• 21 July 2020

    গল্প

    ভৌতিক

    0 58

    #শপি বিচিত্রা

    #বিভাগ--গল্প

    #বিষয়--ভৌতিক

    18.07.2020


    প্রায় দশবছর আগের কথা,অর্কর তখন কিশোর বয়স।

    রাঙামাটি গ্রামথেকে বেরিয়ে দারকেশ্বর নদীর উপরে,অদূরেই কয়েকঘর সাঁওতালের বাস।

    নদীর উপরে শাল,মহুলের জঙ্গলের মাঝে মারাংবুরুর থান,এখানে কিছুটা স্থান পরিচ্ছন্ন ও গোবর দিয়ে নিকানো, আজ এখানে ধানসিং মানসিংহ পরব ও মেলা বসবে দুপুরের পরে, মূলত একবেলার পরব।

    অর্কর, মা বাবা ভাইবোন সবাই, সপরিবারে গ্রামে এসেছে পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে,গতকাল ছিল সংক্রান্তি,আজ পয়লা মাঘ, আখান দিন,গ্রাম সমাজে কথ্যভাষায় বলে 'আখান যাত্তা' অর্থাৎ শুভ দিন।

    সকালে গ্রামেরমাথায় গ্রামদেবতার

    পূজা সম্পন্ন হয়েছে,মাটির ঘোড়া দিয়ে মানসিক শোধ করেছে অনেকে,আবার কেউ কেউ হাঁস মুরগীও বলি চড়িয়েছে দেবতার নিমিত্তে,গড়িয়ে যাওয়া রক্তে হুড়োহুড়ি করে বহু মানুষ কপালে পরেছে রক্তের টিকা,

    হন্তারকের মোষ কালো চেহারায় হাতের টাঙিখানা রক্তমাখা হয়ে ঝলসাচ্ছিল রোদে,

    অর্ক,তাপস,চঞ্চল ও বুনি হামলেপড়ে রক্তের টিকা পরেছে কপালে,

    হয় সবাই পরছে বলে,নয়তো না পরলে ঠাকুর কূপিত হবেন ভেবে,

    যাইহোক সেইসব চুকেবুকে গেছে সকালে।

    এখন ওরা ধানসিং মানসিংহ পরব দেখতে এসেছে বিকেলে, বাড়িথেকে বেরনোর সময় বিভাবতী পৈপৈ করে বলেদিয়েছেন,

    কেউ কাউকে হাতছাড়া করবি না,সন্ধ্যা হতেহতে ফিরেআসবি ঘরে,এইনে দশটাকা পয়সা, বুটভাজা বাদামভাজার তরে, বুনি বলল,"মা বেলুন, ফিরফিরি নেব"

    বিভাবতী বললেন,"ঠিক আছে,আরো পাঁচটাকা সঙ্গে রাখো।


    মারাংবুরুর থানে এসে ওরা দেখতে পেল প্রচুর লোক বেষ্টনকরে ঘিরেআছে দেবতা স্থল,অর্ক,তাপস, চঞ্চল,বুনি প্রবেশের কোন পথ পাচ্ছে না,বুনি মানুষজনকে ঠেলেঠুলে,পায়ের ফাঁক গলে সামনেগিয়ে দাঁড়াল,বাকিরা পায়ের টোএর উপর দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল।

    সাঁওতালদের মধ্যে যারা ব্রতী তারা সাদাধুতি ও গেঞ্জিতে খালিপায়ে গোলহয়ে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করতে লাগল ধামসার ছন্দে,মুখে ক্রমাগত উ লু লু লু, উ লু লু লু শব্দ করছে,হাতে ধরা আছে নিস্পত্র গাছের ডাল,সেটা একবার ডান দিকে একবার বাম দিকে নৃত্যের তালে বৈঠা বাওয়ার মতো বাতাস ঠেলছে,কথ্যভাষায় ঝুপান এসেছে,

    অর্থাৎ এইমুহূর্তে দেবতা ভর করেছে

    ওদের উপরে,তাই ওরা এখন বাহ্যজ্ঞান রহিত,একএকবার করে ওরা ছুটে চলেআসছে ঘিরেধরা মানুষজনের সামনে, মানুষজন শ্রদ্ধা য়,ভয়ে,আতঙ্কে পিছনে পিছোতে গিয়ে এ ওর গায়ে হুমড়িখেয়ে পড়ছে,হাসিরছররা বইছে চরাচর জুড়ে,অদূরেই গরমতেল ফুটছে কড়াইয়ে,কাঠেরজ্বালে আগুনের লেলিহান শিখা উঠছে উপরে,খালিহাতে পিঠেছাঁকা হবে গরমতেলে হাত ডুবিয়ে,এই অনুষ্ঠানটি মেলার আকর্ষণকে মহিমান্বীত করে ধরে রেখেছে,

    অর্ক দেখলো সন্ধ্যা হয়েআসছে, সবাইকে টেনেটুনে নিয়ে এল বাইরে।

    বুনি বলল, 'দাদা পিঠেছাঁকা দেখবি না?

