• 13 July 2020

    পটলবাবুর প্ল্যানচেট

    পটলবাবুর প্ল্যানচেট

    0 83

    #পটলবাবুর_প্ল্যানচেট

    #চিরঞ্জীত


    পটাশপুরের পটলবাবু ছিলেন অতিশয় সজ্জন ব্যক্তি।ছিপছিপে পেটরোগা মানুষটার শান্তশিষ্ট স্বভাবের জন্য তাকে সবাই পছন্দ করত।গ্রামের প্রাইমারি ইস্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য সবাই তাকে 'পটলমাস্টার' বলে ডাকত।


    এহেন পটলবাবুর কেবল একটিমাত্রই দোষ ছিল।অবশ্য সে কোনো গুরুতর দোষ কিনা,তা বলতে পারিনা।এই পটলবাবু ছিলেন মারাত্মক রকমের পেটুক।পটাশপুর তো বটেই ,আশপাশের নিমদিঘি,রায়চাঁদপুর,মুকুটপুর গ্রামেও কোনো অনুষ্ঠান হলে সভ্য হিসাবে পটলবাবু নিমন্ত্রিত হতেন।এই নিমন্ত্রণ রক্ষার ব্যপারে তাঁর কোনোদিনই কোনো অনীহা ছিল না।


    আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে পটলবাবু কোপ্তা-কাবাব,পোলাও-পায়েস,মন্ডা-মিঠাইয়ের যে কিরূপ সদগতি করতেন সেকথা বলা নিষ্প্রয়োজন।শেষমেষ তার যখন খাওয়া শেষ হত,তখন গৃহস্বামীর কাছে গিয়ে তিনি স্বয়ং বলে আসতেন - 'বেড়ে রেঁধেছেন মশাই,কচি পাঁঠার মাংসটা এখনও যেন জিভে লেগে আছে।'


    সেই সময় উক্ত গৃহস্বামী কাঁধের গামছাটায় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে পটলবাবুকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতেন,সেকথা বলাই বাহুল্য।


    তবে এসব খাদ্যদ্রব্য যে সবসময় পটলবাবুর পেটে সহ্য হত,তেমনটা নয়।মাঝেমধ্যেই তিনি পেটের অসুখে ভুগতেন।দুদিন,তিনদিন এমনকি কখনও কখনও পাঁচদিন পর্যন্ত পেটের ব্যথায় কাতরাতেন।তারপর আরোগ্য পেয়ে আবার রসনাতৃপ্তির কাজে লেগে পড়তেন।এইজন্য লোকে তাঁকে বিদ্রুপ করে আড়ালে আবডালে 'পেটরোগা পটল' বলত।


    শেষমেষ এই পেটটাই কাল হল পটলবাবুর।একবার মারাত্মক কলেরায় পড়লেন তিনি।সেই যে পড়লেন, আর উঠলেন না।সাতদিন একটানা ত্যাগ করার পর পটলবাবুর আত্মা জীবন আর খাদ্যদ্রব্যের মোহ ত্যাগ করে তাঁর বিকারগ্রস্ত দেহ ছাড়ল।আর সেখান থেকে শুরু এই গল্প।


    ******


    পাড়ার কয়েকজন ছেলেছোকরা মিলে পটলবাবুর লাশটাকে শ্মশানে নিয়ে গেল।পটলবাবুর ছেলে দুলাল নিজের হাতে বাপের মুখাগ্নি করল।সবকিছু মোটামুটি ঠিকঠাক মিটে গেল।ঝামেলা শুরু হল দিনকয়েক পর।


    পটলবাবুর মৃত্যুর পর তিনরাত পেরোয়নি।তার মধ্যেই তাঁর পড়শি হারুন মণ্ডলের ভেদবমি শুরু হল।সে কি বিশ্রী অবস্থা!উগরে উগরে হারুনের জোয়ান চেহারাটা দুদিনের মধ্যেই আমসে হয়ে গেল।আর শুধু হারুন নয়,হপ্তা ফিরতে না ফিরতেই রতন,বাবলু,গোপালদের সকলের প্রায় একই অবস্থা হল।


    গ্রামের মাতব্বররা শুরুতে মনে করল,এ সংক্রামক রোগ,পটলবাবু মারা যাওয়ার আগে কলেরা ছড়িয়ে দিয়ে মরেছেন।কিন্তু যখন সারা গ্রামজুড়ে কেবল জোয়ান পুরুষরাই কলেরায় আক্রান্ত হতে লাগল,তখন মাতব্বরদের ধারণা ভেঙে গেল।তারা নিশ্চিত হল,এ ওই পটলাবাবুরই কারসাজি!


