• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    শবরী গেস্ট হাউজ

    0 40

    শবরী গেস্ট হাউজ



    বয়স প্রায় পঞ্চাশ  ছুঁই ছুঁই, কিন্তু এডভেঞ্চার করার প্রবল শখ মিহির বাবুর। ঠিক এডভেঞ্চার বললে ভুল হবে, যেমন  জঙ্গলে গিয়ে কোন গার্ডকে সঙ্গে নিয়ে রাতের বেলা জঙ্গলে থেকে যাওয়া, তারপর হাতি তাড়ানোর মাঁচায় উঠে খিচুড়ি ডিমভাজা সহযোগে রাতের আহার, আবার কখনো গাড়ি ড্রাইভ করে কলকাতা থেকে পুরি  বা আরো দূর দূর ঘুরে বেড়ানো, আর রিসেন্ট সংযোজন কলকাতার বিভিন্ন পুরোন আমলের রাজবাড়ি যেগুলো টুরিস্ট দের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সেগুলোতে গিয়ে থাকা। এটা যদিও এডভেঞ্চারের মধ্যে পড়ে না তবুও শখ যেহেতু হয়েছে তাই ওনাকে আটকায় কার সাধ্যি!


    সেদিন পাড়ার বাপির চায়ের দোকানে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। প্রলয় কর, উনি আশিসের ভাই, শিলিগুড়ি থেকে এসেছেন। কথায় কথায় উঠল মিহির বাবুর এডভেঞ্চার প্রীতির কথা, ভূত প্রেতের ব্যাপারে অভয়ের কথা। উনি মিহিরবাবুকে প্রস্তাব দিলেন একটা।


    ওসব বহু বাংলোয়, রাজবাড়ীতে আমার থাকা সাড়া, নতুন কিছু থাকলে বলুন।

    বাইরের কথাতো আমি বেশি বলতে পারব না কিন্তু আমি যেটার কথা বলতে পারি সেটা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ টুরিস্ট প্লেস মনে হলেও এর অভ্যন্তরের ব্যাপার স্যাপার বেশ গোলমেলে। বেশি ঘাটতে গেলেই মুশকিল। মর্গ্যান হাউসের নাম শুনেছেন?

    কালিম্পং এর মর্গ্যান হাউস? এ আর নতুন কী! কদিন আগেইতো উত্তমরা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরে এল, কই ওদেরতো ভুত ধরেনি!


    উহু উহু, মর্গ্যান হাউজেরর লাগোয়া ' শবরী গেস্ট হাউজ'। আমি যার কথা বলছি।


    এত জায়গায় গেছি এই নামতো ভাই আগে শুনিনি! তবে একবার ঘুরেই আসি কি বলেন?

    একটা অনুরোধ, একা যাবেন না দাদা,কাউকে সঙ্গে নিন, কিছু হলে আমার খুব খারাপ লাগবে, আসলে আমিই আপনাকে সন্ধান টা দিলাম কী না!

    চা এর কাপে চুমুক দিয়ে শব্দ করে হেসে উঠলেন মিহিরবাবু, আর একটু হলে বিষম খাচ্ছিলেন, আর কথা বাড়ালেন না।


    এন যে পি পৌছে গাড়ির লাইন লেগে গেল। একজন যাত্রী দেখে অনেক ড্রাইভার আবার শেয়ারে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে মিহির বাবু রাজি হয়ে গেলেন, নয়ত দেরি হয়ে যাবে।


    আকাশের অবস্থা খুব যে ভাল তাও নয়, তার ওপর পাহাড়ি রাস্তা,বৃষ্টি নামলে আবার ঝামেলা হবে, ধস টস এদিকে লেগেই থাকে, অযথা কাল বিলম্ব না করে মিহিরবাবু উঠে পড়লেন সুমো গাড়িতে।

    ওপাশের দরজা দিয়ে একজন ব্যক্তি উঠলেন, মিহির বাবুর চেয়ে বড়ই হবেন, বাঙালীইতো মনে হল।


    কালিম্পং এ বেরাতে?


