#দূরের_শিক্ষা
#ছোটোগল্প
#প্রথম পর্ব
(১)
সকাল থেকে এক্কেবারে দম ফেলার ফুরসৎ নেই শিপ্রার। চারজনের সংসারে সব কাজ একা হাতে করতে হয়। লকডাউনের মধ্যে কমপ্লেক্সে ডোমেস্টিক হেল্প ঢোকা বারণ। এদিকে নিজের অনলাইন ক্লাস, ছেলে জোজোর অনলাইন ক্লাস, মেয়ে তিন্নীর অনলাইন ক্লাস , সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা শিপ্রার। সব্বার শিডিউল আলাদা আলাদা। জোজোর সামনের বছর বোর্ড এক্সাম। ফলে ওর অনলাইন ক্লাসের চাপ একটু বেশিই। এদিকে শিপ্রার নিজেও একটা বেসরকারি স্কুলে উঁচু ক্লাসের বিজ্ঞান শিক্ষিকা। ফলে ওর নিজেরও যথেষ্ট সময় যায় টিচিং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল বানিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের রসায়নের সমীকরণ বোঝাতে। নেহাতই অনিকেতের ব্যবসা এখন একেবারেই বন্ধ তাই ওর জন্য আর আলাদা করে সময়ের পিছনে দৌড়াতে হয় না। অধিকাংশ সময়ই মেয়ে তিন্নী আর তার দাদা জোজো অনলাইন ক্লাসের জন্য ডেস্কটপ নিয়ে মারামারি করে। যেহেতু জোজো বড়, তাই বেশিরভাগ সময় জোজোই জেতে। অগত্যা তিন্নীর ভরসা একমাত্র বাবার ফোন। ওতেই কাজ সারতে হয়! অবশ্য মাঝে মাঝে কাজ হয়ে গেলে শিপ্রা ওর নিজের ল্যাপটপটাও ছেড়ে দেয় তিন্নীকে, তবে সেটার সংখ্যা খুবই কম।
“শুনছো?” ডাকে অনিকেত শিপ্রাকে ।
“হ্যাঁ বলো”। সকালের ব্রেকফাস্ট বানাতে বানাতে মুখ তোলে শিপ্রা।
“বলছিলাম কুরিয়ারে চিঠি এসেছে কাল। তোমায় বলা হয়নি”। বলে অনিকেত।
“কী চিঠি?”
“জোজো আর তিন্নীর স্কুলে ফিস দেওয়া হয়নি, সেটার রিমাইন্ডার”।
মুহূর্তে মুখ কালো হয়ে যায় শিপ্রার। ফিস যে দেওয়া হয়নি, সেটা ও নিজেও জানে। লকডাউনের বাজার, অনিকেতের ব্যবসা প্রায় দু মাস বন্ধ। নতুন ফ্ল্যাট, তার ও ই এম আই আছে, ওর নিজেরও স্যালারির কোনো খবর নেই। সেই মার্চ থেকে বেতন হয়নি। এমাসে শোনা যাচ্ছে খানিকটা দেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাও যে কতটা কে জানে....
ভাবনা থেকে ওঠে শিপ্রা। তারপর বলে,
“ফি স্ট্রাকচার রিভাইস করার কথা লিখে আমরা সব গার্জেনরা মেল করেছিলাম। দেখি চিঠিটা। কত এমাউন্ট দেখাচ্ছে?”
“কিছুই কমায় নি। এমনকি ট্রান্সপোর্ট চার্জ ও ফুল। সব মিলিয়ে এক লাখ টাকার পে স্লিপ”।
ধপ করে বসে পড়ে শিপ্রা। ওর একাউন্টে আছে পঁয়ত্রিশ হাজার। যদি দু মাসের স্যালারিটা একসঙ্গে দিয়ে দিতো স্কুল কর্তৃপক্ষ , তাও হতো। সেটাও হবার নয়। ও জানে। ওর নিজের স্কুলেও একই অবস্থা। বাচ্চার বাবা মায়েরা পেমেন্ট করছে না। ফলস্বরূপ আটকে আছে ওদের পেমেন্ট ও। অথচ রোজ অনলাইন ক্লাসের চাপ। সঙ্গে ওয়ার্ক সিট তৈরি করা, খাটুনি চার গুণ বেড়ে গেছে কিন্তু স্যালারির কথা বললেই শুনতে হচ্ছে যে আগে সব বাচ্চা পেমেন্ট করুক। এদিকে অনিকেতের ফার্নিচারের দোকান। ওর ও দোকান খোলবার উপায় নেই। আর খুললেই বা এখন ফার্নিচার কে কিনবে? লোকে আগে খাবে, বাচঁবে, না ফার্নিচার কিনবে? আপাতত বছর দুয়েক অনিকেতের ব্যবসার যে কী হাল হবে, সেটা বলা মুশকিল। তবুও খানিক আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো শিপ্রা।
“তোমার একাউন্টে কত আছে অনি?”
