• 24 June 2020

    দূরের শিক্ষা(অন্তিম পর্ব)

    Durer sikkha (last part)

    4 222

    #দূরের_শিক্ষা

    #রাখী_চক্রবর্ত্তী

    #অন্তিম_পর্ব

    (৩)


    “হ্যালো মিসেস সিনহা? নমস্কার। আমি আপনার ছেলের ক্লাসটিচার শিপ্রা বসু বলছি। ম্যাম কিছু যদি মনে না করেন একটা কথা বলি, অনুরাগের ফিসটা বাকি আছে। যদি পে করে দিতেন ভালো হতো”।

    “জানি ম্যাম। কিকরে দেব বলুন তো? অনুরাগের বাবা একজন রোজগার করে। আমার মেয়ে এবার ক্লাস টুয়েলভ। ওরটা তো দিতেই হয়েছে। ফলে অনুরাগেরটা আটকে গেছে। যেহেতু ও ক্লাস 8 তাই…. ম্যাম বুঝতেই পারছেন, ব্যবসা বাণিজ্য দুই মাস বন্ধ। এই সময় যদি স্কুল পাশে না দাঁড়ায়!”

    ফোন রেখে দেয় শিপ্রা। এই একই বক্তব্য তো ওর ও। অনুরাগের মা আর শিপ্রা বসু দুজনেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে। শিপ্রা নিজেকে দিয়েই বোঝে অনুরাগের মায়ের অসহায়তা। অথচ ও নিজেও অসহায়। এই কাজটা করতে খারাপ লাগলেও ওকে করতে হচ্ছে। ওর নিজের ছেলে মেয়ের মাইনেও যে আটকে… অগত্যা শিপ্রা চলে যায় পরের ফোনে।

    “হ্যালো মিস্টার ঝুনঝুনওয়ালা? আমি আপনার মেয়ে পিয়ার ক্লাসটিচার। স্যার ওর ফিসটা বাকি। একটু যদি পে করে দেন…”

    “কিকরে ফিস চান আপনারা? স্কুল কি খোলা আছে যে আমরা টাকা দেব? কোন সার্ভিসটা দিচ্ছেন?”

    “কেন স্যার? আমরা তো অনলাইন এডুকেশন করাচ্ছি। পিয়ার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”

    “ওটা পড়ানো? আর তার জন্য তিনমাসের জন্য চল্লিশহাজার টাকার বিল পাঠিয়েছেন? আধ ঘন্টা করে তিনটে সেশন। ওতে পড়া হয়? সব তো আমাদের বাড়িতেই করাতে হচ্ছে। আর অনলাইন মিটিংয়ের কথা তো বাদই দিলাম। এখন লকডাউন তাই বাড়িতে বসে মেয়ের স্কুলের টিচারদের দেখতে পাচ্ছি। ওটা পড়ানোর স্টাইল? ওতে ছেলেমেয়ে বুঝবে? সবকিছু আমাকে আলাদা করে টিউটর রেখে বোঝাতে হচ্ছে। আর স্যার ম্যামদের প্রোনাউনসিয়েশন? বাপরে। এত ভুল এত ভুল যে কী বলবো”।

    মাথাটা দপ করে গরম হয়ে যায় শিপ্রার। কিন্তু ম্যানেজমেন্টের বারণ আছে। মাথা গরম করা যাবে না। পিয়া মেয়েটি ভীষণই অমনোযোগী। আগের ক্লাসেও ওর বিরুদ্ধে অনেক কমপ্লেন ছিলো। গলাটা বরফের মত ঠান্ডা করে শিপ্রা বলে,

    “স্যার আপনার কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা প্রপার চ্যানেলে করুন প্লিজ। আপনি মেল করতে পারেন প্রিন্সিপ্যালকে। আমার ডিউটি ছিলো আপনাকে রিমাইন্ড করানো যে ওর ফিস পেড হয়নি। আমি করে দিলাম”।

