নার্সিং হোমের করিডোরে বসে আছে সমৃদ্ধ। চেয়ারে গা এলিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বসলো, প্রায় দেড় ঘণ্টা হয়ে গেল অপারেশন চলছে রিদ্ধির। রিদ্ধি, সমৃদ্ধর সাত বছরের পুত্রসন্তান। নিজেকে ভীষন একা লাগছে আজ, বাবা থাকলে হয়তো পাশে থাকতেন এ সময়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনেই বললো সমৃদ্ধ,"তাড়াতাড়ি ফিরে আয় রিদ্ধি, জানিস তো বাবাই কতটা একা, তোকে ছাড়া।" চশমার কাঁচটা ঝাপসা হয়ে গেল নিমেষে, ঘুমের আবেশে চোখ দুটো বুজে এলো সমৃদ্ধর। মুহূর্তের মধ্যেই কানে ভেসে এলো একটা অস্ফুট আধো আধো ডাক,"বাব্বা! বা...." চমকে উঠলো সমৃদ্ধ, চোখ বুজেই ডাক দিলো,"এই তো বাবা। এই তো আমি।" তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কাটতেই বুঝতে পারলো স্বপ্ন ছিল এটা। স্বপ্ন, বিগত কয়েক বছর ধরে সমৃদ্ধ তো স্বপ্নেই বেঁচে আছে, কখনো অসম্ভব সুন্দর কিছু স্বপ্ন, আর কখনও দুঃস্বপ্ন। পুরোনো কথাগুলো আজ বার বার মনে পড়ছে, মনে পড়ছে সেই দিনের কথা যেদিন রিদ্ধি প্রথম আসে ওর জীবনে। আজ বার বার মনে হচ্ছে, যদি কেউ পাশে থাকত, কষ্টটা না পারুক স্মৃতিটুকুর ভাগীদার হত, তাহলে হয়তো একটু হালকা হতে পারতো সমৃদ্ধ।
হঠাৎই কাঁধে একটা হালকা হাতের স্পর্শ অনুভব করে চোখ তুলে তাকালো সমৃদ্ধ। ঐশী পাশে এসে বসলো। ঐশী সেনগুপ্ত আবাহমান নামক এক সংবাদ পত্রের রিপোর্টার। ছোটো চুল, জিন্স আর ক্রপ টপ পরা অগোছালো চেহারার ঐশী। রিদ্ধির সব দুষ্টুমির ভাগীদার। সমৃদ্ধর হদিস ও পায় হঠাৎই, রিদ্ধিই ছিল সেই আলাপের সূত্র। সেই থেকে ও সমৃদ্ধর পিছনে পড়ে আছে একটা ইন্টারভিউ-এর জন্যকিন্তু সমৃদ্ধ ওর ব্যস্ত কর্মজীবনের পরে আর সময়ই করে উঠতে পারে না। তবে নাছোড়বান্দা ঐশী রোজই আসতে থাকে, একটু একটু টুকরো কিছু জানার আগ্রহে। আর এই আসা যাওয়ার সূত্রেই ভাব জমে যায়, রিদ্ধির সাথে, সমৃদ্ধর সাথেও হয়ে যায় বন্ধুত্ব, ইন্টারভিউ-এর কথা মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। সমৃদ্ধ পেশায় সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত, তারই সাথে একজন ব্যস্ত বাবা।
ঐশী এসে বসলো সমৃদ্ধর পাশে, বসেই বললো,"কতক্ষণ লাগবে?" সমৃদ্ধ উত্তর দিল,"জানি না, ডাক্তার তো বললেন সময় লাগবে।"
"হুমমম।" সমৃদ্ধ বললো এবার,"আজ নেবেন ইন্টারভিউটা?" ঐশী অবাক চোখে তাকালো সমৃদ্ধর দিকে,তারপর বললো,"আজ পারবেন? আমি তো ভুলেই গেছিলাম।" সমৃদ্ধ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"পারবো, আজ খুব মনে পড়ছে পুরোনো কথা, ইন্টারভিউ না হোক,বলবো আমি।" ঐশী মনে মনে ভাবলো, আজ সেই সপ্রতিভ, সদা হাস্যময় সমৃদ্ধকে ভীষন রকমের ক্লান্ত, বিধস্ত দেখাচ্ছে। আসলে ওর জিয়ন কাঠি যে এখন অপারেশন টেবিলে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, তাই যুদ্ধের পরাজয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকের মতো ক্লান্ত, শ্রান্ত মনে হচ্ছে, ওকে। পুরোনো স্মৃতিচারণ হয়তো প্রাণশক্তি সঞ্চার করবে ওর মধ্যে।ঐশী ব্যাগে দেখলো, রেকর্ডারটা আছে, ফোনের রেকর্ডারটা অন করলো ঐশী।
