• 09 July 2020

    মোড়ক

    'আচ্ছা ঋজু কী আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে ? কে জানে হয়তো তাই.....'

    0 49

    #মোড়ক
    #Ichheuraner_Songi

    ভারী স্কুল ব্যাগ টা পিঠে নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছিলো ঋজু।ভারী ব্যাগ টা আজ আরো ভারী লাগছে,মাথার মধ্যে একটা কথা ই বার বার ঘুরছে,
    'নায়েন্টি নাইন পার্সেন্ট তোকে পেতেই হবে,দেবরাজ যদি পায় তবে তুই পাবি না কেন ?! টিভি,ফোন,ক্রিকেট সব বন্ধ করে দেব আমি।দেবরাজ এর মা র সামনে ছোটো হতে পারব না কিছুতেই।'

    'নায়েন্টি নাইন পার্সেন্ট,নায়েন্টি নাইন...'

    মাথার মধ্যে নায়েন্টি নাইন পার্সেন্ট কথা টাই ঘুরছিলো ঋজু র।মা র আদেশ গুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার পরেও কেন যে এরকম হলো।গতবারের নায়েন্টি সেভেন পার্সেন্ট টা নায়েন্টি নাইন তো হলোই না,বরং উল্টে আরো এক ধাপ কমে নায়েন্টি সিক্স পার্সেন্ট হয়ে গেল।

    ঋজু চেষ্টা করেনি তা তো না।খুব চেষ্টা করেছিল,দিন রাত এক করে পড়তো,স্কুল,টিউশন,কোচিন সেন্টার এর এক্সাম সবকিছু তে মনপ্রাণ দিয়ে খেটেছিলো, তবু আসল সময় কিছুই হলো না।অন্য দিন স্কুলের বাসেই ফেরে সে,আজ বলতে গেলে স্কুল থেকে পালিয়েই তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছে।সে উত্তর কলকাতার রাস্তাঘাট মোটামুটি ভালোই চেনে,এই বছর বাদে প্রত্যেক বার ই মা বাবা র সাথে সে দুর্গাপুজো র সময় কলকাতা র সব ঠাকুর দেখে,যেতে যেতে চেনা হয়ে গেছে।আগের বার টাই শুধু যেতে পারলো না মা র জন্য।পুজোর ছুটি খুললেই এক্সাম বলে মা কিছুতেই যেতে দিলো না ওকে কোথাও।বাবাও কত বার বললো থাক না পায়েল,পুজো তো বছরে বারবার আসেনা ,একটা দিন বেরোলে কীই আর এমন পড়াশোনা র ক্ষতি হবে,মা কিছুতেই শুনলো না।মা র একটাই গোঁ,'না ,সামনে এক্সাম,এখন পড়াশোনা ই কনসেনট্রেট করা প্রয়োজন।নাইনে উঠে গেছ,কচি খোকা তো আর নেই,এখন একটু আনন্দ ফুর্তি কম করলেও চলবে।সামনের বছর বোর্ড এক্সাম।'

    মা আগে এরকম ছিলো না,আগে যখন মা চাকরি করতো,তখন ঋজু র দিন গুলো অন্য রকম কাটতো,তখন ওরা সোদপুর থাকতো,ঠাম্মু দাদুর সাথে।তারপর হঠাৎ একদিন মা বাবা কলকাতায় এই ফ্লাট টায় চলে এলো।প্রথম প্রথম খুব মজা লেগেছিল যখন শুনেছিল খবরটা,তারপর যখন শুনলো দাদু ঠাম্মু ওদের সাথে আসবে না তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেলো।সোদপুর এর বাড়িতে সারাটা দিন বেশ কাটতো।ওর মর্নিং স্কুল ছিলো।মা ওকে ডেকে দিয়েই নিজে অফিস যাবার জন্য রেডি হয়ে যেত।ঠাম্মু ওকে খাইয়ে দিত,ব্যাগ গুছিয়ে দিতো,রেডি করিয়ে দিত তারপর দাদু হেঁটে হেঁটে স্কুল নিয়ে যেত।বাড়ি আসতো দুপুর বেলা,হেঁটে হেঁটেই।খেয়েদেয়ে ঠাম্মুর কোলে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তো,বিকেল বেলা ভিকি,গাবলু, পিকলু দের সাথে ক্রিকেট ম্যাচ,বাড়ি এসে পড়তে বসা আর রাতে বাবা মা অফিস থেকে আসলে রাতে খাবার টেবিলে পাঁচ জন মিলে একসাথে গল্প করতে করতে খাওয়া।ও প্রত্যেক দিন আঁকতো,এঁকে এঁকে খাতা শেষ করে দিত,দাদু কিনে এনে দিত সরঞ্জাম গুলো।কত প্রাইজ পেয়েছে এঁকে।কী সুন্দর ছিল জীবন টা, হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন একদমকায় চেঞ্জ হয়ে গেলো।কলকাতায় এসেও মা প্রথম প্রথম অফিস যেত,তারপর একদিন সেটাও বন্ধ হয়ে গেল।কেও কিছু জিজ্ঞেস করলে বলতো 'ছেলের ক্যারিয়ার এর জন্য গো, ওকে তো মানুষ করতে হবে ?'ওর আঁকা টাও ভালো রেজাল্টের জন্য ছাড়িয়ে দিলো।