    “ওসব ভুলে যান। লকডাউন যতদিন চলছে, আমি একপয়সাও দেব না”।

    আবার ফোন রেখে দেয় শিপ্রা। শিপ্রা জানে পিয়ার বাবা ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসম্যান। লকডাউনের জন্য এফেক্ট পড়লেও সেটা মারাত্মক কিছু নয়। মার্সেডিজ করে স্কুল আসে পিয়া। অথচ তার ও ফিস বাকি। আসলে বর্তমানে অভিভাবকরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। অধিকাংশ সত্যিই আর্থিক মন্দার স্বীকার। বাকি কিছুজন মন্দার স্বীকার না হলেও তারা এই পরিস্থিতি পুরো মাত্রায় ব্যবহার করছে। একটু জল খেলো শিপ্রা। ওর ক্লাস এইট বি। ওর সেকশনে চল্লিশ জন স্টুডেন্টসদের মধ্যে কুড়ি জন পে করেছে। মানে পঞ্চাশ শতাংশ। অবশ্য ওকে ফোনে আরো পাঁচজনের গার্জেন বলেছে তারা চেষ্টা করছে। এই মাসের শেষে হয়ত দিয়ে দেবে। তাদের কে ধরে নিলেও পঁচিশ। মোটামুটি ৬০%। আর তো কেউ দেবে বলে মনে হচ্ছে না।


    লকডাউনে কিছু করার ও নেই। ভাই বোন দুজনেই খুনসুটিতে মত্ত। অনিকেত চা নিয়ে বারান্দায়। এই আবাসনে ফ্ল্যাটটা অনিকেতই পছন্দ করে কিনেছিলো। সারা জীবন নাগেরবাজারের ঘুপচি পৈত্রিক বাড়িতে থেকে থেকে বোধহয় শখ ছিলো একটা খোলা কমপ্লেক্সে থাকার। বছর দুয়েক আগে যখন প্রায় ষাট লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটটা নিয়েছিলো অনিকেত, তখনই শিপ্রা বারণ করেছিলো। এত টাকার ই এম আইয়ের চাপ… নাঃ শোনানো যায় নি অনিকেতকে। আজকাল মানুষটা বড্ড বিমর্ষ থাকে। বোঝে শিপ্রা। রোজগেরে মানুষ, হঠাৎ যদি সব বন্ধ হয়ে যায় ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ পড়ে। ধীরে ধীরে অনিকেতের কাছে এসে ওর পিঠে হাত রাখে শিপ্রা।

    “কী ভাবছো অনি?”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে অনিকেত, “ভাবছি এভাবে আর কতদিন চলবে শিপ্রা। রোগের আতঙ্ক আছে মানছি। কিন্তু এভাবে তো আমরা সবাই এমনিই মরে যাবো। তোমার স্কুল কত টাকা তোমায় পে করবে তার ঠিক নেই। আমার ফার্নিচারের দোকান এখন খুললেও বিক্রির আশাই নেই। তাহলে? উপায় কী?”

    মাথা নামিয়ে নেয় শিপ্রাও। এর উত্তর যে ওর কাছেও নেই।

    “শিপ্রা ভাবছি আমি নিজেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঠের কাজ শুরু করবো”।

    অনিকেতের হাতের কাজ খুব ভালো ছিলো। কাঠের ওপর এমন সুন্দর ডিজাইন করতে পারতো, যে তাকিয়ে দেখতে হতো। প্রথম জীবনে ওটাই করতো ও। পরে আসতে আসতে চাহিদা বেড়েছে। ওর ও দোকান বড় হয়েছে। একটা ছেড়ে দুটো শো রুম। এখন অনেক জায়গায় মাল সাপ্লাই দেয়। নিজে বহু বছর আর কাজ করে না। এখন আবার নতুন করে….

    শিপ্রার মনের কথাটা বুঝি পড়তে পারলো অনিকেত। বললো,

    “উপায় কী শিপ্রা? কিছু তো রোজগার হবে। আমি অনলাইনে এড দিয়ে দেব। বাড়ি গিয়ে ফার্নিচার সারাই বা তৈরি করে দিয়ে আসি”।

    “উপায় নেই আমি জানি অনি। কিন্তু এই কাজটা যখন করতে তখন তোমার বয়স ছিলো বাইশ কি তেইশ। এত বছর পর আবার পারবে? সময়টা কিন্তু কম না। কুড়ি বছর হবে এই কাজ তুমি নিজে হাতে করো না”।

    “হ্যাঁ নিজে হাতে করি না। কিন্তু করাই তো। হ্যাঁ পরিশ্রমের কাজ তো বটেই। সঙ্গে বিশুকে নিয়ে নেব। কী আর করবো বলো। দেখো এখন আমার এত বড় শো রুম খুলেও লাভ নেই। কেউ কিনবে না। যাক তোমার ওদিকে কী হলো? বললে যে জোজো আর তিন্নীর স্কুলে তোমারা পেরেন্টসরা কথা বলছো?”

