• 01 August 2020

    দীপ জ্বেলে যাই

    দীপ জ্বেলে যাই

    5 152

    জ্ঞান যখন ফেরে অভির তখন কিছু মনে নেই। একটা ঘরে ও বন্দী। ঘরটাও খুব অদ্ভুত। দেয়ালগুলো পুরোটা সাদা। ওর হাতে স্যালাইনের চ্যানেল লাগানো। বড্ড অদ্ভুত লাগছে ওর। মাথাটা এতো হালকা কেন? যেন কিছুই নেই সেখানে?


    কিছুক্ষণ পর দেয়ালের একটা দিক খুলে যায়। ওহ, ওটা দরজা। কিছু মাস্ক পরা লোক ঢুকলো ভেতরে। ওদের দেখে অভি ভয় পেয়ে যায়। কারা এরা! হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে থাকে, তার আগেই ওকে একটা ইঞ্জেকশন পুশ করে দেয়া হয়। অভি ঢুলতে ঢুলতে শুয়ে পরে।


    ***********


    মি. বোসের বাড়িতে আজ ড. ক্রেন এসেছে। অভির মায়েরই প্রায় জোর করে টেনে আনা। ছেলের প্রোগ্রেস সম্বন্ধে জানতে চাইছে। ড. ক্রেন বলছেন, "আপাততো অবসার্ভেশনে আছে, হোপ এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট সো সুন।"

      - একবার দেখতে পারি ওকে!

      - ইয়েস, অফকোর্স। বাট ওকে সেন্সলেস করে রাখা হয়েছে। সো ডোন্ট ওরি এবাউট ইট।

      - হুম।


    ড. ক্রেন পকেট থেকে ছোট্ট ডিভাইসটা বার করেন। ন্যানো-ল্যাপি নামের যন্ত্রটি ন্যানো টেকনোলজির আরেকটি নজির। সাইজে একটি ম্যাচ বক্সের মতোন। এর লাল রঙের বাটনটা ক্লিক করে তিনি টেবিলে রাখলেন।

    ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ভাঁজ খুলতে খুলতে ডিভাইসটি সম্পূর্ণ ল্যাপটপের আকার ধারণ করলো। সেখান থেকে সরাসরি ওয়েব ক্যামের মাধ্যমে ১ মিনিটেই সংযোগ স্থাপন হয়ে গেলো অভি যে রুমে আছে সেই রুমের সিসিটিভি ফুটেজের সাথে। ম্যাগনেটিক পাওয়ারের বিস্তার এখন কয়েক মাইল জুড়ে সম্ভব হয়। তাই অভিকে বেশ দেখতে পাচ্ছিলেন মিসেস বোস।


    অভি হাঁ করে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে মনে হচ্ছে যেন একটা মূর্তি, নির্জীব কোন পদার্থ।

    অভির মায়ের ভেতরটা হাহাকার করে উঠলো। তিনি কান্না চেপে রাখতে না পেরে উঠে নিজের বেডরুমে চলে গেলেন।


    মি. বোসকে জিজ্ঞেস করেন ড. ক্রেন

      - উনি সত্যিটা জানেন না?

      - না ড. আমি চাই না ও জানুক। ও সহ্য করতে পারবে না।

      - আই সি। ডোন্ট ওরি, নেক্সট উইকে অভি বাড়ি চলে আসবে, হোপ সো।



    ************


    দুপুর নাগাদ মিস মারিয়া অভির জন্য খাবার নিয়ে আসে। মারিয়ার বয়স প্রায় ত্রিশ, অভির কাছাকাছি। অভির দেখভালের মূল দায়িত্ত্ব তারই। কাল থেকে শুরু হয়েছে ডিউটি।


    অভিকে কিছুটা ডোপামিন জাতীয় মেডিসিন দেওয়া হয়েছে। খালি ঘরে থাকলে হইচই করছে না কিন্তু লোকজন দেখলেই কেমন যেন ঘাবড়ে যাচ্ছে।

    মারিয়া খাবার টা টেবিলে রেখে, দু'হাতে গাল দুটো আলতো করে ধরে অভির। অভি চোখ খুলে তাকিয়ে থাকে মারিয়ার দিকে, ফ্যালফ্যাল করে। এই প্রথম তাকে কেউ স্পর্শ করছে। মারিয়ার দৃষ্টি সোজা অভির দিকে। অভি যেন মন্ত্রমুগ্ধ।


    ড. ক্রেন অন্যঘরে বসে নিজের সাবাশি নিজেই দিচ্ছেন মনে মনে। উনি জানতেন শুধু মারিয়াই পারবে। ওর আকর্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। উনি নিজেই মারিয়ার সম্মোহনী শক্তিতে কাবু হয়ে কতো রাত আদিমতায় কাটিয়েছেন!