    ইতিমধ্যে দুলাল নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে।একদিন সকালবেলা মাতব্বররা তাকে ডাকতে এল।


    দুলালকে নিয়ে মাতব্বরেরা সকলে মিলে নবীন চাটুজ্জের বাড়ি গেল।নবীন চাটুজ্জে এ গ্রামের সবচেয়ে বড়ো ব্রাহ্মণ।সৎকার্য করার বিষয়ে বেশ নামডাক রয়েছে তাঁর।


    সব শুনে ব্রাহ্মণঠাকুর বললেন - 'সবই তো বুঝলাম,কিন্তু পটলবাবুর অতৃপ্ত আত্মা আসলে কি চায়,সেটাই তো বুঝলাম না।'


    মাতব্বরদের মধ্যে ভবেশ একটু চালাক-চতুর ছিল।সে বলল - 'আচ্ছা ঠাকুরমশাই,আমরা যদি প্ল্যানচেট করে পটলবাবুকে ডাকি আর তার কাছে সবটা জিজ্ঞেস করি,তাহলে কেমন হয়?'


    নবীনঠাকুর খানিকক্ষণ ভবেশের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।তারপর বাকিদের দিকে ফিরে বললেন - 'তোমরা কি বলো?'


    ঠাকুরমশায়ের কথায় একটা গুঞ্জন শুরু হল।তারপর একজন বলল - 'বেশ তাই হোক।'


    ঠাকুরমশাই এরপর বললেন - 'তুমি কি বলো দুলাল?'


    - 'আপনি যেটা ভালো বোঝেন ঠাকুরমশাই।'


    - 'বেশ,তবে তাই হোক।আগামী পরশু অমাবস্যা।সেদিন রাতেই নাহয় প্ল্যানচেটে বসা যাবে।'


    ******


    অমাবস্যার গভীর আঁধার রাত।নবীন চাটুজ্জের ঘরে একটা তেপায়া টেবিলের ওপর মিটমিট করে একটা আলো জ্বলছে।অন্ধকারে টেবিলটাকে ঘিরে বসে রয়েছে চারটি প্রাণী।নবীন চাটুজ্জে,ভবেশ,দুলাল আর নিরাপদ কুণ্ডু।


    এই নিরাপদবাবুকে ভবেশ ডেকে এনেছে মুকুটপুর থেকে।উনি নাকি প্রেত-পিশাচ নিয়ে কাজ কারবার করেন।প্ল্যানচেটের মিডিয়াম হিসাবে তাঁর নাকি জুড়ি মেলা ভার।


    টেবিলে হাত রেখে সকলে একমনে পটলবাবুর কথা চিন্তা করতে লাগলেন।দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই।


    হঠাৎ উত্তরদিক থেকে একটা শোঁ শোঁ বাতাস এসে টেবিলের আলোটা নিভিয়ে দিল।আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিরাপদবাবুর শান্তশিষ্ট চেহারাটা বদলে ভয়ানক হয়ে উঠল।তিনি থরথর করে কাঁপতে লাগলেন,তাঁর কষ বেয়ে লাল গড়াতে লাগলো।


    ভবেশের একটু আধটু প্ল্যানচেট করার অভিজ্ঞতা ছিল।সে অন্ধকারেই নিরাপদবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল - 'কেউ এসেছেন?'


    নিরাপদবাবু ভয়ংকর মুখভঙ্গি করে যে গলায় উত্তর দিলেন,সেটা যে তাঁর কন্ঠস্বর নয়,সে বিষয়ে বাকি তিনজনেই নিশ্চিত।তিনি আটকে আটকে গম্ভীর গলায় বললেন - 'হ্যাঁ।'


    তারপর ভবেশ তাকে জেরা করতে শুরু করল,আর নিরাপদবাবু সেই ভয়ংকর গম্ভীর স্বরে আটকে আটকে জবাব দিতে লাগলেন।তাদের কথোপকথন এইরূপ:


    - 'কে আপনি?আপনি কি পটলবাবু?'


    - 'হুম।'


    - 'আপনি কি কয়েকদিন আগে কলেরায় মারা গিয়েছেন?'


    - 'হুম।'


    - 'আপনার মৃত্যুর পরেই কি গ্রামে কলেরা সংক্রামিত হয়েছে?'


    - 'না।'


    - 'তাহলে?'


