• 29 September 2020

    গল্প

    রহস্যের নাম সমাধি বাবা।

    0 42

    রহস্যের নাম সমাধি বাবা






    -দাদা সমাধি বাবার আশ্রম কোনদিকে বলতে পারবেন?


    রাস্তার পাশে একটা পান দোকানে জিজ্ঞাসা করল শৈবাল।দোকানদার চোখ-তুলে আমাদের দিকে চাইল। তারপর হাত তুলে বলল, -ডান দিকের রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন।


    - আমরা ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম।


    ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছে বিশ্বদা। আমাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, - ইনি কিন্তু একজন সত্যিকারের  মহাপুরুষ। নাহলে এত তাড়াতাড়ি কেউ বিখ্যাত হতে পারেনা। দেখলি একবার জিজ্ঞাসা করতেই বলে দিল। আরে ভারতবর্ষ হল সাধু, মহাপুরুষ, যোগীপুরুষ দের দেশ।কিন্তু অনেকে আছে এই সব সাধু, মহাপুরুষ দের মহিমা বিশ্বাস করতেই চায়না।


    শেষের কথা গুলো যাকে উদ্দেশ্য করে বলা সেই অনিলিখা কিন্তু জানালার ধারে বসে একমনে নিজের মোবাইল নিয়ে খুটূর খুটুর করে যাচ্ছে। বিশ্বদার কথা কিছু শুনলো কি শুনলোনা কিছুই বোঝা গেলনা।


    শনিবারের আসর থেকে আমারা সবাই মিলে নতুন গঞ্জ নামে এই অনামি জায়গায় এসেছি। কোলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। বলা বাহুল্য আমাদের এখানে আসার পিছনে যে মানুষটার উদ্যোগ সবথেকে বেশি সেই মানুষ হল আমাদের বিশ্বদা। বিশ্বদার মূল উদ্দেশ্য সমাধি বাবার দর্শন পাওয়া হলেও আমরা সুধু নতুন যায়গায় ঘোরার আনন্দেই চলে এসেছি। তবে সব থেকে আশ্চর্যর বিষয় হল অনিলিখাও আমাদের সঙ্গে সমাধি বাবার দর্শনে এসেছে। অনিলিখা কে সঙ্গে পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। কারণ আজকাল অনিলিখা খুবই ব্যস্ত। সপ্তাহে পাঁচ দিন অফিস তার পর ছুটির দিন গুলোও নান রকম কাজের সাথে যুক্ত থাকে। শনিবারের আসরেও ওকে আর আগের মত পাওয়া যায়না। সৌভাগ্য বসত কালকের আড্ডায় অনিলিখা এসেছিল।একটু দেরি করেই এসেছিল। আমরা ততক্ষণে এখানে আসার প্ল্যান বানিয়ে নিয়েছিলাম। ওকে যখন এই ব্যাপারে জানালাম ও নিজেই আমাদের সাথে আসতে চাইল। ভেবেছিলাম অনিলিখা সঙ্গে এলে ওর গল্প শুনতে শুনতে সময়টা কেটে যাবে। কিন্তু কোথায় কি।জানালার পাশে বসে সেই যে মুখে কুলুপ এঁটেছে। সমাধি বাবার আশ্রমে পৌঁছে গেলাম সেই কুলুপ আর খুললনা। মাঝে দেবসেনাপতি আর প্রতীক অনিলাখার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল।  কিন্তু অনিলিখার অমনোযোগিতার কারণে কথা বেশি এগোয়নি।


    গাড়ি থেকে নেমে আমরা সবাই সমাধি বাবার আশ্রমের দিকে পা বাড়ালাম। এর মধ্যেই বেশ ভিড় জমে উঠেছে।গেটের কাছে যখন পৌঁছলাম হঠাৎ কোথা থেকে কপালে তিলক কাটা ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটা বেঁটে খাটো ধুতি লোক অনিলিখার সামনে এসে দাঁড়াল দেখে মনে হল সে এই আশ্রমেরই লোক। লোকটা বলল, - দিদি আপনিতো আজকে বাবার সাথে কথা বলবেন। আপনার জন্য সামনে জায়গা রাখা আসুন আমার সঙ্গে।”