    পাশের ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে বললেন।

    ওই আরকী! আপনি?


    আই এম পিনাকি চ্যাটার্জি ফ্রম জলপাইগুড়ি,  আমার কর্মস্থল রমভি, ওখানেই একটা স্কুলে পড়াই আজ পঁচিশ  বছর হল।


    আচ্ছা আচ্ছা, মডার্ন স্কুল,রম্ভি? বাহ খুব ভাল স্কুল,য়নাম শুনেছি।


    ইয়েস, ভেরি গুড স্কুল। তা আপনি একাই ঘুরতে বেড়িয়েছেন দেখছি!


    আমি একা একাই বেড়াতে ভালবাসি, বেশি লোকজন ভাল লাগেনা আসলে, শান্তিমত ঘোরা যায়না, এর একরকম মত,ওর একরকম মত,তাই আর কী!


    হুম,আই সি!, তা কালিম্পং এ কোথায় উঠবেন?

    মর্গ্যান হাউজের..


    মিহিরবাবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে উনি বললেন, বাহ!! দারুণ ভাল লাগবে, খুব সুন্দর জায়গা! আ ফেয়ারি প্লেস, সাহেব রা একটা জবরদস্ত বাড়ি করে গেছে এখানে আই মাস্ট সে! আমি কতবার গেছি ওখানে!


    আপনি শোনেননি ভাল করে,আমি বলতে যাচ্ছিলাম মর্গ্যান হাউসের পাশে শবরী গেস্ট হাউজে। চেনেন?


    কিছুক্ষন হা করে তাকিয়ে থাকলেন উনি মিহিরবাবুর দিকে। তারপর অবাক হয়ে বললেন,' এত জায়গা থাকতে সেখানে কেন? এখনতো সিজিন টাইমও নয়,টুরিস্টও হাতে গোনা। লজ আর হোটেল গুলোতো ফাঁকাই রয়েছে!


    না তেমন কিছু নয়, একজন বলল ঘুরে আসতে পারেন তাই চলে এলাম। আমার আসলে একটু অন্যরকম জায়গার প্রতি আকর্ষণ মানে ইয়ে..

    বুঝলাম। তবে সাবধান থাকবেন। অনেকদিন বোধহয় ওখানে কেউ যায়ওনি সেভাবে।দেখুন আগে থাকার মত অবস্থা রয়েছে নাকি।

    কোথা থেকে বুকিং হয় জানেন?


    ঠিক বলতে পারব না, তবে মনে হয় মর্গ্যান হাউজ থেকেই, একসময় ওটার ই অংশ ছিল, মানে আছে আর কী।


    ধন্যবাদ অনেক, কালিম্পং থেকে ফেরার পথে আপনার স্কুল ঘুরে আসব ক্ষন, নিজেই নেমন্তন্ন নিলাম দেখছেন তো?


    আমি চাই আপনি আসুন, কী হল না হল সেটাওতো জানতে হবে নাকি! বলে মুচকী হাসলেন পিনাকি চ্যাটার্জি।


    হাহাহাহা.. সে তো একশবার!


    ওনাকে স্কুল গেটের কাছে নামিয়ে , কালিম্পং রওনা দিল গাড়ি। মর্গ্যান হাউজেরর কাছে মিহিরবাবুকে নামিয়ে ড্রাইভার চলে গেল। ওয়েদার ভাল না খুব একটা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিকেল চার টা বেজে কুড়ি মিনিট, ঘড়ি দেখলেন উনি।


    সুবিশাল মর্গ্যান হাউস টি সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, সামনে প্রশস্ত সবুজ মাঠ, ফুলে ঘেরা পুরো বাড়িটি।তবে বেশ ঠান্ডা, যতটা না ঠান্ডা হবার কথা, এই বৃষ্টির জন্য আরো জাকিয়ে বসেছে শীত। জ্যাকেট ভাল করে বোতাম আটকে নিলেন মিহিরবাবু। ব্যাগ পিঠে চাপিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন।


    কিতনে লোগ হ্যায়?


