুকতেই গোলাপি ঝাকরা ফুলে ছেয়ে থাকা রডোডেনড্রন গাছ টা বড্ড টানছে ওকে, স্মৃতির সারণী থেকে পরপর মনে পরে যায় কত কথা! কলেজে উদ্দাম দিনগুলোর কথা, ঠিক ওদের কলেজের পেছনেই ছিল ডায়না নদী, সেখানেও এমন একটা রডোডেনড্রন গাছ ছিল। তার নীচে ওদের দেখা হত, ওর আর নীলের!


    ' শুধু তাকিয়েই থাকবে না ভেতরে ঢুকবে? '

    শুভর আচমকা প্রশ্নে চমকে গেল অর্ণা।

    উত্তর না দিয়ে হাঁটা শুরু করল ও।


    ভেতরে ঢুকেই মনে হল এক টুকরো স্বর্গোদ্যান এই ইচ্ছেগাঁও। এত সুন্দর ছবির মত একটা গ্রামের কথা আগে কেন শোনেনি! মনে মনে ধন্যবাদ জানাল শুভকে, যদিও মুখে বললনা, কেন জানেনা। শুভ বেশ কলার উঁচিয়ে চলছে যেন বলতে চাইছে 'কেমন দিলাম?'


    হাসিমুখে দুজন গ্রাম্য পুরুষ এবং মহিলা এগিয়ে এল।

    আপনারা কোলকাতা থেকে এসেছেন তো?

    হ্যাঁ, আমাদের শুভময় বোস আর অর্ণা বোসের নামে বুকিং হয়েছে।

    আসুন আমাদের সঙ্গে।


    ওরা তাদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল। দু ধার দিয়ে ছড়ান ছেটান ছোট্ট ছোট্ট বাগান ঘেরা বাড়ি, ফুলে ফুলে ঠাসা। যেন মনে হচ্ছে প্রকৃতি ঢেলে দিয়েছে এদের, আর কিছু পাওয়ার নেই। এখানে যারা থাকে তাদের হয়ত এমনিই মন ভাল হয়ে যায়, দু:খ নেই কোন।

    এখানে, স্যার! আসুন।


    ওরা ওই দুজনের পেছন পেছন ঢুকল বাগান ঘেরা মিষ্টি বাড়িটায়, সযত্নে লালিত এই বাড়ি আর তার আশেপাশের বাগান। যেন মনে হচ্ছে শো পিস এনে বসানো। কোথাও এতটুকু আবর্জনা পড়ে নেই।


    ঘরের ভেতরটা আরো বেশি ভাল বোধহয়। কাঠের দেওয়াল, আর গাছের গুড়ির আসবাব পত্রে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। পাশেই লাগোয়া বাথরুম তাতে লাক্সারির জিনিসপত্র হয়ত নেই, কিন্তু ঝকঝকে মেঝে আর দেওয়াল দেখে ভাল লাগার ই কথা। কোথাও খুঁত ধরার কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।


    এত্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে রেখেছেন আপনারা, দেখে খুব ভাল লাগল।


    কান অবদি হেসে লোকটি বলল, আপনাদের খুশিতেই আমরা খুশি, আপনাদের থেকে শুনে আর পাঁচ টা লোক আসবে, আমাদের ভাল লাগবে। আর মন্দির যেখানে রয়েছে সেখানে অপরিষ্কার থাকলে দেবতা রুষ্ট হন, নারায়ণ থাকেন না সেখানে। এত দূর দূর থেকে আমাদের গাঁয়ে মানুষ কত ইচ্ছে নিয়ে আসেন পুজো দিতে, নারায়ণ কে খুশি রাখাই আমাদের কর্তব্য  ম্যাডাম!


    আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন, তারপর খেতে চলে আসুন ডাইনিংপ্লেসে। মহিলাটি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলল।

    সেটা কোথায়?

    ওইতো, বের হয়েই ডান দিকে ঘুরে গাছের ছায়ায়, খোলা আকাশের নীচে দুপুরের খাবার জায়গা। সকলেই একসঙ্গে খাবে, আরো যারা যারা আছেন।

    আচ্ছা, আসছি।


    দরজা বন্ধ করতে যাবে অমনি একটা ষোল সতের বছরের ছেলে এসে দুহাতে করে দুবালতি গরম জল দিয়ে চলে গেল।ভালই হল, না চাইতেই পাওয়া গেল ,নয়ত এই ঠান্ডায় কীভাবে চান করবে ভাবছিল শুভ আর অর্ণা।


    একটা লাল রঙের উলেন কার্ডিগান পড়েছে অর্ণা, সঙ্গে একটা চেড়া উলের স্কার্ফ, হাল্কা গোলাপি লিপগ্লস দিয়ে শুকনো ঠোট টাকে ভিজিয়ে দিল ও। শুভ আগে আগে যাচ্ছে ফটো তুলতে তুলতে। এখানেও আলাদা আলাদা, পাশাপাশি চলার ইচ্ছেই নেই যেন। আগে একটি বয়স্ক মহিলা যাচ্ছেন,  সঙ্গে একটি মেয়ে।কাজেরই হবে, হাত ধরছে প্রয়োজনে। পেছন থেকে দেখছে ও।