    অভিকে খাইয়ে মারিয়া উঠে পরে। অভি ওর হাত টেনে ধরে। অভি কথাও বলতে পারছে না। ও কি বলতে হবে জানে না। কিন্তু ওর ভালোলাগছে, মারিয়া থাকলে ওর এই অদ্ভুত ঘরটায় থাকতে ভয় করেনা!


    মারিয়া অভির গালে চুমু খায়। তারপর ঠোঁট নাড়িয়ে আওয়াজ করে বলে,

      - বলো, মা-রি-য়া।

      - আ-আ-আ

      - হুম না না, মা-রি-য়া।

      - আ...

      - ওকে, আগে বলো মা-আ-আ-আ

      - ম-ম-...

      - মা-আ-আ-

      - ম-ম-মা...

      - বাহ।



    ঘুমটা ভেঙে যায় মিসেস বোসের। মনে হলো যেন অভি ডাকছে। খাটের সাইডে লাগানো তিনটে বাটনের মাঝের টায় টিপতেই খাটের একটা পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসে কিছু জিনিসপত্র। সেখান থেকে অ্যালবামটা বেছে নেন তিনি। ভেতরে অভির ছবি ভর্তি। একেকটা ফটো দেখতে দেখতে তার চোখের পাতা আর্দ্র হয় মিসেস বোসের। একটা ছবিকে চেপে ধরে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে তার থ্রি-ডি ইমেজ উঠে আসে। অভি গান গাইছে গিটার হাতে। মনে হচ্ছে, চাইলেই ছুঁতে পারবেন মিসেস বোস। আর না পেরে বন্ধ করে দেন অ্যালবামটা আর বুকে চেপে ধরে কাঁদতে থাকেন।


      - আর কোনদিন বকবো না তোকে অভি। তুই যা চাইবি তাই হবে, প্লিজ ফিরে আয় জলদি। তোর গান শুনবো, তোকে বুকে জড়িয়ে রাখবো। রাগ করে সেই যে গাড়ি নিয়ে বেরোলি, তারপর...


    ************



    মারিয়ার সাথে বেশ ভাব জমে উঠেছে অভির এই দুই তিন দিনে। অভি এখন মানুষ দেখলেই ভয় পায় না। তবে একদিন বিড়াল দেখে ভয় পেয়েছিলো। ড. ক্রেনের বিড়ালটাই এমন ভয়ঙ্কর।

    এখন মারিয়া বলতে পারে অভি। ওর সাথে এই সাদা ঘরটা থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে যায় বাগানে। বাগানে সব আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার আর তার এসেন্সটাও কৃত্রিম। অভির কেন যেন এই কৃত্রিমতা ভালো লাগে না।ওর শুধু মারিয়াকে ভালো লাগে। ওর কোলে মাথা রাখতে, ওর গালে চুমু খেতে, ওর হাতে হাত রেখে হাঁটতে খুব ভালো লাগে।


    মারিয়াও ওর ওপর দুর্বল হয়ে পরেছে। এর আগের তিনটে এক্সপেরিমেন্ট করেছে ড. ক্রেন, তাদের সাথেও ভাব জমাতে হয়েছে ওকে। কিন্তু তারা মারিয়াকে এভাবে টাচ করেনি, এভাবে তার সাথে কোমল ভাব দেখায়নি। তারা অল্পতেই ভায়োলেন্ট হয়ে যেতো আর সেক্সুয়ালি মারিয়াকে কষ্ট দিতো। অভি একদম তা নয়। ওর স্পর্শে একটা মাদকতা আছে, কিন্তু সেই স্পর্শের নেশা অন্যরকম। মেয়েরা স্পর্শের ভেদাভেদেই মানুষ বুঝে নিতে

    পারে। অভি আলাদা। ও গুনগুন করে সুর শোনায়। ওকে আকাশের তারা আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। সিন্থেটিক বাটারফ্লাই দেখলে লাফিয়ে ওঠে। যেন একটা বাচ্চা!