    ঋজু র মাঝে মাঝে মনে হয় আচ্ছা, মানুষ হওয়া কাকে বলে ?? পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু দিয়ে কী ক্যারিয়ার হয়না ?! ও তো আঁকতে চায়,এঁকে অনেক বড় হতে চায়,অনেকটা মিকেলেঞ্জেলো র মতোন। কিন্তু মা তো শুনতেই চায়না,একদিন সাহস করে নিজের মনের ইচ্ছেটা মা আর বাবা কে বলেই ফেলেছিলো, বাবা খুব খুশি হয়েছিলো, আনন্দে চোখ দুটো যেন চিকচিক করে উঠেছিলো, কিন্তু মা এক ধমকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলো।
    'ওসব লাইনে কোনো ফিউচার আছে ?! টাকা ইনকাম করতে,এস্টেবলিশ হতে কতো বছর লাগে জানো একবার ও ?!'

    ঋজু চুপ করেছিলো, না ও জানতো না,কিন্তু এটা জানতো মন দিয়ে,ভালোবেসে কোনো কাজ করলে মানুষ সেটাই সাফল্য লাভ করেই,হয়তো সময় লাগে কিন্তু এক দিন না একদিন সে তার পরিশ্রম এর দাম পায় ই।দাদু একদিন ওকে বলেছিল।দাদু এটাও বলেছিল ঋজুর মতো ওর বাবা ও ছোট থেকে খুব ভালো আঁকত,তারপর 'ক্যারিয়ার' গড়ার জন্য পড়াশোনা র চাপে সেসব পাট চুকিয়ে দিয়েছিল।কে জানে,হয়তো এ জন্যই সেদিন বাবা ঋজু র ইচ্ছের কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলো, ওর মনে হয়েছিল বাবা কে বলে মা কে রাজি করাতে,কিন্তু শেষ অবধি আর বলেনি কিছুই,কারণ ও জানে বাবা ও ওর মতো মায়ের ইচ্ছের দাস,এই কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত টাও তো মা,বাবার উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিলো।

    সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ওদের কমপ্লেক্সের গেটে চলে এসেছে খেয়াল ই করেনি ঋজু।ইশ,রাস্তা টা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেলো, এখন গেলেই এত তাড়াতাড়ি আজ এলো কীকরে, এরকম হাজার প্রশ্নে ওকে জেরবার করে তুলবে।অন্য দিন তো গাড়ি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে নামাতে নামাতে আসে বলে দেরি হয়।কিন্তু এখন আর কিছু করা যাবেনা।

    কিন্তু একি!! ওঁদের গেটের সামনে এতো লোক দাঁড়িয়ে কেন,কি হয়েছে,, ভিতরে যেতেই দেখলো দাদু ঠাম্মু ও এসেছে, ফ্ল্যাটের অনেকেই আছে,শুধু বাবা আর মা কেই যা দেখতে পেলো না,কিছু বলে উঠবার আগেই ঠাম্মু জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো,
    'দাদুভাই তোর মা আর নেই,নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলো, উল্টো দিক থেকে একটা লরি এসে এলোপাতাড়ি এমন ধাক্কা দিয়েছে একেবারে ওখানেই শেষ....'
    আরো কতো কিছু বলে যাচ্ছিলো ঠাম্মু আর বাকিরা।কোনো কথা ই কানে যাচ্ছিলো না ঋজু র।মা নেই,নায়েন্টি নাইন পার্সেন্ট নাম্বার পাবার জন্য আর কেও জোরাজুরি করবেনা, রেজাল্ট কার্ড মুখের উপর ছুঁড়ে আর কেও বকবেনা,আর কেও ওর আর আঁকা র মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না,কেও স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি আসার জন্য জেরা করবে না,ও আবার আঁকবে, আগের মতো,মিকেলেঞ্জেলো র মতো একদিন নাম করবে।মা আর নেই,কোনোদিন আসবে না,ওর তো কষ্ট পাওয়া উচিত,চিৎকার করে কাঁদা উচিত ,ও তো এমনটা কখনো চায়নি,কিন্তু কই সে সব তো কিছুই হচ্ছে না বরং হঠাৎ করে একরাশ আনন্দ ওর সারা শরীর টাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতে ওর মুক্তি আজ,এর পর আর কেও ওকে আটকাতে পারবে না।

    কিন্তু হঠাৎ করেই একটা ভাবনা এসে পুরো মনটাকে ঘিরে ফেললো।এক ছুটে মায়ের ঘরে চলে গেলো ঋজু।ওখানেই সেই জিনিস টা আছে,

    তারপরই ঝড়ের বেগে গ্লিসারিন এর বোতল টা নিয়ে সোজা বাথরুমে চলে গেল।না,ওর মনের হদিশ কাওকে জানানো যাবেনা,সবাই তাহলে ওকেই খারাপ বলবে।কাওকে বলা যাবেনা,মোড়ক টা খুলে গেছে,ওর স্বপ্নের মোড়ক,পরাধীনতার মোড়ক।ও এবার নিজের "ক্যারিয়ার" টা নিজেই ঠিক করবে।আচ্ছা, ঋজু কী আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে ??কে জানে,হয়তো তাই।

    (সমাপ্ত)
    কলমে:ইচ্ছেউড়ানের সঙ্গী।



    Susmita Saha


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!