“ই এম আই দেবার পর আর তিরিশ মত পড়ে আছে”।
তিরিশ। আর ওর পঁয়ত্রিশ। দুটো মিলিয়েও এক লাখ হচ্ছে না। সব খরচ করে ফেললেও মুশকিল। মাসিক একটা খরচ আছে। অনিকেতের রোজগারটা একেবারেই শূন্য হয়ে গেছে। জমানো যা ছিলো, সেটাই ভরসা। কিন্তু তাই বা আর কদিন! ফ্ল্যাট করার সময়েই তো অনেকটা জমানো টাকা খরচ হয়ে গেছে। তারপর অনিকেতের মায়ের অপারেশন হয়েছে মাস চারেক আগে। তখনও অনেকগুলো টাকা দিতে হয়েছে। সত্যি। কী যে এক মারণ রোগ এসে গেলো, মধ্যবিত্তের জীবন একেবারে কোনঠাসা করে দিয়েছে। একেবারে প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় দুম করে যদি রোজগার পাতি বন্ধ হয়ে যায়, সাধারণ মানুষের তো নাভিশ্বাস উঠবেই। হঠাৎই কমপ্লেক্স পেরিয়ে সামনের রেশনের দোকানের লাইনে চোখ গেল শিপ্রার। প্রায় ভোর রাত থেকে মানুষের লাইন। লকডাউনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মারপিট কথাকাটাকাটি চলছে। দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও কলহের একটি আভাস আসছে কানে। হঠাৎই শিপ্রার মনে হলো, ওদের থেকে আমাদের অবস্থা কী খুব কিছু আলাদা? এখন আলাদা হলেও আর কয়েকমাস পর? আরও যদি মাস তিনেক এভাবে রোজগারবিহীন অবস্থায় বসে থাকতে হয়, তাহলে কিকরে চলবে এই বিলাসবহুল জীবন? জমানো টাকায় রাজকোষ ও একদিন শূন্য হয়ে যায়, আর এ তো সামান্য মধ্যবিত্তের এমার্জেন্সি ফান্ড। তিন্নী আর জোজোর ফিস স্লিপটায় আবার হালকা চোখ বোলায় শিপ্রা। এরকম একটা মহামারীর সময়েও স্কুল গুলোর নির্লজ্জতা দেখে রাগ হলো খানিকটা। একসঙ্গে তিন মাসের মাইনে, সেশন চার্জ এমনকি বাস চার্জ পর্যন্ত চাপিয়ে দিয়েছে। সব ফুল এমাউন্ট। কোথাও কোনো কাটছাট নেই। দামী স্কুলগুলোর কী কোনো দায়বদ্ধতা নেই ছাত্রছাত্রীদের প্রতি? শিক্ষা মানে শুধুই গাদা গাদা টাকা জমা দেওয়া? আর না দিতে পারলে নির্লজ্জের মত বিবৃতি দেওয়া,
“তাহলে আপনারা বাচ্চা নিয়ে চলে যান!”
অদ্ভুত। একটা স্বাধীন দেশের কোনো দায়িত্ব নেই আগামী প্রজন্মের প্রতি? মনের প্রশ্ন মনেই রয়ে যায়। অনলাইন ক্লাসের সময় হয়ে যায় শিপ্রার।
(২)
দুপুরের পর যথারীতি মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে দুই ভাইবোনে। ক্লাস শেষের পর এটা রোজের চিত্র। রোজই সামাল দিতে হয় শিপ্রাকে। আজ ও তাই দিতে যাচ্ছিলো, হঠাৎই স্কুলের এডমিন গ্রূপের একটা মেসেজ দেখে বসে পড়ে।
“ Zoom meeting with all staff at 3 pm sharp”.