    রিসেপশনে বসে থাকা নেপালি ছেলেটি জিজ্ঞেস করে।

    এক, ম্যায় আকেলাহি। পর, মুঝে ইয়াহা ঘর নেহি চাহিয়ে!

    রেজিস্টার থেকে মুখ তুলে মিহিরবাবুর দিকে তাকাল ছেলেটি। আস্তে করে বলল,' তো ফির?'

    বগলমে 'শবরী গেস্ট হাউজ' বোলকে এক রেস্ট হাউস হ্যায় না, উসমে!


    ছেলেটি খপ করে পেনটা রেজিস্টারের ওপর রেখে ভেতরে চলে গেল,কিছু বলল ও না, অদ্ভুত ব্যাপার তো!


    ব্যাগ পিঠ থেকে নামিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে শুরু করল মিহিরবাবু,ঘরের মধ্যেই। পুরোন দেওয়াল,সাহেবদের ছবি, ব্যাবহারের জিনিষপত্র যেমন টি পট, ওয়াইন গ্লাস, চুরুট ইত্যাদি শোকেস বন্দি করে রাখা, বেশ একটা পুরোন পুরোন গন্ধও আছে, অদ্ভুত লাগে।


    -ইয়েস!


    কর্কশ আওয়াজে ঘুরে তাকাল মিহিরবাবু।

    একজন বেটে করে বয়স্ক ভদ্রলোক, হাতে লাঠি নিয়ে মিহিরবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন ভুরু কুঁচকে।


    আমি শবরী গেস্ট হাউস টা একদিনের জন্য ভাঁড়া চাই, মানে আজ রাতের জন্য।


    ওটাতো অনেকদিন আগেই ভাঁড়া দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, ইউ ডোন্ট নো?  ! আপনি মর্গ্যান হাউজেই থাকতে পারেন, আপনার ভাল লাগবে আই মাস্ট সে!


    ইউ মিন টু সে প্যারানরমাল এক্টিভিটিসের জন্য ভাঁড়া দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে?


    হোয়াট? কে বলল আপনাকে এসব বাজে কথা? ক্যালিম্পং ইজ আ ভেরি ভেরি ওয়েল নোওন টুরিস্ট প্লেস, একে নিয়ে এসব বোগাস কথা বলবেন না। আপনি থাকুন ওখানে, তবে অত লাক্সারি পাবেন না আগেই বলে দিলাম, রাতে কোন এটেন্ড্যান্ট থাকবেনা কিন্তু, নিজেকেই জোগাড় করতে হবে  সব। মর্গ্যান হাউজের ফোন নাম্বার নিয়ে নিন, প্রয়োজনে কনট্যাক্ট করতে পারেন যাতে।


    সো নাইস অফ ইউ। থ্যাংকইউ মিঃ..ভিক্টর গোমস্।


    থ্যাংকস আ লট মিঃ গোমস।


    সোনু ,সাহাবকো গেস্ট হাউস তক ছোড়কে আও।

    সোনু নামে ছেলেটা একবারে শুনল না, তারপর আবার ডাকাতে জোর করে রাজি হল, খুব একটা ইচ্ছে নেই যেন।


    মর্গ্যান হাউজের পাশ দিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেছে ঘাসের রাস্তা, দুপাশে পাহাড়ের বাঁক, যেমন হয় আর কী। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছে কত রঙ বেরঙের ফুল। চোখ জুড়িয়ে যায় । জায়গাটা অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ, এমনিতেই সন্ধ্যে হয়ে আসছে আর পাহাড়েতো আরো বেশি নিঝুম ভাব। শুধু দুজনের পায়ের শব্দ ছাঁড়া আর কোন শব্দ নেই।


    গেটের সামনে বড় বড় অক্ষরে রেখা,' শবরী গেস্ট হাউজ। এসটাব্লিশড ইন 1936।'

    গেট খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা, সামনে অনেকটা জায়গা পড়ে, রক্ষণাবেক্ষণ হয় না এমনও নয়, তবে খুব ভালও না।