    “বলেছি তো। পেরেন্টসরা মেল করেছি। শিক্ষামন্ত্রী কে চিঠি করেছি। উনিও অর্ডার করেছেন। কিন্তু তবু তো বিল এমাউন্ট কেউ কমাচ্ছে না অনি। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে, আর একটা শ্রেনি এই পরিস্থিতিতেও শোষণ করেই চলেছে। তুমি দেখো পরিশ্রম কিন্তু আমরা করছি। মুনাফা লুটছে ম্যানেজমেন্ট। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সবাই। ডাক্তার নার্সরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে এই আপদকালীন অবস্থায়। অথচ নার্স বা হেলথ স্টাফরা পর্যাপ্ত পেমেন্ট পাচ্ছে না। অতিরিক্ত রুগীদের বিলের মুনাফা পুরোটাই নার্সিংহোমের মালিকের পকেটে। এখানেও দেখো, একবার অনেক টাকা খরচ করে একটা স্কুল খুলেছে। ব্যস। চোদ্দ পুরুষ এমনিই বসে বসে রোজগার করে যাচ্ছে। অথচ তাদের কানাকড়ি পরিশ্রম ও নেই। আর যারা আমরা পরিশ্রম করছি, তাদের বলা হচ্ছে পেমেন্ট আদায় করো। নাহলে তোমার ও পে কাট হবে। কেমিস্ট্রি তে মাস্টার্স করেছি কি বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি ফোন করে টাকা আদায় করার জন্য অনি? কাজটা করতে এত সম্মানে লাগছে, লজ্জায় মাথাটা মিশে যাচ্ছে। শুধু করছি ছেলে মেয়ে দুটোর মুখের দিকে চেয়ে। এই এত বড় বড় ইন্সটিটিউশন কি পারতো না অনি একটা বছরের জন্য মুনাফা একটু কম করতে? একটা বছর যদি তিন বা চার মাসের টাকা বাচ্চাদের মুকুব করে দিতো, খুব কি ক্ষতি হতো এদের? এত কোটি কোটি টাকা লাভ করে প্রতি বছর, তুমি আমায় বিশ্বাস করতে বলো, একটা বছর কয়েক মাসের জন্য ওরা স্টাফদের এমনি মাইনে দিতে পারে না?”

    “পারবে না কেন শিপ্রা। সব পারে। এত বড় বড় ইন্সটিটিউশন একটা বছর স্টাফদের ভার বহন করতে পারে না মুনাফা ছাড়া এটা কোনো কথা হলো? পারে। সব পারে। কিন্তু করবে না। রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার লাইনটা পড়ো নি? এই জগতে হায় সেই বেশি চায়, যার আছে ভুরি ভুরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি”।

    (৪)

    ম্যানেজমেন্ট কে ওর ফাইনাল লিস্টটা জমা দিয়ে বসে পড়লো শিপ্রা। শেষ পর্যন্ত ওর ক্লাসে চল্লিশ জনের মধ্যে চব্বিশ জন টাকা পেমেন্ট করেছে।

    রান্নাঘরে হাতের কাজ গুলো সারতে সারতে এক্সপেক্টেড ফোন কলটাও এসে গেলো শিপ্রার। জানতো আসবেই। অদ্ভুত ব্যাপার, এতদিন যে ভয়টা করছিলো, আজ যেন আর করছে না। বেশ নির্ভয়েই ফোনটা ধরলো শিপ্রা।

    “হ্যাঁ বলুন ম্যাম”।

    “হেডমিসট্রেস বলছি শিপ্রা। তোমার রিপোর্ট দেখলাম । শিপ্রা এটা একদম আপ টু দ মার্ক পারফরমেন্স নয় কিন্তু। তুমি চল্লিশ জনের মধ্যে মাত্র চব্বিশ জনের ফিস কালেক্ট করতে পেরেছো। ম্যানেজমেন্ট কিন্তু মোটেই খুশি নয় তোমার পারফরমেন্সে শিপ্রা! তুমি কি আর একটু সময় নিতে চাও?”