"সেদিন ছিল বাবার জন্মদিন। প্রতি বছরের মতো সেবারো ঘুম থেকে উঠে মনে পড়লো বাবার কথা, ওই বছরটা আর সব বছরের থেকে ছিল অনেক আলাদা, কারণ ওঈ বছর বাবা ছিলেন না। কারণ বাবা ওই বছরই কয়েক মাস আগে আমাদের ছেড়ে, এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার আদর্শগুলো আজও মনে রয়ে গেছে। বাবা প্রতিবছর এই দিনটা একটা অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের সাথে কাটাতেন। আমিও বরাবর বাবার সাথেই যেতাম। তাই ঠিক করলাম প্রতিবারের মতোই এবারো যাবো, কিন্তু একাই যেতে হবে এবার, কারণ বাবা চলে যাওয়ার পর মা আর তেমন কোথাও যেতে না। তাই আমিই গেলাম। টাকির এক অনাথ আশ্রম, প্রতিবারের মতো সেবারো ট্রেনে চেপে বসলাম। জানেন ঐশী বাবা বরাবর ট্রেনে চড়তে ভালোবাসতেন, আর বাবার সাথে থেকে আমিও।" এইটুকু বলার পর ফোনটা বাজলো সমৃদ্ধর। কথোপকথনের ধরন থেকে ঐশী বুঝতে পারলো ফোনটা সমৃদ্ধর মা করেছেন, রিদ্ধির খবর নিতে। সমৃদ্ধ ওটির দিকে গেল, ডাক্তারের সাথে কথা বলে, ফোনে কথা বললো, পায়চারি করতে করতে। তারপর আবার ফিরে এল ঐশীর দিকে ।
ঐশী বলে,"কী হলো খবর পেলেন কিছু?"
"হুমমম অপারেশন চলছে,এখনি কিছু বলা যাবে না।"
"চিন্তা করবেন না। He will be fine."
সমৃদ্ধ একটু জল খেয়ে একবার ঘড়ির দিকে, একবার ওটির দিকে তাকালো, তারপর বললো,"হুমম। ঠিক তো ওকে হতেই হবে।" ঐশী রেকর্ডারটা আবার অন করলো,"বলবেন?"
সমৃদ্ধ আবার বলতে শুরু করলো,"তারপর ট্রেনে চেপেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। টাকির নদীর ধার ঘেষে অনেক গেস্ট হাউস, সেই রাস্তা রিক্সা করে গিয়ে পৌঁছলাম, সেই অনাথ আশ্রমে, যেখানে আমার আর বাবার বহু ফেলে আসা স্মৃতি জড়িয়ে ছিল।" এই অবধি বলার পরেই ঐশী বললো,"ওখানেই তো প্রথম..!" ঐশীকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে থাকলো সমৃদ্ধ,"হুমমম, ওখানেই। প্রতিবছর এইদিনে গোটা দিনটা ওখানে কাটাতাম, প্রতিবছরই নতুন নতুন মুখ দেখতাম, কারণ পুরোনোরা নতুন মা-বাবা পেয়ে যেত। এবছরও তাই হলো, একঝাঁক নতুন মুখ। নতুন জামা, চকোলেট পেয়ে, কতো খুশি ওরা, ওদের ওই সারল্য বড্ড আর্কষণ করতো আমায়। ছোটোদের খুশি করা খুব সহজ, আসলে ওদের মনে আমাদের মতো জটিলতা থাকে না তাই। ওই একঝাঁক নতুন মুখের সাথে যখন জমিয়ে গল্প বলার আসরে ব্যস্ত আমি, হঠাৎ আমার ট্রাউজারে একটা আলতো টান পড়লো, পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি এক পুরোনো মুখ। এক পুঁচকে যাকে গত বছরও দেখেছি, বোধ হয় তার আগের বারও।" এবার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো সমৃদ্ধর, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"জানেন ওই দিনটা কখনও ভুলবো না আমি, ও আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চাদের মতো ছিল না, ওকে দেখলেই বোঝা যেত ওর অস্বাভাবিকতা। নিষ্পাপ চোখ দুটো যেন কিছু বলতে চাইছে, আমি তাকাতে আবার আলতো টান দিল আমার ট্রাউজারে। আমি একটু নীচু হলাম, দেখি সারা মুখে হাতে রং মাখা, ওর ছোট্ট হাতটা আলতোভাবে বোলালো আমার মুখে। তারপর ওই হাত দিয়ে আমার হাত ধরলো।" ঐশী অবাক দৃষ্টিতে দেখছে সমৃদ্ধর