বিপত্তির লকডাউন
আত্ম'দংশনে আকীর্ণ
প্রশান্ত পরাশর
18.04.2020
সেদিন ছিল চৈত্র'সংক্রান্তি,নীলের পূজোর উপবাসের অলস আবহে একটি ফোনকল এল রিঙ্কুরকাছে, ঘরেরভেতর থেকে রিঙ্কুর উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর ধৃতির কানে এসে পৌছাল, ধৃতি জানে যে রিঙ্কু একটুবেশি আবেগপ্রবণ এবং সহজেই প্রতিকথায় আশঙ্কিত হয়,তাই এইবিষয়ে ধৃতি নিস্পৃহ রইল, কয়েক'মিনিট পরে রিঙ্কু ধৃতির সম্মুখে এসে বলল,"জানো,সকাল এগারোটার সময় বাবা চৌকিথেকে পড়েগেছে মেঝেতে,
এখন ঘাড়'তুলে দাঁড়াতেই পারছে না,বাবা'ফোনে আমাকে বলল,রিঙ্কু রে আমাকে নিয়ে চল,কোন ভালো জায়গায় ভর্তিকরে'দে,আমি ভালো নেই।
ধৃতি বলল,"বাবা নিজের মুখে এইকথা বললেন"?
রিঙ্কু বলল,হ্যাঁ,
ধৃতি বলল,"তাহলে বিশেষ কিছু উদ্বেগের কারণ নেই,উনি সুস্থই আছেন,তবু একবার অনন্তেরসঙ্গে কথাবলে সব জেনে নিচ্ছি"
সাময়িক রিঙ্কুকে শান্ত করলেও ধৃতি মনেমনে ভাবল, এই লকডাউনের সময় গাড়ি,ঘোড়া পাওয়াই তো মুশকিল,তারপর আবার থানার পারমিশন চাই,হাসপাতালগুলো তো আবার সংক্রমণের আঁতুড়ঘর, তারপর আজ আবার রবিবার,শুধু শুধুই রুগিকে বেডে ফেলে রেখে দিবে,সোমবারের আগে কোন চিকিৎসাই হবে না,
তাছাড়া একদল মানুষ রুগি দেখলেই করোনা'রুগি ভেবে উন্মত্তহয়ে উঠছে
এইসব কথা মনেরভেতরে নাড়াচাড়া করতে করতে ধৃতি ফোনে ধরল অনন্তকে, জিজ্ঞাসা করল,"কি রকম বুঝছো"? বমি হয়নি তো?
অনন্তের মুখে 'না শুনে"আশ্বস্তহয়ে বলল,তবু একজন ডাক্তারকে দেখিয়ে নেওয়া ভালো,দেখো যদি ব্যবস্থা করতে পারো,তাহলে ভালো হয়।
অনন্ত বলল,প্রত্যন্ত গ্রামে এইএক অবস্থা,কাছেপিঠে পাসকরা কোন ডাক্তার নেই,চাইলেও গাড়ি পাওয়া দুষ্কর,দেখছি কতদূর কি করাযায়।
দেখছি,ভাবছি করে,বেশকিছু সময় অতিবাহিত হল,লকডাউনের আবহে অসহায়তা প্রকট হল।
ঘন্টাখানেক পরে রিঙ্কু ধৃতিকে বলল,মায়ের সঙ্গে কথাহচ্ছিল,মা বলল,কথাবলার সময় তোর বাবার গলারস্বর জড়িয়ে যাচ্ছে,শরীরের একপাশ ক্রমশ অসাড়হয়ে আসছে, এখন কিহবে বলতো?
ধৃতি বলল,দাঁড়াও একবার সঞ্জীবকে ফোনকরে দেখি,ওর গাড়িটা পাওয়া যায় কি না,
সঞ্জীবকে ফোন লাগাল,রিং হয়েযাচ্ছে অথচ ধরছে না, মিনিটপাঁচেক পরে আবার করল আবার রিং হয়েযাচ্ছে ধরছে না, অগত্যা মৃত্যুঞ্জয় নাগকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল,মৃত্যুঞ্জয় স্পষ্ট বলেদিল,'না দাদা,লকডাউন পিরিয়ডে আমি যেতেপারবো না, এখন উপায় কি করাযায় ধৃতি এইকথা ভাবছে, এমন সময় ধৃতির whatsappএ মেসেজ ঢুকল,তাতে লিখা আছে the game is over.ভয়ে কেঁপে উঠল ধৃতি, সঙ্গে সঙ্গে সে মেসেজ করল,"কখন হল"
উত্তর এল just now.