    মনে মনে হাসে শিপ্রা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এই ম্যানেজমেন্টই গত বছর ওকে পুরস্কৃত করেছিলো ওর পড়ানোয় খুশি হয়ে। ওর স্টুডেন্টরা নাকি ওর পড়ানোয় দারুন খুশি। আর আজ ওর এপ্রাইজাল হচ্ছে শুধু মাত্র ওর অর্থ কালেকশনের দক্ষতার ভিত্তিতে।

    “না ম্যাম। আমার যতজন স্টুডেন্ট দেবার ছিলো, তারা দিয়ে দিয়েছে। বাকিরা আর দেবে না। সময় নিয়েও লাভ নেই। ওটাই আমার ফাইন্যাল রিপোর্ট”।

    “কিন্তু এতে তুমি ৫০% স্যালারি পাবে শিপ্রা”।

    “চল্লিশ জনের মধ্যে চব্বিশ জন দিলে তো ৬০% হয় ম্যাম। ৫০% কোন যুক্তিতে?” আর চুপ করে থাকে না শিপ্রা।

    “ওয়েল, ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন নিয়েছে ৮০% ফিস কালেক্ট করতে না পারলে ৫০% ই দেওয়া হবে এস পেনাল্টি”।

    “পেনাল্টি? পেনাল্টি কিসের ম্যাম? টাকা কালেক্ট করবার জন্য তো আমাকে রিক্রুট করা হয়নি। আমাকে সায়েন্স পড়ানোর জন্য রিক্রুট করা হয়েছে। আজ প্রায় ছয় বছর আছি এই প্রতিষ্ঠানে, কই কোনো বছর তো এই দায়িত্ব আমাদের থাকে না? আজ যখন গোটা পৃথিবী মারণ ভাইরাসের আতঙ্কে কাঁপছে, ঠিক তখনই এই ভারটা আমাদের ঘাড়ে ম্যানেজমেন্ট কেন ফেললেন বলুন তো? এই ফোন কল গুলো তো ওনারা নিজেরাও করতে পারতেন। তাহলে কেন করলেন না? আমি বলবো? কারণ ওনারা নিজেরাও জানেন হয়তো এবারে সবাই টাকা দেবে না বা দিতে পারবে না।।কিন্তু ওনাদের মুনাফার পার্সেন্টেজ তো ফিক্সড রাখতে হবে, তাই না? ওনারা কেন সাফার করবেন? অগত্যা যতটা মাইনে কেটে, কর্মী ছাঁটাই করে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব!”

    “দেখো শিপ্রা, আমি বুঝতে পারছি তোমার হয়ত খারাপ লাগছে, কিন্তু ভুলে যেও না আমি তোমার হেডমিসট্রেস। তুমি এই টোনে কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলতে পারো না”।

    “না ম্যাম। আসলে সত্যি কথা বলছি তো, তাই বোধহয় আপনার শুনতে খারাপ লাগছে। ম্যাম এই অনলাইন ক্লাস যদি আরও মাস তিনেক চলে আমি আপনাকে লিখে দিচ্ছি , আমাদের স্কুলের আয়াদিদিদের ম্যানেজমেন্ট রাখবে না। দেখে নেবেন। ওনারা ভাববেন যবে স্কুল খুলবে, তবে হায়ার করে নেওয়া যাবে। অথচ স্কুল মেন্টেনেন্স করবার জন্য পুরো টাকা তারা দাবি করছে। কেন ম্যাডাম?”

    আর কথা খুঁজে পান না হেডমিসট্রেস। শুধু বলেন,

    “শিপ্রা, তুমি হয়ত পারোনি , কিন্তু অনেকেই ১০০% টাকা তুলে দিয়েছে। বেশ আমি বলছি একাউন্টসকে তোমার দু মাসের ৫০% স্যালারি রিলিজ করে দিতে”।

    “ধন্যবাদ ম্যাম”।

    ফোন রেখে দেয় শিপ্রা। দু মাসের ৫০% মানে এক মাসের টাকা। যাক, আপাতত সেটা হলেও খানিকটা সুরাহা হয়।

    পুরো বাক্যালাপটা ঘরের ভিতর থেকে শুনে এগিয়ে এলো অনিকেত। শিপ্রার পিঠে হাত রেখে বললো,

    “এত জ্বলতে তো আগে দেখিনি শিপ্রা”।

    “আসলে মানুষের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রতিবাদ এসেই যায় অনিকেত। দূর থেকে হয়ত অসভ্যতা বা রাগের বহিঃপ্রকাশ মনে হয়”।

    “টাকা দেবে?”