দিকে। কথাগুলো বলতে বলতে সমৃদ্ধর চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে আসছে। সমৃদ্ধ চোখটা মুছলো তারপর আবার বলতে শুরু করলো,"হাত ধরে নিয়ে গেল একটা ঘরের কোণে, সেখানে দেখি কতগুলো কাগজ আর রং পেন্সিল ছড়ানো....।" সমৃদ্ধর বলা কথাগুলো রেকর্ডারে রেকর্ড হতে থাকলো, আর ঐশীর যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলো প্রথম দিন, রিদ্ধির সাথে আলাপের দিন, বেশি আগে নয় এই তো কয়েক বছর আগের কথা।
(১)
তখন নতুন চাকরি ঐশীর। রিপোর্টার জীবন খুব যে সুখকর নয়, তা চাকরির শুরুতেই বুঝতে পারে সে। প্রথম দিনেই চিফ এডিটর জানান," নিউজ পেপারে সেই খবরই প্রাধান্য পায়, যে খবরে মশলা থাকে, না থাকলে মশলা তোমরা মেশাও। Make is spicy! না হলে রিডার খাবে না। উপকরণ যাই হোক, আমাদের কাজ রান্না করা আর সুন্দর থালায় সাজিয়ে পরিবেশন করা। Media is the ultimate truth, mirror of the society, আমরা যা দেখাই দর্শক তাই দেখে, 10% অন্যরকম ভাবে, ভাবুক, আমাদের টার্গেট বাকি 90%।" বরাবর যে স্বপ্ন দেখেছিল ঐশী সৎ সাংবাদিক হওয়ার, তা এক নিমিষে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায় সেদিন। তারপর থেকে সত্যি খোঁজা হয়নি বিশেষ। তবু ঐশী এখনও স্বপ্ন দ্যাখে, কোনো একদিন নিশ্চয়ই এমন একটা কিছু হবে যে সত্যের বার্তাকে ও মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবে। তাই কাজের ফাঁকে ও আজও গল্প খোঁজে এমন মানুষের গল্প যারা জানে বেঁচে থাকার মানে, যে গল্প পলিটিক্যাল নোংরামি নয় বা ফিল্মি কেচ্ছা নয়, যে গল্পে নিরাশা আর হতাশাকে জয় করে বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পাবে মানুষ, তেমন গল্প। কখনও সে গল্প ছাপে ভিতর পাতায় ছোট্ট কলামে, কখনও ছাপেও না। সমৃদ্ধর সাথে ওর আলাপ হঠাৎই। প্রথম আলাপ অবশ্য রিদ্ধির সাথেই, সমন্বয় বোধ নিকেতনে। ওখানকার বাচ্চাদের নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করার ইচ্ছে ছিল বহুদিনের, তাই পারমিশন করিয়ে নিজের ক্যামেরা নিয়ে এক ছুটির দিনে বেরিয়ে পড়েছিল ঐশী।
ওখানে বিভিন্ন বাচ্চা আসে, তাদের বিভিন্ন সমস্যা, কারো শারীরিক, কারো বা মানসিক। ছোট্ট ছোট্ট মানুষ বিনা দোষেও যেন অপরাধী। শিশুরা সব সময়ই সরল, কিন্তু এমন শিশুরা, যাদের নিজেদের কথা, নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে অনেক কষ্ট করতে হয়, তাদের মধ্যে একটা আলাদা টান অনুভব করে ঐশী, একটা দুরন্ত প্রচেষ্টা থাকে ওদের মধ্যে, নিজেকে বোঝাবার। সেখানে গিয়ে ও জানতে পারে বহু মানুষের গল্প। জানতে পারে, রিপন, পাপাই, অনীশার গল্প। জানতে পারে, রিপনের এই শারীরিক অক্ষমতার জন্য ওর বাবা ওর মাকে দায়ী করে, সম্পর্কের পরিণতি দাঁড়ায় ডিভোর্সে, সেই থেকে রিপন শুধু তার মায়ের সন্তান। জানতে পারে পাপাই-এর নিজের মা নাকি তাকে সহ্য করতে পারে না, কারণ তার দাদা যে সম্পূর্ণ সুস্থ, সে তাই ওখানেই থাকে, তার বাবা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসে, ছুটিতে বাড়ি নিয়ে যায়, ব্যস ওটুকুই।