    আজকে মারিয়া অভিকে ছাদে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে আশপাশের রিয়েল ওয়ার্ল্ড দেখা যায়। চারপাশে শুধু বড়ো বড়ো বিল্ডিং আর কৃত্রিমতা। যদিও এটাই বাস্তব ২০৪০ এ এসে। শুধু মন ভালো করার জন্য আকাশের গোল চাঁদটা রয়েছে। যদিও বিজ্ঞানীরা চাঁদকে উপগ্রহ হিসেবে ব্যাখ্যায়িত করতে চায় না। সেটাও নাকি কৃত্রিম। কিন্তু যারা ছন্দ ভালোবাসে, ভালোবাসায় থাকতে ভালোবাসে, তাদের জন্য চাঁদ আদিমকালের প্রেম! ছন্দের ও ভালোবাসার রসদ! তাই ছাদ ভরা জ্যোৎস্না দেখে অভির মধ্যে অপ্রত্যাশিত ভাবে রোমান্টিসিজম জেগে ওঠে। মারিয়া ইচ্ছে করেই ওর খুব কাছে চলে আসে। দুজনের নিশ্বাস যেন মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। অভি আলতো করে ছুঁয়ে দেয় মারিয়ার ঠোঁট। না, এটা অভিকে কেউ শিখিয়ে দেয়নি। ভালোবাসা হয়তো শিখিয়ে দিতে হয় না! তাই অভি আর মারিয়া দুজন দুজনের ঠোঁটের সোদা গন্ধে কৃত্রিম জগতেও যেন অরণ্যের ভেজা গন্ধে মেতে ওঠে! এই আদিমতা আজীবন পৃথিবীর বুকে স্বাগত।


    *********


      - অভি ইজ রেডি মারিয়া। কাল ওর ব্রেনে মেমোরি ট্রান্সফার হবে। এইবার আমি ফেইল করবো না।

      - বাট, ইটস টু আরলি...

      - নো মারিয়া। এর থেকে বেশি লেট করলে, তুমি আমার হাত থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার জব এখানেই শেষ। কাল থেকে ছুটি, নেক্সট প্রজেক্টের সময় তোমায় আবার ডাকা হবে।

      - ইউ মিন, ইয়োর ফার্ম হাউস ইজ দ্য নেক্সট প্রোজেক্ট!

      - ডোন্ট ফরগেট মারিয়া, আই এম ইয়োর বস।

      - দ্যাটস মাই ব্যাডলাক!


    কাঁদতে কাঁদতে মারিয়া বেরিয়ে যায়। ঘুমন্ত অভিকে আরেকবার দেখে চলে যায় নিজের রুমে।


    *************


    পরদিন অভিকে সেন্সলেস করে শুইয়ে দেয়া হয় এক্সপেরিমেন্টাল রুমে। চেক করে নেয়া হয় হার্টবিট থেকে প্রেশার সব। সব ঠিকঠাক। এখন ওর মেমোরি ট্রান্সফার হবে। মেমোরি চিপ রাখা হয় একটি ব্লু হার্ড ডিভাইসে যেখান থেকে নির্দিষ্ট অ্যালগরিদমে খুলে থ্রি-ডি ভার্সনে সেই মেমোরির যাবতীয় ডেটা। সেখান লাস্ট ১০ মিনিটের স্মৃতি ডিলিট করেন ড. ক্রেন। তারপর কৃত্রিম নিউরোট্রান্সমিটার এর মাধ্যমে শুরু হয় মেমোরি ট্রান্সফার। কিছুটা রাইবোজোমের নিউরোট্রান্সমিটার হিসেবে কাজ করার মতোন।


    অভির দিকে তাকিয়ে আছে মারিয়া। ভেতরে একটা শঙ্কা। আগের মতোন যদি ফেইল করে এক্সপেরিমেন্ট তাহলে অভির প্রাণও যেতে পারে।


    মারিয়া মুঠো করে জিসাস ক্রাইস্টের লকেট চেপে ধরেছে। বিজ্ঞান উন্নতি করলেও আজো ভয়-শঙ্কায় ঈশ্বরের দারস্থ হতেই হয় মানুষকে। ঈশ্বর অজানা শক্তি হলেও সেই পজিটিভ এনার্জি কোন মেশিন আজো দিতে পারেনি!