    দো তলা বিল্ডিং, ইংরেজি ধাঁচে গড়া। মিহির বাবু একটু অবাকই হয়েছিলেন নাম টা শুনে, মর্গ্যান সাহেব হঠাৎ এমন বাংলা নামের গেস্ট হাউজ গড়তে গেলেন কেন! যাকগে ওসব ভেবে কাজ নেই,আপাতত একটা রাত এখানে কাটিয়ে আবার অন্য কোথাও থাকতে যেতে হবে। চার দিনের জন্য এসেছেন এবার মোটে, তাই।


    সোনু দরজা খুলে দিল, এক মুহূর্তও দাঁড়াল না তারপর আর। যাওয়ার আগে বলে গেল কাকে একটা পাঠিয়ে দিচ্ছে সে এসে ঘর কোনরকম ঝাঁড়পোছ করে দিয়ে যাবে , রাতে আর আসবে না।

    মিহিরবাবু ঘরে এলেন। বেশ সুন্দর গোছানোই রয়েছে, শুধু অনেকদিন না ব্যাবহারের জন্য একটু ধুলো পড়েছে। তবুও তেমন কিছু নয়, একটু মুছলেই চকচকে। ঢুকেই একটা বসবার ঘর, ইয়া বড় সোফা, তার ওপর বাঘের ছাল বিছানা, নীচে কার্পেট পাতা নরম তুলোর। কাঠের গোল টেবিল, যার পায়া গুলো গাছের ডালপালার মত,নীচে সাদা রঙ করা, বাইসনের পায়ের মত। টেবিলে রাখা একটা বড় এ্যাস্ট্রে, এ্যান্টিক দেখতে।


    ভেতরের ঘরে যাওয়ার পর উনি দেখলেন দেওয়ালে অনেক ফটো টানানো রয়েছে, সবই পুরোন আমলের। বেশিরভাগই মহিলাদের ছবি। তার মধ্যে এক মহিলার ছবিই দু তিন জায়গায় রয়েছে। ইনিতো ইংরেজ নন কোনভাবেই, কিন্তু পোশাক পরিচ্ছদ বিদেশি ধাঁচে, বড় গাউন, কুঁচি দেওয়া টপ, গ্লাভস। আর একটা ছবিতে আবার শাড়ি পরে আছেন। বেশ সুন্দর দেখতে ছিলেন ইনি, চোখে লাগার মত।


    পরের ছবিটায় দুজন একসঙ্গে, এই মহিলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন আর চেয়ারে বসে এক বিদেশি মহিলা, চোখের চাহনি টা খুব রূঢ় তার। ফটোর নীচে লেখা, ' মিসেস মর্গ্যান এ্যান্ড মিস শবরী বোস,1938'। খুঁটিয়ে ছবিতে দেখলেন, মর্গ্যান সাহেবের অর্ধাঙ্গিনীর হাতে ছটা আঙ্গুল।


    ছবিগুলো একদিকের দেওয়ালে, উল্টোদিকে পালঙ্কের মত বিছানা, পাশেই সুদৃশ্য আয়না, বিশাল বড়, যেন মনে হচ্ছে ঘর থেকে আয়নাই বড়।


    হঠাৎ বাথরুমে কলের আওয়াজে চমকে গেলেন উনি, কেউ এসেছে বোধহয় পরিষ্কার করতে। মিহিরবাবু আবার বাকি থাকা ছবিগুলোর দিকে নজর দিলেন, ঘোড়ার গাড়িতে বসে সাহেব সুবোদের ছবি, রেসের মাঠে, মর্গ্যান হাউজের সামনে দাঁড়ান আরো অনেক। গেটের আওয়াজে ঘুরে তাকায় মিহিরবাবু, দেখে একজন লোক হাতে বালতি  মগ ঝাঁটা নিয়ে আসছে কাপতে কাপতে।


    বাবু ঘর সাফাই করনা হ্যায়!