আলাপ হয়েছিল অনীশার মা'র সাথে। অনীশা প্রিম্যাচিওর চাইল্ড, ওর খাদ্যনালী গঠন ঠিক মতো হয়নি। লালগোলা থেকে প্রতিদিন কোলকাতা যাতায়াত করেন ওর মা। কারণ এখনও আমাদের দেশের প্রত্যন্ত জায়গায় এই ধরণের স্কুল নেই, নেই উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। আবার নিজের সন্তানকে কাছ ছাড়াও করতে পারেন না তিনি। ঐশী মনে মনে ভাবে,"কত মানুষের কত যুদ্ধ আর আমরা পেপারে কী ছাপাই? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রেমিক বা প্রেমিকার আত্মহত্যার গল্প কিংবা কোন নেতা কার সাথে পরকীয়া করছেন! কিংবা কোন নায়িকা কোন খেলোয়াড়কে বিয়ে করছেন! মাঝে মাঝে লজ্জা হয় এগুলো দেখে।"
ঐশী ওদের সাথে অদ্ভুতভাবে মিশে যায় সেদিন, খেয়ালই করে না,ওর ক্যামেরা ছাড়াও কারো ক্যানভাসে ওর ছবি ফুটে ওঠে। রিদ্ধি এসে পিছন থেকে ঐশীর হাতটা ধরে, ঐশী ঘুরে তাকাতেই বছর পাঁচেকের এক খুদের প্রথম কথা,"দি.....দি।" বাকিটা ইশারায় বোঝায় ওর সঙ্গে যাওয়ায় জন্য। তারপরের ছবিটা স্থির ছবি হয়ে গেঁথে যায় ঐশীর মনে। ক্যানভাসে অনেক রঙের ছটায় ছোট ছোট কয়েকটা বাচ্চার সাথে খেলছে একটা মেয়ে। ঐশী দেখে খুশিতে লাফিয়ে বলে,"এমা এটা তো আমি!!!" ছবিটা এতটা প্রাণবন্ত, জীবন্ত যেন মনে হচ্ছে একটু আগের পুচকেগুলোর হাসির শব্দ যেন শুনতে পায় ঐশী ওই ছবি থেকে। ছবিটা দেখেই ঐশী তার গাল টিপে বলে,"ওরে বাবা, এতো সুন্দর ছবি, কে আঁকল এটা?" বাচ্চাটার মুখে এক অনাবিল হাসি খেলে যায়, ঘাড় কাত করে বললো,"আ...আ...মি..মি।"
ঐশী আবারও বলেছিল,"তুমি এত সুন্দর আঁকো? আমায় শিখিয়ে দেবে?"
খুশিতে হাততালি দিয়ে ও বলেছিল,"দে..দে..ব..বো। দে....বো....দে...এএএ...বো।"
ওর হাততালি শুনে বাকি বাচ্চাগুলোও হাততালি দিয়ে উঠেছিল।
তারপর ঐশী জিজ্ঞেস করেছিল,"তোমার নাম কী?"
"রি....রি...দদ।"
ওখানেই এক শিক্ষিকা তখন বলেন,"ওর নাম রিদ্ধি।"
"ও তো দারুন আঁকতে পারে,এ ছবি নিয়ে তো এক্সিবিশন হওয়ার মতো!"
"হুমমম। they all are very talented. That's why they are special."
ঐশী ওই শিক্ষিকার থেকেই রিদ্ধির সম্পর্কে জানতে পারে, আর জানতে পারে, আর-এক অনন্যসাধারণ মানুষ সম্পর্কে, যে হলো রিদ্ধির বাবা, সমৃদ্ধ। তবে রিদ্ধিকে ভালোবেসেই সমৃদ্ধকে চেনা। কিন্তু ওকে নিয়ে লেখার চিন্তা মাথায় আসে কিছু পরে।
(২)
হঠাৎই সমৃদ্ধর কন্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পায় ঐশী। সমৃদ্ধ বলে,"রেকর্ডারটা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। শুনছেন!"
ঐশী খেয়ালই করেনি। ঐশী তাকিয়ে বললো,"sorry, আমি আসলে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গেছিলাম।"
সমৃদ্ধ বললো,"No no it's ok."
ঐশী বললো,"মিসেস মুখার্জী?"
"রিদ্ধির এই ক্রাইসিসটা তো হঠাৎ করে এসে গেল না!সার্জারিটা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি হবে জানতামই না যে। ও একটা কনফারেন্স-এ কানাডা গেছে। শুনেই ব্যাক করছে। এসে যাবে।"
রেকর্ডার সেট করে ঐশী বললো, "বলতে পারেন আপনি। ওইদিনই প্রথম দেখা তবে। আপনাকেও ছবি দেখাতেই ডেকেছিল ও?"
সমৃদ্ধ হালকা হেসে বলে,"হ্যা।" তারপরই প্রশ্ন করে,"আমাকেও মানে?"