ঘড়ি দেখে শিপ্রা। এখন বাজে আড়াইটে। আধ ঘন্টার মধ্যেই খেয়ে নিতে হবে। সেই ভোরে ওঠা থেকে দৌড়। ক্লাস শেষ করে তিন্নীকে নিয়ে একটু যদি বা শোয়া হয়, আজ আর হবে না। এমার্জেন্সি মিটিং মানেই গুরুত্বপূর্ন কোনো সিদ্ধান্তই হবে। খেতে খেতেই সহকর্মী মল্লিকার ফোন।
“হ্যালো, শিপ্রা? তিনটে থেকে মিটিং। ব্যাপার খুব একটা সুবিধের ঠেকছে না। হঠাৎ এ ভাবে মিটিং কেন?”
আশঙ্কাটা যে শিপ্রার মনেও হচ্ছে না, তা নয়। চারিদিকে এখন কর্মী ছাঁটাই। সেরকম কোনো সিদ্ধান্ত নাকি? মেয়ে তিন্নীকে জোর করে দু গাল ভাত খাইয়ে শিপ্রা বলে,
“জানিনারে মলি। ছেলেটার সামনের বছর আই সি এস ই। অনিকেতের দোকান যে কবে লাভের মুখ দেখবে তা বলা মুশকিল! এর মধ্যে যদি আমার ও চাকরিটার কিছু হয়!”
“অথচ দেখ, আমরা কত পরিশ্রম করি। অনলাইন পড়ানো হয়ে কত খাটনি বেড়ে গেছে আমাদের। অথচ আমরাই টাকা পাচ্ছি না। দু মাস স্যালারি বাকি”।
“হুম রে। দেখা যাক কি বলে”।
“হ্যাঁ খেয়ে নে তুই”।
ফোন রেখে দেয় শিপ্রা। খাবার আর দুশ্চিন্তায় গলা দিয়ে নামে না। ওই কোনো রকমে গলাদ্ধকরণ করেই ক্যামেরার সামনে বসে। জয়েন করতেই প্রিন্সিপ্যালের সাজুগুজু করা হাসিমুখটা ভেসে ওঠে।
“গুড আফটারনুন অল স্টাফস। হাউ আর ইউ অল ডিয়ার? হোপফুলি এভরিওয়ান ইস সেফ এট হোম।”
উফফ এই মহিলা যখনই এই গদগদ হয়ে ভাষণ শুরু করেন, তখনই ওনার মারাত্মক কিছু একটা বলার থাকে। মনে মনে বলে শিপ্রা। এই লকডাউনের বাজারেও সাজের কোনো কমতি নেই। সেজেগুজে ক্যামেরার সামনে। যত কাজ আমরা সামলাবো, আর উনি শুধু সাজবেন। অসহ্য। ভাবনা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়না। ম্যানেজমেন্টের অনেকে একে একে ক্যামেরায় মুখ দেখাতে শুরু করে। এদের সবাইকে শিপ্রা কোনোদিন দেখেই নি। শুধু নামেই চেনে।
“হ্যালো টিচার্স। হাউ আর ইউ অল?” বলেন টপ ম্যানেজমেন্ট পজিশনের একজন।
এমত অবস্থায় সমস্ত দুশ্চিন্তা সাইডে রেখে দাঁত বের করে ভালো আছি বলতেই হয়। কিছু না বললেও সেটা অভদ্রতা। শিপ্রাও তাই করলো।
তারপরেই উনি ভাষণ শুরু করলেন,
“আমরা আজ একটা ভীষণ খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আমি আপনি সবাই ভীষণ আতঙ্কে। আমরা ম্যানেজমেন্টে থেকে আপনাদের প্রতিদিনের পরিশ্রমের দাম বুঝতে পারছি স্যার ম্যামেরা। আপনারা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন”।
শিপ্রার ঠোঁটের গোড়ায় এসে গেছিলো যে বলে, “তবু তো আপনারা দু মাসের স্যালারি বাকি রেখেছেন”। কিন্তু না বললো না । ওটা বলার জন্য সাহস দরকার। আবার ভাষণে মন দিলো শিপ্রা।
“কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের একটা আর্থিক মন্দাও চলছে। ৫০% র বেশি গার্জেন ফিস পেমেন্ট করেননি। এই অবস্থায় আমরা কিভাবে এত পরিষেবা দেবো? এই সমস্ত ওয়ার্কসিট, রোজ অনলাইন ক্লাস, এগুলো তো ফ্রি তে দেওয়া যায় না। মার্চ মাস থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। এপ্রিল, মে এবং জুন তিনমাসের টাকা একসঙ্গে এপ্রিলের মাঝে পে করার কথা গার্জেনদের, কিন্তু দুর্ভাগ্যবসত, মে শেষ হতে চললেও এখনও অর্ধেক দেয় নি”।
আবার ও শিপ্রার ঠোঁটের গোড়ায় “ দেয়নি বলবেন না , বলুন দিতে পারেনি। সবাই পরিস্থিতির স্বীকার। অন্য কোনো বছর এইভাবে টাকার জন্য বসে থাকতে হয় কি আপনাদের?”
