• 17 August 2020

    ছোট গল্প

    পাকা দেখা

    5 118

    পাকা দেখা

    সংহিতা ঘোষাল

    সুমিত আজ ল্যাবরেটরি থেকে বাড়ি ফেরার পর চুপ করে আছে। প্রতিদিন বাড়ি ফিরে ওর কাজ হল হাত-পা ধুয়ে টুকাইএর খোঁজ নেওয়া।টুকাই হল ওর দাদার মেয়ে, মাত্র তিন বছর বয়স। কিন্তু এই বয়সে যা বকবক করে সুমিতের বেশ মজা লাগে। তাই দিনের শেষে ল্যাবের গবেষণার চাপ যেন এক ফুঁয়ে উড়ে যায় টুকাই এর জন্য।আজ টুকাই কাকুর পায়ে পায়ে ঘুরল খানিকক্ষণ। কিন্তু কাকু কিছু না বলায় মায়ের কাছে চলে গেল। মাঝে মাঝে ছোট্ট চোখ দিয়ে অনুসন্ধান করার চেষ্টা করল কাকু কেন এত চুপচাপ। আশা দেবী মানে সুমিতের মা বললেন,"চা হয়েছে খাবি আয়।"

    --"ভালো লাগছে না, খাবো না।"

    --"সেকি রে , শরীর ঠিক আছে তো?"

    --"হুম ঠিক আছে।"

    বলে ও নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ওদিকে মা, বৌদি অবাক।যে ছেলেটা বাড়ি ঢুকে সারা সন্ধ্যায় ভাইজিকে নিয়ে বাড়ি মাথায় করে রাখে,সে হঠাৎ আজ চুপচাপ কেন? টুকাই তো এসব দেখে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে।আজ তাই চুপ করে বসে পুতুল নিয়ে খেলছে ও। রাতে খাবার টেবিলে খেতে দিয়ে সবাইকে আশা দেবী ডাকলেন।সমরবাবু মানে সুমিতের বাবা,দাদা , বৌদি সবাই এল।সুমিত পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির শরীরটাকে যেন টেনে নিয়ে এল খাবার টেবিলে। খানিকক্ষণ খাবার নেড়ে মাত্র একটি রুটি খেয়ে চলে গেল ঘরে। টুকাই কাকুকে বড় বড় চোখ করে দেখল। মাকে কিছু একটা বলতে গেল। কিন্তু সবাই তখন পরস্পরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে আর নিঃশব্দে টেবিলে একটা প্রশ্ন ঘুরছে সুমিতের হল কি?সবাই যে যার ঘরে ঘুমিয়ে গেল।

    ঠিক রাত তিনটে হবে, খাবার টেবিলের কাছে কিছু একটা আওয়াজ শুনে আশা দেবীর ঘুম ভেঙে গেল।কি হলো বেড়াল ঢুকল নাকি? উনি টর্চ জ্বেলে গিয়ে দেখেন সুমিত মাথায় হাত দিয়ে টেবিলে বসে আছে। উনি ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সুমিতের যত কষ্ট‌ই হোক মা মাথায় হাত দিলে সব বলে ফেলে।আজ‌ও তাই করল-

    --"মা খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না।"

    --"আমি তো আছি,কি হয়েছে বল আমায়।

    --"মা আমি নীতাকে ভালোবাসি। আমি ওকে হারিয়ে ফেলব মা।"

    -"নীতা?ক‌ই বলিস নি তো কোনো দিন?"

    --"মা ওকেই তো বলা হয়নি।"

    --"মানে?"

    --"আমি প্রতিদিন ল্যাবে কাজ করে বেরোনোর পর বাস স্ট্যান্ডে ওকে অপেক্ষা করতে দেখতাম। একদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ওকে সেদিন ছাতা দিয়েছিলাম।ও পরের দিন ফেরত দিতে এল। তারপর থেকে প্রতিদিন আমাদের দেখা হয় বাড়ি ফেরার পথে।ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগত।ও ওদের বাড়ির অনেক কথা বলত।আজ হঠাৎ করে বলল কাল নাকি পাকা দেখা। এখন আমি কি করব?"