এবার ঐশী হেসে বললো,"আমাকেও যে।"
"ওহহ হহ! মনে পড়েছে! আপনার ছবি এঁকেছিল তো! ওইদিনই? আমায় পরে দেখিয়েছিল। তখন তো ভালোভাবে কথাও বলতে পারত না, এদিকে ছবি আঁকায় ও বরাবরই খুব ভালো, আরও ছোটো থেকে।"
"হ্যা। ওইদিনই। আমি ভাবতেই পারিনি ওটা ওর আঁকা। কিন্তু ও যখন এক গাল অনাবিল হাসি দিয়ে বোঝালো ওটা ওর আঁকা,তখন বুঝলাম।"
সমৃদ্ধ হাসতে হাসতে বললো,"আমিও সেদিন গিয়ে দেখি রং পেন্সিল ছড়ানো ঘরে এককোনে আর্ট পেপারে, রঙের অদ্ভুত খেলা। জানেন ওর বয়স তখন কত হবে ওই আড়াই মতো।"
ঐশী বললো,"ওর এই আঁকাটা গড গিফ্টেড, দেখবেন ও খুব সাইন করবে একদিন।"
ওটির দিকে আবার একঝলক দেখে সমৃদ্ধ বললো,"প্রার্থনা করবেন যেন তাই হয়।"
ঐশী হেসে বললো,"হবে বই কি। ওর বাবার যুদ্ধ ও বিফলে যেতে দিতেই পারে না।"
সমৃদ্ধ আবার বলতে থাকে,"সেদিন ওকে যিনি দেখাশুনা করতেন ওনাকে বললাম ওকে কেন কেউ নিচ্ছে না?"
ভদ্রমহিলা বেশ একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর করলেন,"ওকে!কে নেবে!আপনি দেখে বুঝতে পারছেন না?"
সেদিনই জানলাম," ওর অসুস্থতার কারণে ওর মা-বাবা মানে ওর বায়োলজিক্যাল পেরেন্টস ওকে হাসপাতালেই ফেলে যান। আর একি কারণে কেউ ওকে নিতে চায় না।"
ঐশী বললো এবার,"আমাদের সোসাইটিতে এখনকার ফাস্ট লাইফে সেটাই তো স্বাভাবিক সমৃদ্ধ বাবু! আপনি এতটা মনের জোর কোথায় পেলেন।"
"আপনি বললেন না ও গড গিফ্টেড! হয়তো ওই শক্তি তো ওর কাছেই পেলাম। ওই মহিলার কাছে ওই কথা শুনে আবার ওর পাশে বসলাম। ও এক মনে কাগজে আঁকিবুঁকি কাটছে আর মুখ দিয়ে কোনো একটা অস্ফুট স্বর বের করছে। আমি গিয়ে পাশে বসতে একগাল অনাবিল হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। মুখ দিয়ে লালা পড়ে যাচ্ছিল জামায়, মুছিয়ে দিয়ে মাথায় হাত দিলাম, তারপর সারাদিন ওর সাথে থেকে বিকেলে যখন যাওয়ার আগে ওকে বলতে গেলাম, সে কি রাগ, খালি চিৎকার করে বলতে লাগল না না না!!! সেদিন ওকে ছেড়ে আসতে ভীষন কষ্ট হয়েছিল।"
ঐশী বললো,"আর কিছু বলেনি?রাগ কমেছিল?"
"হুমমম। বলেনি আবার!! কী রাগ ছেলের!! আসলে ও তো অন্যরকম। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়। ওর মনের ভাব প্রকাশের ভঙ্গিটা অন্যরকম। খুব জেদী। শুনেছিলাম সেদিন সারারাত কেঁদেছে।"
"ওর অ্যাকচুয়াল প্রবলেমটা কী? মানে আমি জানি, তাও লেখার সুবিধার জন্য যদি একটু ডিটেলিং পাই!"
"ওইদিনই জানতে পারি, ও ডাউন সিন্ড্রোমের পেসেন্ট। তা ছাড়া ওর হার্টে হোল আছে। ওটারই অপারেশন আজ।"
ওখানকার এক স্টাফ বলেন,"এমন অসুস্থ বাচ্চাকে কে নেবে বলুন।"
শুনে খুব অবাক লেগেছিল, যে বাচ্চা অসুস্থ, যে সন্তান নিজের কাজ নিজে করতে পারে না, তারই তো বেশি প্রয়োজন মা-বাবার। কথাটা যখন ওনাকে বললাম উনি বললেন,"কে ঝামেলা নিতে চায় দাদা!" কথাটা শুনে রিদ্ধির দিকে তাকালাম, ওই নিষ্পাপ শিশুটাও কারোর কাছে ঝামেলা হতে পারে?" সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এলাম, কিন্তু ওর মুখটা ভাসতে থাকলো। বাড়ি ফিরে, অফিসে সবসময়। শেষে মাকে বললাম ওর কথা। জানালাম নিজের ইচ্ছে।
সমৃদ্ধকে থামিয়ে দিয়ে ঐশী বললো,"ইচ্ছে!"
"হ্যা । ওকে যখন কেউ নেয়না তাহলে বরং আমিই আনি ওকে!"
"কিন্তু আপনি তো অবিবাহিত তখন? আর আপনার মা! তিনি রাজি হলেন?"
"আপত্তি করেননি তা নয়। বলেছিলেন একটা ছেলের পক্ষে একটা বাচ্চার দায়িত্ব পালন অত সহজ নয়, তাও আবার অমন অসুস্থ বাচ্চা। মা কে অনেক বোঝাই, শেষে বলি যে তুমি চলো আমার সাথে,দ্যাখো ওকে।"
"তারপর?"
