আমার বর্তমান আস্তানা জঙ্গলের ভিতর। আমার আর কোন স্থায়ী ঠিকানা নেই! আমি আর কোলাহলে, জনসমুদ্রে ফিরতে চাই না।
এখন সন্ধেবেলা, আমি বারান্দায় বসে আছি। সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ।এখানে বিশেষ একটি জায়গায় আছে মহুয়ার জঙ্গল। মহুয়া ফুলের গন্ধে, মহুয়ার রসে তীব্র নেশা লাগে। কাঁচা নেশায় মানুষ ভোলে তার বর্তমান অস্তিত্ব, পাড়ি দেয় আক্ষাঙখিত জগতে! সে জগত যেন বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যবর্তী। এই জগৎটাই আমি চাই, সব চেনা জানা থেকে দূরে। সব দৃশ্যমান বস্তু ঘোলাটে হোক, স্পষ্ট হোক ভেতরকার অদৃশ্য জগৎ। এই তো আমি চাই!
হ্যাঁ আমি পালিয়ে এসেছি। কেন? ওই যে বললাম অদৃশ্য কোন কিছুর সন্ধানে। এখানে তার দেখা নিশ্চয় পাবো, আরো স্পষ্টভাবে! কার দেখা? একটা মেয়ে। তার নাম জানিনা, আমি নাম দিয়েছি-"চয়নিকা"।
- বাবু, চা।
বুধন মানে বাংলোর কেয়ারটেকার এসে চা দিয়ে গেলো।
আমি কাপে চুমুক দিতে দিতে দৃষ্টিসীমা সরু করে সামনের আঁধারটা ভেদ করতে চেষ্টা করলাম।
কাছাকাছি সাঁওতাল গ্রামের অল্প আগুনে রঙ কুয়াশা ভেদ করেও দেখা যাচ্ছে। মাদল বাজছে জোরে জোরে। বুধন চলে গিয়েছে। আমার মাথায় আবার চয়নিকার কথা ঘুরছে।
একজন যাকে আর কেউ দেখতে পায়না আপনি ছাড়া-যার নাকি অস্তিত্বই নেই, তাকে দেখতে পাওয়াটা কি স্বস্তির? ও কোনো প্রেতাত্মা, নাকি আমার কল্পনা নাকি অন্য কোন অশুভ শক্তি! আমার স্ত্রী বলে আমি মেয়েঘেষা, নতুন মেয়েছেলে পাইনি সদ্য বিয়ের পর, তাই অমন অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমার স্ত্রী আমাকে জোর করে সায়াক্রাটিস্ট-এর কাছে নিয়ে যেতে চাইছিলো। আমি কোন জোরজার পছন্দ করি না, তাই চয়নিকাকে আরো কাছে, নিজের মতোন পাবো বলেই পালিয়ে এসেছি এখানে, অফিসে কদিন ছুটি নিয়ে!
চয়নিকার চাবুকের মতো শরীর, সুগঠিত স্তনযুগল না দেখলে আমার ঘুম হয়না। আমি ওকে ছুঁতে পাইনা, ওর মুখটাও ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি কখনো। কিন্তু ওর শরীরের যেটুকুন দেখি, ওইটুকু না দেখলে আরো দামাল হয়ে যাই। কেমন নিজেকে অসম্পূর্ণ লাগে।
চয়নিকা এখানেও তো আসতে পারতো, এখনো আসছে না কেন?
ভেতরে আবার একটা অস্থিরতা চাগাড় দিয়ে উঠছে আমার।
বারান্দা থেকে উঠে ঘরে গেলাম।
চেয়ারটা টেনে বসলাম, টেবিলে খোলা আছে নীল ডায়েরি।
চয়নিকার সব গল্প লেখা আছে ওতে, পাঁচ বছর ধরে ওর আবছা ছায়ামূর্তি আমাকে তাড়া করছে। কখন, কিভাবে, কোথায় সব রয়েছে ওতে!