    “একমাসের টাকা দেবে”।

    “ হুম। তাই দিক। আপাতত এক মাসের টাকা হলেও কিছুটা সুবিধা হয়। আচ্ছা শোনো জোজো আর তিন্নীর স্কুলের ম্যাম ভিডিও কলে পেরেন্টসদের সঙ্গে কথা বলবেন আজ।।ঠিক বেলা তিনটেয়”।

    আসুক।।মনে মনে বলে শিপ্রা। সবাই আজ সামনে আসুক। একটা এস্পার ওস্পার হয়ে যাক। এই চাপা টেনশন আর নেওয়া যাচ্ছে না। ঘড়ি দেখে শিপ্রা। বেলা আড়াইটে। আশ্চর্য্য কদিন আগেও যে কলের ভয়ে খেতে পারতো না, সে আজ দিব্যি ডাল ভাত ডিমভাজা খেয়ে বাসন গুলো বেসিনে ধুয়ে নিলো। অনিকেত অবাক হয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো,

    “শিপ্রা, ওদের স্কুলে আমরা টাকা দিতে পারিনি। আমি জানি কলটা সেই সংক্রান্তই। তোমার ভয় করছে না? এত মনের জোর পাচ্ছ কোথা থেকে?”

    স্মিত হাসে শিপ্রা। বলে,

    “আসলে ভয় পেতে পেতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। জানলার ওই পারের মানুষগুলোর দিকে তাকাও অনি। দেখো রেশন দোকানে যারা মারামারি করছে, তারাও জানে এই সময়ে সোশ্যাল ডিস্টান্স মেন্টেন না করলে ওরা যে কোনো মুহূর্তে মারণ ভাইরাসের কবলে পড়তে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে ওরা সেটা ভাবছে না। ভাবার অবস্থায় নেই। ওদের কাছে আপাতত ওদের হকের চাল, ডাল আদায় করে নেওয়াটা বেশি জরুরি। তারপর মারণ ভাইরাসের আতঙ্ক। ওরা জানে, পর্যাপ্ত পরিমাণ রেশন না পেলে ওরা না খেতে পেয়েই মরে যাবে। করোনা হবে কী হবে না ওরা ভাবার অবস্থায় নেই। আমার ও অবস্থা খানিকটা তাই। আমি জানি টাকা কাটবেই। সে আমি যাই করি না কেন! আবার জোজো তিন্নীর স্কুলেও পুরো টাকাই দিতে হবে,অথবা ছাড়িয়ে নিতে হবে। এই দুটো অপশন আমার জন্য খোলা। কেউ কোনো টাকা কমাবে না। সুতরাং আমার সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে”।

    “ছাড়িয়ে নিতে হবে মানে? তুমি কি তাই ভাবছো নাকি? না না শিপ্রা। আমি দেখছি।।দরকার হলে লোন…”

    “না। আর কোনো লোন নয়। যথেষ্ট লোনের ই এম আই আছে মাথার ওপর। আমাদের এই দুর্বলতাটাই সক্কলে কাজে লাগাচ্ছে”।

    “না তা বলে…”

    কথা শেষ হয় না স্বামী স্ত্রীর। অনলাইন কলের রিং টোন বেজে ওঠে।

    “হ্যালো মিস্টার এন্ড মিসেস বসু। আমি আপনার ছেলে জোজো এবং তিন্নীর হেডমিসট্রেস এবং উনি ওদের ক্লাসটিচার। নমস্কার। আচ্ছা আগে বলুন আপনারা কেমন আছেন? তিন্নী আর জোজো কেমন আছে?”