    চার পাঁচ টা বড় বড় টেবিলকে জোড়া লাগিয়ে এক করা হয়েছে। তাতে সব চেয়ারে ভর্তি লোক আর বাচ্চা, শুধু চার টে চেয়ার ছেঁড়ে, ওদিকে দুটো এদিকে দুটো। সবাইকে বাঙালি মনে হচ্ছেনা কিন্তু, তবে বেশিরভাগই। অর্ণা এদিকের চেয়ার টেনে বসল। শুভ এখনো ছবি তুলে চলছে।

    কি গো এস!

    আসছি আসছি! তুমি শুরু করে দাও।


    মহিলারা মিলে পরিবেশন করছে, সব ই আছে, ভাত ডাল, মাছ তরকারি, রুটি মাংস, যে যেটা খায়। অর্ণাদের পাশে এক মাড়োয়াড়ি পরিবার বসেছে, দুটো বাচ্চা, খুব চীৎকার চ্যাঁচামেচি করে যাচ্ছ, মা' টা শুধু মারছে ওদের। অর্ণার খুব কষ্ট হল দেখে। এত ছোট বাচ্চা কে কীকরে মারে কে জানে! নিজের বাচ্চাকে ভালবাসা ছাড়া আর কিছু করা যায়  নাকি! চোখ ছলছল করে ওঠে ওর।


    শুভ এসে চেয়ার টেনে বসল। সামনের ফাঁকা জায়গা টা'তে ওই বয়স্ক মহিলা এসে বসলেন, আর ঘন ঘন কাকে খুঁজছেন।


    অর্ণারা খেতে শুরু করল, শুভ খেতে খেতেই ক্যামেরার ছবি দেখাচ্ছে ওকে, হঠাৎ চেয়ার টানার শব্দে চমকে ওদিকে তাকায় অর্ণা।


    নিমেষেই বুকের ভেতর টা ঠান্ডা হয়ে গেল ওর, হৃদযন্ত্রের আওয়াজ টা কানে বাজতে লাগল সব কিছু ছাপিয়ে। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে থেমে গেল ওখানেই। নীল এসে বসল ওই বয়স্ক ভদ্র মহিলার পাশে। নীল! অর্ণার প্রাক্তন প্রেমিক।


    মুহূর্তের মধ্যে দুজনের দৃষ্টি আদানপ্রদান হয়ে গেল। চমকে গেল নীলও।খাওয়া বাদ দিয়ে অর্ণা ভাবতে লাগল আগের কথা।


    পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছে ওরা। অর্ণাকে নীল আঁকড়ে ধরেছিল ছেড়ে আসবার সময়, যখন অর্ণা ওকে বলতে এসেছিল ওর অন্যখানে বিয়ে ঠিক হয়েছে। নীল তখন বেকার, শুধুমাত্র কটা টিউশানি করত। অর্ণা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে এত্ত বড় ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছিল, বাবা বলেছিল ও যদি নীলকে বিয়ে করে তবে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন পথ থাকবে না।


    মা নেই ওর, আর বাবাকে খুব ভালবাসত ও, বুকে পাথর চেপে নীলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল, উফ সেই দিন টার কথা ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অর্ণার। বিয়ের পরদিন সেই যে মালদা ছেড়ে  চলে এসেছিল আর যায়নি বেশি, দু একবার গেছিল বাবাকে দেখতে। তারপর বাবা চলে গেল হঠাৎ, আর যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল।


    আজ এখানে এতদূরে নীলকে দেখতে পাবে স্বপ্নেও ভাবেনি ও, ভগবানের এ কী লীলা! কেন এমন হচ্ছে ওর সঙ্গে! ও তো সবকিছু গুছিয়েই নিচ্ছিল, শুভ যেমন ই হোক,তাকে নিজের স্বামী মনে করে নিজের করেও নিয়েছিল তবে কেন এখন নীল আবার ওর সামনে!


    ডাল টা পাস করতো!

    কি ভাবছ? ডাল টা দাও বললাম যে!

    ও হ্যাঁ!

