মিথ্যে
পলাশ মজুমদার
সন্ধ্যায় ছোটমামা এলেন। হাজার পাঁচেক টাকার প্রয়োজন। বাবাকে ফোন করে আগেই জানিয়েছিলেন। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর বাবা, মামার হাতে পাঁচ হাজার টাকা তুলে দিলেন। একশো টাকার বান্ডিল। মামা বাড়ি পুরুলিয়া। সকালেই মামা বেরিয়ে যাবে। খড়গপুর ষ্টেশন থেকে সাড়ে দশটায় ট্রেন।
কান্ডটা ঘটলো সকাল বেলা। মামা টিফিন খেয়ে রেডি। ন 'টা বাজে, বেরোবে। কিন্তু টাকার বান্ডিল উধাও! মামা একটু বেখেয়ালী ধরনের। টাকাটা টেবিলের উপর রেখেছিলেন। মামা এলে আমার রুমেই থাকেন। কোথাও টাকার দেখা নেই। শেষমেশ আমাকেও জেরা করা হলো। জেরা করে সবাই বুঝতে পারলো,আমি নেইনি। বড়রা চোখ দেখে, হাবেভাবে ছোটদের মনের কথা পেড়ে ফেলতে পারেন। যতবার অন্যায় করেছি, মায়ের চোখে প্রতিবার ঠিক ধরা পড়ে গ্যাছি। তাছাড়া অতটুকু বয়সে এ্যাত টাকা হাতে নেয়ার দুঃসাহস আমার ছিলো না।
আমাকে নিয়ে ঘরে সর্বসাকুল্যে চারটে প্রানী। তাহলে গেলো কোথায় টাকা! তন্নতন্ন করে খুঁজে আশা ছেড়ে দিলো সবাই। অগত্যা মা আলমারি থেকে আরও পাঁচ হাজার টাকা বের করে মামাকে দিলেন। মামা সাড়ে দশটার ট্রেন ধরতে বেরিয়ে পড়লেন।
শীতু মাসী আমাদের বাড়ি কাজ করে। ভালো নাম শীতলা। সকাল ছ 'টা নাগাদ কাজে আসে। আটটায় বেরিয়ে যায়। ঘর মোছা , থালা - বাসন ধোয়া, কোনো দিন টুকিটাকি কাচাকুচি - এই তার কাজ। দশ বছর ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। খুব বিশ্বাসী। তবু টাকার কিনারা না হওয়ায় সকলের সন্দেহের তীর মাসীর দিকে। সিদ্ধান্ত হলো, মাসী পরদিন কাজে এলে সহানুভূতির সাথেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। গরীব মানুষ। হয়তো অভাবের তাড়নায় লোভ সামলাতে পারেনি। অভাবে অনেক সময় স্বভাব দিকভ্রষ্ট হয়।
কিন্তু পরদিন মাসী কাজে এলেন না। সকলের সন্দেহ গাঢ়তর হচ্ছে। সবাই একপ্রকার নিশ্চিত। তারও পরদিন কাজে এলেন মাসী। প্রথমে মা, তারপর বাবা। সবাই মিলে নানাভাবে নানা প্রলোভন দেখিয়ে সত্যটা জানার চেষ্টা করা হলো। কিন্তু মাসী কিছুতেই স্বীকার করলেন না। মাসী কাঁদো কাঁদো। সবাই বিরক্ত। বাবা শেষমেশ বলতে বাধ্য হলেন - ' সত্যি কথা বল্, সত্যি বললে মাফ করে দেবো, নয়তো কাল থেকে আর কাজে আসবি না, পুলিশেও দিতে পারি , তখন সব সত্যি বেরিয়ে আসবে।'
মাসী এবার নিরুপায়। সত্যটা স্বীকার করলেন - ' হ্যাঁ, বাবু আমি নিয়েছি '
মা বললেন - ' এ্যাতগুলো টাকা দিয়ে কি করেছিস? '
মাসী একটু চিন্তিত হয়ে ভয়ার্ত গলায় বললেন - ' একটা ছাগল কিনলাম। '
বাবা রাগত সুরে বললেন -' এ্যাত দিনের বিশ্বাস ভেঙে দিলি! তোর টাকা দরকার, আমাকে বলতে পারলি না! আর কক্ষনো এই ভুল করলে ক্ষমা করবো না, মনে থাকে যেন '
অপরাধী চিহ্নিত হলো। মাসী নিয়মিত কাজে আসেন। তবে মাসীর চলাফেরা, হাবভাব এখন একটু বেশিই নজরে রাখেন মা।
ঘটনার মাসখানেক পরে। কি একটা প্রয়োজনে ভাড়ার ঘর খুলতে হলো। আপত অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অনেক সময় প্রয়োজনে লাগে। কখনোবা প্রয়োজনের থেকেও বেশি। একটা জায়গায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই মা অবাক। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আধখাওয়া সাবান, বিস্কুট, প্লাস্টিকের কৌটো, চামচ, আরও টুকিটাকি জিনিসপত্র। অনেক দিন থেকেই এইসব উধাও হচ্ছিল। টাকা চুরির ঘটনার পর মা নিশ্চিত হয়েছিল ,ওগুলো তাহলে শীতুর কাজ। মায়ের ভুল ভাঙলো। পুরনো খেলনা সাইকেলের পাশে ওটা কি? টাকার বান্ডিল! হ্যাঁ, এ তো সেই টাকা ! দুই তৃতীয়াংশ ইঁদুরে খেয়েছে। বেশ কায়দা করে। বড় শিল্পীর কাজ! ইঁদুরের উৎপাত বেড়েছে খুব। ইতিউতি দু চারটে বড় সাইজের ইঁদুর লুকোচুরি খেলছে।
রাতে বাবাকে সব বললেন মা। কিন্তু একটা খটকা রয়েই গেলো। সকালে যথারীতি মাসী কাজে আসতেই পাকড়াও করলেন মা -
' বল্ তো শীতু, টাকা কি তুই সত্যি নিয়েছিলি? '
- হা দিদি, নিয়েছি।
' না, তুই নিস্ নি। সেদিন কেনো মিথ্যে বলেছিলি, সত্যি করে বল্। নয়তো কাল থেকে কাজে আসা বন্ধ। '
মাথা নীচু, আমতা আমতা করে মাসী বললেন - ' আমি টাকা নেইনি, দিদি। সেদিন মিথ্যে না বললে আমায় যে তাড়িয়ে .......'
আর কিছু বলতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পরে শীতু মাসী।
সেদিনের একটি মিথ্যে ,মস্ত বড় এক সত্যের জন্ম দিয়ে গেলো।
---------------© পলাশ মজুমদার