    - 'আমার অতৃপ্ত আত্মাই ওদের শরীরে প্রবেশ করে এইসব কান্ড ঘটাচ্ছে।'


    - 'আপনার আত্মা অতৃপ্ত কেন?'


    - 'রোগভোগে মৃত্যু হয়েছে আমার।আমার মরার বয়স হয়নি।বেঁচে থাকতে আমি খেতে খুব ভালোবাসতাম,এখনও বাসি।তাই যখনই ইচ্ছে হয়,এর-ওর শরীরে প্রবেশ করি।তারপর তার আত্মাকে দুর্বল করে আমি বাস করতে শুরু করি।আমার কলেরা হয়েছিল,তাই তাদেরও কলেরা হয় তখন।'


    - 'কী করলে আপনার আত্মা তৃপ্ত হবে বলুন।'


    - 'বলবো না' -নিরাপদবাবু হিহি করে হাসতে লাগলেন।


    এইসময় ভবেশের চোখগুলো যেন জ্বলে উঠল।বাকি দুজনে দেখলেন যে জায়গায় ভবেশের চোখ থাকার কথা,সেখানে দুটো আগুনের গোলা জ্বলছে।তাঁরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেলেন।


    ভবেশ চিৎকার করে বলল - 'ভুলে যাস না,আমার নাম ভবেশ।ভূত-প্রেতকে কীভাবে জব্দ করতে হয়,আমিও জানি।'


    নিরাপদবাবু তেমনই আটকে আটকে বললেন - 'কি করবি তুই,কি করবি?'


    - 'গাত্রবন্ধন মন্ত্র দিয়ে তোকে বেঁধে ফেলবো,যাতে তুই আর কারোর শরীরে না প্রবেশ করতে পারিস।আর কোনওকিছু না খেতে পারিস।'


    নিরাপদবাবুর গলাটা এইসময় যেন একটু কেঁপে গেল।ধীরে ধীরে বললেন - 'এমন করিস না,বলছি বলছি।'


    - 'হুম বল।'


    - 'এই জগতে শুধু খাবারের প্রতিই আমার টান রয়ে গেছে।খাবারের মায়া ত্যাগ করতে পারিনি বলে আমার মুক্তি হচ্ছে না।তুই আমার ছেলেকে বলিস গয়ায় গিয়ে আমার পিন্ডদান করতে।আর তার সাথে ভালো ভালো খাবার কোপ্তা-কাবাব,মন্ডা মিঠাই দিতে।তাহলেই আমার মুক্তি ঘটবে।'


    - 'বেশ বলব।এখন তুই যা।'


    - 'হুম যাচ্ছি' - বলার পরেই ঘরের মধ্যে আবার একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল।আর পরক্ষণেই নিরাপদবাবু চেয়ার থেকে টলে একপাশে পড়ে গেলেন।


    ভবেশ দেশলাই দিয়ে টেবিলের আলোটা জ্বেলে তাঁকে আবার চেয়ারে তুলে বসালো।


    ******


    পরদিন সকালে জনসমক্ষে ভবেশ ঘোষণা করল যে,গ্রামের সবকিছুর জন্য পটলবাবুর প্রেতাত্মাই দায়ী।তিনি গতরাতে প্ল্যানচেটে এসে একথা স্বীকার করেছেন।এছাড়া বাকি আর যা যা বলেছে,সবই বিস্তারিতভাবে জানালো ভবেশ।নবীনঠাকুর আর দুলাল তার হয়ে সাক্ষী দিল।


    তারপর সকলে মিলে ঠিক হল,পরদিন ভোরেই দুলাল গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান করবে আর পটলবাবুর কথামতো বাকি সব খাবারও গঙ্গায় ভাসাবে।সবকিছুর ব্যবস্থা গ্রামবাসীরাই করবে;তারা কেবল এসব উৎপাত থেকে মুক্তি চায়।


    হলও তাই।গ্রামবাসীদের থেকে সবরকম জিনিসপত্র খাবারদাবার নিয়ে সেদিন বিকেলেই দুলাল আর ভবেশ গয়া রওনা দিল।পরদিন ভোরবেলা যথাযথ নিয়ম মেনে বাবার পিন্ডদান করল দুলাল,সাথে সেই খাবারগুলোও জলে দিল।


    সেদিন সকাল থেকেই গ্রামের সব রুগীদের কলেরা সেরে উঠতে লাগলো।তারপর থেকে দীর্ঘদিন পটাশপুরে আর কারোর কলেরা হয়নি।


    ******

    সমাপ্ত



    Chiranjit Patra


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!