    কোই তো আয়া হ্যায়, ও ফির কওন হ্যায়, বাথরুম সাফ কর রাহা হ্যায়।

    হামিই তো সাফ সাফাই করি সাব, কিধর দিখাইয়েতো!


    মিহিরবাবু বাথরুমের দিকে চলতে শুরু করলেন, পেছন পেছন লোকটা ঝাঁটা হাতে।


    বাথরুমের দরজা বন্ধ ছিল, ছিটকিনি খুলে ঢুকল মিহিরবাবু ,কিন্তু কেউই নেই ওখানে, ফাঁকা। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কেউ এখুনি পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। ঝকঝক করছে, নতুন টাওয়েল,সাবান, শ্যাম্পু, হেয়ার ড্রায়ার( ঠান্ডার দেশে যেটা মাস্ট),সব কিছু। লোকটা তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন, তারপর কিছু না বলে ঘর পরিষ্কার করা শুরু করে দিল। হয়ত খুশিই হল যে ওর কাজ কমল। কেউ এসে করে দিয়ে গেছে ঠিক।


    লোকটা একাএকাই কথা বলে চলছে, ঘর জলদি যানা হ্যায়, অন্ধেরা হোরাহা হ্যায়, শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে কী দেখছে আর কোনরকম ঝাড় দিচ্ছে।

    নাম কেয়া হ্যায়?


    প্রথমবারে শুনল না,আবার জিজ্ঞেস করায় বলল, অতুল রায়।

    অতুল আমাকে একটু রাতের খাবার এনে দেবে? এই সারে ন' টার দিকে!


    ঝাঁটা ফেলে হাত জোড় করে অতুল বলল,' আমকে ক্ষমা করেন বাবু, আমি পারবনি, আমার জলদি যেতে হবে।'


    ওহ, ঠিক আছে।


    কোনরকম ঘর টাকে থাকার মত করে দিয়েই চলে গেল ও। মিহিরবাবু বেড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে রুটি মাংস খেয়ে চলে এল, রাতে খিদে পেলে বিস্কিট দিয়ে কাজ চলে যাবে।


    এত্ত সুন্দর একটা গেস্ট হাউজ, থাকার জন্য অসাধারণ। রাত তখন সবে ১০ টা, কিন্তু পাহাড়ে এটাই অনেক। যদিওবা খুব ঠান্ডা, কিন্তু তবুও বাইরে বারান্দায় যাওয়ার লোভ সামলাতে পারল না মিহির বাবু।


    তিনটে বারান্দা, এক একটা স্যুট লাগোয়া এক একটা। কাঠের সুন্দর ডিজাইনের রেলিং, বসার জায়গা, ছোট টি টেবিল। জ্যাকেট, আর চাদরে মুড়ে আরাম করে বসলেন উনি। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি, আহা কী সুন্দর পরিবেশ, এর জন্যইতো ছুটে ছুটে আসা এত দূর থেকে।


    আয়েস করে একটা সিগারেট ধরাতেই লাইটারের আগুনে চোখে পড়ল ওপাশের ঝুল বারান্দায় দুজন মহিলা।

    অদ্ভুত তো, ভিক্টর গোমস বলল এটা ভাঁড়া দেওয়া হয় না অনেকদিন। উনি মিথ্যে বললেন কেন! অবশ্য হতে পারে এদেরই কোন আত্মীয়স্বজন এসে বিনে পয়সায় থাকছে।থাকুকগে, চীৎকার চ্যাঁচামেচি না হলেই হল। আর যে কারণে আসা সেটাই ভেস্তে গেল বেশি লোকজনের জন্য ,সেজন্যে খারাপ লাগছে! কীই বা করা!