    মারিয়ার আকুতি শুনেছেন ঈশ্বর। সমস্ত মেমোরি ট্রান্সফারের পর এখনো অভির বডি ঠিকঠাক কাজ করছে।


      - উই হ্যাভ উন মারিয়া। ড. ক্রেন ছুটে এসে মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলেন।


    প্রায় একঘন্টা পর অভির জ্ঞান ফেরে। মি. বোসও এসেছেন। মিসেস বোসকে আনেননি, তবে তিনি অধীর আগ্রহে ছেলের অপেক্ষায় আছেন।


    অভির চোখ উন্মীলিত হয় ধীরে ধীরে। চারদিকের সবকিছু অচেনা লাগে, চিনতে পারে শুধু মি. বোসকে।

      - বাবা!

    মি. বোসের বুক থেকে যেন একটা বোঝা হালকা হয়ে যায়। বুকে জড়িয়ে নেন অভিকে।


    মারিয়া খুব খুশি অভির জন্য। এসে সেও হ্যান্ডশেক করে অভির সাথে।

      - কংগ্র‍্যাচুলেশন অভি!

      - থ্যাংকস। বাট আপনাকে চিনতে পারলাম না।

    এমন প্রশ্ন আসবে মারিয়া জানতো। তবুও ধাক্কাটা যেন জোরেই লাগে। গলা বুজে আসে, তবুও নিজেকে সামলে বলে

      - আমি মারিয়া, আপনার নার্স।


    **********


    বিকেলে অভি ফেরে ঘরে। ছেলেকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পরেন মিসেস বোস। অভিও খুব খুশি। দুর্ঘটনার পর ও যে ফিরে আসতে পারবে সেটা ও ভাবতেই পারেনি।


    মি. বোস আর ড. ক্রেন এর গভীর আলোচনা চলছিল মি. বোসের সিক্রেট রুমে। মোটা অঙ্কের টাকা পেয়ে ড. ক্রেন খুব খুশি।


      - ২০ দিনে ক্লোন বানিয়ে সেখানে অভির মেমোরি ট্রান্সফারা করা অব্দি প্রচুর এক্সাইটেড ছিলাম। একটা ডি.এন. এ থেকে ক্লোন বানানো যায় কৃত্রিম প্রোটিন পটের মাধ্যমে। এর আগেও এমন দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত মানুষের মেমোরি হার্ড ব্লু ডিস্কে কালেক্ট করে সেটা একটা চিপে সেভ করে রেখেছিলাম। তারপর কিছুদিন বডিকে এডজাস্টমেন্টের জন্য, এই রিয়েল ওয়ার্ল্ডকে বুঝতে দেয়ার জন্য টাইম দিয়ে ট্রান্সফার করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ক্লোন বডি নিতে পারেনি। এবার পেরেছে। আর তাই আপনি ফিরে পেলেন আপনার ছেলে আর আমি আমার লুজ হওয়া কনফিডেন্স।

      - প্লিজ, মিসেস বোসকে বলবেন না যে অভি নয় অভির ক্লোনকে আমরা পেয়েছি ছেলেরূপে।

      - ডোন্ট ওরি। আমরা আর মিট করবো না মি. বোস। দিস ইজ আওয়ার লাস্ট মিট!



    রাতে বারান্দা দিয়ে অভি চাঁদ দেখছে। একটা নতুন সুর মাথায় ঘুরছে। এই সুরটা খুব অদ্ভুত! চোখ বুজে গিটারের সাথে সুরটার অ্যাডজাস্টমেন্ট করছিলো অভি, হঠাৎ যেন মনে হয় তার ঠোঁটে কার যেন একটা সোদা গন্ধ!

    চোখ খুলে ফেলে অভি। মনে হলো একটা ছায়ামূর্তি যেন সরে গেলো তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে!


    ***********

    পরদিন সকালে ড. ক্রেনের কাছে খবর আসে। সুইসাইড করেছে মারিয়া।

    ড. ক্রেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লাস্ট নোটে লেখা ছিলো একটি কথাই।

      - আমি অভিনয় করিনি, আমি সত্যিই অভিনয় পারিনা!




    Mukulika Das


Your Rating
blank-star-rating
Anamika Sengupta - (01 August 2020) 5
ভালো লাগলো

1 0