    প্রতি নমস্কার জানিয়ে হেসে ভালো বললো শিপ্রা। ও জানে এগুলোই ম্যানেজমেন্টের কথা বলার টেকনিক। সরাসরি কেউ প্রথমেই টাকা চায় না।

    “আচ্ছা ম্যাডাম, বলছি আপনার দুটো বাচ্চার ফিসই পেন্ডিং রয়েছে। আমরা অনেকবার রিমাইন্ডার দেওয়া সত্ত্বেও আপনারা তো কেউ…”

    “আসলে ম্যাম এখন আমাদেরও যথেষ্ট ফিনান্সিয়াল ক্রাইসিস চলছে। আমরা তাই পেরেন্টস ফোরাম থেকে আবেদন করেছিলাম, অন্তত ট্রান্সপোর্ট চার্জের কিছুটা আর সেশন চার্জটা ওয়েভ অফ করতে। এখন তো ট্রান্সপোর্ট লাগছে না ম্যাম। এইটুকু যদি করতেন, আমাদের অনেক উপকার হতো”।

    “ওয়েল, দেখুন স্কুল তো সারাবছর বন্ধ থাকবে না। স্কুল তো খুলবে। বাস তো আমাদের মেন্টেন করতে হচ্ছে ছুটির মধ্যেও। তা ছাড়া বাস ড্রাইভারদের মাইনেও আছে। আমরা সব্বাইকে ইকুইয়াল সিকিউরিটি দিয়ে থাকি। এই বিপদে আমরা প্রত্যেক স্টাফের পাশে”।

    মনে মনে হাসে শিপ্রা। কথাগুলো একদম ওর স্কুলের ম্যানেজমেন্টের লোকেদের মত শোনালো। রাজা আলাদা হলেও শোষণ করার পদ্ধতি বোধহয় সকলেরই সমান। কত যে সিকিউরিটি আর পেমেন্ট দিচ্ছে, সেটা ওই ওনার পাশে হাসি হাসি মুখে বসে থাকা ক্লাসটিচার আর বাস ড্রাইভারদের ফোন করলেই জানা যাবে।

    “হ্যাঁ ম্যাম সেটা জানি। কিন্তু পেট্রল কস্ট, ইলেক্ট্রিসিটি কস্ট, এইগুলো তো লাগছে না। এইগুলো তো আপনারা ওয়েভ অফ করতেই পারতেন , তাই না?”

    একটু কঠিন মুখে চুপ করে যান হেডমিসট্রেস। ওনার অভিব্যক্তিই শিপ্রার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়। আবার বলে শিপ্রা,

    “ম্যাম টু বি ফ্র্যাঙ্ক , দুটো বাচ্চার ফিস শো করছে প্রায় এক লাখ টাকা। এই মুহূর্তে আমার কাছে এত টাকা নেই। আগামী তিন মাসেও জোগাড় হবে কিনা বলতে পারছি না। সো, এবার আপনারা ভাবুন”।

    “বাট, ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন নিয়েছে ফিস না পে করলে নাম কেটে দেওয়া হবে”।

    আবার সেই ম্যানেজমেন্ট। এই ম্যানেজমেন্ট কথাটা আজ প্রায় একশো বার শুনেছে শিপ্রা। এরা এমনভাবে কথাটা উচ্চারণ করে, যেন মনে হয়, ম্যানেজমেন্ট কোনো অন্য গ্রহের জীব। কোনো মানুষ নয়। তবে আজ ভয়ঙ্কর কঠিন শিপ্রা। বলে,

    “আমার কিছু করার নেই ম্যাম। আমার কাছে এই মুহূর্তে টাকা নেই”।

    “আপনি কি একটু সময় নেবেন মিসেস বসু?” ক্লাসটিচার ম্যাম বলেন

    “সময় নিয়েও লাভ নেই ম্যাম। আমার হাজব্যান্ডের ব্যবসা এখন দু বছরে ঠিক হবে কিনা জানা নেই। আমার ফুল পেমেন্ট আমি কবে থেকে পাবো তাও জানা নেই”।

    “বাট, মিসেস বসু, জোজোর সামনের বছর বোর্ড!”