    কিছুক্ষণ পর বেশ ঠাণ্ডা লাগা শুরু হল, সঙ্গে হাওয়া।আর বাইরে বসা যাচ্ছে না,দরজা বন্ধ করে ভেতরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন, লেপ টাকে গলা ওবদি টেনে। শুধু হাত বের করে সুনীল গাঙ্গুলির' পায়ের তলায় সর্ষে' র ৭৮ পাতা খুলে পড়া শুরু করলেন, পেজ মার্ক টা পাশে রেখে। লাইট অফ করে বিছানার পাশের নাইট ল্যাম্প টা জ্বলছে, হাল্কা কমলা আলো। বই পড়তে পড়তে ধীরে ধীরে ঘুম চলে এল একসময়।


    রাত্রি গভীর তখন, দুটো আড়াইটে হবে, পাশের ঘর থেকে খট খট আওয়াজ হওয়া শুরু হল, আস্তে আস্তে কথা, ফিসফিস, আবার কোনসময় গলার আওয়াজ জোরে, সেই দুজন মহিলারই কথা মনে হচ্ছে। কী জ্বালা রাত বিরাতে, শান্তিতে ঘুমোবে তাও উপায় নেই, মাঝরাতে চীৎকার চ্যাঁচামেচি। যত তিনি ভাবছেন এই বুঝি থেমে যাবে ওরা কিন্তু বেড়েই চলছে কথা, বেশ ঝগড়া হচ্ছে মনে হচ্ছে। ধুর!


    মহিলাদের মধ্যে গিয়ে ঝগড়া থামাতে ভাল লাগে? তাও আবার অচেনা!

    লেপের থেকে কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, কিন্তু তবুও কষ্ট করে উঠে বারান্দায় যাওয়ার দরজা খুললেন উনি।


    খুব ঠান্ডায় যেন জমে আছে চারিদিক, হুহু করে হাওয়া ঢুকছে ঘরে। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ওদিকে তাকালেন। দেখলেন ঠিকই, একজন লং স্কার্ট বা ওই  জাতীয় কিছু পরা এক মহিলা বাইরে ছিল, ভেতরে ঢুকে গেল, এক মিনিট পরই বিকট চীৎকার, আর্তনাদ হল, আর সব থেমে গেল। কর্কশ গলায় একটা হাসি হাসল কেউ।


    কিছুক্ষন আর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে এসে শুয়ে পড়লেন মিহিরবাবু। ঘুমও চলে এল আরামে। ঘুম ভাঙল কপালে গরম হাওয়ায়, মনে হচ্ছে মাথায় কেউ গরম বাতাস করছে। এদিকে এত ঠান্ডা, কিন্তু এমন কোত্থেকে সম্ভব, উঠে গেলেন উনি, নাইট ল্যাম্পের আলো শুধু ঘরে, এখনো মাথায় গরম ভাব।


    এদিক ওদিক তাকালেন,দেখলেন টেবিলের ওপর হেয়ার ড্রায়ার টা রাখা। অবাক হলেন একটু,এখানে এটা আবার কে রাখল! অবশ্য হতে পারে অতুল এনে রেখেছে কোন কারণে।


    বেশ ডিস্টার্ব হচ্ছে ঘুমের, প্রায় বরফ হয়ে থাকা জলের বোতল থেকে অল্প জল খেলেন। ওপাশে ঘুরে শুলেন এবার। কিছুক্ষন যেতে না যেতেই আবার একটা হাল্কা মেশিনের আওয়াজ শুরু হল, মনে হচ্ছে সামনেই কোথাও। নাহ এবার উঠে ওই মহিলাদের ধমক দিয়েই আসতে হবে, কষ্ট করে উঠে দরজা খুললেন।


    বেরিয়ে কিছুক্ষন দেখলেন, কিন্তু সব চুপ দেখে ঘরে ফিরে এলেন। দরজা বন্ধ করে বিছানার কাছে এলেন, চোখ পড়ল বিরাট আয়নায়। উহ! কী ভয়ানক দৃশ্য! এটাই বোধহয় মিহিরবাবুর জীবনের শেষ রাত, আর সূর্যোদয় দেখা হবেনা কোনদিন! ভয় কাকে বলে তা আর বলে বোঝাতে হবে না তাকে, গায়ের প্রতি টা লোম খাড়া হয়ে আছে।


