• 28 March 2020

    সত্যি গল্প মিথ্যে গল্প

    দুঃখের ভাগীদার

    0 44

    দু:খের ভাগিদার

     


    আমার বাড়িতে তখন আত্মীয়স্বজনে গমগম করছে,দিদির বিয়ে আগামী বুধবার। চারিদিকে সাজোসাজো রব। মাসি মেসো,মামা মামি, সকলে মিলে মজা, হাসি আনন্দে চার পাঁচ টা দিন হৈ হৈ করতে করতে কাটছে।


    নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে টাকার প্রাচুর্য ছিল না , বাবা সামান্য মাইনের চাকরি করত প্রাইভেট ফার্মে, মা গৃহবধু। তবে মাকে আমরা কখনো সুস্থ দেখিনি, বাতের রোগে মা  পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল, চলাফেরা সীমিত ছিল, কারো সাহায্য ছাড়া বাথরুমেও যেতে পারত না। তবুও মা রান্নাঘরে টুলে বসে রান্না করত, যতক্ষণ পারত করত, তার পর লীলা মাসি জোর করে মায়ের হাত থেকে খুন্তি কেড়ে নিয়ে নিত।


    লীলামাসি আমাদের বাড়িতে কাজ করত, মা অসুস্থ হবার পরপরই বাড়িতে কাজে ঢোকে।আমাদের দুবোনের জীবনের অনেকটা সময় ধরে আমরা তাকে দেখছি, মায়ের যত্ন থেকে শুরু করে ঘরের সব কাজ সামলাতে অত্যন্ত পারদর্শী মহিলা।


    লীলামাসির একটাই মেয়ে ছিল, আমাদের থেকে একটু ছোটই হবে। নিজের সংসারের পুরো দায়িত্ব টাই ছিল ওর ঘাড়ে, স্বামী কোন কাজ করত না, বসে বসে থাকত, আর লীলামাসির থেকে টাকা নিয়ে লটারির টিকিট কাটত। না দিতে চাইলে মারধোরও করত। তাও স্বামীকে ছেড়ে যায়নি কোনদিন, মুখ বুজে পড়ে থাকত।


    খুব বেশি মায়না দেওয়ার সামর্থ্য বাবার ছিল না লীলামাসিকে, তবুও অনেকদিন থাকার জন্য নিজের মত হয়ে গেছিল বলে রয়ে গেছিল। আরো তিন বাড়ি কাজ করত ফাঁকেফাঁকে, সংসার তো চালাতে হবে তাকে!


    দিদির সঙ্গে যার বিয়ে ঠিক হয়েছে, সে প্রাইমারী স্কুল টিচার। মধ্যমগ্রামে বাড়ি। একটাই ছেলে বাবা মায়ের। বিয়েতে কিছু চায়নি আলাদা করে কিন্তু কিছু দিলে খুশিই হবে এরকম একটা ব্যাপার ছিল। বাবা যেহেতু স্বল্প বেতনের চাকরি করত তাই খুব বেশি সঞ্চয় কখনোই ছিল না। যা ছিল মায়ের চিকিৎসা তেই চলে যেত, কিচ্ছু জমতয না। দিদির জন্য সামান্য যা যা দরকার তা কিনে দিয়েছিল বাবা, বেশিটাই মায়ের পুরোন কিছু গয়না গাটি ভেঙে।


    মা বলত, এসব তো মেয়েদের জন্যেই। তবে যা ছিল সবটুকুই দিদির বিয়েতে চলে গেল, আমি তখন অনেক ছোট , মা বল্লল পরের টা ঠিক যোগাড় হয়ে যাবে। গয়না গাটির মধ্যে একটা সরু নেকলেশ, একজোড়া ছোট্ট ঝুমকো, দুহাতের দুগাছা ব্রঞ্জের চুড়ি সোনার পালিশ দেওয়া, আর একটা আংটি, ব্যাস দিদির এটুকুই, সঙ্গে জামাইবাবুর সোনার চেন, আংটি,খাট ড্রেসিংটেবিল, আলমারি আর একটা ইনভার্টার।


    আজকাল নাকি মধ্যমগ্রামে ভারি লোডশেডিং হয়, আর প্রচণ্ড গরমে খুব কষ্ট হয় ওদিকের লোকের, তাই অগত্যা এটাও জুড়ল সঙ্গে।

    তখন ছোট ছিলাম তাই সব বুঝতে পারতাম না, কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম যে বাবা অনেক সহ্য করে শারীরিক ধকল কে গুরুত্ব না দিয়ে, অফিসে বেশি সময় কাজ করে এসব করেছিল, নয়ত সম্ভব ছিল না।


    আমাকে কেউ কিছু বুঝতে দিত না , দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে থাকত, কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত না কখনো।