"আমারই তো মা! আমার মধ্যে যেটুকু যা ভালো তা তো মা-বাবার থেকেই পাওয়া।"
"আর তারপরেই আপনার আসল লড়াই শুরু।"
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সমৃদ্ধ, তারপর বললো,"হুমম। প্রথমে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করি। জানতে পারি, down syndrome is a genetic disorder যেটা কিওরেবল নয়, তবে ঠিক ঠিকঠাক যত্নে এর তীব্রতা কমে। আর হার্টে হোলের ব্যাপারে জানলাম ওটা ও একটু বড়ো হলে সার্জারি করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। জানাই ছিল না, যে দেশে ছেলেদের বিয়ের বয়স ২১বছর, সেখানে একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার বয়স ৩০। এদিকে আমার বয়স তখন ২৬। তা ছাড়া ছেলেদের নাকি একক পিতৃত্বের অধিকার দেওয়া হয় না।"
এই অবধি বলেই ওটির দিকে তাকালো সমৃদ্ধ, একজন নার্স বেরোচ্ছেন দেখে ছুটে গেল সেদিকে, নার্স ওকে দেখেই বললেন,"Don't worry he is fine."
এরই মধ্যে, করিডোরের অপর প্রান্ত থেকে হন্তদন্ত হয়ে এলেন অনিন্দিতা, সমৃদ্ধর স্ত্রী, রিদ্ধির মা। সমৃদ্ধকে দেখেই একটা ঢোক গিলে বললো,"কী খবর? কেমন আছে ও?"
সমৃদ্ধ ওর কাঁধে হাত রেখে বললো,"এই মাত্র নার্সের সাথে কথা হলো ঠিক আছে তোমার ছেলে।" অনিন্দিতা ছলছল চোখে বললো,"তোমার খুব ঢকল গেল, তুমি বাড়ি যাও এবার।"
"তোমার কনফারেন্স অ্যাটন্ড করা হলো না যে।"
"কোনো কিছু আমার রিদ্ধির চেয়ে বেশি ইম্পর্টেন্ট নয়, জানো তুমি।"
ঐশী পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিল ওদের কথোপকথন। ভাবছিল কী অদ্ভুত দুটো মানুষ। এদের দেখে কে বলবে এরা বায়োলজিক্যাল পেরেন্ট নয় রিদ্ধির। অনিন্দিতা হলেন সেই শিক্ষিকা, সমন্বয় বোধ নিকেতনে যার কাছে প্রথম সমৃদ্ধর কথা জেনেছিল ঐশী। তখনো বোধ হয় ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক ছিল না। রিদ্ধিই ওদের সম্পর্কের যোগসূত্র। রিদ্ধিকে পাওয়ার আইনি লড়াইয়ের গল্প অনিন্দিতার কাছেই শুনেছিল ঐশী। বছর দেড়েকের আইনি যুদ্ধে অবশেষে জয়ী হয় সমৃদ্ধ, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধান মন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপতি কারোকে আবেদন করতে বাদ রাখেনি ও। অবশেষে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অ্যাডপটেশনের বয়স কমিয়ে ৩০ থেকে কমিয়ে ২৫ করা হয়, আর সমৃদ্ধ রিদ্ধির কেসকে স্পেশাল হিসেবে কাউন্ট করা হয়। সমৃদ্ধ ভারতের প্রথম একক পিতৃত্বের অধিকার পায়। ইতিমধ্যে ওটি থেকে ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এসে বলেন,"Operation successful. চিন্তার কারণ নেই। তবে ৭২ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে।"
অনিন্দিতা বললো,"কেন?"
ডাক্তার বাবু বললেন,"ওটা রুটিন প্রসেস। Don't worry, your son is very brave like you."
সমৃদ্ধ বললো এবার,"দেখতে পারি ওকে?"
"ওটি থেকে বের করার সময় দেখিয়ে নেওয়া হবে, বেডে দিলে দেখা করে আসবেন। বেশি কথা বলবেন না।ওকে আমরা এখন একটু সিডেটিভ দিয়ে রাখবো।"
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সমৃদ্ধ দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সোফায় বসলো। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে গেল। অনিন্দিতা ওর পাশে এসে বসলো। ঐশী বুঝতে পারলো এই মুহুর্ত ওদের একান্ত, ওর এবার বেরোনো দরকার, তাই কিছু না বলেই ও বেরিয়ে পড়লো।
(৩)
নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে অটোয় উঠলো ঐশী। মনে মনে ভাবলো যে এতদিন শুধু কেরিয়ারের পিছনে ছুটল ও। এমন একটা গল্প চোখের সামনে লেখাই হলো না, এতদিন পর সময় হলো, মনে হলো, অথচ এখন কি ছাপানো হবে এই গল্প পেপারে!তবু ও লিখবে নিজের জন্য হলেও লিখবে। এমন সময় অটোতে একটা গান বেজে উঠলো,
"তু মেরা দিল, তু মেরি জান,
O I love you Daddy...