    তিনি আয়নায় নিজেকে দেখছেন না, অর্থাৎ আয়নায় যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি ফটোর সুন্দরী মহিলা, মিস শবরী বোস!! তিনি নিজে আয়নার কোথাও নেই! ডান হাত টা আপনা থেকেই চুলের কাছে চলে যাচ্ছে তার , হাতে একটা হেয়ার ড্রায়ার! তার  নিজের কোন কন্ট্রোল ই নেই শরীরের! এসব কী হচ্ছে!  চীৎকার করতে গেলেন, গলা দিয়ে তার নয়, একজন মহিলার আওয়াজ বের হল! উফ! আর দেখতে পারছেন না কিচ্ছু!


    হঠাৎ জোরে শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল, দ্রুত গতিতে ভেতরে ঢুকল আরেক জন বিদেশি মহিলা, আরে ইনিতো মিসেস মর্গ্যান!! ১৯৩৬ সাল মিহিরবাবুর সামনে উপস্থিত! কীভাবে, কেন আর বুঝতে বাকি রইল না তার! নিমেষের মধ্যে মিসেস মর্গ্যান তার হাতে ধরে থাকা পিস্তল থেকে পর পর তিন টে গুলি তে খতম করে দিল মিস শবরীকে,  লুটিয়ে পড়ল মিহিরবাবু।


    হাতে ধরে থাকা ড্রায়ারটিও সশব্দে চলে যাচ্ছে তখনও।

    বিছানায় নিজেকে হাতরাচ্ছেন তিনি, আবার আসল রূপে ফিরে গেছেন, মিস শবরী কোথাও নেই, গুলিও নেই বুকে! তাকিয়ে দেখলেন মিসেস মর্গ্যানের ভূতও কোথাও নেই, তবেকি উনি ভুল দেখলেন!!


    উনাকে আমি রিপিটেডলি মানা করেছিলাম  বাট উনি শোনেন নি, হি ওয়াজ রিজিড।

    চুপ করে বসে আছেন পিনাকি চ্যাটার্জি। এবার মুখ খুললেন।

    আমি ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে যাই কেমন কাটল ওনার গতকাল রাতে, স্কুল তো আজ হাফ ডে, তাই। কি হতে পারে বলতে পারেন?


    ইয়েস, আই নো হোয়াট হ্যাপেনড টু হিম।

    উনি নিশ্চই কিছু দেখেছেন। শোনা যায় মিস শবরী ছিলেন মিসেস মর্গ্যানের হেয়ার ড্রেসার ।দেয়ার ওয়াজ আ ভেরি গুড ফ্রেন্ডশিপ বিটউইন দিজ লেডিস।


    বাট ফাইনালি যা হয়, মিঃ মর্গ্যান প্রেমে পড়লেন বিউটিফুল শবরীর, ওর জন্য আলাদা বাড়ি বানিয়ে দিলেন তার বাড়ির পেছনে। সেখানে যেতে শুরু করলেন দিন রাত। ব্যাস! মিসেস মর্গ্যানের কানে এল সব আর একদিন রাগের মাথায় এই বাড়িতে গুলি তে ঝাঁঝড়া করে দিলেন শবরীকে।


    আর তারপর থেকে এভরি ১৩থ জুলাই এই ঘটনা রিপিট হয় এই গেস্ট হাউজে, আনফরচুনেটলি ইয়েসটারডে ওয়াজ ১৩থ জুলাই। আমি দেরি হচ্ছে বলে খোঁজ নিতে এসে দেখি এই কান্ড!


    বিছানায় শুয়ে রয়েছেন মিহিরবাবু। চোখ গুলো যেন বের হয়ে এসেছে, খুব ভয় পেলে যেমন হয় সেরকম। সব বুঝতে পারছেন শুনতে পারছেন , কিন্তু কথা বলার ক্ষমতা নেই তার, জিভ অসাড়। মুখ বেকে গিয়েছে


    গলার মধ্যে আঙ্গুলের দাগ স্পষ্ট, ছ'টা!!










    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!