    শুভ আবার কিছু সন্দেহ করলনাতো! নাহ ও কী ভাববে! ও তো আর চেনে না! ওদিকে নীলের পাশে বসা বয়স্ক মহিলা, ওর মা ই হবে, অর্ণা কোনদিন দেখেনি আগে এত বছরেও, নীলকে প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে যত্ন  করে।


    কোনওমতে খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে অর্ণা। খাওয়ার টেবিল থেকে পালিয়ে বাঁচে।

    চলুন মেডাম, সন্ধ্যে বেলার অনুষ্ঠানের জন্য শিল্পিরা চলে এসেছে। একটা চাদর নিয়ে নিন মাথা ঢাকবার জন্যে, খোলা জায়গায় তো, বেশ ঠান্ডা পড়বে।

    তুমি যাও, আমি ক' টা কাজ সারি।

    শুভর কমন ডায়ালগ,  অর্ণা কিছু বলে না।


    স্থানীয় মেয়েরা নাচ গান করছে, মাঝখানে অনেক কাঠ কুঠো দিয়ে আগুন জ্বালান, আর তাকে ঘিরে সকলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। অর্ণা এসে গুটিসুটি মেরে বসল। ওর খুব একটা আসবার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ঘরে  ভাল লাগবে না তাই এসেছে। চারপাশে ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে, নাহ, নীল নেই। হাফ ছেড়ে বাঁচল ও।


    এদিকে কফি আর পকোড়া সার্ভ করা হচ্ছে নাচ গানের ফাঁকে ফাঁকে। পরিবেশ টা খুব সুন্দর হয়ে উঠেছে, কিন্তু মনের ভেতরে কী যেন চলছেই ওর। কিছুতেই মন বসছে না।


    ঘরে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ায় ও,‌ হাঁটতে হাঁটতে নিজের ঘরের দিকে যেতে থাকে আনমনা ভাবে। কিছুদূর যাওয়ার পর থমকে যায়, দেখে নীল এদিকে আসছে কোলে বাচ্চা নিয়ে। বাচ্চাটা ঘাড়ে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে।


    অর্ণার অস্বস্তি হওয়া শুরু হল, এই তাহলে ছিল ওর ভালবাসা। বিয়ে করে বাচ্চাও হয়ে গেল! বৌ কে ঘরে বন্দী করে রেখেছে কেন তবে। ঝট করে একটা রডোডেন্ড্রন গাছের পেছনে লুকিয়ে পড়ল ও। নীলের মুখোমুখি হতে চায় না, যদিও চারিদিকে সোলার লাইটের আলোয় আলোকিত, লুকিয়ে থাকলেও টেনসন থাকেই।


    ও এদিকেই আসছে ধীর পায়ে, বাচ্চাটা মনে হয় খুবই ছোট, এক দেড় বছর হবে, পেছন দিকে মাথা এলিয়ে আছে বলে দেখা যাচ্ছে না। অর্ণার হিংসে হচ্ছে এবার, ওর চোখের সামনে ওর প্রাক্তন প্রেমিক বাচ্চা কোলে নিয়ে চলে যাবে! আর ওর কোল এখনও শূন্য!


    নীল এগোতে থাকে, একদম গাছটা'র সামনে চলে আসে।অর্ণা চোখ বুজে থাকে ভয়ে। অবশেষে ওকে ক্রস করে চলে যায়, অর্ণা ঘুরে তাকায়।


    নীলের ঘাড়ে মাথা এলানো ছোট বাচ্চাটা'র মাথাটা প্রয়োজনের তুলনায়  বেশি বড়। শরীর আর মুখের বয়সে আকাশ পাতাল ফাড়াক। মনে হচ্ছে একজন বেশী বয়সের কাউকে জোর করে ছোট করে দেওয়া। সেই অদ্ভুত দর্শন বাচ্চাটি চোখ বুজে রয়েছে।


    নীল বাচ্চা সমেত ছোট হতে হতে দূরে চলে গিয়ে মিলিয়ে যায় লোকের ভিড়ে।

    অর্ণা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। সময় টা যেন ওখানেই থেমে যায় হঠাৎ, গলার মধ্যে একটা কিছুর দলা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়, গা গুলিয়ে ওঠে ওর। বাচ্চাটার বলিরেখা পরা মুখটা ভেসে ওঠে শুধু, দৌড় দেয় ওর কটেজের দিকে। ঘরে ঢুকে বাথরুমে চলে যায়, চুপ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।


    উনি তো দুবার এলেন এই নিয়ে। স্ত্রী মারা গেছে বাচ্চার জন্মের সময়। বাচ্চাটাও অদ্ভুত রোগে ভুগছে, এদের আয়ু স্বল্প, আমাদের যেমন বয়স বাড়ে, ওর তার তিন গুণ তাড়াতাড়ি বাড়ে। আসলে ওর বয়স মোটে এক বছর। আর বেশিদিন নেই ও। ইন্দ্রনীল বাবু বাচ্চাটার জন্য কীই না করছেন, এ ডাক্তার সে ডাক্তার! কাল আবার

    মন্দিরে ওর জন্য পুজো দেবেন। আপনি চেনেন ওকে?


    মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শোনা যায়, নির্জন ইচ্ছেগাঁও ঘন্টার শব্দে আন্দোলিত হতে থাকে, অর্ণার বুকের মধ্যেও হাজারটা হাতুড়ির আঘাত লাগতে থাকে, নিজের অজান্তেই চোখের কোণ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে ওর চিবুকে।













    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!