নাঃ এবারেও গলা দিয়ে একটা আওয়াজ ও বেরোলো না। চুপ করেই থাকলো শিপ্রা। আসলে ওনার বলা কথাগুলোর মধ্যে কোথাও বোধহয় নিজেকে খুঁজে পাচ্ছিলো শিপ্রা । দেখতে পাচ্ছিলো ওর ক্লাসের ছেলে মেয়েদের অভিভাবকদের অসহায় মুখ....
“হ্যাঁ, তো যা বলছিলাম, যেহেতু এবারে ফিস কালেক্ট হয়নি, তাই আমরাও আপনাদের পেমেন্ট দিতে পারছি না। বাট আই হ্যাভ আ সলিউশন টু দিস প্রবলেম। দেখুন, পেরেন্টসরা আমাদের চেনেনা।।কিন্তু আপনাদের মানে ক্লাসটিচারদের চেনে। আমরা তো অনেক মেসেজ, মেল, চিঠি পাঠালাম, বাট নো রেসপন্স। এবার তাই ম্যানেজমেন্ট ঠিক করেছে এই কাজটা রেস্পেক্টিভ ক্লাসটিচার করবে। যে ক্লাসের সব বাচ্চা পে করে দেবে, সেই ক্লাস বা স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে সেই সেকশনের টিচারের ফুল পে রিলিজ করে দেবে একাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। যে টিচারের সেকশনের বাচ্চারা 70% ক্লিয়ার করবে, তার নিজেরও 70% স্যালারি হবে। ক্লাসটিচারদের প্রত্যেক পেরেন্টসকে ফোন করে রিকুয়েস্ট করতে হবে পে করে দেবার জন্য। কিন্তু একটা কথা খেয়াল রাখবেন, আপনি চাইবেন টাকা বাট ভীষণ পোলাইটলি। আজকাল আবার বাবা মায়েরা কথায় কথায় কোর্টে যাচ্ছে”।
এই অবধি বলে থামেন ভদ্রলোক। শিপ্রা দেখলো, স্তাবকরূপী প্রিন্সিপ্যাল, অন্যান্য প্রশাসনিক পদের ব্যক্তিরা “ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া” বলে হাততালি দিতে থাকলো।
শিপ্রা কিছু বলতে গিয়ে দেখলো, ওদের মিউটে রাখা আছে।অর্থাৎ ওরা শুনতে পাবে, কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। আরও দশ মিনিট স্তাবকতার পর মিটিং শেষ হয়। কান থেকে হেডফোন খোলে শিপ্রা। সামনে আয়নার দিকে তাকায়। নিজেকেই নিজে বলে, “ তাহলে শিপ্রা বসু, রসায়নের শিক্ষিকার কাজ থেকে অব্যাহতি তোর। ওই রসায়ন পড়ানোর টাকা তুই তখনই পাবি, যখন তুই “কাবুলিওয়ালা” শিপ্রা বসু হিসেবে সাফল্য পাবি”।