প্রথম প্রথম অসহ্য মনে হতো! কিন্তু ও যেন আমার নেশা, আমার একাকীত্বের সম্বল, আমার কথা বলার সঙ্গী! চয়নিকাই জানে আমার সব আব্দার, অভিযোগ, সুখ-দুঃখের ইতিহাস! মাঝরাতে যখন আশপাশের পরিবেশটা শান্ত হয়ে যায়, ও আমার কাছে আসে৷ ওর আসমানী রং শাড়িটার আঁচল আমায় ছুঁয়ে যায় কিন্তু মুখ ঢাকা থাকে দীঘল কালো চুলে!
আমি কথা বলি, কত কথা! ও বলে না, শুধু হাসে। ওর হাসির আওয়াজ এই নদীর স্রোতের কুলকুল শব্দের মতোই!
কেন জানি না, ওই সাঁওতাল গ্রামের উৎসবের আওয়াজ আরো জোরে ধরা দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, অনবরত সেই ছন্দের তরঙ্গ মস্তিষ্ককে চিরে রক্তাক্ত করছে! আমার শুধু চয়নিকা চাই, ওর হাসির ছন্দ চাই! এমন আওয়াজ হতে থাকলে ও কখনো আসবে না!
দূরে সাঁওতাল গ্রামের বাজনা অসহ্য মনে হচ্ছে এবার। উফ, আর লিখতে পারবো না। নীল ডায়েরীটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। ছুটে চললাম গ্রামের দিকে!
******************
পরদিন সকালে দেরিতে ঘুম ভাঙলো।
হুইস্কির পুরো বোতল ফাঁকা।
কাল ভাতের বদলে এটাই তবে ডিনার ছিলো! কি মাথাটা ধরেছে,উফ্।
বুধন ছুটে এসে জানালো পুলিশ আমার খোঁজ করছে। সাঁওতাল গ্রামে নাকি কাল খুন হয়েছে!
বুধন বললো,
- বাবু, আপনাকে কতো খুঁজলাম। রাতে খেলেন না, মাঝ রাতে এসে দরজা দিলেন। পুলিশকে কিছু বলিনি বাবু, আমি!
আমি বাইরে বেরিয়ে এলাম। পুলিশেরা আমায় জানালো সাঁওতাল মেয়েটির কথা।
তারপর দুখী দুখী মুখ করে তারা বললো, আমার জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ ও আছে। আমার অফিস থেকে এই বাংলো বুকিং এর খবরটা তারা পেয়েছিলো, তাই দুঃসংবাদটা দিতেই তাদের মূলত আসা এখানে।
আমি বেরিয়ে আসার প্রায় দুদিন পর আমার স্ত্রীর বিবস্ত্র লাশ পাওয়া গিয়েছে আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ডাম্পিং জোনে।
আমার ভেতরটা কেঁপে উঠলো, শাশ্বতী নেই!
তারা কেসের ব্যাপারে তদন্ত করতে চায়। তাই জলদি আমায় কোলকাতা ফিরতে হবে।
পুলিশেরা ফিরে গেলো।
কিসব হচ্ছে আমার চারপাশে?
কে খুন করলো শাশ্বতীকে?
সাঁওতাল মেয়েটিই বা মরলো কিভাবে? কে মারলো?
আমি আর দেরি করলাম না। ব্যাগ গুছিয়ে, বুধনকে ঘরের চাবি গছিয়ে বেরিয়ে পরলাম কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
******************
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎ একটা মিষ্টি ঝাঁঝ ঝাঁঝ গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে। আমি নেশাতুরের মতোন সেই গন্ধের দিকেই অগ্রসর হই। আমি জানি, আমি ভুল পথে যাচ্ছি, তবুও সেই গন্ধটা...এটাই কি মহুয়া ফুলের গন্ধ?
জিপ ধরে এগোতে এগোতে দেখি চয়নিকা?
হ্যাঁ, চয়নিকাই তো!