    - একটু দাঁড়ান আজকে আমার সঙ্গে আমার বন্ধুরাও এসেছে। আপনি ওদের জন্য যদি একটা ব্যবস্থা করতে পারেন।


    -ঠিক আছে আমি দেখছি। আসুন আমার সাথে।


    আমরা সবাই হতভম্বের মত ওদেরে কথা শুনছিলাম।বিশ্বদা একটা ঢোক গিলে বলল, - মনে হচ্ছে অনিলিখা আগেও এখানে এসেছে। কই আমদের আমাদের তো কিছুই জানায়নি।- তার পর একটু থেমে আবার বলল, - মনে হচ্ছে ইনি সত্যি সিদ্ধ পুরুষ।


    অনিলিখার কারণে একদম সামনে না হলেও আমরা মাঝামাঝি একটা ভালো যায়গা পেলাম।এখান থেকে সব কিছুই ভালো ভাবেই দেখা যাবে। অনিলিখা না থাকলে এই ভিড়ে আমরা কেউই হয়তো বসার যায়গা পেতামনা।


     একটা ব্যাপার আমাকে খুব অবাক করল। এখানে ভিড়ের বেশির ভাগটাই দখল করে আছে কিশোর কিশোরীরা। যেটা সচরাচর কোথাও দেখা যায়না। আর এত ভিড় হওয়া স্বত্বেও সবাই কেমন চুপচাপ।কেউ কোনও শব্দ করছিলোনা। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল, -বাবা এসেছেন। বাবা এসেছেন।  - সামনে তাকিয়ে দেখি গেরুয়া বসন পরিহিত এক সৌম্য দর্শন  সাধু দাঁড়িয়ে আছেন।বিশ্বদা এখান থেকেই হাতজোড় করে বলে উঠল,  -বাবার চোখ মুখ থেকে কেমন জ্যোতি প্রকাশিত হচ্ছে দেখ।


    তার পর হাত জোড় করে বলল, -জয়। সমাধি বাবার জয়।


    -সত্যি কথা বলতে আমরা কিন্তু কোনও রকম জ্যোতি দেখতে পাচ্ছিলামনা।


     চার পাশে অনবরত শাঁখ,ঘণ্টা, কাঁসর বেজে চলেছে।বম ,বম আওয়াজ আর ধুনোর গন্ধে পুরো আশ্রম ঢেকে পড়েছে। তার পরে শুরু হল বাবার উদ্দাম নাচ।বিশ্বদা সেই যে হাত যোড় করেছে হাত আর খোলেনই। অনিলিখা সামনে চুপ চাপ বশে আছে। হঠাৎ করেই বাবা নাচ থামিয়ে দিলেন। তার পর একদম স্থির হয়ে দাঁড়ীয়ে গেলেন। ভিড়ের মধ্যে আবার গুঞ্জন উঠল, -বাবা সমাধি নিয়েছেন।বাবা সমাধি নিয়েছেন। জয়। সমাধি বাবার জয়।


     মনে মনে ভাবলাম ,  -  এই কারণেই কি ওনার নাম সমাধি বাবা!’ - কিন্তু কাকে জিজ্ঞাসা করব? - যাকে জিজ্ঞাসা করলে এর উত্তর পাওয়া যাবে সেই অনিলিখাতো অনেকটা দূরে বসে আছে।


     বাবার সেই  ভক্ত এগিয়ে এসে বলল, -  বাবা সমাধি নিয়েছেন। সমাধি ভেঙ্গে জেগে উঠলে প্রতিদিনের মত আজও বাবা পাঁচ জনের সঙ্গে কথা বলবেন। তাদের সমস্যা সমাধানের পথ বলে দেবেন। আজকের যে পাঁচজন এই সৌভাগ্য পেলেন তারা তৈরি থাকুন। আর তার পরে সবাই বাবার প্রসাদ পাবেন। - তারপর সে অনিলিখার দিকে তাকিয়ে বলল, --দিদি তৈরি থাকুন আপনি সবার আগে আছেন।


    বিশ্বদা আবার ফিসফিসিয়ে বলল, - অনিলিখা কি জিজ্ঞাসা করবে বলতো?


