• 02 October 2020

    দুঃস্বপ্ন

    দুঃস্বপ্ন

    0 119

    জীবনটা বড়োই বিচিত্র। আরো বিচিত্র মেয়েদের জীবন।
    জন্ম থেকেই বুঝতে পেরেছি আমি পরিবারের একটা অপ্রয়োজনীত বস্তু। বস্তু বলার কারন আমি তো মানুষ না,আমি তো মেয়ে।আর মেয়েরা আবর্জনার মতোই অপ্রয়োজনীয়।যৌথ পরিবার ছিলো আমাদের। আমার বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান ছিলাম। আমার আগেও একটা মেয়ে জন্ম দিয়েছিলো আমার অভাগী মা।বোনটি আমার এক মাসের মধ্যেই মারা গিয়েছিলো বিনা চিকিৎসায়। ঐ যে মেয়ে তাই ! তারপর আমার পালা। দাদা-দাদি, বাবা এরা সব রাগ আমার মায়ের উপর ঝেড়ে নিতো।আমি অজান্তে অবহেলার মাঝ দিয়ে বেড়ে উঠতে লাগলাম। আমি যখন কিছু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই দেখতাম আমার জামা ছেঁড়া , জুতো নেই । রাতে শোবার আগে পা ধুয়ে নিতাম। আর দেখতাম সবসময় মাকে ঘনো ঘনো চোখ মুছতে। সংসারে কিন্তু অভাব ছিলো না আমাদের। অভাব ছিলো শুধু আমার বেলায়। আমার বয়সী একটা কাকাতো ভাই ছিলো। ওকে মাটিতে পা রাখতেই দিতো না কেউ। আমার বাবাও বাজার থেকে যাই আনবে আগে ওকে মনভরে খাইয়ে নিবে। পরে আমার ভাগ্যে জুটলেও জুটতো আবার কখনো জুটতোই না।ভাইটাকে পড়ানোর কি চেষ্টা সবার... আমি শুধু কাঁদতাম একটু স্কুলে যাওয়ার জন্য। লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ির পাশের প্রাইমারী স্কুলে চলে যেতাম। মেয়ে বলে মা ছাড়া কেউ খোঁজ করতোনা। স্যারদের পড়ানো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম।লেখার জন্য কোনো খাতা কলম তো ছিলো না। স্যারদের নজরে পরতেই আমার সাথে কথা বললো।তখন আমি কিছু বলতে পারিনি শুধু কেঁদেছিলাম।
    তারপর স্যার আমাদের বাড়ি গিয়ে অনেক কথা বললেন। লজ্জায় পড়ে আমার বাবা বললেন " তাহলে যাক স্কুলে। " সেই থেকে শুরু , সবসময় ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হইনি।খাতা কলম জুটতো অনেক কান্নাকাটির পর।যখন পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যাই তখন আমকে একটা নতুন জামা আর একজোড়া জুতা কিনে দেওয়া হয়। তাও আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক দিয়েছিলেন।যাতে বাবার একটু লজ্জা , অনুতাপ হয়।হয়েছিল কিছুটা। তাড়াতাড়ি গিয়ে স্যার কে টাকা দিয়ে এসেছিলো বাবা। মুচকি হেসে স্যার নিলেন টাকা পরে আমার হাতে দিয়ে বললেন এটা তোর কাছে রেখেদে পরে কাজে লাগবে।
    তারপরে প্রতি ক্লাসে প্রথম হতাম।স্কুলে থাকতেই বাবা বিয়ের জোগাড় করতে লাগলো। খুব কষ্ট করে এসএসসি পরীক্ষায় দিলাম।খুবই ভালো করলাম শতো কষ্টের মাঝে। এরপর হঠাৎ করেই বাবা বিয়ের জন্য মায়ের উপর নির্যাতন শুরু করলো।আমি দাদু, কাকা সবাইকে বললাম বাবাকে বোঝানোর জন্য। কেউ আমার কথা শুনলো না।শেষে মাকে বাঁচাতে বাবার কথায় রাজি হই।অনেক সপ্নের সেদিনই কবর দিয়েছিলাম।
    ছেলে আমি দেখিনি কিন্তু ছেলে আমাকে দেখেছে। কোনো আয়োজন ছাড়াই হয়ে গেলো আমার মরন।আমার বয়স পনেরো কি ষোলো আর ছেলে চল্লিশোর্ধ। প্রথম রাতেই জানোয়ারের চেহারা দেখিয়ে দিলো।পরের দিন সকালে খাবার খাওয়ার সময় শাশুড়ি বললো " আগেই তোমার বাবার কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়েছি তাই তোমার বাবাকে কি করে বলি তুমি বরং তোমার মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে এসো"। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম শুধু। আর ভাবছিলাম এই পরিবারের কোন যোগ্যতায় আমায় বিয়ে দিলো বাবা।
    এরপরই টাকা দিতে শুরু করে বাবা।শুধু টাকা নয়,ওদের সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করতো বাবা।আমার গয়নাগুলো প্রথমেই বিক্রি করে দেয় ঔ স্বামী নামক জানোয়ার আর তার বাবা।পরে জেনেছি আগেও একটা বিয়ে করেছিলো।