তু মাসুম তু শয়তান
But you love me Daddy..."
গানটা শুনে ঐশীর মনে পড়লো সমৃদ্ধর বাকি যুদ্ধের কথা। কারণ রিদ্ধিকে নিজের কাছে পাওয়ার পরবর্তী পথ মসৃণ ছিল না। সেই পথের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল ঐশী। ডাউন সিন্ড্রোম এক জেনেটিক ডিস অর্ডার। এইসব বাচ্চাদের সাথে স্বাভাবিক বাচ্চার অনেক তফাৎ। ওদের মস্তিষ্কের বিকাশ অনেক ধীর গতিতে হয়। যে কারণে যে জিনিসগুলো একটা স্বাভাবিক বাচ্চার শিখতে খুব অল্প সময় লাগে, সেগুলোই ওদের শিখতে কয়েক দিন কয়েক মাস লেগে যায়, যা মা-বাবার কাছে ধৈর্যের পরীক্ষার সমান হয়। রিদ্ধির ক্ষেত্রে ভালো দিক ছিল ও খুব ভালো আঁকতে পারত। তাই ওকে কিছু এঁকে বোঝালে ও তাড়াতাড়ি বুঝতে পারত। ঐশীই সমৃদ্ধকে একজন স্পিচ থেরাপিস্টের সন্ধান দেয়। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কাজের চাপ সামলেও সমৃদ্ধ রোজ নিয়ে যেত রিদ্ধিকে সেখানে। রিদ্ধিকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছিল ঐশী, সমৃদ্ধকে বলেছিল,"কোনোদিন সময় করে শুনবো আপনার কথা, ততদিন পর্যন্ত শুধু রিদ্ধির পাশে থাকতে চাই। আমার ভালো লাগে।" মনে আছে একদিন সমৃদ্ধর বাড়ি গিয়ে দেখে সারা ঘর হুলস্থুল, কাকিমাকে জিজ্ঞেস করতে বলে,"বাবা ছেলে পড়াশোনা করছে।" ঘরে ঢুকে দেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুজনে মুখভঙ্গি করছে। ঐশী বুঝতে পারলো এটা স্পিচ থেরাপির অংশ, নিজের প্রতিচ্ছবির সাথে কথা বলা, জিনিস দেখিয়ে ছবি দেখিয়ে চেনানো। ছেলে পালায় করবে না বলে, বাবাও দৌড়োয় তার পিছনে। রিদ্ধির সাথে থেকে সমৃদ্ধও শিশুসুলভ আচরণ করত। সেগুলো দেখে ঐশী হেসে ওঠে আর বলে,"আমিও খেলবো রিদ্ধি সোনার সাথে।"
এভাবেই কেটে গেছিল আরও একটা বছর। সে বছর সমৃদ্ধর জন্মদিনে ঐশী ওদের বাড়ি গেছিল। ঘরে ঢোকার সাথে সাথেই সমৃদ্ধ বলেছিল, "সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য।" এর মধ্যে ছোটোজন এসে বলে,"বা...বা....বাবা...জ...ম..ম..দি...দি...ন!"
সমৃদ্ধ আবাক হয়ে তাকালো, অনিন্দিতা এসে দাঁড়ালো রিদ্ধির পিছনে,"A very happy birthday to you..." সমৃদ্ধ কেঁদে ফেলেছিল সেদিন, প্রথমে রিদ্ধিকে জড়িয়ে, তারপর অনিন্দিতার হাত ধরে। ওদেরকে দেখে কিছুটা পিছিয়ে আসে ঐশী। বুঝতে পারে সমৃদ্ধর দেওয়া সারপ্রাইজের নাম অনিন্দিতা। আসলে সেদিন ঐশীর কাছেও একটা সারপ্রাইজ ছিল দেওয়ার। কিন্তু মনের কথা মনে রেখেই সেদিন সেখান থেকে চলে আসে ঐশী, সেই কথা আর বলা হয় না কোনোদিনই। পুরোনো কথাগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে, হঠাৎ অটোচালকের ডাকে সম্বিত ফিরে পায়, বুঝতে পারে ওর চোখের কোণটা ভিজে গেছে। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি লিখতে বসলো ঐশী। এক অপরাজিত বাবার গল্প, যে গল্পের চরিত্র হয়তো ও নিজেও হতে পারত, কিন্তু ও শুধু কথকই রয়ে গেল।
পরদিন সকালে সমৃদ্ধ ফোন করে ওকে জানালো যে রিদ্ধি ভালো আছে। সারারাত জেগে লিখে সেই লেখা নিয়ে ঐশী গেল তার চিফ এডিটরের কাছে। চিফ এডিটর পড়লেন লেখাটা। খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন,"Look Aishi. Its a quite nice story. কিন্তু দ্যাখো এখন পলিটিক্যাল ইশ্যুগুলো তুঙ্গে as you know। তা ছাড়া সেইফ করিনার ছেলে হলো, পাঠকরা এই খবর পড়বে না। আর এটা পুরোনো নিউজ, ফ্রন্ট পেজে দেবো কেন?"