    -আমি এই কথার কোনও জবাব দিলামনা। আসলে বিশ্বদার মত আমিও ধন্দে ছিলাম এই ভেবে যে অনিলিখা কি জিজ্ঞাসা করতে পারে। যাক সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা জানতে পারব।


    প্রায় দশ মিনিট পর বাবা সমাধি ভেঙ্গে জেগে উঠলেন। সেই ভক্ত ইশারায় অনিলিখা কে এগিয়ে যেতে বলল।  অনিলিখা বাবার বেদির কাছে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। সমাধি বাবা স্মিত হেসে বললেন, -বল মা তোর কি জানার আছে?


    অনিলখা কোনোরকম ভণিতা না করে নিজের সেই পরিচিত কণ্ঠে বলল, -- বাবা আমি একজন লোককে খুঁজছি।তার ভালো নাম আদিত্য গোডপড়ে।তবে আসল নামের থেকে পিটার নামেই বেশি পরিচিত। ড্রাগ সাপ্লায়ার হিসাবে অনেকদিন ধরে পুলিশের হিট লিস্টে আছে। কিছুদিন আগে ধরাও পড়েছিল। কিন্তু পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যায়। শুনেছি সে এই এলাকার আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে। আর এখান থেকেই সে তার কাজকর্ম চালাচ্ছে।ব্যবসার জন্য কিশোর কিশোরীদেরই সে তার টার্গেট করছে। বাবা আপনিতো অন্তর্যামী একবার যদি.........।


    অনিলিখার কথা তখনো শেষ হয়নি বাবা হাত তুলে ওকে থামতে বললেন। অবাক হয়ে দেখলাম বাবার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।আর তার বাবা কেমন খাবি খাওয়া মাছের মত হিচকি তুলতে লাগলেন। একজন ভক্ত তাড়াতাড়ি জল নিয়ে বাবার কাছে এলো। জলটল খেয়ে একটু ধাতস্থ হল।


     অনিলিখা আবার শুরু করল, - এখানে সাদা পোশাকের অনেকগুলো পুলিশও উপস্থিত আছে। আশ্রমের বাইরেও বেশ কয়েক জন আছে আপনি একবার পিটারের ঠিকানা বলে দিলে তাকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।


    দেখলাম ভিড়ের মধ্যে  থেকে  কয়েকজন উঠে দাঁড়িয়েছেন। তাদের দেখার পর বাবার সেই হিচকি আবার শুরু হল। আশ্রমের বাইরেও বেশ কয়েকজন পুলিশ এসে দাঁড়িয়েছে।তারা সবাই ইউনিফর্ম পরে এসেছে। পুলিশ দেখে ভিড়ের মধ্যে একটা হই চই শুরু হয়ে গেল। এর মধ্যেই বাবা উঠে পালানোর চেষ্টা করছিল।কিন্তু পারলনা।সাদা পোশাকের পুলিশ ততক্ষণে বাবার কাছে চলে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন বাবার দাড়ি আর মাথার চুল ধরে টান দিতেই সেগুলো খুলে গেল।তারপরে ক্লিনসেভড যে মানুষটা বেরিয়েএল তাকে দেখার পর বিশ্বদার মুখ ডুকরে কেঁদে ওঠার মত একটা অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে এলো।


     বিশ্বদা সেই যে বসেছে।একবারও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়নি। আমরা নতুন গঞ্জ ছেড়ে কলকাতার দিকে চলেছি। ইতিমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। সমাধি বাবার ছদ্মবেশে থাকা পিটার আর তার ভক্তরা ধরা পড়েছে। অনেকগুলো স্কুল কলেজে পড়া কিশোর কিশোরী ছিল তাদের বাড়ীতে খবর দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা বেশিরভাগই নাকি ড্রাগ অ্যাডিক্ট।খবর পেয়ে মিডিয়া, রিপোর্টার সব ভরে গিয়েছে। অবশ্য তার আগেই অনিলিখা আমাদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে অনিলিখার সাথে আমাদের ভালো করে কথা হয়নি। সোহীনিই প্রথম মুখ খুলল, -অনিলিখাদি ব্যাপারটা কি হল। কাজ কর্ম ছেড়ে হঠাৎ জেল পালানো আসামি কে নিয়ে পড়লে কেন?