    তাপস বলল,'দেখবি তো পাঁপড় ভাজা খাবি কখন?

    চঞ্চল বলল,'দাদা আমাকে একটা পুঁ,পাঁ বাঁশি কিনে দে না,

    অর্ক বলল,'হবে, হবে, সবহবে,আগে দোকানের সামনে চল তো তোরা।


    অর্করা যখন খেলনা কিনে,বুটভাজা চিবোতে চিবোতে নদীতে নামলো,তখন অন্ধকার গেড়েবসেছে, নদীর ব্যাপকতা ও বিশালতা একটু একটু ভয়ের উদ্রেক করছে,

    বুনি লেপ্টে আছে অর্কর গায়ে, হঠাৎ তাপস ভীরুস্বরে বলল,"দাদা ঐটা কি নড়ছে?

    অর্ক চকিতে চোখ ফেরাতেই দেখল,সিঙসিঙে লম্বা কালোমতো কিছু একটা নড়ছে,ঠেলাঠেলি করে দ্রুত এগোতেগিয়ে বালির উপর আছাড় খেল তাপস ও চঞ্চল, প্রতিবর্তক্রিয়ায় দ্রুত উঠে দাঁড়াল দুইজনেই, কিন্তু গুটিপাথরে চঞ্চলের হাঁটুকেটে রক্ত ঝরছে, বুনি বিড়বিড় করে বলেচলেছে সমানে,"ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি,

    রাম লক্ষ্মণ সাথেআছে,ভয়টা আমার কি,

    কিন্তু বুনি যে ভয়পেয়েছে সেটা ওর সিঁটিয়েথাকা দেখেই বুঝা যাচ্ছে,

    বুনির আঙ্গুলের নখ চেপে বসেছে অর্কর কব্জিতে ।

    কালোমতো আকৃতিটা এগিয়েআসছে বাতাসে দুইহাত উপর নিচে দোলাতে দোলাতে,আবছা আলো অন্ধকারে ভূতের কাঁধ পর্যন্ত নেমেআসা ঝাঁকড়া চুলগুলো,ছৌ'নাচের ধামসা বাদকের মতো দুলছে মাথার দুই পাশে,ভূতের নিম্নাঙ্গে মনেহল লেংটির আবরণটুকু ছাড়া শরীরে কোন বস্ত্র নেই,

    ভূত নাঁকি সুরে, অয় রে, অয় রে, অয় রে, করে ডাকছে, ভূত যতো এগিয়ে আসছে অর্করা ততই দ্রুত বালি ভাঙছে দ্রুতপায়ে,

    এইভাবে কিছুক্ষন চলার পরে ভূতের সঙ্গে দূরত্ব কমেআসছে দেখে,অর্ক ফিসফিস করে বলল,'ছুট তোরা আগে আগে, আমি তোদের পিছনে পিছনে ছুটছি,বলাও শেষ হয়নি,চারজনেই ছুটতে শুরু করল রুদ্ধশ্বাসে, প্যাঁ পোঁ বাঁশি ও বেলুন হাতথেকে খসে পড়ল বালুচরে।

    নদীথেকে ডাঙায় উঠার সময়,কর্দমাক্ত মাটিতে পা' পড়ে,অর্ক গড়িয়ে পড়ল গমক্ষেতে,

    একপাটি চপ্পল গেঁথে রইল কাদাতে।

    ছুটতে ছুটতে গ্রামের নিকটে পৌছে, হাঁপাতে হাঁপাতে অর্ক পিছনফিরে দেখল ভূত তাড়াকরে আসছে কি না,না নেই দেখে আশ্বস্ত করল সবাইকে," দাঁড়া, আর ছুটিস না" বলল ।

    তাপস বলল,' দাদা আকাশ পথেও ভূত আসতে পারে হাওয়ায় ভেসে,

    চঞ্চল চকিতে একবার আকাশটা দেখে নিল, নেই দেখে সাহস পেল মনে, অর্ককে বলল,"দাদা তুই ছুটতে বললি কেন?