গাড়ি দাঁড় করিয়ে ওর পিছন পিছন গেলাম। আজ ওর মুখ আমি দেখবোই।
আমাকে পেছনে আসতে দেখে ও থমকে দাঁড়ায়। ওর শরীর দেখে এক অদ্ভুত খিদে জাগে আমার। বহুদিনের অপ্রাপ্তির খিদে, দাবিয়ে রাখা এক অস্তিত্বের খিদে।
আমাকে দেখতে থাকে ও। আজকে ওর মুখটা অনেক স্পষ্ট! আশপাশের মিষ্টি গন্ধ আমায় ঘিরে ধরছে যেন! মাতালের মতোন ওর আরো কাছে এগোতে থাকি। ওর চেহারা আরো স্পষ্ট হচ্ছে। চোখ, নাক, ঠোঁট সব আজ যেন আমি ছুঁতে পারবো।
কিন্তু এই চেহারাটা আমার এতো চেনা লাগছে কেন? কেন মনে হচ্ছে চয়নিকা অপরিচিতা কেউ নয়, ওকে যেন আমিই সবচেয়ে বেশি দেখি, সবচেয়ে বেশি জানি, সবচেয়ে...
এ কি!
ওর সবকিছু আমার চোখে স্পষ্ট এখন। কিন্তু চোখ, নাক গাল সব যে আমার মতোন! আমার মতোন ওষ্ঠজোড়া! এ কি করে...
ছিটকে অনেকটা দূরে পড়ে যাই আমি। কাল রাতের ঘটনা ভেসে ওঠে স্মৃতিতে।
সাঁওতালি গ্রামের দিকে পাগলের মতোন ছুটে যাই ডায়েরিটা ছুঁড়ে ফেলেই। ততোক্ষণে উৎসব শেষ, কিন্তু আমাকে আসতে দেখেই অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে, একটি সাঁওতালি মেয়ে আমার পিছু নেয়। আমি হাঁটতে হাঁটতে একটা পরিত্যক্ত গভীর খালের ধারে আসি। জোর করে মেয়েটি আমার সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করতে চায়। নিজের নগ্নতা দিয়েও সে আমায় গলাতে পারেনি। একসময় ধস্তাধস্তি শুরু হয় আর আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে নীচু খালে ফেলে দিই!
ঘরে দ্রুত ফিরে চোখ বুজে গিলি হুইস্কি।
আমাকে কোন মেয়ে কোনদিন আকর্ষণ করতে পারেনি! শাশ্বতীও পারেনি বিয়ের পর থেকে, ওর কোনো কমতি ছিলনা।
শাশ্বতীর সাথে শেষ যেদিন দেখা হয়, সেদিন আমায় অপমান করলো নপুংসক বলে? মাথায় রক্ত চেপে গিয়েছিল! কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, ও হয়তো সত্যিটাই বলেছিল!
আজীবন চয়নিকাকেই চেয়েছি, নাকি আমিই চয়নিকা হতে চেয়েছি?
চয়নিকা এগিয়ে আসে আমার দিকে। ওর ঠোঁটে সেই মিষ্টি হাসি। কিন্তু আমার চোখে লজ্জা, ঘেন্না। আমিই তো চয়নিকা, ও তো আমিই! আমি আজীবন তবে চয়নিকা হতে চেয়েছি তবে! আমি অসুস্থ, আমি সত্যিই..
সেই নীচু খালটার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। চিৎকার করে বলছি
- চলে যাও চয়নিকা, তোমায় আমি চাই না, না না...
চয়নিকা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় আমার লোমশ বুক। আমার পা হড়কে যায়।
ধীরে ধীরে খালের গভীরে এগোচ্ছি অভিকর্ষজ টানে। আবছা দৃষ্টিতে দেখছি চয়নিকা মধ্যদুপুরে পুরোপুরি মিলিয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মতোন। যতো ও মিলিয়ে যাচ্ছে, ততোই আমার লোমশ বুক হয়ে উঠছে সেই মসৃণ স্তনযুগল, আমার গোঁফ মিলিয়ে যাচ্ছে, পাতলা ওষ্ঠে জেগে উঠছে এক তীব্র প্রাপ্তির স্বস্তি।
অতলে হারিয়ে যাওয়ার আগে অস্ফুটে বলে উঠলাম
-আহ, শান্তি!