              -সে সব বলতে গেলে একটা বড় গল্প হয়ে যাবে।


    -যা কিছু সহ্য করলাম তার পর তোমার গল্পও অনায়াসে হজম হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি শুরু কর।, - বিশ্বদা সামনের দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলল।


    অনিলিখা কয়েক ঢোক জল খেয়ে শুরু করল, - সমীর নাম ছেলেটার। একটা অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে। এর আগে আমি বেশ কয়েকবার ওদের ওখানে গিয়েছি সেখানে ওর সাথে কথাবার্তা বলেছি। কিন্তু কোনোদিন ওর মধ্যে কোনও রকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করিনি। কিন্তু সেদিন আশ্রমে গিয়ে মহারাজের কাছে  জানতে পারলাম ওনারা সমীর কে আর রাখতে চাননা। এর মধ্যে  একবার মহারাজের টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আর সারাদিন নাকি নেশা করে পড়ে থাকে। এর মাঝে ও দু- তিনদিনের জন্য অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পরে অনেক টাকা নিয়ে ফিরেছে। আশ্রমের বাচ্চাদের জন্য কাপড় জামা কিনে এনেছে। মহারাজের সন্দেহ ও কোনও খারাপ চক্রে জড়িয়ে পড়েছে। ও থাকলে  অনাথা আশ্রমের বাকি বাচ্চারাও খারাপ হয়ে যাবে।


    ঘটনাটা আমকে ভাবিয়ে তুলেছিল। খোঁজ নিয়ে জানলাম ও মাঝে মাঝে  সমাধি বাবার আশ্রমে আসে। তারপর আমিও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি। সমাধি বাবা সেজে থাকা পিটার কে আমি প্রথম দিনেই চিনে ফেলেছিলাম। তোদের হয়তো মনে থাকবে পেপারে পিটারের খবর বেরনোর পর কত রকম ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে এই নিয়ে তোরা কজন পেন্সিল দিয়ে ওর ছবিটায় বিভিন্ন রকম ভাবে দাড়ি গোঁফ আঁকছিলি


    -ব্যাপারটা আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম অনিলিখা আবার মনে করিয়ে দিল। একদিন শনিবারের আড্ডায় আমরা পিটারের মুখে নকল দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে  কেমন দেখতে লাগে সেটা দেখছিলাম। সেদিন অনিলিখা ছদ্মবেশ নিয়ে একটা গল্প বলেছিল।


    -তোদের সেই কাজের জন্যই আমি পিটার কে একবার দেখেই সনাক্ত করতে পেরেছিলাম।এ সি পি মজুমদারকে অনেক দিন থেকেই চিনি। ওনাকে সব জানালাম।কিন্তু উনি পুরোপুরি কনফার্ম হতে চাইছিলেন সমাধি বাবা আর পিটার একই লোক।  সে কারণে ওর সাথে কথা বলার প্রয়োজন ছিল। আর ডাক না পেলে সেটা সম্ভব ছিলোনা। আর সেটা খুব সহজে পাওয়া যায়না। নির্বাচিত পাঁচজন ছাড়া পিটার কারোর সাথে কথা বলত না ।


    -কিন্তু শুধু কথা বলেই কিভাবে বুঝতে পারলে এই আসলে পিটার, শৈবাল জিজ্ঞাসা করল।


    -আসলে পিটারের এংজাইটি ডিসঅর্ডার বা উদ্বেগ জনিত সমস্যা আছে। একটু বেশি টেনশন করলেই ওর ভয়ানক হিচকি হয়। আর আজ তোরা নিজের চোখেই সব দেখলি।


    -কিন্তু এই কাজটা তো পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ও করতে পারত। তুমি কেন? , বিশ্বদা জিজ্ঞাসা করল।


    -আমি সমাধি বাবার ডাক পেয়েছি শুনে মজুমদার স্যর আর দেরি করতে চায়নি। তাই আমাকেই মাঠে নেমে পড়তে হল।


    -আর আমরাও একজন সত্যিকারের মহাপুরুষ দেখতে পেলাম।, শৈবালের এই কথায় সবাই হেসে উঠল।শুধু এক জনের গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত রকমের আওয়াজ বেরল।


                                                           


                                 গল্পটি ফেসবুকে অনিলিখা ফ্যান ক্লাব গ্রুপে গল্প প্রতিযোগতার জন্য লিখেছিলাম






    সুবীর মন্ডল


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!