    হ্যাঁ। এটা ঠিক। হঠাৎই ওর নিজের ক্লাসের একটি গার্জেনের কথা মনে পড়ে শিপ্রার। ক্লাস টুয়েলভে পড়া মেয়েটির ফিস দিয়েছে, ছেলেটির নয়।

    “আচ্ছা ম্যাম, যদি আমি দুজনেরই হাফ টাকা পে করি আপাতত?” বলে শিপ্রা।

    “সরি ম্যাম।।আমাদের ইনস্টলমেন্টের কোনো ব্যবস্থা নেই”।

    “ইন দ্যাট কেস ম্যাম, আমরা জোজোর ফুল ফিস পে করে দিচ্ছি। তিন্নীর জন্য পারলাম না। সরি”।

    অনিকেতকে ক্যামেরার ওপাশ থেকে হাঁ হাঁ করে উঠতে দেখে শিপ্রা। কিন্তু শান্ত ভাবে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়।

    “ম্যাম, তিন্নীর নাম তো তাহলে…”

    “কেটে দিন। আপনাদের রুলস তাই বললে কেটে দিন। জোজোর টাকা আমি কাল পে করে দেব। নমস্কার”।

    ফোন রেখে দেয় শিপ্রা। অনিকেত ক্যামেরার ওপাশ থেকে এসে জড়িয়ে ধরে শিপ্রাকে। এতক্ষন শক্ত থাকা শিপ্রা এবার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে অনিকেতের বুকে।

    “এ তুমি কী করলে শিপ্রা? তিন্নীর নাম কাটিয়ে দিতে বললে? না না। আমাকে কটাদিন সময় দাও। আমি দেখি ক্রেডিট কার্ডে কোথাও পে হয় কিনা”।

    “তারপর? তারপর কী করবে? একমাস পর? কিকরে শোধ দেবে? অলরেডি এই কোয়ার্টারে দু মাস হয়ে গেছে। আর একমাস পরেই নেক্সট কোয়ার্টারের টাকা চাইবে। কিকরে দেবে? জোজোরটা পারতেই হবে। উপায় নেই। সামনে বোর্ড অনিকেত। ওকে এখন কোথাও শিফট করানোর মত অবস্থা নয়। কিন্তু তিন্নী সবে ক্লাস থ্রি। ওকে তো শিফট করানোই যেতে পারে”।

    “মানে তুমি, তিন্নীকে স্কুল… আমি ভাবতে পারছিনা শিপ্রা”। ভেঙে পড়ে অনিকেত।

    “প্রি করোনা এবং পোস্ট করোনা দুটো যুগ সম্পূর্ন আলাদা হবে অনিকেত। অনেক অনেক কিছু পরিবর্তন হবে, এবং সেটা আমাদের মানতেও হবে। হ্যাঁ আঘাত পাবো, সময় লাগবে, তবে মেনেও নিতে হবে। তিন্নীর ফিস দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু একটা স্কুল থেকে নাম কেটে দেওয়া মানে শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। এমনিতেও এই বছর স্কুল কিভাবে হবে জানিনা। দাঁড়াও, পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলে, তখন ভাববো। তখনও যদি তিন্নীর স্কুলে তিন্নীর নাম থাকে, আমরা এফোর্ড করতে পারি, তো টাকা জমা দেবো। আর যদি ওরা নাম সত্যিই কেটে দেয়, তখন আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী অন্য কোনো স্কুলে ভর্তি করতে হবে অনিকেত। এটা শুধু তিন্নীর ক্ষেত্রে নয়। জোজোর ক্ষেত্রেও। আমি ভেবে রেখেছি। বোর্ড হয়ে গেলে অত দামী স্কুলে জোজোকে আর ক্লাস ইলেভেনে ভর্তি করাবো না। বা বলা ভালো করাতে পারবো না। সব কিছু নতুন করে ভাবতে হবে অনিকেত। একদম নতুন করে। ভেবোনা সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি আছি তো। পে কাট হলে লাইফ স্টাইলেও কাট না আনতে পারলে আমরা ভেসে যাবো অনিকেত। এটা বোঝো”।

    একদম চুপ করে যায় অনিকেত। ওর সাধের ফ্ল্যাটটা দেখতে থাকে দু'চোখ ভরে! শেষ পর্যন্ত এটাও রক্ষা হবে তো? ভাই বোনে তখনও খুনসুটিতে মগ্ন। শিপ্রার বলে যাওয়া কথা গুলো ফ্ল্যাটে ঘুরতে থাকে ।।ঘুরতেই থাকে।।

    সমাপ্ত



    রাখী চক্রবর্তী


Your Rating
blank-star-rating
Sanjay Das - (08 July 2020) 4

1 1