    জুডোর প্যাঁচে আমি ভূতকে কুপোকাত করতাম।

    বকবক করতে করতে ওরা বাড়ি ঢুকতেই বিভাবতী খেঁকিয়ে উঠল,'এতো দেরি করলি যে'?

    তোদের বলেছিলাম না,সন্ধ্যে হবার আগেই ফিরতে, কি হোল কথা কানে যায় না নাকি?

    অর্করা ভূতের কথাটা এখনকার মতো চেপে গেল,

    বুনি কিছু একটা বলারচেষ্টা করেছিল," জানো মা" বলে,

    তাপস ওকে চোখের ইশারায় চুপকরিয়ে বলল,'আমরা দারুন মজা করেছি।


    রাতে খাওয়া দাওয়ার পরে, অর্ক তাপস ও চঞ্চল একঘরে শুয়েছে, বুনি শুয়েছে বিভাবতীর সঙ্গে অন্যঘরে,ঘুম আসছে না কারোরই, উত্তেজনা তখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে শরীরে,তাই তাপস বলল,'দাদা সেই কালো লেংটি ভূতটা!

    অর্ক চাপা নাঁকি সুরে অয় রে,অয় রে,অয় রে,বলে রহস্যময় কায়দায়

    দুইহাত খেলাতে লাগলো, জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে অর্কর চোখে পড়ে রহস্যময়তা আরো বাড়িয়ে তুলল,যেন সেই অশরীরী আত্মা,সশরীরে এইঘরে উপস্থিত হয়েছে, অর্ক আর অর্ক নেই, সাক্ষাত ভূতে পরিনত হয়েছে।

    তাপস, চঞ্চল, উভয়েই কাঁদু কাঁদু গলায় বলল," দাদা রে চুপকর, ভয় লাগছে,এরপর অর্ক ভূতের ভেতরথেকে বেরিয়ে এল আস্তে আস্তে।

    এইঘটনার পরের দিন ওরা শহরে চলে এল, কারন স্কুল কামাই হচ্ছে যে,শহরের প্রখর আলোয়,ভূত দেখা দেয় না,অন্তত অর্ক দেখা পায়নি।

    এইবছর পূজোরছুটি পড়ার দুইদিন আগেই গ্রামে ফিরে এল অর্করা, দাদু বিধুশেখরের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে।

    দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর বিধুশেখর চক্রবর্তী গত পরশুদিন পরলোক গমন করেন, মৃত্যুকালে তার সামনে ছিল ছোটছেলে ও পুত্র বধূ ।

    লোকজন ও আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা কয়েকদিন হলো গমগম করছে।

    শ্রাদ্ধশান্তি সম্পন্ন হতেই যে যার নিজের নিজের বাড়ি ফিরেগেছে,শুধু অর্কর পিসিমণি আয়েত্রী রয়েগেছে।

    সন্ধ্যা বেলায় বিভাবতী কূয়োতলায় জল আনতে গিয়ে,সড়সড় শব্দের উৎসমুখে চোখ রাখতে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে গোঁ গোঁ শব্দে সংজ্ঞা হারালেন,শব্দ অনুসরণ করে সবাই ছুটেগিয়ে দেখল,বিভাবতী কূয়োর চাতালে পড়েআছেন,ধরাধরি করে ঘরেএনে মুখেচোখে জল দিতেই আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরেএল,ধাতস্থ হয়ে বললেন,

    উনি এসেছিলেন কূয়োতলায়।

    অনুমান করে তাপস বলল,"কে দাদু"

    অর্ক বলল,"মা,এটা তোমার ভ্রম"

    বিভাবতী বললেন আমি নিজের চোখে দেখেছি যে,

    আয়েত্রী বলল,'বৌদি,সত্যিকথা বলতে কি,সন্ধ্যারপর কূয়োতলা যেতে আমারও গা ছমছম করে,শেষকালে বাবা কি ভূতহয়ে আমাদের ঘাড় মটকাবে!

    রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘরের আলোজ্বেলে শুতেগেল সবাই,

    অর্ক বলল,আলোতে আমার ঘুম আসেনা,আমি বৈঠকখানা ঘরে ঘুমোচ্ছি।

    রাত তখন কটা হবে কে জানে,উঁহু হু,উঁহু হু শব্দে অর্কের ঘুম গেল ভেঙে,মোবাইলের আলোজ্বেলে ছুটেগিয়ে দেখল,পিসিমা ছটফট করছে,তার গলাদিয়ে অদ্ভুত শব্দ বেরোচ্ছে,বিভাবতী ভয়ে চোখবন্ধ করে ঠকঠক কাঁপছে,

    কি হলো কি?বলতেই,আয়েত্রী চোখ মেলল,কিন্তু গলাদিয়ে কোন স্বর ফুটছে না,কন্ঠনালি শুকিয়ে কাঠ হয়েছে,শুধু হাতের ইশারায় জল চাইল,জলখেয়ে গলাভিজিয়ে বলল,"বাবা এসেছিল গলা চিপতে"

    অর্ক বলল,'কি যা তা বলছো,তোমাদের ঘরের আলো কে নেভালো ?

    সাহস পেয়ে বিভাবতী বলল,'সত্যি তো, আলো কে নেভালো ?

    অর্ক সুইচে হাতদিয়ে দেখল, সুইচ অনআছে,কারেন্ট নেই,বাকি রাতটা ওরা বসে গল্পকরে কাটালো।


    গতরাতে ঘুম হয়নি শরীরটাও ঠিক নেই অর্কর,দারকেশ্বরের নদীচরে বসেআছে বিকেলে,টকটকে লাল সূর্য দিগন্তেএসে মিশেছে, নদীর জলে যেন কেউ আগুন গুলে দিয়েছে, তিরতিরকরে কাঁপছে তার শিখা,যে দিকে তাকায় শুধু শূন্যতা বিরাজ করছে, এমনি বসে থাকতে থাকতে আলো মরে এল, নেমেএল অন্ধকার।

    অর্ক দেখে দূরে একটা অস্পষ্ট অবয়ব ফুটে উঠছে, অর্কর স্মৃতিবেয়ে কিছু একটা উঠে আসছে, সেই লম্বা সিঙসিঙে নির্মেদ কালো চেহারা,ঘাড় পর্যন্ত নেমেআসা ঝাঁকড়া চুল,খালি গা,চলন ভঙ্গি অবিকল এক,অর্কর শিরদাঁড়াবেয়ে নেমেগেল হিমশীতল স্রোত,এটা শরীর না অশরীরী তাইনিয়ে অর্ক পড়ল ধন্দে, আস্তে আস্তে সে উঠে দাঁড়াল,

    পায়ে পায়ে এগিয়েগেল শিঙশিঙে অবয়বের দিকে,মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,'তুমি কে, ?

    উত্তর এল,'আমি সনাতন পরামানিক,রোজ হাজামত শেষে বিকেলবেলা নদীর জলে স্নানকরে ঘরেফিরি,না বেরোলে,পেট চলবে কি করে বাবু?

    অর্ক বলল,'তা তো বুঝলাম,কিন্তু তুমি আমাদের ভয় খাইয়েছিলে কেন,কয়েক বছর আগে,সন্ধ্যাবেলায় নদীতে,কিছু মনে পড়ে?

    সনাতন মাথা নিচু করে বলল,'ভুল হয়েগেছে বাবু,

    ভুল,ইচ্ছেকরে তুমি বাচ্চাছেলে পেয়ে বদমাইশি করেছ,জানো,এতে মানুষের নার্ভ সিস্টেম বিকল হয়েযেতে পারে?

    এই,কান মুলছি বাবু,আর হবে না,

    ঠিক আছে যাও,আর কিছু বলার নেই ।


    নদীথেকে ঘরে ফিরেএসে অর্ক বলল,'মা,পিসিমণি,তোমরা কোথায়,একবার এইদিকে এসো,কথা আছে,

    বিভাবতী বলল, কি বলছিস রে?

    আয়েত্রীও সামনে এসে দাঁড়াল,

    অর্ক বলল,'বলছি যে, যে কারনেই হোক তুমি তো দাদুর সেবাযত্ন করোনি,আর পিসিমণি,দাদু তোমার ওখানে থেকে ডাক্তার দেখাতে চেয়েছিল,তুমি নিয়ে যাওনি,টালবাহানা করে এড়িয়ে গেছ,এরজন্য যে অপরাধবোধ জমাআছে তোমাদের মনে,সেই অপরাধবোধ আতঙ্ক সৃষ্টিকরছে তোমাদের অবচেতনে, একহয় সঞ্চিত অপরাধবোধ থেকে মানুষ ভূত দেখে,নয়তো ভয়ে, মানুষের অপকর্মকে ভূতের কর্ম ভাবে,

    বুঝলে না,ভয়ই ভূত,

    সত্যিকারের ভূত'বলে কিছু নেই।।









    Prasanta Dubey


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!