    আমার পরিবারে অবহেলার পাএি হলেও বাবার মেয়ে বলতে আমি একাই ছিলাম। পরে আমার একটা ভাই হয়েছিল। তখন আমার মা একটু সুখের মুখ দেখলো।তো বাবা টাকা দিলে ওরা কিছু দিন ঠান্ডা থাকতো পরে যা তাই।নির্যাতনের কোনো পর্ব বাদ দেয়নি ওরা।এমনকি মাঝে মাঝে খাবারের সাথে কি কি ঔষধও খাওয়াতো।অসুস্থ হয়ে পড়তাম। বাবাকে এসে হসপিটাল নিয়ে সুস্থ করে আবার দিয়ে যেতো ওখানে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বাবার বাড়ি গেলে বাবা আবার সেই পথেই ফিরিয়ে দিতো ও বাড়িতে।রাগ করে কতো ঘুমের ঔষধ খেয়েছি কিন্তু মরিনি।একবারতো ঘুমের ঔষধ খেয়ে পড়ে আছি,বাবাএসে খুলনা নিয়ে গেলো।জ্ঞান ফিরে আসলো কিন্তু আমার হাত পা অবশ হয়ে গেছে।ডাক্তার আমার সকল পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়ে বললো বাবাকে আপনার মেয়ে অনেক আগে থেকেই ঘুমের ঔষধ খায় আপনারা কেনো খেয়াল করেননি ...
    এখন ওর শিরার কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে । আমি কিছু ঔষধ দিয়ে দিচ্ছি যদি না কমে তবে অপারেশন লাগবে।খুলনা হসপিটালে একসপ্তাহ ছিলাম।পরে বাবার বাড়িতে নিয়ে এলো দয়াকরে।সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহে এক মাসেই সুস্থ হয়ে উঠি।পরে বাবাকে সাহস করে বললাম আমি যাব না ঔ বাড়িতে।বাবা বললো তুই এবাড়িতে থাকলে আমি থাকব না।বসে বসে কাঁদছিলাম। একটু পরে মাকে আর আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। রাস্তায় নামতে মা বললো তুই ও-বাড়ি না গেলে আমায় বাড়িতে ঢুকতেদেব না। তুই চলে যা।
    বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় বাবা হাতে দশ টাকা দিয়ে বলেছিলো এই টাকা দিয়ে বিষ কিনে খাবি,কিন্তু আমার বাড়িতে ও না আবার ঔ বাড়িতে ও না রাস্তায় বসে খেয়ে মরিস।আরও অনেক কথা যা কখনো এ জীবনে ভোলা যাবেনা।
    একথা শুনে একটা জিদ আসলো মনে যে মরবো না।দেখা যাক কি হয়.... চলে আসলাম শশুর বাড়ি। একটা মেয়ের জন্ম দিলাম।এখানেও একই কথা মেয়ে কেনো ছেলে হতে পারলোনা? ওরা বাবাকে দিয়ে শহরে একটা বাড়ি কিনালো।এখন বড়ো বিল্ডিং এর জন্য বাবাকে টাকা দিতে বললো। বাবা টাকা নিয়ে এলে আমি সাহস করে সব টাকা বাবাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বললাম। আরও বলি যদি টাকা লাগে আমি গিয়ে নিয় আসবো।এই প্রথম বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আসলে বাবাও টাকা দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছেন।
    বাবা চলে গেলে সে যে কি অত্যাচার করলো .... ছোট্টো মেয়েটাকে সরিয়ে আটকে রাখলো আমায়।খাবারের সাথে কি মিশালো জানি না, খাওয়ার পর আস্তে আস্তে গায়ে ফোস্কা ফুটে বেরুলো। সমস্ত গায়ে এক অবস্থা হলো।অনেক কষ্ট করেছি। গায়ের কাপড় গায়ে আঠার মতো লেগে থাকতো।ফোস্কার জন্য। একদিন সুযোগ বুঝে মেয়েকে নিয়ে পথের একটা লোকের পা ধরে বললাম আমাকে যেনো তাড়াতাড়ি বাবার বাড়ি দিয়ে আসে। লোকটা দয়াকরে আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো। তারপর বাবার ডাক্তার দেখিয়ে নয় মাস বসে সুস্থ করে তুললো। আমার বাবার পরিবর্তন দেখে চোখে জল এসে পড়তো আমার। তারপরেও অনেক ঝড় গেছে আমার আর আমার মেয়ের উপর দিয়ে।বাবা-মা পাশে ছিলো বলে এবার সাহসের সাথে ঘুরে দাঁড়িয়েছি।বাবাই ডির্ভোস করিয়ে বললো এখন থেকে তোকে আর কষ্ট করতে হবে না।সেই থেকে বাবার বাড়িতে আছি। মেয়েটাকে মেয়ের মতো করে নয় মানুষের মতো করে মানুষ করার চেষ্টা করছি।
    বাবা এখন হার্টের অসুখে ভুগছেন। বারবার আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছেন।আর বলছেন আমি তোকে ইচ্ছে করে বিয়ে দিইনি। আমি যদি তোকে বিয়ে না দিতাম তাহলে ওরা আমাকে আর তোর ভাইকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো।আমি কিছু বললাম না, শুধু নিরবে চোখের জল ফেললাম...

    হায়রে বাবা..... "নিজের জীবন বাঁচাতে নিজের মেয়ের জীবনটা ব্যবহার করলো।"




    Kotha Koli


Your Rating
blank-star-rating
Sorry ! No Reviews found!