ফোনে নেই শুনে,ধৃতি স্তব্ধহয়ে বসে রইল,রিঙ্কুকে এখনই বলাযাবে না এইকথা,কারন ওকে সামলানো মুশকিল হবে,কিন্তু ধৃতির'মন সক্রিয় হয়ে উঠে,পরবর্তী কাজগুলো মনেমনে পর্যায়ক্রমে গুছিয়ে নিতে লাগল,চেয়ারথেকে উঠেপড়ে রিঙ্কুর দৃষ্টিসীমার বাইরেগিয়ে বড় শ্যালক আবিরকে ফোনে ধরল,আবির ফোন তুলতেই বলল,শুনেছো তো তোমার বাবা আর নেই,এখন তুমি কি করবে বলো?আসতে পারবে কী?আসতেও তো তোমার সোলঘন্টা সময় লাগে,মাঝে তিনটে রাজ্য পারহতে হয়,এই লকডাউনের সময় কি তা সম্ভব হবে!,তা যদি সম্ভব না হয় তাহলে তোমার অপেক্ষায় নাথেকে দাহ'করার প্রক্রিয়া এগিয়েনিয়ে যাওয়াই সমীচীন হয়,আমি তোমার দিদিকে নিয়ে তোমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে কিছুক্ষন পরে রওনা দিচ্ছি,তার আগেদেখি--তিল,কুশ,গঙ্গামাটি,মার্কিন জোগাড় করতে পারি কি না,এই লকডাউনে তো সব দশকর্মার দোকান বন্ধ আছে,তোমার হাতে দুঘণ্টা সময় রইল,সমস্তদিক খতিয়েদেখে সিদ্ধান্ত জানাও,ছুটোছুটি ধরাধরি করে দেখ; যদি কোনও উপায় বারকরতে পারো,এখন ছাড়ছি ।
আমাকে এড়িয়ে কারসঙ্গে কথা বলছো,দূরথেকে রিঙ্কুর গলা শুনতে পেল ধৃতি,
এড়াবো কেন,টাওয়ার নেই তাই----
কার সাথে কথা বলছিলে?
অনন্তের সঙ্গে,চলো তৈরীহয়ে নাও,বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে,রাত্রে মায়েরকাছে তো তোমাকেই থাকতে হবে,
রিঙ্কু বলল,"কিছু লুকোচ্ছ না তো, সত্যি বলছো?
হ্যাঁ রে বাবা,চলো তাড়াতাড়ি কর,
আমি এখনি আসছি বলে ধৃতি, বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল।
টুকিটাকি গুছিয়ে নিয়ে,গোপন জিনিসগুলো জোগাড়ের ক্লেশ জামাকাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে নিয়ে, তালাচাবি দিয়ে বিকেল ছয়'টা নাগাদ ধৃতি ও রিঙ্কু মোটরসাইকেলে চেপে বসল,মোড়ে মোড়ে পুলিশের বাঁধাঠেলে এগিয়ে চলল,বিপদের সময় রাস্তা ফুরোতে চায় না,কিন্তু ওদের নিজেদের মধ্যে কথা ফুরিয়েছে,দিনও ফুরিয়ে আসছে, চাপাউদ্বেগ ও উৎকন্ঠার সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে,অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাকাদুটো গর্তেই পড়ছে।
বাড়ির অদূরেই মানুষের জটলা দেখে এতক্ষণ যে আশা নিরাশার দোলায় দুলছিল রিঙ্কু ,তা যেন গতি পেল,অবরুদ্ধ কান্না সেআর ধরে রাখতে পারল না,কেঁপেকেঁপে ফুঁপিয়ে উঠে ছুটলো বাড়ির ভেতরে,মেয়ে ও মায়ের মিলিত কান্নার রোল নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করেদিল,কেন জানিনা বাড়িরবাইরে গাড়ি স্ট্যান্ডকরে ব্যগপত্র নিয়ে ঘরেঢুকতে ধৃতি একটু বেশি সময়ই নিল।
নীরবে মাথা নিচুকরে গুটিগুটি পায়ে ধৃতি মৃতদেহের পাশে এসে দাঁড়াল,এটাসেটা কথারপর অনন্ত বলল,"পড়েযাওয়ার পরে বাবা একটু সুস্থহয়ে প্রথমেই দিদিকে ফোন করেছিল,
ধৃতি'মনেমনে ভাবল,অপরাধ'বোধে ভুগছে অনন্ত,এতে যদি ওর গ্লানি কমে তো কমুক না,এইভাবনা যদি ওকে নির্দোষ অবস্থানে নিয়েযায় তো যাক,ক্ষতি কি ?