"স্যার আমাদের তো গল্পের জন্য এক্সট্রা পেজ থাকে রবিবার। তার জন্য তো রাখাই যায় এই নিউজটা!"
"You are not a writer Aishi. We need famous writer there."
"স্যার আমার লেখা খারাপ কিনা আপনি এডিটরদের চেক করতে বলুন। The story of Samridho will be an inspiration for this generation যেখানে মানুষ তার মনুষত্ব থেকে অনেক অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।"
"ঐশী আমার প্রথম দিনের কথাগুলো তুমি বোধ হয় ভুলে গেছ। পাঠকরা মশলা চায়, মশলাদার খবর। এখন মানবিকতা কোথায় বলতো?"
"ভালো মানুষ কি কেউ নেই, যারা এই গল্প পড়বে?"
"কেন থাকবে না। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তারাও তখনই মানবিকতার মূল্য দেয়, যখন সেই মানবিকতা স্বীকৃতি পায়, প্রচার পায়। প্রাইজ, অ্যাওয়ার্ড। Otherwise it don't deserve a page...একটা ছোটো কলাম দিতে পারি, ব্যস।"
ঐশী কোনো উত্তর দিল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। পরদিন বিকেলে ঐশী রিদ্ধিকে দেখতে গেল নার্সিং হোমে। ঐশীকে দেখেই একগাল হাসি। ঐশীর ওর মাথায় হাত রেখে বললো,"তাহলে কেমন আছে আমার চ্যাম্পিয়ান?"
করুন মুখে তাকিয়ে স্যালাইনটা খোলার জন্য টানতে যায় রিদ্ধি, ঐশী সাথে সাথেই বলে,"এমা এ তো একটু ব্যথা। মশার কামড়ের মতো, আমার রিদ্ধি এটাও সহ্য করতে পারছে না!! I thought Ridhi is very strong like...like Bahubali..."(বাহুবলী রিদ্ধির খুব প্রিয় সিনেমা।) ব্যথা ভুলে খিলখিল করে হেসে ওঠে পুচকেটা। ওর মাথায় হাত বোলায় ঐশী।
২০ বছর পর,
সকালবেলা নিউজ পেপারটা খুললো, সমৃদ্ধ, ফ্রন্ট পেজটা দেখেই ডাকলো,"অনি এই অনি দেখে যাও।"
খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজ জুড়ে রিদ্ধির ছবি। ওই বছর ভারতের হয়ে, আর্ট অ্যান্ড পেন্টিং-এর সবচেয়ে বড় সম্মান নিতে ইউনাইটেড স্টেটস-এর মাটিতে পা রেখেছে রিদ্ধি মুখার্জি, অ্যাওয়ার্ড হাতে ওর ঝলমলে ছবি বেরিয়েছে পেপারে। আর সাথে বেরিয়েছে তার জীবনের গল্প। অপরাজেয় বাবার এই অনন্যসাধারণ সন্তান আজ নিজের জায়গা করে নিয়েছে নিজের গুণে খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। আর সেই খবরের নীচে লেখা রয়েছে রিপোর্টারের নাম....ঐশী সেনগুপ্ত।
নিউজ পেপার অফিসে নিজের কেবিনে, খবরের কাগজটাকে বুকে জড়িয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল ঐশী। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনেই বললো, এইভাবেই এগিয়ে যেও বাবা, কাউকে যেন তোমার জায়গা করে দিতে না হয়, তুমি নিজেই নিজের জন্য জায়গা করে নাও, তাই তো তোমার বাবা তোমার এক্কেবারে যথার্থ নামকরণ করেছেন, তোমাকে পেয়ে আজ শুধু তোমার মা-বাবা নন, গোটা দেশ রিদ্ধ, গর্বিত, you are truly my champ।
দ্রষ্টব্য
গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক নয়। ভারতবর্ষের প্রথম একক পিতৃত্বের অধিকারী ২৬বছরের বাবা আদিত্য তিওয়ারি ও তার সন্তান অবনীশ তিওয়ারির জীবন থেকে অনুপ্রাণিত। ওনার কথা আমার মনের গভীরে দাগ কাটে, সেই থেকেই এই গল্পের সৃষ্টি, আদিত্য আর অবনীশের জীবনের সাথে আমার কল্পনার মিশ্রণেই জন্ম এই গল্পের। আশা করি, আপনাদের ভালো লাগবে। ভুল ত্রুটি হলে মার্জনা করবেন।