    বিয়ের দিন সকালে একটা অঘটন ঘটল হঠাৎ। দিদির বানান গয়না গুলো আগে বাড়িতে আনা  হয়নি, দোকানেই রাখা ছিল আলাদা করে।


    সেদিন বাবা ওগুলো আনতে যায়, সব কিছু দেখেশুনে ঠিকঠাক ভাবেই ব্যাগে ভরেছিল ,ট্যাক্সিতে উঠতে গিয়ে কোনভাবে  কানের ঝুমকোদুটি ব্যাগ থেকে কোথাও পড়ে যায়। বাড়িতে এসে দেখে মাথায় হাত পড়ে সকলের, বাবা আবার ছুটে যায়  সোনার দোকানে, কিন্তু ওরা বলে বাবা ফেলে যায়নি দুল দুটো, আর প্রমান স্বরুপ সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ডিং দেখিয়ে দেয়।


    বাবা নিরাশ হয়ে যখন  বাড়ি ফেরে তখন  দরদর করে ঘামছে। চেয়ারে বসিয়ে জল দেওয়া হল, ফ্যান চালিয়ে দেওয়া হল জোরে । শুধু একটা কথাই বলে চলছে বাবা,' আমি কারো কোন ক্ষতি করিনি, কেন আমার সঙ্গে এমন হল, বল তো মামনির মা? '

    বাড়িতে সকলে চুপচাপ, বিয়েবাড়িটা হঠাৎ কেমন নির্জীব হয়ে পড়ল। আমরা জানতাম বাবার পক্ষে আর টাকা যোগাড় করে নতুন দুল কেনা সম্ভব নয়, সব কিছুর জন্য আলাদা টাকা হিসেব করা, একটা অতিরিক্ত টাকা বাবার কাছে নেই।


    অদ্ভুত ভাবে বাকি আত্মীয়স্বজনেরাও চুপ হয়ে গেল, কেউ এগিয়ে এলনা। সুখের পায়রার মত তারা আনন্দের ভাগিদার হতেই চাইছিল যেন, আমাদের দু:খে আর প্রয়োজনে তাদের পেলাম না, আর বাবার এমন আত্মসন্মানবোধ যে কারো কাছে হাত ও পাতবে না, সে দরকার হলে শূন্য কানে মেয়ের বিয়ে হবে তাও ভাল।


    থমথমে পরিবেশে বাড়িটা হঠাৎ কেমন যেন পাল্টে গেল, মা অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, জলে ভিজে আছে দুচোখ। দিদি বলছে ওর কোন দুলের দরকার নেই, কোন ইমিটেশন পরে নেবে, এইযে বাবা মায়ের দেওয়া জিনিস তা ই অনেক কষ্টের রোজগার, ওর আর কিচ্ছু চাই না।


    সময় এগিয়ে আসে, দিদিকে সাজানোর তোড়জোড় শুরু হয়, গয়না যা ছিল পরান হয়, আয়নায় দিদি নিজেকে দেখে আস্তে করে কানে হাত দেয়। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে লীলামাসি, হাতে একটা প্যাকেট। ধীরে ধীরে এসে দিদির সামনে দাঁড়ায়।


    কি হল লীলামাসি, কিছু বলবে?

    প্যাকেট টা খুলে একটা ছোট্ট বাক্স বের করে সে। আর বাক্সটা খুলে একটা ছোট্ট সুন্দর ঝুমকো হাতে নেয়।


    দাওতো দেখি কান টা এগিয়ে, পরায়ে দেই!

    দিদি লীলামাসির হাত চেপে ধরে, এটা কি করেছ মাসি! তুমি সোনার কানের দুল কোথা থেকে আনলে? সত্যি বল তো, বাবা কি দুলটা পেয়েছে? উত্তেজনায় ছটফট করতে থাকি আমরা, আমি দিদি আর পিসি।


    আরে মেয়ে তুমি তো আমার মেয়েই, মেয়ের বিয়াতে এইটুক দিব না আমি? পারুলের বাপ লটারিতে কিছু টাকা পেয়েছিল, তা থেকে আমি সরিয়ে ফেলছি আগেই, তোমার জন্যে!


    হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দিদি, আর পিসি, আমিও। আর লীলামাসি দিদির কানে পরিয়ে দেয় দুল দুটো। অসম্পূর্ণ সাজ পূর্ণ হয় আমার দিদির, ওর চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে  গলায়,চিবুকে , আর লাল বেনারসিতেও!


    লীলামাসির পা ছুঁতে যায় ও, আর মাসি ওকে আদর করে জড়িয়ে নেয় বুকে! দুজনের সুখের কান্নায় চোখ ভিজে যায় আমারও।।


    himimitra@gmail.com





    Himi Mitra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!