ক্ষতি যা হবার তা তো হয়েইগেছে।
রিঙ্কু তো উপলক্ষ মাত্র,লক্ষ তো আমি,রঘুনাথপুর,টাটা,দুর্গাপুর,পুরুলিয়া যখন যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন,আমি সঙ্গী ছিলাম,এমন কি মলদ্বারে আঙুলদিয়ে জলশৌচ পর্যন্ত করিয়েছি আমি,আমাকে বড় ছেলের মান্যতা দিয়েছেন উনি,
ধৃতি ভাবল,সবার সামনে বারেবারে অনন্ত কি যে বলছে,তা ও নিজেই জানে না,
চল্লিশবছরের ছেলে ঘরে মজুদ থাকতে যদি বিবাহিত মেয়ের সাহায্যে ডাক্তার দেখাতে হয়,এর অর্থ,ছেলেরপ্রতি যে অনাস্থা দেখানো হয়,এবং সেটা জাহিরকরার মধ্যে যে কোন মহত্ত্ব নেই সেই বোধশক্তিটুকুও নেই অনন্তর,
ধৃতি অনন্তের কথায় কান না দিয়ে কাঠ ও কেরোসিনের জোগাড়ে ব্যস্তহয়ে পড়ল।
আবির যে আসতে পারবে না, সেকথা এখনো নিজেরমুখে সে স্বীকার করেনি,তা করাতে হবে,পরে যাতেকরে ভুলবোঝাবুঝির কোন অবকাশ না থাকে,ও বেচারা বড় কষ্ট'পাচ্ছে,জীবনের চলারপথে ছোট ছোট বঞ্চনা,উপেক্ষা, প্রিয়জনের মৃত্যুরপর স্মৃতিতে বড়বেশী প্রকটহয়ে উঠে, একধরনের অপরাধবোধ কুরেকুরে খায়,এই লকডাউন বাপ,ছেলের শেষ সাক্ষাৎটুকু কেড়েনিল,
বিপত্তির লকডাউন আত্মদংশনে আকীর্ণ'হয়ে রইল।
মরা'খবর বাতাসে উড়ে,তাই অনেক সমব্যথী আসছেন,স্বাভাবিক ভাবেই কখন মৃত্যু হল,কি ভাবে হল, এইপ্রসঙ্গ উঠছে,অনন্ত ঘুরিয়েফিরিয়ে সেই একইকথা বলছে,"বাবা,দিদিকেই প্রথম ফোনকরে বলেছিল আমাকে বাইরে কোথাও নিয়েচল,
এই'শোকের আবহেও ধৃতির ঠোঁটেরকোণে হাসি এল,হাঁকদিয়ে বলল ও ভাই হাঁসু,দুটো কাঁচাবাঁশ চাই যে,চিতারপাশে খুঁটিগাড়তে হবে তো,
চলো,আর দেরিকরা যাবে না,রাত্রি দশটা বাজে,দেখছো না বাড়ির পরিবেশ কেমন ভারী'হয়ে উঠছে,
ধৃতি উঠোনথেকে উঠে এসে ঘরের ভেতরে বসল,অন্ধকারে,
আলো জ্বালাবার ইচ্ছে হল না ওর, হয়তো এইমুহূর্তে আয়নায় নিজের মুখদেখার ইচ্ছেনেই বলেই,এমন সময় অশ্রুসিক্ত'রিঙ্কু,ধৃতির কাছেএসে বলল,"ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার আবেদন নিয়ে, ফোনে বাবার যে আর্তির কন্ঠস্বর,আমি কিছুতেই ভূলতে পারছি না,"
ধৃতি বুঝল,রিঙ্কুর'স্নায়ু,পেশি,মস্তিষ্কে এই অপরাধবোধ চারিত হয়েছে, বারবার একইকথা শুনে রিঙ্কু নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেছে, এই বোধথেকে ওকে টেনেতোলা দরকার,এবং তা এখনই দরকার,
ধৃতি,রিঙ্কুর পিঠেহাত রেখে বলল, সব দোষ আমার,ফোনটা উনি আমাকেই করেছেন,তোমার মধ্যেদিয়ে বার্তা উনি আমাকেই দিতে চেয়েছেন,
আমিই প্রকৃত দোষী,
আমিই হত্যাকারী।