    এই পর্যন্ত শুনে আশা দেবী চুপ র‌ইলেন। সুমিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নে গবেষণা করে।ওর কাজ অন্তিম পর্যায়ে।আর নীতা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে গবেষণারত। অন্তিম পর্যায়ে কাজ ও খানিকটা মুখচোরা স্বভাবের জন্য ওর নীতাকে বলা হয়নি কথাগুলো। কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় নীতার কাজল মাখা চোখ,টোল পড়া হাসি দেখা ও ব্কবকানি শোনার জন্য অপেক্ষা করে থাকত।বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা দিয়ে পরিচয় শুরু তারপর কিভাবে যে প্রেমের রাজ্যে ওরা অজান্তেই প্রবেশ করেছে তা বুঝতে পারে নি।

    চুপ থাকার পর আশা দেবী বললেন"দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা। ওদের বাড়ি কোথায়?"

    --" হাওড়ার মল্লিক ফটকে।"

    --" হুম সকালে চা খাওয়ার পর তৈরী হয়ে নিস।আর ঐ তুঁতে রঙের পাঞ্জাবিটা পড়বি। ঠিক সাড়ে সাতটায় বেরোবো। এখন একটু ঘুমিয়ে নে। চোখ-মুখ বসে যাবে যে।"এই বলে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘরে ঘুমাতে পাঠালেন। সকালে সকলের জন্য চা আর টুকাইএর জন্য দুধ গরম করে নিজে তৈরী হলেন। দুধে আলতা রঙের শাড়িতে ,কাঁচা-পাকা চুলে আশা দেবীকে বেশ লাগে। সুমিত ও তৈরী। উনি আড় চোখে দেখে নিলেন ছেলেকে,যাক ভালো মানিয়েছে নতুন পাঞ্জাবিটা। সুমিত দীর্ঘদেহী বলে পাঞ্জাবি বেশ ভালো মানায়।সমর বাবু ওদের দেখে বললেন,"কী ব্যাপার গো ? কোথায় চললে?"

    --" দাঁড়াও আগে সব মিটুক এসে কথা হবে।"

    দাদা, বৌদি সব দেখে খানিক চুপ র‌ইল।ওরা দুজন ঠিক আটটায় মল্লিক ফটকে পৌঁছে গেল। তারপর একে ওকে জিজ্ঞাসা করে নীতাদের বাড়ি হাজির হল। কলিং বেল বাজানোর পর দাঁত মাজতে মাজতে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুললেন।

    --" কাকে চাই?"

    --"এটা কি নীতা স্যানালের বাড়ি?"

    --"হুম।"

    --" আপনি কি ওর বাবা?"

    --"হুম, বলুন কি দরকার?"

    --"ভিতরে আসতে পারি? দরকারি কথা আছে।"

    আশা দেবী অনুমতি চাইলেন এবং পেয়ে গেলেন। তারপর দুজনে ওদের বেঠকখানায় বসে নীতার বাবাকে সব কথা বললেন। ততক্ষণে নীতার মাও এসে হাজির।সব শুনে ওনাদের মুখ এমন ভাবে হাঁ যে কে সি দাসের বড় রসগোল্লা একবারে ঢুকে যাবে।তারপরে নীতাকে তলব করা হল। ঘুম জড়ানো চোখে ছোট বিনুনিতে নীতাকে বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে ।সব শুনে মাথা নিচু করে বলল,"গত সপ্তাহে সুমিত বলেছিল ও নাকি সুইজারল্যান্ডে পোস্ট ডক্টরেট করার ডাক পেয়েছেন। আমার ওকে ভালো লাগে।ও যদি চলে যায় আমার কি হবে? আমি বলতে পারি নি। তাই পাকা দেখার ফন্দি করেছি।"সুমিত ছাড়া বাকি সবাই হেসে ওঠে।আর সুমিত তখন মনে মনে বলে ওঠে,"য‌ত‌ই তুমি পাকা দেখার ফন্দি করো,পাকা দেখা কিন্তু আজ সত্যি হয়ে গেল।"

    **********************************************

    সেই সুমিত আজ কুড়ি বছর পর কলকাতার বুকে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিযুক্ত। টুকাই এখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে কাকুর মত গবেষণাকে বেছে নিয়েছে।আর ঘরে তার সঙ্গী পুপাই মানে নীতা আর সুমিতের মেয়ে ।নীতাও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতা।আর আশা দেবী ফ্রেমের মধ্যে থেকে প্রশান্তির হাসি হাসছেন।





    Sanhita Ghosal


Your Rating
blank-star-rating
Sushanta Ganai - (16 September 2020) 5

1 0

শংকর হালদার শৈলবালা - (18 August 2020) 5
সুন্দর লেখা ভালো লেগেছে। একটি পাঠক চক্র তৈরি করলে হয় সবাই সবার লেখা পড়ে উৎসাহিত করা হবে।

1 1